মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে গুলি খাইছি, এইডা কতবার প্রমাণ করতে হইব?

ট্রেনিং তখন শেষ। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাগুরার শ্রীপুরে, আকবর চেয়ারম্যানের কাছে। তাঁর অধীনে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি দল। আমরা যোগ দিতে দলটি বড় হয়; সব মিলিয়ে ২০০ জন। ছোট ছোট গ্রুপ করে আমরা অপারেশন করি। নবুয়া, আহম্মদ, ভিকু, রাজ্জাক, সুধীর বিশ্বাসও ছিলেন আমাদের দলে।

“রাজাকাররা অত্যাচার করত খুব। যুবতীদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে দেওয়া আর লুটপাট করা ছিল তাদের প্রধান কাজ। শ্রীপুর থানার ভেতরে কিছু রাজাকার তখন অবস্থান করছিল। থানার চারপাশ আমরা নিয়ন্ত্রণে নিই। ওরা ভেতরে। আকবর চেয়ারম্যান প্রথমে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা বললেন। প্রত্যুত্তরে তারা গুলি ছুড়ে। আমরাও পাল্টা জবাব দিই। অল্প সময়ের মধ্যেই গুলি করতে করতে থানা দখল করে নিই। ওই অপারেশনে মেলে অনেকগুলো অস্ত্র। এভাবেই চলছিল অপারেশনগুলো। নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না। যে কোনো সময় শক্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। একবার হলও তাই।

“শ্রীপুর তামান্না স্কুলের ভেতর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রেস্ট নিচ্ছিল। রাজাকাররা এ খবর পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে। ওরা এসে ঘিরে ফেলে স্কুলটিকে। অতঃপর নির্মমভাবে হত্যা করে দশজন মুক্তিযোদ্ধাকে। তাদের লাশগুলোর দিকে তাকাতে পারিনি। কারও চোখ উড়ে গেছে, কারও বুক বেয়নেটের আঘাতে রক্তাক্ত। এখনও মনে হলে বুকটা ছেক করে ওঠে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনার কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস।

ভারতীয় ট্রেনিংয়ের প্রত্যয়নপত্র

তাঁর বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার পথের হাট গ্রামে। বাবার নাম বেনুয়ারি বিশ্বাস ও মা সরলা বিশ্বাস। চার ভাই ও দুবোনের সংসারে চৈতন্য সবার ছোট। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কোয়ারী হাই স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন সত্যজিতপুর হাই স্কুলে। ওই স্কুলেই তিনি পড়েন ক্লাস নাইন পর্যন্ত।

ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে চৈতন্যর বেশ খ্যাতি ছিল। হায়ারে খেলতে যেতেন বিভিন্ন উপজেলায়। একবার ভাইদের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। রাগ হয়ে চৈতন্যও তখন বাড়ি ছাড়েন। চলে যান যশোর শহরে। সেখানে কাজ নেন এক দোকানে। যা পেতেন তাই দিয়ে চলছিল তাঁর জীবন।

কিন্তু সে জীবনেও ঝড় ওঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কারণে। চৈতন্য বলেন:

“আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। দেশের খবর জানতাম মানুষের মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিও শুনি রেডিওতে। তিনি বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই আমার কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা।”

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাটির কথা জানান এই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

“২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামে। তারা গণহত্যা চালাতে থাকে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মার্চের শেষ দিকেই সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। সঙ্গে ছিলেন তিন বন্ধু। মান্দাতলা গ্রাম দিয়ে আমরা সীমান্তে যাচ্ছিলাম। ওই গ্রামের অনেক বাড়িঘরই জ্বলছিল তখন। এক লোক চিৎকার করে দৌড়ে কাছে এসেই বললেন, পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি পাগলের মতো কাঁদতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা সামনে থাকতে পারে, এমন চিন্তা করে ভয়ে তখন সঙ্গে আসা দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন। নিজের কথা ভেবে তাঁরা ফিরে যায় নিজ গ্রামে।

“কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল থাকি। পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে বর্ডার পাড় হব? সে চিন্তা করছিলাম। ওই সময় মুচি সম্প্রদায়ের এক দল লোক যাচ্ছিল ভারতের দিকে। তাদের দলের সঙ্গে আমি মিশে যাই। পাকিস্তানিদের চোখ এড়িয়ে বাগদা সীমান্ত দিয়ে চলে আসি ভারতের গুগরা শরণার্থী ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসি টালিখোলায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ওখানেই রিক্রুট করা হচ্ছিল। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু লম্বা না হওয়ায় আমাকে বারবার বাদ দিয়ে দেয়। অনুরোধ করেও ফল হয় না। শেষে যুদ্ধে যাওয়ার তীব্র আগ্রহ দেখে আমার নাম লিখে নিল ক্যাম্পের লোকেরা। সেখানে লেফট-রাইট চলল বিশ দিনের মতো। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, বিহারের চাকুলিয়ায়। এসএলআর, এলএমজি, থ্রি নট থ্রি, গ্রেনেড, এক্সক্লুসিভসহ নানা বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয় ২৮ দিন। আমার এফএফ নং ছিল ৯৯৯।”

ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস অপারেশন করেন ৮ নং সেক্টরের শ্রীপুর, মোহাম্মদপুর, আরোয়াকান্দি প্রভৃতি এলাকায়। ওই সেক্টরের কমান্ডার তখন মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর। চৈতন্যরা ছিলেন গেরিলা। দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতেন। রাত হলেই চলত অপারেশন। পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই ছিল গেরিলাদের প্রধান কাজ।

এক অপারেশনে এই সূর্যসন্তান বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি বের করা গেলেও পয়জন ছড়িয়ে পরে গোটা পায়ে। তাই স্বাধীনতার পরেও চৈতন্যর যুদ্ধ থামে না। লড়াই চলে পাটিকে টিকিয়ে রাখার। অনেক কষ্ট আর চিকিৎসার পরও বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ জায়গাটিতে ইনফেকশন হয়ে তা ছড়াতে থাকে। একসময় পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। ফলে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ডাক্তাররা তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন।

কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এই বীরযোদ্ধা? প্রশ্ন শুনে চৈতন্য প্রথমে আবেগ আপ্লুত হন। অতঃপর বলেন:

“আমরা তখন রাজাপুর গ্রামের জয় গোপালের বাড়িতে। সেখানে ইয়াকুবের নিয়ন্ত্রণে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি দল। তাদের সঙ্গে যোগ দিই আমরাও। সব মিলিয়ে দেড়শ জন মুক্তিযোদ্ধা। থাকি মোহাম্মদপুরের পলাশ বাড়িতে।

গুলি লাগার কারণে গ্যাংগ্রিন হওয়ায় ২০১২ সালে চৈতন্যের বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়

“নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের কথা। পরিকল্পনা হয় মোহাম্মদপুর থানা আক্রমণের। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। মধ্যরাতে রওনা দিয়ে আমরা থানার চারপাশে অবস্থান নিই। পাশেই সিও অফিস। তার ভেতরে ছিল একটি পুকুর। পুকুরের পাশেই ফাঁকা জায়গা। ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা গোসল করতে আসবে ওই পুকুরে। ফাঁকা জায়গা থেকে আমরা তখনই আক্রমণ করব ওদের ওপর। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। একটা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কমান্ডার আমাদের সংকেত দিবেন।

“পরিকল্পনা মতো আমরা অ্যাডভান্স হই। গ্রেনেডের শব্দ পেয়েই সবাই ফায়ার ওপেন করি। গোলাগুলি শুরু হতেই ভেতর থেকে পাকিস্তানি সেনারাও আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে। বৃষ্টির মতো গুলি চলছিল। চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় দুই যোদ্ধা। ছোট ভাই মোহাম্মদকে বাঁচাতে গিয়ে মারা পরেন আহাম্মদও। ভোর পর্যন্ত চলে গোলাগুলি।

