মুক্তিযুদ্ধ

বাঙালি যে এক হতে পারে মুক্তিযুদ্ধই তার প্রমাণ

একাত্তরে ধর্মই প্রধান বিষয় ছিল রাজাকারদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের এক হিন্দু ছেলের দায়িত্ব ছিল আমাদের খাওয়ানো। একদিন গোলাগুলি চলছে এর মধ্যেই সে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। অথচ ওখানেই সে গুলি খেয়ে মরতে পারত। কত হিন্দু ছেলেরা জীবন দিয়ে অন্যকে বাঁচিয়েছেন। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁরা কি শিক্ষিত লোক, হাইফাই ফ্যামেলির? কোনোদিনও না। ৯০ পারসেন্ট ছিল অশিক্ষিত ও গরিব। তাদের কাছে ধর্ম আর জাত বিষয় ছিল না। সবার ওপরে ছিল দেশ। যারা এখন ধর্মের নামে সম্প্রীতি নষ্ট করছে তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।

ছোটবেলা থেকেই মোসলেম ছিলেন চঞ্চল। লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতেন। সুযোগ পেলেই জাম্বুরা নিয়ে ছুটতেন মাঠে। তখন জাম্বুরাই ছিল গরিবের ফুটবল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেই বাবা ইয়াকুব মন্ডল লাঠি নিয়ে তেরে আসতেন। কিন্তু মা কুলসুম বেগম নানা ছলে ছেলেকে বাঁচাতেন। এভাবেই চলছিল দিনগুলো।

মোসলেম তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র। জমিজমা নিয়ে তাদের বিরোধ হয় স্থানীয় কালু ডাকাতের সঙ্গে। ওরা ছিল লাঠিয়াল। গুষ্টিও বড়। একদিন তাঁর বাবা চাষবাদ করতে যান ওই জমিতে। অমনি আশপাশ থেকে কালু ডাকাতের লোকেরা আক্রমণ করে তাঁকে। তারা দা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে মারে মোসলেমের বাবাকে। ফলে পরিবারে নেমে আসে ঘন অন্ধকার। বাবা হত্যার বিচারও পান না মোসলেম!

পরিবার বাঁচাতে তখন পথে নামতে হয় তাঁর মাকে। কষ্ট আর অভাবের মধ্যে কাটে তাদের জীবন। আপনজনেরাও এগিয়ে আসেনি। কিন্তু সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও নানি জিলাফি বেগম ও মামারা মোসলেমদের পাশে ছিল সবসময়। অনেক বছর কেটে গেছে। এখনও মোসলেমের মন থেকে মুছে যায়নি বাবা হত্যার দুঃসহ স্মৃতি।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোসলেম উদ্দিনের কথা আমরা জানতে পারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রকিবুর রহমানের (অবঃ) কাছ থেকে। আগ্রহী হতেই মুঠোফোনের নম্বরটি দিয়ে তিনি সহযোগিতাও করলেন। অতঃপর বার কয়েক আলাপ চলে মুঠোফোনে। এই যোদ্ধা আসেন ঢাকায়। খবরটি পেয়েই তাঁর মুখোমুখি হই।

মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি শেহালা প্রাইমারি স্কুলে। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বেতবাড়িয়া হাইস্কুলে। কিন্তু এইট পর্যন্ত পড়ার পরেই লেখাপড়ায় ইতি টানেন তিনি। অতঃপর ভর্তি হন সেনাবাহিনীতে।

মোসলেম উদ্দিনের মাথায় স্প্লিন্টার বিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন
মোসলেম উদ্দিনের মাথায় স্প্লিন্টার বিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন

কীভাবে? সে কাহিনী শুনি তাঁর জবানিতে:

“তখন ‘মোহিনী মিল’ ইস্ট পাকিস্তানের নামকরা কাপড়ের মিল। ওদের একটা বেস্ট ফুটবল টীম ছিল, নাম ‘কুষ্টিয়া মোহিনী মিল টিম’। আমি ওই টিমে চাঞ্জ পাই। ১৯৬৬ সালের কথা। যশোর ও কুষ্টিয়া দলের খেলা দেয় পাঞ্জাবিরা। আমি খেলি কুষ্টিয়ার পক্ষে। যারা ভালো খেলেছে খেলা শেষে তাদের গায়ে সিল মেরে দেন সেনারা। তখনও কিছু বুঝিনি।

