বঙ্গবন্ধুর ভাষণই গোটা জাতিকে এক করে দেয়
এক অপারেশনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আঘাত পান। পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলিতে তাঁর ডান হাতের কবজির উপরের হাড়টি গুঁড়ো হয়ে যায়। ফলে হাতটি স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। এখনও হাতটিকে উপরের দিক করে ঘুমাতে হয়। ব্যথা হয় সবসময়। তবুও দেশের জন্য সবকিছু সহ্য করছেন এই ত্যাগী যোদ্ধা। দেশ ও দেশের স্বাধীনতা তাঁকে ভুলিয়ে দেয় সব কষ্ট-বেদনা।
“বড় সংসার। ছয় ভাইবোন। জমি ছিল সামান্য। তা দিয়া বাবায় কোনো রকমে পরিবার চালাইত। খেলার দিকে তহন মন টানত বেশি। ফুটবল খেলতাম। লেফট সাইডের প্লেয়ার আছিলাম। বাবার কাজেও সাহায্য করছি। হাল দিতাম, গরু চড়াইতাম। বন্ধুগো লগে দল বাইন্ধা স্কুলে থেইকা ফিরতাম। বিকাল হইলেই হুমায়ুন, মালেক, ফিরোজ, মিজানের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। ভালাই কাটতেছিল সব কিছু।
“বড় বন্যার সময়ের ঘটনা। মারে নিয়া বড় বোনরে দেখতে যাই তার শ্বশুর বাড়িত। ফিরার পথে নৌকা ডুইবা মা যায় মইরা। আহারে, অহনও মনে অইলে বুকটা ছ্যাক কইরা ওডে। মা নাই, তাই দুনিয়াডাই অন্ধকার মনে হইছে। বড় বোন রহিমা তহন আমার দায়িত্ব নেয়। কোলেপিঠে করে মানুষ বানায়। মায়ের মতো ওর ঋণও শোধ করতে পারমু না।
“তহন ক্লাস নাইনে। দেশে চলতাছে মুজিবের আন্দোলন। সবার মুহে মুহে তাঁরই কথা। একবার স্কুল থাইকা বাড়ির দিকে যাইতাছি। রেল স্টেশনটা ছিল বাড়ির কাছাকাছি। উত্তর-দক্ষিণ পাশে দাঁড়াইয়া আছি। গাছের ছায়ায়। গ্রামের পরিচিত এক লোক কথা কইতেছে পাকিস্তানি এক ইপিআরের সঙ্গে। ওরা ভাবছিল আমি ওগো কথা শুনছি। আসলে কিছুই খেয়াল করি নাই। ইপিআর পাকিস্তানিডা আমারে গালাগালি শুরু করল। প্রতিবাদ করাতে তার লগে হাতাহাতি হয়। ওরা আমারে ধইরা নিয়া যায় ক্যাম্পে। অনেক মারে। খবর পাইয়া ছুইটা আসেন মেরাছানি স্কুলের হেড মাস্টার। উনি খুব ইংরেজি জানতেন। ইংরেজিতে কথা কইয়া ক্যাম্প থাইকা আমারে ছাড়াইয়া নেন। ওইদিন থাইকাই মনে জিদ চাইপা গেছিল। পাকিস্তানিগো দেখলেই রক্ত টলমল করত।
“৭ মার্চ ১৯৭১। শেখ সাহেব ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। বাজারের এক দোকানে বইসা আমরা রেডিওতে ওই ভাষণ শুনি। সাধারণ মানুষ সব ছিল আমগো পক্ষে। বঙ্গবন্ধু কইলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’ নেতার এই কথাগুলা মনে গাঁইথা গেছিল। পরে সিঙ্গাইরবিল বাজারে আমরা মিটিং করি। ওইদিনই সিদ্ধান্ত নিছি দেশের জন্য যে কোনো সময়েই পথে নামমু।”
যুদ্ধদিনের এ গদ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের জবানিতে শোনা। তাঁর বাবার নাম আবদুল কাদের ও মা কুরফুলেন নেসা। বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার কাশিনগর গ্রামে। সম্প্রতি এক সকালে পা রাখি তাঁর গ্রামের বাড়িতে। কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
