আমরা অনেক তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেয়ে গেছি
‘সবার হাতে হাতে লাঠি। সবাই তখন প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেই যেন যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু তিনি সরাসরি কিছু বললেন না। শুধু বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল… আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব…।’ রক্ত তখন টলমল করছিল। ওই দিনই ভেবেছি দেশের জন্য জীবন দিতেও পিছপা হব না।’
“২৫ মার্চ ১৯৭১। সকাল বেলা। চারপাশে কানাঘুষা। একটা কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু কী ঘটবে? দিন গড়িয়ে রাত নামে। তখন আনুমানিক রাত ১২টা। হঠাৎ ঢাকার আকাশে আলোর ঝলকানি। গোলাগুলির শব্দ। দূর থেকেই বুঝে যাই ঢাকায় আক্রমণ হয়েছে।’’
“পরদিন রাস্তাঘাটে শত শত লোক। যে যেভাবে পারছে ঢাকা থেকে পালাচ্ছে। ২৭ মার্চ খবর আসে নারায়ণগঞ্জে আর্মি ঢোকার। ভয়ে লোকজন শহর ছাড়ছে। আর্মি ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ হন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা। কিছু হাতিয়ারও সংগ্রহ হয়ে যায়। মুজাহিদ ট্রেনিং ছিল আমার। রাইফেল চালাতে পারতাম। তাই ওঁদের সঙ্গে আমিও যোগ দিই।’’
“পঞ্চবটি হয়ে নারায়ণগঞ্জ ঢোকার চেষ্টা করে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের আমরা ঠেকিয়ে দিই মাসদাইর গোরস্থানের কাছে। জায়গাটা ছিল উঁচুনিচু। ফলে আত্মরক্ষায় সহজ হয়। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। কিন্তু একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দলকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি তখন আমাদের ছিল না। ওদের ঠেকাতে পারি মাত্র এক রাত। সকাল হতেই পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণের তোড়ে ছত্রভঙ্গ হই। আত্মগোপন করে চলে যাই গ্রামের দিকে। ওরা তখন নারায়ণগঞ্জ শহর দখলে নিয়ে নেয়।’’
“শহরে ঢুকেই পাকিস্তানি আর্মি ব্যাপক গণহত্যা চালায়। হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যুবকদের গুলি করে আর বেয়োনেটের খোঁচায় নির্মমভাবে হত্যা করে। আতঙ্কিত হয়ে শহরের লোকজন পালাতে থাকে। অনেক ছেলে গোপনে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে।’’
“তখনও আমি গ্রামে। মানুষ মরছে চারপাশে। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করব ভাবছি। এমন সময় খবর পাই, পাশের গ্রামের মাঝিপাড়ার এক ছেলে ফিরেছে ট্রেনিং থেকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সে আমারই সহপাঠী– ইসরাফিল। গোপনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আগ্রহী হতেই ও আমায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাওয়ার রুট বলে দেয়। এক রাতে বাবা-মায়ের সম্মতিও পাই। অতঃপর ১৭ মে তারিখে ঘর ছাড়ি দেশের টানে, স্বাধীনতার স্বপ্নে।’’
১৯৭১এ বাড়িছাড়ার বর্ণনা এভাবেই দিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জহির উদ্দিন প্রধান।
তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের গোধনাইল এনায়েত নগরে। বাবা ওসমান গণি প্রধান চাকরি করতেন পিডিবিতে। আর মা জরিনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই ও তিন বোনের সংসারে জহির সবার বড়। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গোদনাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর তিনি ভর্তি হন গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে।
বাবার স্বল্প আয়ে জহিরদের পরিবার চলত না। বিদ্যালয়ে পড়তেন বিনা বেতনের সুবিধায়। অফিসের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হত বাবা ওসমান গণিকে। কিন্তু তবুও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জহিরকেও তাই খেতখামারে কাজ করতে হত। ফলে স্কুলে যাওয়া প্রায়ই বন্ধ থাকত। এভাবেই একসময় জহিরের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ছিলেন ১৯৬৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী।
স্কুলজীবনের স্মৃতি এখনও তাঁর মানসপটে জীবন্ত হয়ে আছে। জহিরের ভাষায়:
‘‘মালেক, জলিল, দেলোয়ার, মোস্তফা, আজিজুল্লাহ ছিল আমার কাছের বন্ধু। দলবেঁধে আমরা চলতাম। হাডুডু আর দারিচা খেলা ছিল প্রিয়। চাঁদনি রাত হলেই কানামাছি খেলা নিয়ে হইচই করতাম। মাঝেমধ্যে নিজেরা চাঁদা তুলে ঘুরতে যেতাম মধুগড়ে। স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের অনেক আদর করত। আবার পড়া না পারলে বেতও মারত। বাড়িতে পড়ার প্রয়োজন হত না। এখন তো শিক্ষকরা অধিকাংশই ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। ক্লাসে পড়া হয় না। পড়তে হয় কোচিংয়ে গিয়ে। দেড়-দুই হাজার টাকা দিতে হয় কোচিং ফি। যাদের আয় কম আর ছেলেমেয়েও তিন-চারটা, তাদের জন্য সন্তানদের লেখাপড়া করানোই অনেক কঠিন!’’