“মেডিকেল করা হল। এরপরই জানলাম সৈনিক পদে যোগ দিতে হবে সেনাবাহিনীতে। অনেকেই কান্নাকাটি শুরু করল। আমি রাজি হতেই ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে। ছয়মাস ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হয় যশোরে। দেশের যে কোনো জায়গায় আর্মি খেলা হলেই অ্যাটেন্ড করতে হত। আমার আর্মি নম্বর ছিল ৩৯৩৭১৯৩।”

একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে ব্যারাকের ভেতরকার বৈষম্যের কথা জানান মোসলেম, “বৈষম্য ছিল পোস্টিংয়ে। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে শুধু পাঞ্জাবিরা, বেলুচ রেজিমেন্টে বেলুচ ছাড়া অন্য কেউ থাকত না। কিন্তু বেঙল রেজিমেন্টের ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। বাঙালি ছাড়াও এখানে পাঠান ও পাঞ্জাবিদের পোস্টিং ছিল। শুধু বাঙালি রেজিমেন্ট ওরা মেনে নিতে পারত না।”

ভিডিও: https://www.youtube.com/watch?v=eecPZFFIQN0

সত্তরের নির্বাচনের পর সবাই নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসছেন শেখ মুজিব। কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে। ব্যারাকের ভেতর থেকে মোসলেমরাও বুঝতে পারেন, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ফলে পাঞ্জাবি-পাঠানদের সঙ্গে বাঙালি সেনাদের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে।

চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আন্ডারে ছিল দুটি ট্রেনিং সেন্টার– ‘ওয়ান ট্রেনিং ব্যাটালিয়ান’ এবং ‘টু ট্রেনিং ব্যাটালিয়ান’। ওই সময় মোসলেমের পোস্টিং ছিল টু ট্রেনিং ব্যাটালিয়ানে। তাঁদের কমান্ড করতেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরি। ব্যাটেলিয়ানের সেন্টার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম আর মজুমদার। চারজন পাঞ্জাবি অফিসারও ছিল সেখানে– কর্নেল শিগরি, লেফটেনেন্ট কর্নেল মাহমুদি বেগ, মেজর কামাল ও ক্যাপ্টেন সরোয়ার।

 ২৪ মার্চ ১৯৭১। বেলা তখন সাড়ে চারটা। ঢাকা থেকে আসা হেলিকপ্টার নামে ব্যাটালিয়ানে। ঢাকায় জরুরি মিটিংয়ের কথা বলে নিয়ে যাওয়া এম আর মজুমদার ও আমিন আহমেদকে। ব্যারাকে থাকে শুধুমাত্র চারজন পাঞ্জাবি অফিসার। ওরা গোটা ব্যাটালিয়ানের নিয়ন্ত্রণ নেবে– এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ফলে বাঙালি সেনারা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়।

কীভাবে? সে ইতিহাস শুনি মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের মুখে:

“হাবিলদার মেজর বাদশা মিয়া ও হাবিলদার সুলতান আমাদের নেতৃত্ব দেন। দুটি ট্রেনিং ব্যাটালিয়ানে ওস্তাদ ছিল শতাধিক। আমরা একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করি। অস্ত্রাগার থেকে গোপনে অস্ত্র নিয়ে নিজের কাছে রাখি। আমার কাছে ছিল একটা এমজি। ওটা চালাতে হেলপ করত সালেহ আহমেদ।

মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের অনুকূলে বঙ্গবন্ধুর পত্র
মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের অনুকূলে বঙ্গবন্ধুর পত্র

“২৫ মার্চ ১৯৭১। দিনের বেলা। খবর আসে জাহাজে করে ইস্ট বেলুচ রেজিমেন্ট পৌঁছে গেছে বন্দরের ১২ নম্বর জেটিতে। নেমেই তারা অ্যাটাক করবে আমাদের ওপর। বায়োজিত বোস্তামির পাশের একটা ছোট্ট খালের ওপারে পজিশন নিয়ে আমরা বসে থাকি।

“মধ্যরাত। ব্যারাকও থমথমে। রাত পৌনে একটার দিকে ওরা অ্যাটাক করে। আমরাও ব্রাশ মারি। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ওদের ঢুকতে দেই নাই। কিন্তু আক্রমণের মুখে শেষে টিকতে পারি না। ওখানেই শহীদ হন বাদশা মিয়া আর সুলতান। আমরা হই ছত্রবঙ্গ।”

এরপর কোথায় গেলেন?

