ট্যাম্পাকো ট্রাজেডি : দায়ী মালিক সরকার না নিয়তি?
সাধারণ সময়ে তাদের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। হয় না কোনো প্রতিবাদ, সমাবেশ, ঘেরাও, প্রতিবেদন কিংবা মধ্যরাতের টক শো। আলোচনায় আসতেও তাদের জীবন দিতে হয়। যেমনটা হয়েছিল সাভারের রানা প্লাজায়। আর আজ টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামক কারখানায়।
প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করার আনন্দ নিশ্চয়ই অন্যরকম। তাই অনেকেই পৌঁছে গিয়েছেন তার গন্তব্যে। নাড়ির টানে অনেকেই ছুটছেন জ্যাম, ভিড়, নানা বিড়ম্বনা আর দুর্ঘটনার শংকাকে পেছনে ফেলে। কিন্তু যাদের কথা বলব তারা সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় নেই। কেননা তারা শ্রমিক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা পান তা দিয়ে তাদের পরিবার চলে না।
তবুও বুকভরা আশা নিয়ে তারা কাজ করে যান। তাদের নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথ্যা নেই মালিকপক্ষ কিংবা সরকারের। তাদের কথা না শুনলেও কিছু যায় আসে না তাদের। কারণ তারা খেটেখাওয়া শ্রমিক। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা গরিব।
সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন-মৃত্যুর কাহিনিগুলো। তবুও তাদের জীবনের কোনোই মূল্য নেই? কারখানার পরিবেশ তা যেমনই হোক না কেন, তারা কাজ করে যান। কম মজুরিতে, জীবনের সব ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই।
সাধারণ সময়ে তাদের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। হয় না কোনো প্রতিবাদ, সমাবেশ, ঘেরাও, প্রতিবেদন কিংবা মধ্যরাতের টক শো। আলোচনায় আসতেও তাদের জীবন দিতে হয়। যেমনটা হয়েছিল সাভারের রানা প্লাজায়। আর আজ টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামক কারখানায়।
বয়লার বিস্ফোরণে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে আগুন লাগে। যখন লিখছি তখন পর্যন্ত বিস্ফোরণে ও চাপা পড়ে মারা গেছে ২৪ শ্রমিক। এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পাঁচতলার পুরো ভবনটি ধসে পড়েছে। পাশের ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাতাসে ছড়াচ্ছে লাশের পোড়া গন্ধ। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে প্রিয়জনদের আহাজারি। ছবি হাতে নিয়ে প্রিয়জনকে খুঁজছেন অনেকেই।
প্রশ্ন উঠেছে-টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামক পাঁচতলা কারখানাটি সরকারের প্রচলিত আইন ও ব্লিডিং কোড মেনে করা হয়েছে কিনা? কারখানার চারপাশে যে পরিমাণ জায়গা খালি রেখে করা দরকার তা এখানে মানা হয়নি। শুধু তাই নয় বয়লার বিস্ফোরণের ঝুঁকি ঠেকাতে যে পরিমাণ প্রটেকশন রাখা দরকার তার ন্যূনতম প্রটেকশন ছিল না কারখানাটিতে। যা খুব কম খরচেই করা যেত বলে বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে মতামত দিচ্ছেন।
গার্মেন্টস ও অন্যান্য কারখানাগুলোতে শ্রমিক ঠকানোর বিষয়টি বহুল আলোচিত। তাছাড়া রয়েছে সঠিক সময়ে বেতন প্রদান না করার অভিযোগ। কারখানার কর্ম পরিবেশ ও ঝুঁকির বিষয়গুলো সমাধানে অনেক মালিকপক্ষই আন্তরিক নয়। ফলে কারখানায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে সাধারণ শ্রমিকদের। অথচ এই শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়েই কোটিপতি ব’নে যাচ্ছেন মালিকরা। তাই কারখানায় শ্রমিক মৃত্যুর এই দায় সর্ব প্রথমে কারখানার মালিকের ওপরই বর্তায়।
ভবন এলাকা পরিদর্শনে এসে স্বরাস্ট্রমনত্রী বলেছেন কারাখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সেটি হওয়াও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দুর্ঘটনা ঘটার পূর্বে কিংবা শ্রমিকদের জীবন বিপন্নের আগে কেন সরকার কারখানাটির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারল না।
সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের যারা এ কাজটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তারা কেন এই ক্রুটিগুলো আগেই চিহ্নিত করলেন না। তাই মালিক পক্ষের সঙ্গে সঙ্গে এই জীবনহানির দায় সরকারও এড়াতে পারে না। বয়লার ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়মিত পরিদর্শনের নিয়ম থাকা সত্বেও সংশ্লিষ্টরা কেন তা করেন নি তাও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সরকার নিহত পরিবার প্রতি ২লক্ষ করে টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু জীবনের মূল্য কি টাকা দিয়ে পরিশোধ হয়? এটি নিহতদের পরিবারের জন্য হয়তো কিছুটা হলেও সহায়ক হবে মাত্র। আমরা চাই, শ্রমিকদের মৃত্যুর পর শুধু ক্ষতিপুরণ প্রদান করলেই চলবে না। সরকারকে এ ধরণের কারখানা চিহ্নিত করে আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনই সবার উর্ধ্বে।
কারখানার আগুনে যারা পুড়ে মারা গিয়েছেন, মৃত্যুর আগে কত কষ্টই না হয়েছে তাঁদের। যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। অতঃপর মৃত্যু হলো ২৪টি প্রাণের। ২৪টি পরিবার। হয়তো মৃত শ্রমিকদের উপার্জন দিয়েই চলতো ওই পরিবারগুলো। এখন কিভাবে চলবে তারা?
তারা অপেক্ষায় ছিল, তাদের প্রিয়জন ঘরে ফিরবে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিবেন। কিন্তু না, তা আর হলো না! আজ এই পরিবারগুলোর বুকে চাপা কষ্ট। আপনজন হারানোর এই বেদনা কিভাবে তারা মেনে নিবেন। কাকেইবা দায়ী করবেন এই পরিণতির জন্য- কারখানার মালিককে, সরকারকে, নাকি নিজের নিয়তিকে ?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১১,২০১৬
© 2016 – 2018, https:.