আদিবাসী

চৈত্র-বৈশাখে ভিন্ন জাতির উৎসব

কৃষি, শিকার ও নববর্ষ ঘিরে আদিবাসী উৎসবগুলো উদযাপিত হয়ে আসছে আবহমান কাল থেকেই। উৎসব ঘিরেই ঘটে তাদের বৃহৎ সম্মিলন, যা দলবদ্ধতা ও একতাবোধের প্রতীকও। দারিদ্র্য আর নানা অবহেলার মাঝে এ উৎসবগুলোই তাদের টিকে থাকার মূল প্রেরণাশক্তি।

চৈত্র-বৈশাখে বাঙালির মতো অন্যান্য জাতির মানুষেরও সম্মিলন ঘটে নানা উৎসবে। এসব উৎসবই তাদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় আদিবাসীরা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষ। ফলে সুদৃঢ় হয় তাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ।

প্রথমে বৈসাবির কথা। মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ উৎসব থেকে ‘বৈ’, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব থেকে ‘বি’—তিনটি নামের আদ্যাক্ষরে হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। এটি আলাদা কোনো উৎসব নয়।

দৈনিক কালেরকন্ঠ, বৈশাখী রঙের মেলা, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

ত্রিপুরাদের প্রধানতম উৎসব হলো বৈসুক। উদ্যাপিত হয় চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনে। প্রথম দিনে ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তুলে ঘর সাজায় এবং কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। এটিই তাদের আদি রীতি। এ উৎসবে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে, আর ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন মদ, মুরগি ও চাল তুলে গরাইয়া দেবতার পূজা করে তারা।

মারমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে আনে। তাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে দেবীর পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় এ উৎসব—এমনটিই বিশ্বাস মারমাদের। ফলে যে কদিন দেবী পৃথিবীতে অবস্থান করবেন সে কদিনই তারা নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।

মারমাদের সাংগ্রাইং চলে তিন দিন। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’ অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ দিন মারমা যুবতীরা নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধপূজার রাত্রে সেসব ফুল সাজিয়ে দল বেঁধে সবাই বৌদ্ধ বিহারে গমন করে।

উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ঘরে ঘরে চলে প্রবীণপূজা। তৃতীয় দিনটি দেবীর নির্গমন দিবস। এদিন ভোরে এরা মঙ্গলাচরণ, অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধস্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপপূজা এবং রাতে আরতিদানের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটায়। এ ছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।

চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে তিন দিন। বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে চাকমারা মূল বিজু, আগের দিনটিকে ফুল বিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে।

ফুল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠেই বিভিন্ন ধরনের ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর সেগুলো দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহদেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়িঘর সাজানো হয়। গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায়ও পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা। এ দিনে সবাই একত্র হয়ে শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নানঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করে।

মূল বিজুর দিন চাকমারা খুব ভোরে দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামের একধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ সময় আগতদের নানা ধরনের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দল বেঁধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় ও বাজি ফোটায়। মূল বিজুর দিনে নানা ধরনের পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য খায়। তাই এর পরদিন বা নববর্ষের প্রথম দিনে চাকমরা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই এ দিনকে এরা ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।

বৈসাবি পালন না করলেও সাঁওতালরা চৈত্রের শেষে ধুমধামের সঙ্গে বাহা পরব উৎসবটি উদ্‌যাপন করে। ‘বাহা’ মানে ফুল আর ‘পরব’ মানে অনুষ্ঠান বা উৎসব। মূলত এ উৎসবে তারা নতুন শালফুলকে বরণ করে নেয়।