“সালেহ আহমেদকে নিয়ে চলে যাই ইপিআর ট্রেনিং সেন্টারে। ওটার দায়িত্বে তখন মেজর সুবেদ আলী ভুঁইয়া। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যসহ তিন শতাধিক একত্রিত হয় ওখানে। পরে সুবেদার নুরুল ইসলাম ও এমলাক সাহেবের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ি সীতাকুণ্ডের কুমিরায়। ঢাকা থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা যেন বেলুচ রেজিমেন্টকে সাহায্য করতে না পারে– এটাই ছিল উদ্দেশ্য। আমাদের অস্ত্র ছিল ছোট ছোট। কিন্তু মনোবল আকাশচুম্বি। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ওদের আমরা ঠেকিয়ে রাখি। প্রতিদিনই মারা পড়ত পাঁচ-ছয়জন। একপর্যায়ে আমরা চলে যাই ছাগলনাইয়ার চৌতাখোলা বাজারে, ফোর বেঙ্গলের একটি কোম্পানিতে। ওখানে কমান্ড করতেন ক্যাপ্টেন হালিম।”

রণাঙ্গনে বসে মায়ের কথা মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেমের। মন ছুটে যায় তাঁর। অতঃপর সাতদিন সাতরাত হেঁটে চলে যান কুষ্টিয়ায়। বাড়িতে গিয়েই দেখেন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মানসিকভাবে প্রবল ধাক্কা খান তিনি। মাইল দুয়েক দূরেই ছিল পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প। তাদের সাহায্য করে রাজাকার মতিন মাস্টার ও মকবুল কারিগর। ‘খাস মেলিটারির বাড়ি’ বলে ওরাই মোসলেমের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তখন তাঁর মা ও ভাইরা আশ্রয় নেয় বর্ডারের ওপারে, শিকারপুর শরণার্থী ক্যাম্পে।

তখন কী করলেন?

মোসলেম বলেন, “মাকে দেখে চলে যাই শিকারপুর ক্যাম্পে। ওখানে আরও ১৩ জন আর্মির লোক ছিল। মেজর হাফিজ খুঁজছিলেন ট্রেন্ড সোলজার। সানাউল্লাহ ও আমাকে জিপে তুলে নিয়ে তিনি আসেন প্রথমে বনগাঁ এবং পরে আমাদের পাঠিয়ে দেন আসামের তোরা পাহাড়ের কাছে, গোয়াল বাথান তেল ডালা নামক স্থানে।

“সেখানে ছিল ‘থ্রি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’, ‘এইট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ আর ‘ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। দরবার বসল। মেজর জিয়া, ওসমানি, মানিক শাহ প্রমুখ উপস্থিত থেকে ‘জেট ফোর্স’ ঘোষণা করেন, যার কমান্ডিং অফিসার হন মেজর জিয়া। পরবর্তীতে অপারেশন করি ১১ নং ও ১ নং সেক্টরের বিভিন্ন জায়গায়।”

 এক অপারেশনে এই মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হন। শেলের স্প্লিনটার বিদ্ধ হয় তাঁর মাথার ডান পাশে। এখনও একটি স্প্লিনটার মাথার ভেতরে রয়ে গেছে। এ ছাড়া তিনি গুলিবিদ্ধ হন ডান পায়ে। তবুও মৃত্যুভয় পেছনে ফেলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?

