আদিবাসী

এখন চালাচ্ছেন জমির লড়াই

১৯৭১ সালে দশম শ্রেণিতে পড়তেন খ্রীষ্টফার মুর্মূ। ইউসুফ প্রফেসরের কথা শুনে বুঝতেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ঠকাচ্ছে। শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। পরে জর্জদার সঙ্গে দেখা হলে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন। নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীন দেশে এখন নিজের জমির জন্য লড়ছেন।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সাকইরডাঙ্গা গ্রাম। খ্রীষ্টফার মুর্মূর বাড়ি এই গ্রামে। জোয়াকিম মুর্মূ ও মারিয়া মার্ডির পঞ্চম সন্তান খ্রীষ্টফার। সাঁওতাল রীতিতে বাবার টাইটেল লাভ করায় পুরো নাম হয় খ্রীষ্টফার  মুর্মূ। বাবার ছিল ১২-১৩ বিঘা জমি। গ্রামের তখন অর্ধেক মানুষই সাঁওতাল। সাইকরডাঙ্গায় ‘বাহাপরব’ আর ‘সোহরাই’ উত্সব হতো জোরসে। ঢোল-খোলের বাজনাসমেত বাড়ি বাড়ি সাঁওতাল নৃত্যের আসর জমত।

খ্রীষ্টফার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে স্কুল ছিল ১০ মাইল দূরে দিনাজপুর শহরে। পায়ে হেঁটে যেতেন অনেকটা তারপর নদী পার হতেন। স্কুলে তাঁর বন্ধু হয়েছিল হাকিম, জব্বার, মণ্ডল ও রমজান। তখন ‘ওরা ও আমরা’র ভেদ বেশি ছিল না। জব্বারদের সঙ্গে মিলেমিশে ফুটবল খেলত খ্রীষ্টফার। পুনর্ভবা নদীতে মাছও ধরত। খ্রীষ্টফার  বলে চলেন, ‘সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল কম। তাই তারা জমিজমার সইসাবুদ করতে পারত না। মুখের কথাতেই চলত। সাইকরডাঙ্গা থেকে স্কুলে শুধু আমিই যেতাম তখন। পাশের গ্রাম থেকে যেত পশরউদ্দিনের ছেলেমেয়েরা।

salek khokon-3১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র।তখন স্কুল থেকে ছাত্ররা মাঝেমধ্যে মিছিলে যেত। ইউসুফ প্রফেসরের মুখে শুনেছেন, পশ্চিমারা চাকরিবাকরিসহ আমাদের সব সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। তিনি বলতেন, ‘কাগজ তৈরি করি আমরা আর তার দাম এখানেই চড়া। আখের চাষ করি আমরা আর চিনি নিয়ে যায় তারা।’ দিনাজপুরে অনেক বিহারি ছিল। তারা ছিল পাকিস্তানপন্থী। ‘একবার বিহারিদের ইকবাল স্কুলের সঙ্গে আমাদের সেন্ট ফিলিপ স্কুলের মারামারি হয়। তারপর চলতে-ফিরতে ওরা আমাদের গালিগালাজ করত।’

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠের এক কুঠিবাড়িতে। একাত্তরের ২৮ মার্চে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচায় পাঠান-পাঞ্জাবিরা। শুরু হয় গোলাগুলি। বাঙালি ইপিআর জোয়ানরা হাতিয়ারসহ বেরিয়ে আসেন ব্যারাক থেকে। খ্রীষ্টফাররা আশ্রয় নেন বর্ডারের কাছে। ওই গ্রামটির নাম ছিল ধর্মজায়েন। তারপর মে মাসের প্রথমদিকে তাঁরা চলে যান ভারতে। তিনি বলতে থাকেন, ‘ভারতে বেকার সময় কাটাচ্ছিলাম। হঠাত্ দেখা জর্জ দার (জর্জ আর এন দাশ) সঙ্গে। তিনি ছিলেন ইপিআরে। বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করতে চাই। তোমরাও আসো। ফুপাতো ভাই পিযুষ হেমব্রম ও জন মার্ডিসহ পর দিনই চলে গেলাম শিববাড়ীতে। তখনো ক্যাম্প হয়নি। কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে জর্জ দা ট্রেনিং শুরু করেন। ১৫-২০ দিন শিখলাম শুধু লোড, আনলোড আর পজিশনিং। ধীরে ধীরে লোক বাড়তে থাকল। খাবারের কষ্ট ছিল। শিববাড়ী মিশন থেকে পাওয়া রিলিফের চালই তখন ভরসা। পরে আমাকে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় ভারতের পতিরাম ক্যাম্পে। সেখানে এক মাস ট্রেনিং নিই। রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান চালানো শিখি। থ্রিনটথ্রি ভালো চালাতাম। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন শ্রী হরি। ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন এক বাঙালি। তাঁর ছিল ইয়া মোচ! দুষ্টুমি করে ‘পাংগাশ’ বলে ডাকতাম। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠানো হয় হামজাপুর ক্যাম্পে। ৭ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর ছিল সেটি। সেখান থেকেই পাই অস্ত্র।’