“আমি গাছের আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছি। পাশেই আতিয়ার। তাকে ডাকতাম ‘পাগলা আতিয়ার’ বলে। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে আমার পায়ে। প্রথমে টের পাই না। পাশ থেকে আতিয়ার বলে, ‘তুমি গুলি খাইছ।’ বাঁ পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্তে ভেজা। হাঁটুর নিচের দিকটাতে ঢুকে গেছে গুলিটি। আমি পরোয়া করি না। তখনও শক্রুর দিকে গুলি চালাচ্ছি। এক ফাঁকে শরীরের চাদরে বেঁধে নিই পাটা। কিন্তু রক্ত তখনও ঝরছিল। এভাবে একসময় গোটা শরীরটাই শীতল হয়ে যায়। আমি লুটিয়ে পড়ি মাটিতে।

“অন্যরা কাভারিং ফায়ার করলে পাগলা আতিয়ার তখন আমাকে কাঁধে তুলে নেয়। পেছনে সরে এসে আমাকে শুইয়ে রাখে গ্রামের ভেতরের এক বাঁশঝারে। পানির জন্য আমি ছটফট করছিলাম। এক সহযোদ্ধা বলল, ‘ওকে পানি দিস না। পানি খেলেই তো ও মারা যাবে।’”

সহযোদ্ধারা বাঁশে বেঁধে চৈতন্যকে নিয়ে যান ডাংগাপাড়ায়। সেখানে ছিলেন এক গ্রাম্য ডাক্তার, নাম বজলু। তিনিই তাঁর পা থেকে গুলি বের করে আনেন। পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় তখন গুলিটি বের হলেও ক্ষত স্থান থেকে পয়জন ছড়াতে থাকে। চৈতন্য ডাংগাপাড়া গ্রামে ছিলেন এক মাস। সেখানেই খবর পান দেশ স্বাধীনের।

কেমন লেগেছিল ওইদিন?

“কি যে আনন্দ লেগেছিল ভাই! গুলি খাওয়ার কষ্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঘরের ভেতর ছিলাম শোয়া অবস্থায়। স্বাধীনতার খবর পেয়ে বাইরে বেরুতে চাইলাম। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে উঠোনে শোয়ায়। তৃপ্তি নিয়ে দেখলাম স্বাধীন দেশের মুক্ত আকাশটাকে। বিড়বিড় করে গাইলাম: ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি…।’”

হাসপাতালের ছাড়পত্র

যুদ্ধাহত হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমরা বিশ্বাস ভাতা পাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই। মেডিকেল বোর্ড ফেস করেছেন কয়েকবার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পর এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধাহত ভাতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় গত জুলাই মাস থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাগুরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলী স্বাক্ষরিত একটি পত্র পৌঁছে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে। পত্রটিতে ১৫ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া যুদ্ধাহত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইন্ডিয়ান ট্রেনিং, ডিসচার্জ, মুক্তিবার্তার নম্বর ও বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে ভাতা পাওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্যের নামটিও তুলে দেওয়া হয় সেখানে।

কিন্তু কেন?

মুঠোফোনে মাগুরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলীর সঙ্গে কথা হয়। এ বিষয়ে কোনো যৌক্তিকতা তুলে ধরতে না পারলেও তিনি স্বীকার করেন, “এটা আমাদের ভুল হয়েছে। উনি প্রকৃত যুদ্ধাহত। তদন্তের সময় আমরা ঠিক করে নিব।”

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কষ্ট নিয়ে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে গুলি খাইছি, এইডা কতবার প্রমাণ করতে হইব বলেন? কত পরীক্ষা দিতে হইব? ভুলে ওরা আমায় ভুয়া বানালো, এর দায়টা কে নিবে? অনেক আগেই এ তালিকা চুড়ান্ত করা প্রয়োজন ছিল। দেশকে শক্রমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। অথচ সুবিধালাভের আশায় আজ অমুক্তিযোদ্ধারাও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আগে ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ ছিল। এখন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে। কিন্তু সঠিক তালিকা কই হচ্ছে? কমান্ডাররা তো বুঝে বা না বুঝে প্রকৃতদেরই আজ ভুয়া বানাচ্ছে। তাহলে সঠিক তালিকা হইব কীভাবে?”