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের কথা উঠতেই তিনি বলেন:
‘‘আমাদের এখানে কাগজ তৈরি হইত। কিন্তু সেটা পশ্চিম পাকিস্তান ঘুরে আসলেই দাম বেড়ে যেত কয়েক গুণ। মাছে-ভাতে আমরা বাঙালি। ওরা চাইত আমরা যেন ওদের মতো রুটি খাই। তাই চালের দাম বাড়িয়ে দিত। গমের দাম ছিল কম। কিছু হলেই ওরা আর্মি দিয়া আমাদের টর্চার করত।’’
রেডিওর খবরাখবর আর চাচা আবুল কাশেমের মুখেই জহির প্রথম শোনেন বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের কাহিনি। একবার আদমজীতে আসেন বঙ্গবন্ধু। মুনলাইটের দক্ষিণ পাশের মাঠে ভাষণ দেন। খুব কাছ থেকে শোনা বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ জহিরকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে।
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন রেসকোর্স ময়দানে। চাচা আবুল কাশেমের সঙ্গে সাইকেলে চড়ে ওই দিন জহিরও চলে যান সেখানে। দুপুরের দিকে পৌঁছান রেসকোর্স মাঠে। বাকি ইতিহাস শুনি জহিরের জবানিতে:
‘‘সবার হাতে হাতে লাঠি। সবাই তখন প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেই যেন যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু তিনি সরাসরি কিছু বললেন না। শুধু বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল… আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব…।’ রক্ত তখন টলমল করছিল। ওই দিনই ভেবেছি দেশের জন্য জীবন দিতেও পিছপা হব না।’’
[আহত হওয়ার ঘটনার বিবরণ দিলেন মুক্তিযোদ্ধা জহিরউদ্দিন প্রধান:
https://www.youtube.com/watch?v=DL_pefXCXKA]
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
তিনি বলেন:
‘‘মেঘনা নদী পার হয়ে কুমিল্লা দেবিদ্বার রামকৃষ্ণপুর দিয়ে আসি চালনায়। সেখান থেকে কোম্পানিগঞ্জ হয়ে প্রথমে ভারতের কোনাবন্ধ এবং পরে আসি আগরতলা কংগ্রেস ভবনে। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হয় নরসিংগড় ইয়ুথ ক্যাম্পে। মুজাহিদ ট্রেনিং থাকায় ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনেস্ট্রাক্টর ছিলাম এক মাস। অতঃপর চলে যাই হায়ার ট্রেনিংয়ে। আমাদের ৭২ জনের স্পেশাল গ্রুপকে প্রথমে পাঠানো হয় নাইন-টি-টু বিএসএফ-এ। ১৫ দিন পরে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তরঙ্গপুরে। ২১ দিনের ট্রেনিংয়ে আমরা শিখি গ্রেনেড থ্রো, ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএলআর, এলএমজি, রাশিয়ান এলএমজি চালানো প্রভৃতি। একদিন ক্যাম্পে আসেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও শিবগঞ্জ এলাকার এমপি মন্টু ডাক্তার। উনারা বাছাই করে আমাদের নিয়ে যান ৭ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টার, মহদেবপুরে। সেখানেই হাতিয়ার দেওয়া হয়।’’
জহিররা ছিলেন ফ্রন্ট ফাইটার। আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে পেছনে থাকত ভারতীয় আর্মি। সোনা মসজিদ দিয়ে ঢুকে তাঁরা সম্মুখযুদ্ধ করে চলে আসেন কানসার্ট পর্যন্ত। স্থানীয় এরফান ডাক্তার ছিলেন তাদের গাইড। জহিরদের সরাসরি কমান্ড করতেন নজরুল ইসলাম ও মেজর রফিক। তিনি ছিলেন ৩৩ জনের প্লাটুনের টোয়াইসি। প্লাটুনটির কমান্ড করতেন বাঞ্ছারামপুরের মমতাজ উদ্দিন। তাঁরা অপারশেন করেন সোনা মসজিদ এলাকা, ডোবরা, গলাবাড়ি, কানসাট রাজবাড়ি, গোমস্তাপুর, কাইশ্যাবাড়ি, দলদলি প্রভৃতি অঞ্চলে।
রণক্ষেত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জহির বলেন:
