মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা উপেক্ষিত ছিল

“১৯৬৫ সাল। মেট্রিক পাস করেছি মাত্র। একটা চাকরিও পেয়ে যাই তখন। দিনাজপুরের হাউজিং অ্যান্ড স্যাটেলমেন্ট অফিসের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে দেয় সবাই। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টিকে থাকেনি। প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় বছর দেড়েকের মধ্যেই চাকরি হারাই। কেউ তহন পাত্তা দেয় না। পরিবারেও আদর কমতে থাকে। অনেক কষ্ট পেলাম। রাগ করে একদিন বাড়ি থেকে এক কাপড়েই বেরিয়ে যাই। কাজের সন্ধানে চলে আসি চট্টগ্রামে।

“পকেটে টাকা নেই। ঠিকমতো খেতেও পারতাম না তহন। দিনভর চাকরি খুঁজি আর রাতে থাকি মসজিদে। লোকমুখে একদিন পুলিশে লোক নেওয়ার খবরটি পাই। লাইনে দাঁড়াতেই শরীরের মাপে ফিট। মেট্রিক পাশ শুনতেই নিয়া নিল। কিন্তু মেডিকেল করাতে হবে। সে জন্য লাগবে ৩১ টাকা। মন খুব খারাপ হইল। হাসপাতালে বসে টাকার চিন্তা করছি। হঠাৎ এক রোগী পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। চিৎকার শুনে তার কাছে ছুটে যাই। নানাভাবে সেবাও করি। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হতে থাকেন। পরে জানলাম পুলিশেরই এক হাবিলদার তিনি। সমস্যার কথা শুনে তিনিই সাহায্য করলেন। পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিলাম। বডি নম্বর ছিল ১৯৯।

“হালি শহরে ছয় মাস ট্রেনিং। অতঃপর পোস্টিং হয় কুমিল্লায়। পরে পুলিশ টেলিকমিউনিকেশন কোর্সের জন্য আমাকে পাঠানো হয় রাজারবাগে। ১৯৭১এ ছিলাম ওখানকার ওয়ারল্যাস অপারেটর।

মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের তৎকালীন ছবি

“৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন রেসকোর্স ময়দানে। এরপর থেকেই পুলিশ ব্যারাকের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। ওখানে অবাঙালি পুলিশ সদস্য যেমন ছিল, আবার বাঙালি হয়েও স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকও ছিল। খেতে বসলেই ওরা অহেতুক আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। আগে এটা আমরা সহ্য করতাম। কিন্তু শেখের ভাষণের পর হাতাহাতি হতে থাকল।

“রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর পাড়ে আমরা আলোচনায় বসতাম। সিদ্ধান্ত হয় যা-ই ঘটুক আমরা প্রতিহত করব। কিন্তু কীভাবে? তা-ও জানা ছিল না! ভয়ও ছিল। কারণ তখন আমাদের বিপক্ষে ছিলেন এআইজি টেলিকমিউনিকেশনের প্রধান এসএম নবাব এবং ডিএসপি (ট্রেনিং) বজলুর রহমান মজুমদার। তবে পক্ষে ছিলেন ডিএসপি (প্রশাসন) মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন।

“২৫ মার্চ ১৯৭১। সকাল বেলা। ঢাকা শহর থমথমে। পাকিস্তানি সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে মেইন রাস্তাগুলো টহল দিচ্ছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কী ঘটবে কেউ জানে না। সন্ধ্যার পর সংগ্রাম কমিটির লোকেরা রাস্তায় নামে।
আমাদের আবাসন ছিল মৌচাক মার্কেটের পাশে, ২০৬ নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িটিতে। রাত তখন ৮.৩০ মিনিটি। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যে কোনো সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা আক্রমণ করবে। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেবের ছেলে ছিলেন আমার পরিচিত। সে-ও এসে একই খবর দেয়। তখন পোশাক পরে দ্রুত রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চলে আসি।

  “তখন রোলকল হচ্ছিল। খবরটা তুলতেই সবাই উত্তোজিত হয়ে ওঠে। এর আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আমরা ২০-৩০ জন ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে চাবি এনে মেইন অস্ত্রাগার খুলে দিই। কমান্ড বলতে তখন কিছু ছিল না। উচ্চ পর্যায়ের কেউ সাহায্যও করেনি।

“থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগজিন নিয়ে দু-তিনশ পুলিশ রোডের পাশে, মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যায়। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তারা ব্যারিকেড দেয় মৌচাক, মালিকবাগ, শান্তিনগর ও চামেলিবাগের ডন স্কুলের সামনে (বর্তমান ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট)। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেয় ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য।

“দুটো রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়ারল্যাস বেইজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়ারল্যাস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়ারল্যাসে কোনো ম্যাসেজ আসে কি না।

৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের কাহিনি প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়

“রাত তখন ১০.৩০। একটা ম্যাসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় পেট্রোলে থাকা ওয়ারল্যাস অপারেটর আমিরুল ম্যাসেজ দেন। বলেন: ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইভ হেয়ার মি, ওভার।’

“আমি প্রত্যুত্তরে বলি: ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউট অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ ওভার।’

“তখন তিনি বলেন: ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফরম দা ক্যান্টনমেন্ট।’

“আমরা নিশ্চিত হই। ওরা আসছে। প্রায় ছয়-সাতশ লোক ছিল রাজারবাগে। একজন গিয়া পাগলা ঘণ্টা বাজায়। ফলে বাকি পুলিশ সদস্যরাও আরেকটি অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে চলে যায়।

“রাত ১১.৩০। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালায়। প্রথম টার্গেটেই পাকিস্তান সেনাদের দুজন মারা যায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। পাকিস্তান সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিল পুলিশ সদস্যরাই। পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার আরম্ভ করে। ওদের এলএমজি, এমএমজি, এইচএমজি, মর্টারগুলোও গর্জে ওঠে।

“গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশের ব্লিডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। নানা চিন্তা ভিড় করে মনে। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারা দেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে– এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়ারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।

“রাত ১২টা বাজার তখনও তিন-চার মিনিট বাকি আছে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়ারল্যাস বার্তায় আমি বলি:

“Base for all station of east Pakistan police, very very important massage for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and out.”

১৯৭১এ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়ারলেস ম্যাসেজ প্রদানের ইতিহাসটি এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া।

সৈরত আলী ও আমেনা বেগমের বড় ছেলে শাহজাহান। বাড়ি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা গ্রামে। এক বিকেলে পা রাখি তাঁর গ্রামের বাড়িতে। মুখোমুখি চলে নানা আলাপচারিতা। স্মৃতি হাতরে তিনি জানালেন শৈশবের নানা কথা।

“নানায় একটা স্কুল করেছিলেন। বটতলা মিলকী বাড়ি স্কুল। ছোটবেলায় ওখানে কলার পাতায় লিখতাম। কুপি বাতির সলতার ওপরের কালি এবং উরু বা সিমের পাতার রস মিশিয়ে কালি তৈরি করতাম। কলম ছিল বাঁশের কঞ্চি। কলম আকারে তা কেটে কালি দিয়ে কলা পাতায় লিখতাম: অ, আ, ই, ঈ। পরে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই বাট্টা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মেট্রিক পাস করি জয়হরি স্প্রাই ইনিসটিটিউশন থেকে।”

একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে দুটি ঘটনার কথা শুনি শাহজাহানের জবানিতে:

“১ মার্চ ১৯৭১। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে গোলমাল চলছিল। খবর পেয়ে অ্যাডিশনাল এসপি ফজলুর রহমান যান কালিগঞ্জ থানায়। সেখানে অবাঙালিরা তাঁর ওপর আক্রমণ করে। কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলে তাঁকে। তাঁর লাশ যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আসে তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কালিগঞ্জের অবাঙালিদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতিও নেয় সবাই। পরে পুলিশের বড় কর্মকর্তারা আমাদের শান্ত করে।