তিনি মনে করেন এদেশে মুক্তিযুদ্ধ একবারই হয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সরকার পরিবর্তনের পর পরই হালনাগাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু যাচাইবাছাই করে তালিকাটি চূড়ান্ত করে ফেলা। তিনি বলেন, “এটা তো ভোটার তালিকা নয় যে, বারবার হালনাগাদ করতে হবে।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে চৈতন্য কুমার বিশ্বাস অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি।
তাঁর ভাষায়:

চৈতন্য কুমার বিশ্বাসের অনুকূলে সেক্টর কমাণ্ডার স্বাক্ষরিত সনদ

“তারা দেশের যে ক্ষতি করেছে বিচার তো আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে জিয়া ও তাঁর দল যুদ্ধাপরাধীদের স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী করেছে। এটা ছিল চরম অপমানের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের গোপালগ্রাম ইউনিয়নের আফজাল হোসেন চেয়ারম্যান ছিল রাজাকার। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। কোনো বিচার হয়নি তার। বরং আওয়ামী লীগের পতাকা তলে রাজনীতি করছেন। এটা তো রাজনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিচার দেরিতে হলেও একজন রাজাকার ও খুনি সাধু হয়ে যায় না। খুনিরা খুনিই থাকে।”

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

“বঙ্গবন্ধু অবশ্যই উদার মনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তবু ছোট ছোট অপরাধের মাফ না করে তাদেরও শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।”

আমাদের কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্যের বড় ছেলে চঞ্চল বিশ্বাসের সঙ্গে। বিএডিসিতে চাকুরি করছেন তিনি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান হিসেবে গর্ব বোধ করেন। বললেন, “আমার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত না দিলে এই দেশটা স্বাধীন হত না। পাকিস্তানের কাছে দেশ পরাধীন থাকত। তাদের আদর্শে সততার সঙ্গে আমরাও কাজ করতে চাই দেশের জন্য। প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ থাকা। তাহলেই দেশ সঠিক পথে থাকবে।”

দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চলবে। মায়ের ভাষায় কথা বলবে। মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন দেশেরই স্বপ্ন দেখতেন মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস। কিন্তু স্বাধীনের পর এদেশে যখন নিজেদের মধ্যে হানাহানি দেখেন তখন কষ্টে নীরব হয়ে যান এ বীরযোদ্ধা। তিনি বলেন:

“সরকার তো ভালোই থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের চ্যালাফ্যালারা দলের ১২টা বাজিয়ে দেয়। সরকার যদি সাধারণ মানুষের কথা, দেশের কথা চিন্তা করে কাজ করে তবে দেশটা অবশ্যই অন্যরকম হবে।”

সপরিবারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। মুচকি হেসে চৈতন্য বলেন:

“সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করে। আমরা এখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নই। যুদ্ধাপরাধীর বিচার থামাতে মার্কিন মন্ত্রীর টেলিফোনকেও শেখের মাইয়া পরোয়া করে নাই। বাংলাদেশ এখন একটা সাহসি নাম। অর্থনীতিতেও উন্নত হচ্ছে। এটা ভাবলেই মন ভরে যায়।”

খারাপ লাগে কখন?

“যখন দেখি মানবতা নাই। মানুষ মানুষকে খুন করছে, মন্দিরে আগুন দিচ্ছে ধর্ম রক্ষার নামে। কই একাত্তরে তো সবাই কাধে কাধ মিলিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। ধর্ম রক্ষা বলে তো তখন কিছু ছিল না। সেটাই যদি মানুষ মেনে নিত তাহলে তো বাংলাদেশের জন্মই হত না।”

পরবর্তী প্রজম্মের হাত ধরেই এ দেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাসের। তাদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন:

“তোমরা নিজেদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত থাকবে। দেশপ্রেম আর আদর্শই তোমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রক্তে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে তোমরাই আলো জ্বালাবে।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩০ জানুয়ারি ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button