জসিম উদ্দিনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নোয়াবাদি প্রাইমারি স্কুলে। ক্লাস ফাইভ পাসের পর তিনি ভর্তি হন মেরাছানি হাই স্কুলে। ওই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৭০ সালে। এরপর ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন মনতলা শাহজালাল কলেজে। কলেজে তিনি ছাত্রলীগের প্রথম ব্যাচের জয়েন সেক্রেটারি ছিলেন। রফিক তখন ভিপি। ওখানে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন মকসেদ আলী। ১৯৭১ সালে জসিম ছিলেন ইন্টারমেডিয়েট ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র।
ভিডিও দেখতে: https://www.youtube.com/watch?v=B8kxYIQVxEE
২৩ মার্চ ১৯৭১। হায়ারে ফুটবল খেলতে জসিম যান নরসিংদীর শিবপুরে। আলী তখন নরসিংদী কলেজের ভিপি। তাঁর মাধ্যমেই তিনি খেলতে যান সেখানে। ২৫ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ২৬ তারিখ পায়ে হেঁটে জসিম রওনা হন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। পথে পথে তখন হাজার হাজার মানুষ। সবার হাতে লাঠি। লাঠি দিয়েই তারা আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়বে। অস্ত্র কেমন সেটা তখন বড় কথা ছিল না। স্বাধীনতার জন্য বুকভরা সাহস আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই গোটা জাতিকে এক করে দেয়।
জসিমের সঙ্গে পথেই দেখা হয় আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন মির্জার। তিনি তাঁর হাতে তুলে দেন সংগ্রহ করা একটি রাইফেল। এরই মধ্যে কুমিল্লা ক্যানটনমেন্ট থেকে বেশ কয়েকজন বাঙালি আর্মি অস্ত্রসহ চলে আসেন ব্রাক্ষণবাড়িযায়। সবাই মিলে প্রথমে তাঁরা একটি ট্রেন আটকে দেন। কিন্তু টিকতে পারেন না। ফলে এপ্রিলের প্রথম দিকেই ট্রেনিংয়ের জন্য ওই দলটির সঙ্গে জসিম চলে যান ভারতে– আগরতলার নারায়ণপুরে।
বাকি ইতিহাস শোনা যাক মুক্তিযোদ্ধা জসিমের মুখেই–
“নারায়ণপুরেই নাম লেখাই। পরে আমগো পাঠিয়ে দেওয়া হয় তেলিয়াপাড়ায়। সেখানে তিন-চারদিন চলে লেফট-রাইট। এরপর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় আসাম কাসার ডিসটিকে। ইন্দ্রনগর ক্যাম্পে। দুর্গম পাহাড়ে ছিল ট্রেনিং ক্যাম্পটি। আমরা ১০৩ জনের মতো। ট্রেনিং চলল এক মাস। আমগো শিখায় রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান, এসএমজি, অ্যাক্সক্লোসিভ লাগানো প্রভৃতি। পরে আমি, খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম), আশারাফুল হকসহ (বীর প্রতীক) ২৫ জনকে বাছাই করে দেওয়া হয় জেএলডাব্লিউ (জুনিয়র লিডার উইং) ট্রেনিং। ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন চৌহান আর ক্যাপ্টেন ধীরেন। সুবেদার মেজর সাব্বির সিংয়ের কথা এখনও মনে পড়ে। ওগো আন্তরিকতার কমতি পাই নাই। ট্রেনিংয়ের সময় আমার বডি নম্বর ছিল: ই-৫২৪৮। মরবার আগ পর্যন্ত এই নম্বরটা ভুলমু না।”
জসিম উদ্দিন বলেন, “ট্রেনিং ক্যাম্পেই শপথ নিছিলাম– আমি দেশকে ভালবাসব, দেশের পতাকাকে ভালবাসব, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনব। যুদ্ধের সময় কোনো অন্যায় করব না। স্বাধীনতার পথে যদি আপনজনেরাও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তবে তারেও ক্ষমা করব না। দেশ তো স্বাধীন হইল। মুক্তিযোদ্ধাগো ওই শপথ এহন কই গেল? অসৎ মুক্তিযোদ্ধায় তো দেশ ভইরা গেছে। সবাই ব্যস্ত যার যার স্বার্থে। এ জন্যই কই– নয় মাসে দেশ স্বাধীন না হয়ে যদি ২০ বছরে স্বাধীন হইত, তবে দেশের মানুষ বুঝত– স্বাধীনতা কারে কয়।”
