সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথা
কিছু একটা হবার জন্য কলম ধরিনি। হ্যাঁ, লেখক হতে চেয়েছিলাম, কলম ধরে কেউ কিছু লিখলে তাকে তো লেখকই বলতে হয়, নাকি? কিন্তু লেখা? সে কি হচ্ছে? হয়েছে? চারদিকের বন্দনাস্তুতি কি অখ্যাতির ধ্বনি আমার ওপর দিয়ে বহে যায়, হাঁসের মতো আমি জল আর পাঁক ঝেড়ে উঠি। আমার চোখ মহাকালের দিকে। যে-মানুষ যে-দেশ আর যে-কালের ভেতরে আমি জন্মটা পেয়েছিলাম, আর নিজেকে একদিন যে-কাজটা এর ঝুঁকিসমেত গ্রহণ করেছিলাম, কাজটা কি ঠিকমতো করে যাচ্ছি? দাউ দাউ করে আগুনজ্বলা পাটাতনে দাঁড়িয়েও, ইংরেজি কবিতায় পড়া সেই বালকের মতো আমি কি বলতে পারছি—পিতা আমাকে বলো, তোমার আদেশ কি আমি পালন করতে পারছি? উত্তরটা যদি মহাকাল দেয়। তবে তত দিন আমি বেঁচে থাকব না। আর, এই বেঁচে থাকার কালে যে বাদ্যি রব শুনি—কর্কশ কি মধুর, কান তাতে দিই না। কারণ, হয়ে ওঠার চেষ্টাটাই এখনো আমি করে চলেছি।
সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তাঁর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে,কুড়িগ্রামে। সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও হালিমা খাতুনের প্রথম সন্তান শামসুল হক। পিতা ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।
সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। ১৯৫০ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর পিতার প্রবল ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন।কিন্তু তা এড়াতেই শামসুল হক বম্বে পালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নিজের পছন্দ অনুসারে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। স্নাতক পাসের আগেই অর্থ্যাৎ পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই সৈয়দ শামসুল হক চেয়েছিলেন লেখক হবেন। নিজের আত্মকথায় তিনি লিখেছেন-‘ আমার বাবাকে লিখতে দেখেছি। চিকিৎসক তিনি, লিখতেন হোমিও চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর বই। রাত জেগে লিখতেন। বাবার পাশেই আমি ঘুমোতাম। ঘুমোবার চৌকির পাশেই তাঁর লেখার টেবিল। সকাল থেকে তাঁর রোগী দেখার ভিড়, সারা দিন ওই, ছুটি পেতেন অধিক রাতে, বই লেখার অবসরই তাঁর ছিল শেষ রাতে। হঠাৎ একেকটা রাতে জেগে উঠে ঘুম জড়ানো চোখে দেখতে পেতাম, লণ্ঠনের আলোয় বাবার মুখখানা অন্ধকারে পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে, ঝুঁকে পড়ে তিনি লিখে চলেছেন, রাতের নির্জন স্তব্ধতার ভেতরে শব্দ উঠছে খস্ খস্ খস্ খস্, কাগজের ওপরে তাঁর কলম চলছে, দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কালি নিচ্ছেন, ভাবছেন, আবার লিখছেন। এই ছবিটা আজও এতটাই স্পষ্ট, যেন এখনই দেখছি। এখন আমি মনে করি, বাবার ওই নিশুতি রাতের ছবিটা, ওই ছবিটাই! তখনই আমি ভাবি, আমাকেও লিখতে হবে। বাবা যে কাজটি রাতের ঘুম থেকে উঠে করেন, যে কাজটি করবার সময় তাঁর মুখখানি যে পদ্ম হয়ে ওঠে, ওই কাজটিই আসল কাজ। মনের ভেতরে ঝোঁক আর সামাল দিতে পারি না। প্রতিজ্ঞাটিই শুধু—লেখক হব!
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে।ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য এই কবি ও লেখক ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কালজয়ী অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখা নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরুল দীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।
লেখক হওয়া প্রসঙ্গে এই কীর্তিমান বলেছেন- ‘কিছু একটা হবার জন্য কলম ধরিনি। হ্যাঁ, লেখক হতে চেয়েছিলাম, কলম ধরে কেউ কিছু লিখলে তাকে তো লেখকই বলতে হয়, নাকি? কিন্তু লেখা? সে কি হচ্ছে? হয়েছে? চারদিকের বন্দনাস্তুতি কি অখ্যাতির ধ্বনি আমার ওপর দিয়ে বহে যায়, হাঁসের মতো আমি জল আর পাঁক ঝেড়ে উঠি। আমার চোখ মহাকালের দিকে। যে-মানুষ যে-দেশ আর যে-কালের ভেতরে আমি জন্মটা পেয়েছিলাম, আর নিজেকে একদিন যে-কাজটা এর ঝুঁকিসমেত গ্রহণ করেছিলাম, কাজটা কি ঠিকমতো করে যাচ্ছি? দাউ দাউ করে আগুনজ্বলা পাটাতনে দাঁড়িয়েও, ইংরেজি কবিতায় পড়া সেই বালকের মতো আমি কি বলতে পারছি—পিতা আমাকে বলো, তোমার আদেশ কি আমি পালন করতে পারছি? উত্তরটা যদি মহাকাল দেয়। তবে তত দিন আমি বেঁচে থাকব না। আর, এই বেঁচে থাকার কালে যে বাদ্যি রব শুনি—কর্কশ কি মধুর, কান তাতে দিই না। কারণ, হয়ে ওঠার চেষ্টাটাই এখনো আমি করে চলেছি।’
লন্ডনের রয়াল মার্সডেন হাসপাতালে চার মাস চিকিৎসার পর গত ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ সৈয়দ শামসুল হক দেশে ফেরেন। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানে পরীক্ষায় তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। লন্ডন থেকে ফিরলে তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ ওই হাসপাতালেই বিকেল ৫টা ২৬ মিনিটে মারা যান সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত।
তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথমআলো, বিডিনিউজ২৪.কম।
© 2016 – 2018, https:.