বাহা পরবে গোত্রপ্রধান উপোস অবস্থায় পূজা দেন বোঙ্গার (দেবতা) সন্তষ্টি লাভের জন্য। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেঁড়ে দেওয়া হয়। কুলার মধ্যে রাখা হয় চাল, সিঁদুর, ধান, দূর্বাঘাস আর বেশ কিছু শালফুল। উৎসবের প্রথম দিন পূজার মাধ্যমে প্রথমে বলি দেওয়া হয় মুরগি। সাঁওতাল নারীরা তখন শালফুল গ্রহণ করে বিশেষ ভক্তির সঙ্গে। ওই দিনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করা হয় শালফুল। যে ফুল বিলি করে তাকে পা ধুইয়ে বাড়ির ভেতরে নেওয়া হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস, এভাবে ফুলরূপে দেবতা বা বোঙ্গাই তাদের ঘরে প্রবেশ করে।

দ্বিতীয় দিনটিতে সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মধ্য দিয়ে পুরনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে তা দূর হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তৃতীয় দিনটিতে চলে নানা আনন্দ আয়োজন। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে ঢোলের তালে নাচে সাঁওতাল নারীরা।

বৈশাখের প্রথম প্রহরে সাঁওতালরা পুরনো বছরের পান্তা খেয়ে নতুন বছরের শুভ সূচনা করে। একদল তখন তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। আরেকটি দল নদীতে ছোটে মাছ ধরতে। নারীরা বাড়ি বাড়ি তেল ও চিতই পিঠা তৈরি করে। বিকেলের দিকে সাঁওতাল নারীরা দল বেঁধে হাত ধরাধরি করে নেচে-গেয়ে বরণ করে নতুন বছরকে।

সমতলে সংখ্যার দিক থেকে সাঁওতালদের পরেই ওঁরাওদের স্থান। তাদের উৎসবগুলোও আবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে। বৈশাখের প্রথম প্রহরে এরাও দল বেঁধে শিকারে বের হয়। তবে বনে ঢোকার আগে মাটিতে তীর-ধনুক রেখে, জল ছিটিয়ে দূর্বাঘাস ও আতপ চাল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে বাঘমন্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য পূজা দেয়। বিকেলে শিকারগুলো দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। বছরের প্রথম দিনটিকে এভাবেই তারা দলবদ্ধতা ও বীরত্ব হিসেবে উদ্‌যাপন করে।

তবে বৈশাখে তুরিদের আয়োজন একেবারেই ভিন্ন। চৈত্র মাসের শেষ পাঁচ দিন এরা ‘চৈতাবলি’র অনুষ্ঠান করে। শুরুর দিন থেকে তারা ছাতু-গুড় খেয়ে নাচ-গান করে। চৈত্রের শেষ দিন বাড়িতে রান্না হয় সাত পদের তরকারি। তা দিয়ে ভোজ সেরে তারা বিদায় দেয় চৈত্রকে।

বৈশাখের পুরো এক মাস তুরিরা খায় শুধুই নিরামিষ। এ সময় প্রতি রাতে তুরিপাড়ায় চলে কীর্তন। এ সময় দূর-দূরান্ত থেকে আসা নানা বিশ্বাসের মানুষরা ভিড় জমায়। বৈশাখ শেষে প্রতি বাড়ি থেকে তারা চাল তুলে একত্রে খিচুড়ি রান্না করে খায়।

কিন্তু ভুনজারদের আয়োজন তুরিদের মতো নয়। চৈত্রের শেষ দিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনের আয়োজনকে ভুনজাররা বলে ‘চৈত-বিসিমা’ উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ সন্ধ্যায় এরা ‘বাসন্তীপূজা’ করে। একসময় গ্রামগুলোতে বসন্ত রোগে মারা যেত শত শত মানুষ। এই রোগটি থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারিকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের পূজা করে। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির পূজা বলেই এর নামকরণ হয়েছে ‘বাসন্তীপূজা’।

এভাবেই কৃষি, শিকার ও নববর্ষ ঘিরে আদিবাসী উৎসবগুলো উদযাপিত হয়ে আসছে আবহমান কাল থেকেই। উৎসব ঘিরেই ঘটে তাদের বৃহৎ সম্মিলন, যা দলবদ্ধতা ও একতাবোধের প্রতীকও। দারিদ্র্য আর নানা অবহেলার মাঝে এ উৎসবগুলোই তাদের টিকে থাকার মূল প্রেরণাশক্তি।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button