‘‘খাবারের খুব কষ্ট ছিল। সারা দিনে একবেলা খেতে পারতাম। ভাত, আলুভর্তা আর ডাল। পাঞ্জাবিরা ছিল শিবগঞ্জে। রাজাকাররা ওদের নানা খবরাখবর পৌঁছে দিত। একবার কানসাটে ৮ জন রাজাকার ধরছি। ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ওই দিন বোয়ালিয়া হাই স্কুলে চলছিল অনুষ্ঠান। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত শুরু হইতেই আমরা টুইঞ্চ মর্ডার চালিয়ে দিয়ে জাতীয় সংগীত বন্ধ করে দিই।’’
এক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। স্বাধীনতার জন্য হারান তাঁর বাঁ পা। ডান পায়ে ও ডান হাতে বিদ্ধ হয় অসংখ্য স্প্লিন্টার।
কী ঘটেছিল ওই দিন তা জানাতে চাই আমরা। প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা জহিরের মনে ঝড় ওঠে। মনের ভেতর জমে থাকা চাপা কষ্টগুলো তাঁকে নীরব করে দেয়। আমরাও নীরব থাকি। অতঃপর তিনি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন:
‘‘১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম গোমস্তাপুর থানাধীন কাইশ্যা বাড়িতে, একটা প্রাইমারি স্কুলের পেছনে। কোম্পানি নিয়ে আমরা পাগলা নদী পার হয়ে যাব রহনপুরে। খুব ভোরে রওনা হলাম। সবার সামনে আমি। হাতে একটা ব্রিটিশ এলএমজি। আগেই রেকি করা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা যে চাঁদনি রাতে ওই পথে মাইন পুঁতে রেখেছে সে খবর আমাদের ছিল না। ওরা মাইন পুঁতে নদী পার হয়ে চলে যায়।’’
‘‘আমরা খুব সর্তক হয়ে এগোচ্ছি। আলমপুর এসে একটা বাঁশঝাড় পড়ে। সামনে উঁচু জায়গা। একটা নালা বা ক্যানেলের মতো আছে। আমি সবাইকে থামিয়ে দিই। অতঃপর শক্র আছে কিনা দেখার জন্য সামনে এগোই। একটা উঁচু জায়গায় মাইন পোঁতা ছিল। সেখানে আমার বাঁ পা পড়ে। সামনেই ছোট্ট ক্যানেল। আমি লাফ দিয়ে পার হব, অমনি বিকট শব্দ। খানিক দূরে ছিটকে পড়ি।’’
‘‘প্রথমে কিছুই টের পাইনি। পরে দেখলাম বাঁ পা চামড়ার সঙ্গে ঝুলে আছে। সেখানকার মাংস থরথর করে কাঁপছে। খানিক পরেই পা দিয়ে তীরের বেগে রক্ত বেরুতে থাকে। ডান পায়ে বিদ্ধ হয়েছে অসংখ্য স্প্লিন্টার। ডান হাতের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম কনুই পর্যন্ত ঝলসে গেছে। আমি আহত হলেও ওই দিন গোটা কোম্পানি রক্তাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল।’’
‘‘সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে যায় দলদলি ক্যাম্পে। সেখান থেকে পাঠানো হয় মালদহ হাসপাতালে। তখনও জ্ঞান ছিল। প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত। পানি মুখে দিতেই জ্ঞান হারাই। পরে চোখ খুলে দেখি, আমি পঙ্গু। বাঁ পাটি হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। খুব কষ্ট লাগছিল। হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। খানিক পরেই এক নার্স এসে বলল, ‘তোমহারা দেশ আজাদ হো গিয়া।’ স্বাধীনতার কথা শুনে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।’’
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা জহিরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রাশিয়াতে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলে ছয় মাস। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্প্লিন্টারের ক্ষতের কারণে মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।।
তখনও অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, আপনি কেন গেলেন?
এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা জহির মুচকি হেসে বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যারা শুনেছে, তারা বসে থাকতে পারে নাই। দেশের অবস্থা দেখে তখন শপথ করেছিলাম, মরলে যুদ্ধ করেই মরব। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। বেঁচে থাকলে গাড়ি-বাড়ি পাব। এমন তো চিন্তা ছিল না। তখন ৯৯ পার্সেন্ট বাঙালির একতাই ছিল আমাদের শক্তি। এ দেশটা আমাদের– এই বিশ্বাসই ছিল মনোবল। নৈতিক দায়িত্ব ছিল, তাই মুক্তিযুদ্ধ করেছি।’’
যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘‘পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি।’’
কেন?
‘‘আমরা অনেক তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। এক পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা আছেন তো একশ পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নাই। আবার একশ পরিবারে একজনও শহীদ হয়নি। কিন্তু দেখবেন এক পরিবারেই দু-তিন জন শহীদ হয়েছেন। দেশের জন্য যে পরিবার রক্ত দিয়েছে তারাই বুঝে স্বাধীনতার মানে কী। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন, অন্যদের কাছে তেমনটা নয়। তাছাড়া স্বাধীনতা লাভের পর বহু বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতার বিরোধী চেতনার দল। ফলে রাজাকাররাও হয়েছে রাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রী। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিতে। তাহলে আপনিই বলুন, চেতনা কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে! আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লড়াই চলবে আরও অনেক বছর।’’
মুক্তিযোদ্ধা জহির মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নয় বরং রাজাকারদেরই তালিকা করা উচিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:
‘‘বিএনপির সময়ে অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করেছে অমুক্তিযোদ্ধাদের। এভাবে অমুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকাররা জায়গা করে নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। এখনও তালিকা বাড়ছে। এই দায় শুধু সরকারের নয়, কিছু সংখ্যক লোভী মুক্তিযোদ্ধারও। নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিন্তু কোনো সনদ নেননি, এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও কম নয়! তাহলে কি আমরা তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলব না?’’
দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন: ‘‘ওরা তো বহু আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। দশ বছর আগেও রাজধানীতে প্রকাশ্যে ওরা স্লোগান দিয়েছিল, আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান। আপনারা সেটা ভুলে বসে আছেন! এরা কারা? প্রশাসন কি কিছুই জানে না? গুলশানের হত্যাযজ্ঞে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা ছিল। তাদের বিরুদ্ধেও সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।’’
তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নাই। শুধুমাত্র ওরা চায়, শেখ হাসিনা সরকারকে বিপাকে ফেলতে। আরে, হাসিনা তো জীবনের মায়া করে না। শেখের মেয়ে কি জঙ্গিদের ভয় পাবেন! প্রত্যেক পরিবার যদি সচেতন থাকে তাহলেই তো জঙ্গি তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতির কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা জহির বলেন:
‘‘ডিজিটাল সরকারের উন্নয়ন দেখলে ভালো লাগে। স্বীকার না করলেও আপনার জীবন সহজ করেছে এই সরকার। অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেক এগিয়েছি। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা বলতে এখন আর কিছুই নেই। কেউ আর না খেয়ে মারা যায় না। পদ্মা সেতুও হচ্ছে নিজেদের টাকায়। পৃথিবীতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। এসব দেখলে মন ভরে যায়।’’
খারাপ লাগে কখন?
মলিন মুখে এ বীর বলেন:
‘‘খুনখারাবি দেখলে খারাপ লাগে। মানুষ কেন ভয়ে থাকবে? আগে নেতারা রাজনীতি করত মনের টানে, দেশের টানে। চাওয়া-পাওয়া বলতে কিছুই ছিল না। এখন তো হাইব্রিড নেতায় ভরে গেছে। কীভাবে টাকা কামানো যায় সেটাই তাদের ধান্ধা। পয়সায় বেচাকেনা হন তাঁরা। মুজিবের নৌকাও এখন নেতারা বিক্রি করে দেন। এ কারণে রাজাকারের পোলাও আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যানের মনোনয়ন পায়। এই সব দেখলে সত্যি কষ্ট লাগে।’’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জহির উদ্দিন প্রধান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐক্য থাকলে, মানুষ তার নিজের কাজের প্রতি সততা দেখালে, এই দেশ একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলা হবে। আর এটি ঘটবে পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই। এ কারণে পরবর্তী প্রজন্মকেও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে হবে। তাই তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:
‘‘তোমরা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে। দেশের স্বার্থে এক থোকবে। দেশের স্বার্থে কাজ করবে। তোমরাই হবে পরবর্তী বাংলাদেশে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা।’’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে, প্রকাশকাল: ৩১ জুলাই ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.