প্রশ্ন শুনে খানিক নিরব হয়ে যান তিনি। চাপা কষ্টের মেঘগুলো তাঁর দুচোখ দিয়ে জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমরাও নীরব থাকি। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

“জুলাইয়ের প্রথম দিকের ঘটনা। শেরপুর ধনিয়া বিওপির কাছে ছিল পাকিস্তানিদের এফএফ রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। ওটা উড়িয়ে দিতে হবে। দায়িত্ব দেওয়া হয় ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। কমান্ডে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মনতাজ। তিনি রেকি করার জন্য সঙ্গে নিলেন নায়েক সুবেদার আব্দুল হাই, ন্যান্স নায়েক শফি, ন্যান্স নায়েক রবিউল ইসলাম আর আমাকে। নানা বেশে একদিন ওই ক্যাম্পের চারদিক ঘুরে আমরা তথ্য আনি। সেটা দিয়ে ম্যাপ তৈরি করেন ক্যাপ্টেন স্যার। অতঃপর ওই রাতেই গেরিলা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানিদের দুইজন সেনাকে মেরে ফেলি।

“এ ঘটনার পরপরই ওরা ক্যাম্পে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ওদের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল রংপুরে। সেখান থেকে একটা ব্যাটালিয়ান চলে আসে। বেলুচ রেজিমেন্ট থেকেও আসে সেনারা। তিনটা ব্যাটালিয়ানে ওরা ২,৪০০ জন। আর আমরা দুটি কোম্পানিতে মাত্র ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা।

“এক দিন পরেই ওই ক্যাম্পে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালাই আমরা। ভোর তখন ৫টা। গুলি করতে করতে আমরা এগোতে থাকি। সালাউদ্দিন স্যার বললেন, ‘লাইন পজিশন, লোড’– এ পর্যন্তই। গো গো করে একটা আর্টিলারি এসে পরে তাঁর শরীরে। আমার পাশে ছিল সালউদ্দিন নামে ইপিআররের এক ছেলে। শেলের টুকরা এসে লাগে তাঁর মাথায়। ও মাটিতে পড়ে শুধু বলল, ‘ওস্তাদ’। আমি ওর দিকে এগিয়ে আসি। ওর মাথাটা তুলে ধরব, এমন সময় শেলের দুটো স্প্লিনটার ঢুকে যায় আমার মাথার ডান পাশে। আমি ছিটকে পড়ি। জ্ঞানও হারাই। সূর্যের আলো মুখে পড়তেই আবার জ্ঞান ফিরে। উঠতেই পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে। গুলিতে বিদ্ধ হয় আমার বাম পায়ের মাসলের ওপরে। তখন আমি গড়িয়ে পড়ি পাশের পাট খেতে। এরপর আর কিছুই মনে নাই।

“এক মাস ১৭ দিন বেহুস ছিলাম। চোখ খুলতেই ক্যাপ্টেন সানজিনা বলেন, ‘মাত ঘাবরাও, এ পাকিস্তান নেহি হে, ভারত গোহাটি হসপিটাল হে।’”

ওই অপারেশনে মোসলেমরা হারান ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। ৮২টা পেনিসিলিন ইনজেকশন দিয়ে তাঁকে সুস্থ করা হয়। গুলি খাওয়ার চেয়েও কষ্টের ছিল ওই ইনজেকশন দেওয়া।

মাথায় এখনও ব্যথা হয় এই যোদ্ধার। দেশের জন্য ওই কষ্ট মেনে নিয়েই কেটে যাচ্ছে তাঁর দিনগুলো।

দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আপনি কোথায়?

মুক্তিযোদ্ধা সনদ
মুক্তিযোদ্ধা সনদ

“সুস্থ হয়ে আবার রণাঙ্গনে ফিরে আসি। আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১ নং সেক্টরে। ১৬ ডিসেম্বরে ছিলাম সিলেটের সুনামগঞ্জে। স্বাধীনতার খবর পেয়ে টানা নিঃশ্বাস ফেলেছি। বিশ্বের মধ্যে পাকিস্তানি সোলজার ছিল নামকরা যোদ্ধা। তাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। এটা ভেবে আনন্দেই চোখে পানি চলে এসেছিল। কাউকে চিনি না। অথচ শত শত সাধারণ মানুষ আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল ওই দিন। দেশের জন্য বাঙালি যে এক হতে পারে মুক্তিযুদ্ধই তার প্রমাণ।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি মোসলেমের মতো অনেক সেনার জন্যই ছিল ফলপ্রসূ দিকনির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আর্মির সদস্যরা তখন তাদের নির্দেশটি পরিষ্কারভাবে বুঝে যায়। এই ঘোষণা সৈনিকদের মনে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে।”