“আবুজার গিফারী কলেজের ভিপি ছিলেন ফারুক। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ৩ মার্চ ১৯৭১। সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে টহল দিচ্ছে। ফারুকের নের্তৃত্বে ছাত্ররা তখন পিকিটিং করতে রাস্তায় নামে। ডিউটি না থাকায় আমিও থাকি। বড় একটা আর্মি ট্রাকে পাকিস্তানি সেনারা মগবাজার থেকে টার্ন নিয়ে রামপুরার দিকে এগোচ্ছে। পেছন থেকে ছাত্ররা ঢিল মারছে। রামপুরায় টিভি সেন্টারের কাছাকাছি এসে ওরা ব্যাক পজিশনে থেকে ফায়ার ওপেন করে। প্রথম গুলিটি আইসা লাগে ফারুকের বুকে। আমি তাকে কোলে তুলে পিছু হটি। তার রক্তাক্ত শরীরটা এখনও চোখে ভাসে। সেদিন সঙ্গে ছিলেন পুলিশের নুর ইসলাম ও অক্ষয় কুমার বড়ুয়াও। পরে ফারুকের লাশ নিয়ে মিছিল হয়। আন্দোলনের ভয়াবহতাও বেড়ে যায়। গুলি চালিয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দমাতে পারেনি!”

২৫ মার্চ রাতে ওয়ারলেস ম্যাসেজ পাঠানোর পর আপনারা কী করলেন?

“মনিরকে নিয়ে প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থা নিই। সেখানে ছিল আরও ৪০-৫০ জন। আমরা পাঁচজনের একটা করে ট্রুপস করি। আমার ট্রুপসে ছিল মনির, গিয়াসউদ্দিন, আবু সামাদ, সালাম। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশনে যাই। আর্মিরা ভেতরে ঢুকলেই ঠেকাব।

শাহজাহান মিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সনদ

“রাত তখন ৩টা হবে। গোলাগুলি চারদিকে। ট্যাংকের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বেরুতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মরে। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। তখন আর টিকার জো নেই। দেখলাম পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। ভোর ৪টার পর ৮-১০ ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়।

“আমাদের গুলি তখন শেষ। ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু আমরা বেরুতে পারিনি। নিরুপায় হয়ে রাইফেল ফেলে পানির টাংকের নিচে আশ্রয় নিই। ফজরের আজানের পরে পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাইফেলের বাট আর হকিস্টিক দিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। ওদের বুটের নিচে স্টিলের পাত থাকত। সেই বুট দিয়ে লাথি দিত। রক্তে লাল হয়ে জমাট বেঁধে যায় আমাদের খাকি পোশাক। বন্দি ছিল দেড়শর মতো। ভেবেছিলাম মেরেই ফেলবে!

“২৮ মার্চ ১৯৭১। বেলা তখন ৩টা। তালিকা করে আমাদের হস্তান্তর করা হয় এসপি এমাজ আহমেদ চৌধুরির কাছে। ১০ জন করে গ্রুপ করে চিকিৎসার জন্য ছাড়া হয়। পরে রির্পোট করতে হবে মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে। রির্পোট না করেই পালিয়ে আমি চলে যাই এক আত্মীয়র বাড়িতে, উলুনে। পরে বন্ধু আসেদ আলীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে চারদিন পর পৌঁছি নেত্রকোণায়।

“গ্রামে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা করা হল: ‘যারা পুলিশ থেকে বের হয়ে গেছে তারা যেন অনতি বিলম্বে যোগদান করে। তাহলে সাধারণ ক্ষমা করা হবে। তা না হলে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিবে।’”

এদিকে শাহজাহানদের গ্রামের মাওলানা আব্দুল জলিল শান্তিকমিটির থানা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ফলে তাদের পরিবারের ওপর হুমকি আসে: চাকরিতে যোগদান না করলে ওরা বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিবে। ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই শাহজাহান ছোট দুই ভাইসহ ধর্মপাশার মধ্যনগর এলাকা হয়ে চলে আসেন ভারতের মহেশখোলায়।
বাকী ইতিহাস জানালেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান। তাঁর ভাষায়:

“ওখানে পাই বারহাট্টা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুজ্জামান চিসতি, আটপাড়ার সাধারণ সম্পাদক সেকান্দার নুরিকে। কয়েকদিন পরই ইপিআরের হাবিলদার মোবারক আলীসহ ছয়-সাতজন ট্রেইন্ড লোক চলে আসে। যুবকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমরা তখন মহেশখোলা নামা হাই স্কুলে রিক্রটিং ক্যাম্প খুলি। বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করিয়ে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাই ১২০ জনকে। যুদ্ধ করি ১১ নম্বর সেক্টরে। বিএসএফের ক্যাপ্টেন চৌহান আমাদের গাইড করেন।