ট্রেনিং শেষে জসিমদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার নং সেক্টরে– ইকো ফোরে। মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে ভারতের বদরপুরের অদূরে জালালপুরে ছিল তাঁদের গেরিলা ঘাঁটি। সবাই ছিলেন গেরিলা। জালালপুর থেকে ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেই তাঁরা আবার ফিরে যেতেন। এভাবেই জসিমরা অপারেশন করেন কানাইঘাট, আটগ্রাম ডাকবাংলা, জুলাই ব্রিজ, কালিগঞ্জ বাজার প্রভৃতি এলাকায়। তাঁদের কমান্ডের সেকেন্ড ম্যান ছিলেন খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ খুব সহজ ছিল না। ভয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই পালাইছে। আমি চালাইতাম স্টেনগান। গামছায় বাঁধা থাকত কয়েকটা গ্রেনেড। জকিগঞ্জের কালিগঞ্জ বাজারের রাজাকারগো ক্যাম্প আক্রমণ কইরা ১৭টি রাইফেল পাইছিলাম। একবার আটগ্রাম ডাকবাংলা অপারেশনের সময় তিনজন পাঞ্জাবিরে ধইরা নিয়ে আসি। পরে তাগো নিয়া যায় ইন্ডিয়ান আর্মিরা। জুলাই ব্রিজ অপারেশনের সময়ও ধরছিলাম পাঁচজন রাজাকার। দেশের শত্রুরে যারা সাহায্য করে ওরা তো দেশের বড় শত্রু। কয়লা ধুইলেই কি ময়লা যাইব? রাজাকার তো রাজাকারই থাকে। ওগো রাখলেই তো ওরা দেশের ক্ষতি করব। তাই তাগো বাঁচতে দেই না।”
সেপ্টেম্বর তখনও শেষ হয়নি। জসিমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তিন নং সেক্টরে, বদিউজ্জামানের আন্ডারে। এবার সম্মুখযুদ্ধ। তাঁদের ক্যাম্প ছিল মনতলি কলাগাইচ্ছায়। অপারেশনের সময় আর্টিলারি সার্পোট নিয়ে পেছনে থাকত ভারতীয় আর্মিরা।
এক অপারেশনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আঘাত পান। পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলিতে তাঁর ডান হাতের কবজির উপরের হাড়টি গুঁড়ো হয়ে যায়। ফলে হাতটি স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। এখনও হাতটিকে উপরের দিক করে ঘুমাতে হয়। ব্যথা হয় সবসময়। তবুও দেশের জন্য সবকিছু সহ্য করছেন এই ত্যাগী যোদ্ধা। দেশ ও দেশের স্বাধীনতা তাঁকে ভুলিয়ে দেয় সব কষ্ট-বেদনা।
কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনটিতে? খানিক নীরব থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিম জানালেন ওই দিনের আদ্যপান্ত।
তাঁর ভাষায়, “আমরা ছিলাম রামরাইলে। সিএমবির অপজিটে। মুভ করতাছি। সামনে সব এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার)। একটা প্লাটুনে ৪০ জনের মতো। ২৯ নভেম্বর ১৯৭১। বৃহস্পতিবার। রাত তখন ৪টা। আমরা অ্যাটাক করব রামরাইল ব্রিজটিতে। ওখানে ছিল পাঞ্জাবিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। আমগো পেছন থেকে আর্টিলারি সার্পোট দিবে ভারতীয় সেনারা। মূল উদ্দেশ্য ব্রিজটা উড়াইয়া দেওয়া।