আহত হওয়ার কারণে স্বাধীনতার লাভের পর এই বীর সেনার অনুকূলে বঙ্গবন্ধু একটি পত্র ও সহযোগিতা হিসেবে পাঁচ শ টাকা দেন। কিন্তু তবু সরকারের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। এ নিয়ে কোনো খেদ নেই তাঁর।

সেনাবাহিনীতে সাহসিকতার জন্য ১৯৮২ সালে মোসলেম ‘বীর প্রতীক’ খেতাব লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে এই সম্মাননার মেডেল পড়িয়ে দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটিই তাঁর কাছে পরম পাওয়া। সবশেষে তিনি ‘সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার’ হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

উত্তরে এই সূর্যসন্তান বলেন, “দেশ তো পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে যখন মন্ত্রী ছিল রাজাকার, তখন কষ্ট লাগত। গ্রামেগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা নিগৃহীত ছিল। আহতরা জীবন কাটাত ভিখারির মতো। শেখ হাসিনা তাঁদের ভাতা বৃদ্ধি করে বাঁচিয়েছেন। সম্মানিত করেছেন ভালোবেসে। কই অন্য কোনো সরকার তো তাঁদের মূল্যায়ন করেনি। শেখ মুজিব না থাকলে যেমন বাংলার মাটিতে কেউ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখত না, তেমনি শেখ হাসিনা না থাকলেও বাংলার মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারত না।”

দেশ কেমন চলছে?

“ভালো যে চলছে এটা সবাই টের পাচ্ছে। অভাব নাই। চুরিধারি কমেছে। আমি তো ছোট মানুষ। আমার কথা কি সরকার শুনবে? যদি দলের নেতাকর্মীরা ভালো মানসিকতার হয়, শেখ হাসিনা যদি তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেন, তবে অবশ্যই দেশ আরও অনেক ভালো চলবে।”

নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

“একাত্তরে ধর্মই প্রধান বিষয় ছিল রাজাকারদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের এক হিন্দু ছেলের দায়িত্ব ছিল আমাদের খাওয়ানো। একদিন গোলাগুলি চলছে এর মধ্যেই সে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। অথচ ওখানেই সে গুলি খেয়ে মরতে পারত। কত হিন্দু ছেলেরা জীবন দিয়ে অন্যকে বাঁচিয়েছেন। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁরা কি শিক্ষিত লোক, হাইফাই ফ্যামেলির? কোনোদিনও না। ৯০ পারসেন্ট ছিল অশিক্ষিত ও গরিব। তাদের কাছে ধর্ম আর জাত বিষয় ছিল না। সবার ওপরে ছিল দেশ। যারা এখন ধর্মের নামে সম্প্রীতি নষ্ট করছে তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।”

মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন মনে করেন দেশে দুর্নীতির জন্ম ঘুষ থেকে। চাকরি নিতে আর বদলি হতে যদি ঘুষ দিতে হয়, তবে ওই ব্যক্তি চাকরিতে যোগ দিয়েই ওই টাকা তুলবে। ঘুষ বন্ধ না করলে দেশে দুর্নীতি কমবে না বলে মত তাঁর।

স্বাধীন দেশে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। তিনি বলেন:

“ক্রিকেটের সময়ে বিদেশের মাটিতে যখন আমার দেশের পতাকা ওড়ে, প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশের হয়ে জাতিসংঘে ভাষণ দেন, তখন সত্যি বুকটা ভরে যায়।”

খারাপ লাগে কখন?

“যখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও উপেক্ষিত হয় তখন খারাপ লাগে। সবচেয়ে কষ্ট লেগেছে বিডিআর ক্যাম্পে আমাদের অফিসারা যখন মারা গিয়েছিল। একটা অফিসার দেশের সম্পদ। আল্লাহর রহমত না হলে কাঁধে ‘স্টার’ ওঠে না ভাই। ক্ষতিটা তো দেশেরই হয়েছে।”

বর্তমানে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলে দেশ আরও উন্নত হবে বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোসলেম উদ্দিন। চোখে-মুখে আশার আলো ছড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন:

“রক্ত দিয়ে তোমাদের পূর্বসূরিরা দেশটা স্বাধীন করেছেন– এটা তোমরা ভুলে যেও না। দেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে তোমরা বিরত থেক। মনে রেখ রাষ্ট্রের তুমিও একজন নাগরিক। তোমার হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে।”

লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button