“প্রথম দিকে অস্ত্রের ঘাটতি ছিল। আমরা ট্রেইন্ড পারসনরা নৌকা যোগে ধর্মপাশা থানা অপারেশন করে ১০টি রাইফেল ও গুলির বাক্স নিয়ে আসি। সেটি ছিল প্রথম অপারেশন। একবার চান্দুয়ায় অ্যামবুশ করে এক মেজরসহ ১২ জন পাকিস্তানি আর্মিকে খতম করি। সে সংবাদ বলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে। পরে জগসোগ্রাম সাব সেক্টর কোয়াটার মাস্টারের দায়িত্ব পাই। সেখানে ক্যাপ্টেন মুরারি কমান্ড করতেন। পাহাড়ের ভেতর ছিল ক্যাম্প। বাঁশ দিয়ে মাচা করে থাকতাম। ডালডা দিয়ে মাটির প্রদীপ জালাতাম। চিনা জোকের আক্রমণে রাতভর ঘুমাতেও পারতাম না।”

রণক্ষেত্রে শাহজাহানদের ব্রিফ করতেন ভারতের সেনা কর্মকর্তারা। স্মৃতিপটে গেঁথে থাকা তেমন একজনের কথা বললেন শাহজাহান:

“রংরা নামক স্থানে ক্যাম্প ছিল তখন। একদিন রাতে ক্যাম্পে আসেন এক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল। সবাই তাঁকে বাবাজি বলে ডাকতেন। তিনি বললেন: ‘শুধু রাইফেল হলেই যোদ্ধা হওয়া যায় না। মনটাকে আগে পবিত্র ও আত্মাকে শুদ্ধি করতে হবে। লোভ লালসা ত্যাগ করতে হবে। তোমাদের উদ্দেশ্য থাকবে একটাই সেটি হল– স্বাধীনতা। অস্ত্র হাতে নিলেই মনে হবে বিরাট শক্তি। যুদ্ধে যখন যাবে সুন্দরী নারী দেখলেই ঠিক থাকতে পারবে না, মানুষের টাকা-পয়সা আর সম্পদ দেখলেই লোভ হবে। মন থেকে এগুলো আগে ত্যাগ করো। তারপর অস্ত্র নাও। তা না হলে অস্ত্র নিয়ে কোনো লাভ হবে না।’

“বাবাজির ওই কথাগুলো মনে গেঁথে আছে।”

 দেশের স্বাধীনতার জন্য এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের স্প্লিনটারে বিদ্ধ হয় তাঁর বাম পায়ের পাতা। ক্ষতবিক্ষত হয় ওই পায়ের একটি আঙুল। রক্তাক্ত ওই দিনের স্মৃতি শুনি শাহজাহান মিয়া জবানিতে:

“আমরা তখন জগসোগ্রাম ক্যাম্পে। যৌথবাহিনীর কমান্ডে তখন মেজর পিরিত। বিজয়পুরে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে অ্যাটাক করতে হবে। কাছাকাছি থেকে ওই ক্যাম্পের দিকে গোলাগুলি চলে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওইদিন রাত ১২টায় পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে আসি।

“৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোর বেলা। ওদের ফার্স্ট ক্যাম্পের পূর্বদিকে প্রথম অ্যাটাক করি। ওরা ধীরে ধীরে পালাতে শুরু করে। ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে একটা বাংকার দখলে নিই। এর আগেই ওরা ক্যাম্প ছেড়ে পিছু হটে, আশ্রয় নেয় দূর্গাপুরে। বাংকারগুলো আমরা সার্চ করছি। সামনে ওসমান গনি, তার পেছনে ছোটভাই নুরুল ইসলাম, এর পেছনে আমি ও কামাল। সবাইকে সর্তক থাকতে বলি।

