একাত্তরে আনন্দ ও বীরত্ব প্রকাশের ভাষা ছিল ‘জয় বাংলা’
এক মুক্তিযোদ্ধার নাম বদলে গেছে একাত্তরে। ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন তিনি। ছিলেন ভীষণ সাহসী। মৃত্যুর আশঙ্কা সত্ত্বেও যুদ্ধে এগিয়ে যেতেন; জীবনের মায়া তাঁর ছিল না। একরোখা ও বেপরোয়া যোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধ করেছেন টাঙ্গাইল অঞ্চলে। টাঙ্গাইলের লোকেরা তাঁকে ডাকে ‘পাহাইড়া’ বলে। সহযোদ্ধাদের পাহাইড়া ডাকই একসময় রূপ নেয় ‘পাহাড়ী’তে। ‘এস এম আনোয়ার হোসেন’ থেকে এভাবেই তিনি হয়ে যান ‘আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী’।
এ তথ্যটি জানান যুদ্ধাহত আরেক মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মালেক। আমরা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী জানাতেই মুঠোফোন নম্বর দিয়ে সহযোগিতা করলেন। অতঃপর এক সন্ধ্যায় পা রাখি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর বাড়িতে। মুখোমুখি চলে আলাপচারিতা।
রমজান আলী শেখ ও খাইরুন নেছার একমাত্র সন্তান আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী। বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দিয়ার ধানগড়া গ্রামে। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দিয়ার ধানগড়া প্রাইমারি স্কুলে। ক্লাস থ্রির পর ভর্তি হন জ্ঞানদায়িনী হাই স্কুলে। নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন জ্ঞানদায়িনী হাই স্কুলে ছাত্রলীগের প্রথম কমিটির তিনি ছিলেন সভাপতি। ১৯৬৮ সালে ওই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। অতঃপর সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাসের পর তিনি ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
আমাদের কথা এগিয়ে চলে এই বীর যোদ্ধার শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনাপ্রবাহে। তিনি বলেন–
“থানার মাঠে ফুটবল খেলতাম আনোয়ারুল, শেখর, নুরুল ইসলাম, বাবু, কামাল প্রমুখের সঙ্গে। তখন যমুনা হতে কাটা খালের ভেতর বড় বড় লঞ্চ আসত। লঞ্চের হর্ন বাজলেই আমরা ঘাটে ছুটে যেতাম। কালি পূজার সময় আনন্দ হতো বেশি। রাত জেগে গান শোনা, পাঠা বলি দেখা আর কলাপাতায় বসে খাওয়ার মজা ছিল অন্যরকম। রথ যাত্রায়ও অংশ নিতাম। ঈদের দিনে কার্তিক ও পরাগ ঠাকুরসহ হিন্দু ধর্মালম্বীরাও আমাদের বাসায় বেড়াতে আসত। ওটাই ছিল তখন কালচার। সিরাজগঞ্জে হিন্দু, মাড়োয়ারি আর পশ্চিমারাও কম ছিল না। তবু সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য ছিল সুদৃঢ়।
“১৯৬২ সালের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস ফাইভে। সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ১৮ মাসে বছর করার। এ নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন চলে। মিছিল করে আমরা স্লোগান দিই– ‘সিলেবাসে জগাখিচুরি করা চলবে না’, ‘১৮ মাসে বছর বাতিল কর, করতে হবে’, ‘বাকস্বাধীনতা দিতে হবে’। আমরা উচ্চারণ করতাম ‘বাঘ-স্বাধীনতা’। ‘বাঘ স্বাধীনতা’ আবার কী? এক সিনিয়র ভাই বোঝালেন, ‘বাঘ’ নয় ‘বাক’, মানে কথা বলার স্বাধীনতা। সেসব কথা মনে হলে আজও হাসি পায়।
“১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু সিরাজগঞ্জে আসেন। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে নেতাকে প্রথম দেখি। সোফায় বসা। একটা হাওয়াই শার্ট পরা। জায়গা না থাকায় আমরা তাঁর পায়ের কাছে মেঝেতে গিয়ে বসি। ভরাট কণ্ঠে তিনি নানা পরামর্শ দিলেন। এরপরই আমরা ৬ দফা আর ১১ দফা নিয়ে মাঠে নামি। শহীদ মিনার থেকে আমরা মিছিল বের করতাম। কণ্ঠে উচ্চারিত হত– ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘আমি কে তুমি কে? বাঙালি বাঙালি।’
“১৯৭০ সালের নির্বাচনে সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মোতাহার হোসেন তালুকদার। উনি তখন জেলে। তবুও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সারা দেশে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি জান্তা। শুরু হয় অসহোযোগ আন্দোলন।
“এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। বঙ্গবন্ধু বললেন– ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…।’”
নেতার এই নির্দেশই আনোয়ারকে বিমোহিত ও আন্দোলিত করে।
১২ মার্চ থেকেই আনোয়ারারা ট্রেনিং শুরু করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে। স্কাউটসের ডামি রাইফেল দিয়ে ৩৩ জনকে ট্রেনিং করান সেনাবাহিনীর লেন্স নায়েক লুৎফর রহমান অরুন ও রবিউল গেরিলা। ২৫ মার্চের পর থেকেই সিরাজগঞ্জ শহর থমথমে। প্লেন যাওয়ার শব্দ পেলেই মনে করা হত বোমা ফেলা হবে। এ কারণে প্রায় রাতেই গোটা শহর ‘ব্লাক আউট’ করে রাখা হয়। অতঃপর খবর আসে পাকিস্তানি সেনারা আরিচা-নগরবাড়ি হয়ে সিরাজগঞ্জে ঢুকবে। তাদের ঠেকাতে তখন প্রস্তুতি নেন আনোয়াররা।
( ভিডিও দেখতে :https://www.youtube.com/watch?v=5Z6kRVKaMKU )
কীভাবে? সে ইতিহাস শুনি আনোয়ার হোসেনের জবানিতে–
“৮ এপ্রিল ১৯৭১। প্রতিরোধের জন্য সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি ঘাটে আমরা পজিশন নিই। নেতৃত্বে ছিলেন লতিফ মির্জা। এরই মধ্যে থানা থেকে সংগ্রহ করা হয় ৮টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এক দিন পরেই আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় বগুড়া থেকে আসা পাঁচজন বাঙালি ইপিআর সদস্য। তাদের কাছে ছিল চাইনিজ এলএমজি, এসএমজি ও রাইফেল। নদীর পাড়ে বাংকার তৈরি করে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। এ সময় ইপিআর সদস্যরা আমাদের এলএমজি ও এসএমজি চালানো শিখিয়ে দেন।
“২৩ এপ্রিল সকাল বেলা। পাকিস্তানি সেনারা দুটি জিপে এসে নদীর ওপারে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে পজিশন নেয়। অতঃপর ফায়ার ওপেন করে। আমরাও ফায়ার করে পাল্টা জবাব দিই। তুমুল গুলিবর্ষণ চলছে। আমাদের কাছে ওয়ার্কশপে তৈরি লোকাল একটি অস্ত্র ছিল। সেটি দিয়ে গোলা নিক্ষেপের সময় বিকট শব্দ হত। পাকিস্তানি সেনারা ভাবল এটা ভারী কোনো অস্ত্র। মিনিট বিশেক গোলাগুলির পরই তারা পিছু হটে। আমরা তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলি। মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ ও বীরত্ব প্রকাশের ভাষা ছিল ‘জয় বাংলা’।”
এভাবে আনোয়ার উল্লাপাড়ার রেল অপারেশনসহ ৭ নং সেক্টরের সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু আধুনিক সামরিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকানো যায় না। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তারা সিরাজগঞ্জ শহর দখলে নেয়। অতঃপর গণহত্যাসহ শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আনোয়ার তখন পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আশ্রয় নেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি গ্রামে। সেখানেও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলছিল।
আপনারা তখন কী করলেন?
“মে মাসের শেষ দিককার কথা। বন্ধু আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে আমি চলে যাই তার নানা বাড়ি, টাঙ্গাইলের গোপালপুরে। সেখানেই যোগ দিই কাদেরিয়া বাহিনীর হুমায়ুন কোম্পানিতে। পরে আমাকে ওই কোম্পানির টু আইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতঃপর যুদ্ধ করি ১১ নং সেক্টরের হাজরাবাড়ির চেরাভাঙ্গা ব্রিজ, ভেংগুলা, ভুঞাপুর থানা, সিংগুরিয়া, সোহাগপাড়া ব্রিজ, মির্জাপুর থানা, নাগরপুরসহ মোট ২১টি অপারেশনে।”
এই বীর যোদ্ধা ১৯৭১ সালে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশের গুলি তাঁর বাঁ গালের মাংস ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেড়িয়ে যায়। মৃত্যু পথ থেকে ফিরে আসেন আনোয়ার হোসেন।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজও মুখের সেই ক্ষত মনে করিয়ে দেয় রক্তাক্ত সে দিনটির কথা। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের মনে তখন ঝড় ওঠে। জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই মৃত্যুস্মৃতি।
তাঁর ভাষায়–
“পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল নাগরপুর থানায়। তালগাছ কেটে তারা থানার চারপাশে দুর্ভেদ্য বাংকার তৈরি করে রাখে। দিনেদুপুরে সেটি দখলে নিতে হবে। কাদেরিয়া বাহিনীর ধরন ছিল এমনই। যুদ্ধ করতে হত ফেস-টু-ফেস। আমরা ছিলাম নাগরপুরের লাউহাঠি গ্রামের এক স্কুলে। দশটা কোম্পানির প্রায় এক হাজার যোদ্ধা। প্রথম বিফিং দিয়ে বলে দেওয়া হয় কোন কোম্পানি, কোন দিক থেকে আক্রমণ করবে। কথা ছিল তিনদিক থেকে আক্রমণের। পশ্চিম দিকটা থাকবে খোলা। সে পথে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে চাইলে আমাদের কোম্পানি তাদের জীবিত ধরবে। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩০ নভেম্বর সকালে আমরা পজিশন নিলাম। আমাদের অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। দুটি থ্রি ইঞ্চ মর্টার নিক্ষেপের মাধ্যমে তিনি অপারেশন শুরু করেন। গোলাগুলি চলছে। কিন্তু আমরা ওত পেতে বসে আছি। অসাবধানতাবশত হঠাৎ সহযোদ্ধা নান্নুর এলএমজি থেকে মিস ফায়ার হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের পজিশন টের পেয়ে যায়। ওরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সহযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন।
“সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমাকে পাঠানো হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা ক্যাম্পে। সেখান থেকেই শিখি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল চালানো। বিশেষভাবে তৈরি ওই রাইফেলটি জিরো অ্যাঙ্গেলে সেট করে থার্টি সিক্স গ্রেনেড ঢুকিয়ে থ্রো করা হত। একটু এদিক-ওদিক হলে নিজেকেই মরতে হবে।
“বিকেল তখন ৩টা। আরেকটি দল নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিলেন কমান্ডার সবুর খান। তিনি আমার কাছে চিরকুট পাঠালেন, যাতে গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল নিয়ে শত্রুর বাংকার ভাঙতে আমি তাকে সহযোগিতা করি। আমি দ্রুত হুমায়ুন বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে সবুর খানের দিকে সরে আসি। পজিশন নিই নাগরপুর থানার সম্মুখে লৌহজং নদীর এপাড়ে। পাকিস্তানি সেনারা খুব কাছাকাছি।
“দেখলাম একটি বাংকার থেকে চাইনিজ এলএমজির গুলি ছুড়ছে তারা। বাংকারটা টার্গেট করি। একটি জিগা গাছের পাশ থেকে জিরো অ্যাঙ্গেলে ফায়ার করতেই গ্রেনেড গিয়ে পড়ে বাংকারটির ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে সেখানে থাকা পাকিস্তানি সেনারা। তা দেখে আমি উদ্দীপ্ত হই। টার্গেট করি ওদের আরেকটি বাংকার। সবুর খান অন্যদিকে ফায়ার দিচ্ছিলেন। ওদের দৃষ্টি যেন এদিকটায় না পড়ে। হুমায়ুন বাঙালি বিশেষ রাইফেলটির বাট ধরে রেখেছেন। আমি হাঁটু গেড়ে পজিশনে বসা। ট্রিগারে চাপ দিব অমনি আমার দিকে চোখ পড়ে ওই বাংকারের এলএমজি-ম্যানের। দ্রুত সে ব্রাশের ব্যারেলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। অমনি শত শত গুলি। একটি গুলি আমার বাম গাল ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেড়িয়ে যায়। রাইফেলের বাট ধরে থাকা হুমায়ুন বাঙালের পিঠেও লাগে দুটি গুলি।
“আমি পেছনে ছিটকে পড়ি। মনে হল, চোখের সামনে হাজার হাজার জোনাকি পোকার আলো যেন জ্বলছে। এরপরই জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমার মাথাটা সবুর খানের কোলে। চোয়ালের হাড় রক্তাক্ত। মুখের দাঁত বেরিয়ে গেছে। গরম রক্ত পড়ছে। অনুভব করলাম রক্ত গলার ভেতর গিয়ে গলগল শব্দ হচ্ছে। শুনলাম কে যেন বলছে, ‘পাহাড়ী মরে গেছে।’ বহু কষ্টে চোখ মেলে শুধু বললাম– ‘মরি নাই।’”
চিকিৎসা নিলেন কোথায়?
“সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে প্রথমে নেয় লাউহাটি স্কুল মাঠে পরে ব্যারিস্টার শওকত আলীর কাচারি বাড়িতে। ওখানেই কাদেরিয়া বাহিনীর ডাক্তার শাহজাদা আমার মুখে ও গলায় সেলাই করেন। একপর্যায়ে মুখে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। কী যে কষ্ট পেতাম তখন! নিজের শরীরের গন্ধ নিজের কাছেই অসহ্য লাগত! পরে কুমুদিনী হাসাপাতালে নরওয়ের ডাক্তাররা আমার মুখে ও গলায় চারবার অপারেশন করে আমাকে সুস্থ করে তোলেন।”
একাত্তরের আর এখনকার কাদের সিদ্দিকীর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?