“আমরা সামনে এগোতে থাকি। কাছাকাছি যেতেই বুঝে যাই রেকি ভুল ছিল। ব্রিজের ওপর কোনো পাঞ্জাবির বাংকার থাকার কথা না। কিন্তু দেখলাম তারা বাংকারে ওত পেতে বসে আছে। কী করব? পেছনে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। আমি ক্রলিং করে ব্রিজের কাছাকাছি চলে যাই। প্রথমে দুটি গ্রেনেড চার্জ করি। সঙ্গে সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তৃতীয় গ্রেনেডটি মারার পরপরই শো করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে আমি রাস্তা থেকে ২০ ফিট নিচে পড়ে গেলাম। তখনও জ্ঞান হারাইনি। স্টেনগানটা ধরে ফায়ার করার চেষ্টা করি। কিন্তু না, ডান হাতটা কাজ করছে না। কী হইল হাতে? অনুভব করলাম ডান হাতটা নাড়াতে পারছি না। দেখলাম কবজি ঝুলে আছে। রক্ত বেরোচ্ছে পিনপিন করে। আঙুল দিতেই বুঝি ডান হাতের কবজির ওপরের হাড় গুঁড়ো হয়ে বেরিয়ে আসছে। খানিক পরেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনদিন পরে চোখ মিলে দেখি আমি আগরতলায়– মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে। ওই অপারেশনে ১৭ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছিল।”
চিকিৎসা হল কোথায়?
“প্রথমে ভারতের গোহাটি ও লক্ষ্নৌ হাসপাতালে। স্বাধীনের পর চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে আমাকে পাঠানো হয় যুগোশ্লোভাকিয়ায়। ওখানে হাতের অপারেশন করে ভেতরে রড ও কৃত্রিম পাত লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পেটের চামড়া দিয়ে গ্রাফটিং করা হয় ক্ষতস্থানটি। পরে হাতটির ভেতরে প্লাস্টিকের নাট লাগানো হয় পোলান্ডের এক হাসাপাতালে। হাতটি কাটা না হলেও ওই হাতে কোনো কাজ করতে পারি না। হাত ওপরের দিকে না রেখে ঘুমালে রগগুলো ফুলে যায়। হাতটিতে সারাক্ষণই পিনপিন করে ব্যথা করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা সহ্য করতে হবে। করছিও। মনোবল আছে বলেই বেঁচে আছি ভাই।”
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, এখনও কষ্ট পাচ্ছেন– স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
মৃদু হেসে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন বলেন, “স্বাধীনতা, দেশ আর পতাকা পাইছি। এটাই ছিল তহন স্বপ্ন। দেশের জন্য কষ্ট করলাম, বাবা-মারেও কষ্ট দিলাম আর রুটি-রোজগারের সময়টায় পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা দিছে স্বাধীনতার জন্য। কিছু পাওয়ার জন্য না। কিন্তু স্বাধীনের পর যহন রাজাকার আর দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধারা তরতর কইরা ধনী হইয়া গেল, তহন খারাপ লাগত। জীবনের হিসাব মিলত না।”
বর্তমানে যুদ্ধাহত ভাতায় কোনোরকমে চলছে এই যোদ্ধার পরিবার। ১১ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাহতের ভাতা বৃদ্ধির নির্দেশ দিলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন, “শেখের ডাকে যুদ্ধে গেছি। শেখের মাইয়াই ভাতা বৃদ্ধি করছে। তা না হলে পরিবার নিয়া ভিক্ষা করতে হইত। কিন্তু এহন তাঁর নির্দেশও মন্ত্রী-সচিবরা মানেন না। যুদ্ধাহতের ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে টালবাহান করেন।”
৪৪ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
“পয়সা খেয়ে প্রশাসন এইটা করছে। আর যারা ভুয়াদের শনাক্ত করছে তারা অধিকাংশই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেই আবার টাকা খেয়ে ভুয়া শনাক্ত করেছে। এহন এই তালিকাই আমগো জন্য লজ্জার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই, অথচ কেউ কেউ এহন মুখ টিপে আসেন আর আমগো সামনেই ভাতা তোলেন। এই দুঃখের কথা কারে কমু ভাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমগো কমান্ডারদেরও উচিত ছিল তালিকা করে রাখা। তাঁরা উদ্যোগ নিলে স্বাধীনতা লাভের পরে সহজেই তালিকা চূড়ান্ত করা যেত।”
দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান বিষয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার উপলব্ধি হল, “রাজাকারগো বিচার হচ্ছে। ওদের দল আর বংশধররা কি বসে থাকব? ওরাই তো চায় এ দেশে শান্তি না থাকুক। শেখ হাসিনা টিকে না থাকুক। খালেদা জিয়া জামায়াত শিবিররে কোলে তুইল্লা রাখছে। আবার আওয়ামী লীগ সরকারও তাগো নিষিদ্ধ করে না। তাইলে বলেন, জঙ্গি হইব না কেন? রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সাহায্য ছাড়া জঙ্গিরা এ দেশে এত বড় ঘটনা ঘটাইতে পারত না। তাই সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে কারা ওদের সাহায্য করছে। নিজের দলের লোক জড়িত থাকলে তাকেও উপযুক্ত শাস্তি দিতে হইব।”
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?
এ প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একটু বিরতি দিয়ে বলেন, “শেখ হাসিনা সরকারের উন্নতির কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। কিন্তু দলের দুর্নীতিবাজ আর সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের বিষয়ে কঠোর হতে হবে। আগে বিএনপি করত, জামায়াতের সার্পোটার– এমন লোকেরাও এহন আওয়ামী লীগের কথা কয়। চোর, বদমাস, গুণ্ডা, চাঁদাবাজের মুখেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনি। হাসি পায় তহন। এটা কিন্তু দলের জন্য ক্ষতিকর। কারা কেন দলে আসছে সেইটা নজরদারিতে রাখতে হইব। মুখে ‘জয় বাংলা’ বললেই কেউ আওয়ামী লীগের হয়ে যায় না। এটা ভাবা মস্ত বড় ভুল। নিজের ভালো কাজের মধ্য দিয়েই জয় বাংলার প্রতিফলন ঘটাতে হয়।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি?
“যারা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, একাত্তরে যারা আমাগো মা-বোনদের ইজ্জত নিছে, মুক্তিযোদ্ধা মারছে, সাধারণ মানুষ মারছে, দেরিতে হলেও তাদের বিচার হচ্ছে, ফাঁসি কার্যকর হয়েছে– এটা ভাবলেই ভালো লাগে। তহন মন থেকে দোয়া করি শেখের মাইয়ারে।”
খারাপ লাগে কখন?
“যখন দেখি স্বাধীন এই দেশে টক শোর নামে চ্যানেলগুলোতে বইসা কিছু সাংবাদিক, উকিল, ব্যবসায়ী যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারগো পক্ষে গুণকীর্তণ করে, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তহন খুব খারাপ লাগে।”
পরবর্তী প্রজন্মই পারবে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে– এমনটাই বিশ্বাস করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন। পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, দেশের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ কর। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের কথা স্মরণ করে দেশকে এগিয়ে নিও। তাহলে তোমাদেরকেও স্মরণ করবে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে, প্রকাশকাল: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.