স্প্লিনটারে বিদ্ধ হয় শাহজাহানের বাম পায়ের পাতা ও একটি আঙুল

“একটি বাংকার থেকে অন্য একটি বাংকারের যাওয়ার ছোট্ট একটি রাস্তা। অন্যদিক দিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। চলে যাওয়ার আগে ওরা সেখানে অ্যান্টিপারসোনাল মাইন পুঁতে যায়। হঠাৎ একটি মাইনে পা পড়ে ওসমানের। বিকট শব্দ হয়। চারদিকে কুন্ডুলি পাকানো ধোঁয়া। দেখলাম ওসমানের পা উড়ে গেছে, নুরুল ইসলামের গালের মাংস উপড়ে পড়ে দাঁত বেরিয়ে গেছে। খানিক পরে দেখলাম আমার বাম পায়ে স্প্লিনটার বিদ্ধ হয়েছে। ওই পায়ের একটি আঙুলেরও মাংস উড়ে যায়। পায়ের পাতা রক্তে ভেজা। সহযোদ্ধারা আমায় তুলে নেয় বাগমারা ক্যাম্পে। ওখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।”

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া খেতাব প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তিনি বলেন:

“একাত্তরের সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে যে খেতাব দেওয়া হয় সেটির নিয়ন্ত্রণ ছিল সেনাবাহিনীর হাতে। ফলে তারা শুধু নিজেদের লোকদেরই খেতাব প্রদান করে। পুলিশের কাউকে খেতাব দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা প্রবলভাবে উপেক্ষিত ছিল।”

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এ বীর যোদ্ধা দুঃখ করে বলেন:

বাট্টা গ্রামে শুধু আমরা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। এক ভাই শহীদ হয়েছেন। আর কেউ নাই। এ বছর দেখলাম একশর বেশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন করেছেন। আমরা সুপারিশ করিনি। ১৯৭৫এর পর থাইকা ১৯৯০ পর্যন্ত এই লোকগুলা কোথায় ছিল? আগে কি একটাও দরখাস্ত করেছে এরা? তখন মুক্তিযোদ্ধাগো ওপরে নির্যাতন হইছে নানাভাবে। তবুও সহ্য করছি।

“বিএনপি তো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ১২টা বাজাইছে। কিন্তু এ সরকারও কম করছে না। কেন্দুয়ায় বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হইছে। সে কবে, কোথায় যুদ্ধ করেছেন খোঁজ নেন। এখন প্রভাব খাটায়াও মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে। সরকারের বাধ্যগত লোকদেরও মুক্তিযোদ্ধা করা হচ্ছে। আমি দল করি আওয়ামী লীগ। কিন্তু সত্য কথা বাবারেও বলতে পিছপা হই না। এখন তালিকা নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেও ইচ্ছা করে না।”

’৭৫এর পর দেশ আবার পাকিস্তান হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। বলেন:

“বঙ্গবন্ধুর আমলে গণভবনে ছিলাম। ’৭২ সালে এসএম নবাব এবং বজলুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগ এনে মামলা করি এবং প্রামাণ্য তুলে ধরি। ফলে তাদের চাকরি থেকে ডিসমিস করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জিয়ার হাত ধরেই আবার চাকরিতে ফিরে আসেন ওই বজলুর রহমান মজুমদার। এভাবে প্রায় সব সেক্টরেই স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ওটা ছিল আরেক পাকিস্তান আমল।”

যে দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের উত্তর:

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া

“সেটা পাইনি। তবে আশায় আছি। দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ হবে। এ দেশে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে, ‘জিন্দাবাদ’ বলবে, ওদের পক্ষ নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে– এমন দেশের জন্য তো দেশ স্বাধীন করিনি।”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে তিনি বলেন:

“শেখ মুজিবের প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাঁর কন্যা এখন ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করছেন। মানুষকে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন– এটা দেখলে সত্যি ভালো লাগে ভাই।’

খারাপ লাগে কখন?

“ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে খারাপ লাগে। জামায়াত-শিবির আর হেফাজতের তাণ্ডব দেখলে কষ্ট লাগে। এদের তো নিষিদ্ধ করা উচিত।’

পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে স্বপ্নবিভোর হন মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে, বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন:

“প্রথমে হল দেশপ্রেম। তোমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত থেক। নিজের মাকে যেভাবে ভালবাস, তেমনি দেশের প্রতি ভালবাসা নিয়ে নিজের কাজটুকু কর। তবেই দেখবে দেশটা বদলে গেছে।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ মে ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button