খানিক হেসে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বলেন, “রাত আর দিন। ১৯৭১ সালের কাদের সিদ্দিকীকে শুধু বীর নয়, মহাবীর বলতেও আপত্তি নাই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনিই প্রথম প্রতিবাদ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়েন। হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১০৪ জন শহীদও হয় তখন। কিন্তু এরপর তো মিলাতে পারি না।”
কেন?
“বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীল নকশা করে জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশে-বিদেশে চাকুরি দিয়ে পুনর্বাসিত করেন জিয়া। দালাল আইন বাতিল করে জেলে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করেন। গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তার সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল রাজাকার শাহ আজিজ। জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদের মতো রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এসব ইতিহাস কি কাদের সিদ্দিকী ভুলে গেলেন? উনি এখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীর দল বিএনপির নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। ব্যক্তি স্বার্থে বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেন। তাই আমার কাছে একাত্তর আর পঁচাত্তরের কাদের সিদ্দিকী আজ মরে গেছে।”
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই বীর প্রতীক অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত–
“বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের জন্য ভাতার প্রচলন করে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ দেশে ডাক্তার ভুয়া হয়, ইঞ্জিনিয়ার ভুয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল হয়। তাহলে সুবিধা লাভের জন্য মুক্তিযোদ্ধাও ভুয়া হবে– এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য দায়ী উপজেলা বা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা। তাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু সনদ বাতিল করলেই চলবে না। কঠিন শাস্তিও দিতে হবে।”
আলাপচারিতার একপর্যায়ে চা-নাস্তার বিরতি। আমরা তখন কথা বলি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর বড় মেয়ে সানজিদা প্রীতির সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স করছেন তিনি। নিজের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাবা প্রসঙ্গে বলেন–
“বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। দেশের মানুষের জন্য সত্যিকারভাবে কিছু করতে চাই। এ ইচ্ছাটা তৈরি হয়েছে দেশের জন্য বাবার আত্মত্যাগ দেখে।”
প্রীতি বলেন, “এ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের চ্যাপটার আরও বাড়ানো দরকার। একুশটা বছর কিন্তু গ্যাপ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে দেওয়া হয়নি। যার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেই বঙ্গবন্ধুকেই তখন অ্যাভয়েট করা হয়েছে। এ বিষয়গুলোও এ প্রজন্মকে জানাতে হবে।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার বলেন–
“শেখের মেয়ে আছেন বলেই বিচার হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করেছিলেন। ক্ষমতা দখল করে জিয়া তো আইনই বাতিল করে দেন। এরপর সাত্তার, এরশাদ ও খালেদারা রাজাকারদের উত্থান ঘটিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে ধ্বংস করে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালিয়েছে। তাই শুধু জামায়াত নয়, বিএনপির কৃতকর্মেরও বিচার হওয়া উচিত।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর যোদ্ধা বলেন–
“দেশের ক্ষমতায় রাজাকার নাই। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাও নাই। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিচ্ছেন। এটা ভাবলেই ভাল লাগে।”
খারাপ লাগে কখন?
খানিক নীরব থেকে বীর প্রতীক আনোয়ার বলেন, “গুলশানে জঙ্গি হামলায় বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হল। এরা আসলে কারা? একাত্তরে আমাদের শক্রু ছিল স্পষ্ট। প্রতিপক্ষ ছিল আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু আজকে আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে হয় জঙ্গি। বড় বড় লোকদের ছেলেমেয়েও এ পথে যাচ্ছে। দেশের জন্য এটাই ভয়ের বিষয়। এর জন্যই কি দেশটা স্বাধীন করেছি! আমি মনে করি, শেখ হাসিনা সরকারের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই জঙ্গিবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো লোকও যদি জড়িত থাকে তবে তারও কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
পরবর্তী প্রজন্ম অনেক মেধাবি। সারা পৃথিবীতে তারা দেশের মুখ উজ্জল করবে। এমনটাই বিশ্বাস করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন–
“তোমরা এ দেশটাকে ভালবেসো। দেশের স্বার্থে এক থেক। সবাই মিলে জঙ্গিবাদকে রুখে দিও। মনে বিশ্বাস রেখ– জয় বাংলার এ দেশে, জঙ্গি আর সন্ত্রাসী যাবে ভেসে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে, প্রকাশকাল: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.