salek khokon-2খ্রীষ্টফার মুর্মূদের ১২ জনের দলের কমান্ডার ছিলেন ইয়াকুব ও আনোয়ার। তাঁরা অপারেশন করেন ৭ নম্বর সেক্টরের হিলি, স্কুলপাড়া ও বিরলসহ দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গায়। একবার তাঁদের দলটি অল্পের জন্য রক্ষা পায়। পলাশবাড়ীর পূর্বপাশে ছিল সালাম পুকুর। পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ছিল সেখানে। সেই ক্যাম্প দখলে নিতে যান খ্রীষ্টফাররা। প্রথমে গেরিলা সেজে আশ্রয় নেন গ্রামের এক পরিচিত লোকের বাড়িতে। লোকটির নাম কফিল হাজি। খ্রীষ্টফাররা জানতেন না লোকটি পাকিস্তানিদের চর। তিনি সাদরে ডেকে নিয়ে তাঁদের ঘরে বসিয়ে মুড়ি-গুড় খেতে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেসব দিনে মুড়িই ছিল অমৃত। তাই খ্রীষ্টফাররা হামলে পড়েন, আর সে সুযোগে কফিল বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে দেয়। তারপর খবর দিতে চলে যায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে। কপাল ভালো, খ্রীষ্টফারদের হুঁশ ফেরে অল্পক্ষণের মধ্যেই। তাঁরা জানালা ভেঙে আশ্রয় নেন নদীর ধারে।

দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার দিনটির গল্পও বলেন খ্রীষ্টফার—‘হামজাপুর ক্যাম্প থেকে সুন্দরায় বর্ডার হয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। উদ্দেশ্য দিনাজপুর শহর দখলে নেওয়া। বিভিন্ন দলে আমরা ৬০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। পেছনে ভারতীয় সেনাবাহিনী। রাতে এসেই পজিশন নিই সদরের স্কুলপাড়ায় খালের পাড়ে। খালের একপাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। ভোর হতেই শুরু হয় গোলাগুলি। চলে বিকেল পর্যন্ত। বড় যুদ্ধ ছিল ওটা। মাথার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গুলি চলে। একটু উনিশ-বিশ হলেই মারা পড়তে হতো। সন্ধ্যার আগেই আমরা দখলে নিই ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত। সেখান থেকে আমাদের দলটি নদীর পশ্চিম অংশ দিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। বিরল থেকে আরেকটি দলও এগিয়ে আসে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোরবেলা। কুঠিবাড়ী দিয়ে ষষ্ঠিতলা হয়ে আমরা শহরের মর্ডান মোড়ে এসে পজিশন নিই। বিরল মুক্ত হয় তারও এক-দুদিন আগে।’

এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে খ্রীষ্টফার বললেন, স্বাধীন দেশে নিজের জমি নিয়ে বড় ঝামেলা চলছে। আদালতের রায় পেয়েও দখল নিতে পারছি না। দেশ পেয়েছি, তবে জমি বুঝে পাচ্ছি না।’

আট হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান খ্রীষ্টফার। নিজের গ্রিলের ব্যবসা আছে। পাঁচ সদস্যের পরিবার। ভাতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কৃতজ্ঞ বর্তমান সরকারের প্রতি। তিনি মনে করেন, দেশপ্রেম থাকলে, স্বার্থপরতা আর দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে দেশ এগিয়ে যাবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, প্রকাশকাল: ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫

 

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button