মুক্তিযুদ্ধ

শেখের বেটি টিকলে জঙ্গিবাদ টিকব না

“ছোটবেলা থিকাই চঞ্চল আছিলাম। বন্ধুগো লগে ফুটবল খেলতাম। গোলি ছিলাম। পরজুনা গ্রামে একবার বড় খেলা হইল। আমারে ওরা হায়ার করল। জীবন দিয়া খেলছি ওইদিন। জিতছিলাম। অনেক প্রাইজ আর সম্মানও পাইছি।

“বর্ষার দিনে কাদার মধ্যে আমরা গুডুগুডু (হাডুডু) খেলতাম। মজা হইত খুব। আমি কেচকি ধরলে কেউ ছুইট্টা যাইতে পারত না।

একবার বন্ধু হাকিমের লগে ঝগড়া হয়। মাঠের মধ্যেই ওর নাকমুখ ফাটায়া দিয়া আসি। বাবার কাছে ওরা বিচার নিয়া আসে। বাবাও চেইত্যা যায়। সবার সামনে আমারে লাঠিপেটা করে। মারামারি করতাম প্রায়ই। বিচারও আসত শত শত। আমারে নিয়া ভয় পাইত বাবায়। কহন কোন ঘটনা ঘটায়া ফেলি, সে চিন্তাতেই চোখে চোখে রাখত।

“সাত বিঘা জমি ছিল আমগো। ৩৩ শতাংশে এক বিঘা ওখানে। ১৯৬৪ সালের ঘটনা। জমিতে ধান পাকছে। পাঁচদিন গেলেই কাটমু। কিন্তু সেইটা আর হইল না! একরাতেই জমিত পানি ঢুইকা ফসল তলায়া গেল। এরপর শুরু হইল যমুনার ভাঙন।

মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীর বাম হাতের কনুইয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন

“এভাবে বছরের পর বছর যখন জমি তলাইতে থাকল তখন সংসারের অবস্থা নাজেহাল হইয়া গেল। সংসার তো চলে না। লেহাপড়া করমু কেমনে। ৮ম শ্রেণি পাস দিয়াই কাপড় বোনার কাজে নামলাম। তহন তাঁতের হানা-বাউ করতাম। সপ্তাহ গেলেই মিলত ৫০ টাকা। আস্তে আস্তে আয়ও বাড়ছে। কিন্তু আমার মারামারি তো কমে না। তাই বাবার চিন্তাও শেষ হয় না।

“আবু হেনা নামে আমার এক মামাতো ভাই আছিল সেনাবাহিনীতে। তার কাছেই বাবা লোক নেওয়ার খবর পায়। আমারে পাঠায়া দেয় ঢাকায়। ঢাকার পিলখানার পাশেই সেনাবাহিনীর অফিস আছিল। ওইখানে গিয়া দাঁড়াইলাম। বডির মাপ ঠিক হইতেই বুকে সিল মাইরা ওরা নিয়া নিল। আমার ব্যাচে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালও ছিল। সিপাহী হিসেবে সেনাবাহিনীতে জয়েন করলাম ১৯৬৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর। আর্মি নম্বরটা এহনও মুখস্থ, ৩৯৩৭৮২৮।”

শৈশবের নানা স্মৃতি আর সেনাবাহিনীতে যোগদানের ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো.শাহজাহান আলী।

ইয়াকুব আলী মোল্লা ও মাহিরুন নেছার দ্বিতীয় সন্তান শাহজাহান আলী। বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রূপনাই গাছপাড়া গ্রামে। এক সকালে আমরা পা রাখি তাঁর গ্রামের বাড়িতে। কথা চলে দেশ, সমাজ ও যুদ্ধদিন নিয়ে।

 শাহজাহান আলীর লেখাপাড়ায় হাতেখড়ি রূপনাই প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ভর্তি হন দৌলতপুর হাই স্কুলে। ওই স্কুলেই তিনি পড়েছেন ক্লাস এইট পর্যন্ত।

সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ের স্মৃতিচারণ করেন শাহজাহান আলী। তাঁর ভাষায়:

“ছয় মাসের ট্রেনিং হয় চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে। বোমা মারার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল বেশি। তাই আরআর সেকশনে কাজ করি। ওয়ান ও সিক্স এবং সেভেন্টি ফাইভ আরআর শিখি ট্রেনিংয়ের মধ্যেই। এরপর কছম প্যারডে কোরআনের ওপর হাত রেখে দেশের জন্য জীবন দিতেও পিছপা হব না বলে শপথ করেছিলাম। ট্রেনিং শেষে পানির জাহাজে করে আমগো পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে, ইলেভেন ডিপে। ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন ছিল ওখানে। কমান্ডিং অফিসার খিনজির খায়াত খান। টোয়াইসি ছিলেন খালেদ মোশাররফ।

“১৯৭০ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকের কথা। পুরো ব্যাটালিয়ানসহ ফোর বেঙ্গলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এ সময় কমান্ডিং অফিসার করা হয় লে. কর্নেল এমার চৌধুরীকে। খালেদ মোশাররফই টোয়াইসি ছিলেন।”

ব্যারাকের ভেতর বাঙালি-পাকিস্তানি বৈষম্য বোঝাতে এ বীর যোদ্ধা ওই সময়কার কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন:

শাহজাহান আলীর অনুকূলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সনদ

“পেপার আর পাট চলে যেত পশ্চিম পকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন নাই, অথচ পাকিস্তানের রাজধানী ওরা প্রথম করল করাচি, তারপর লাহোর, তারপর রাওয়ালপিন্ডি। ব্যারাকে ওদের সঙ্গে আমরা তেমন মিশতাম না। তবে যখন যৌথভাবে কাজ হত তখন সমস্যা হত। ওরা ‘মাদারচোদ’ বলে আমগো গালি দিত। সহ্য করতে পারতাম না। ব্রতচারী করতাম। একটু ঊনিশ-বিশ হলেই মাইর দিত। ওদের লোক ভুল করলেও তেমন শাস্তি পেত না। লাহোরে একবার হেভি ওয়েট বক্সিয়ের ফাইনালে কুমিল্লার গিয়াস উদ্দিনকে ওরা অন্যায়ভাবে নক আউট করে। আমরা ওখানেই এর প্রতিবাদ করি। রড আর ইট মেরেছিলাম থার্টি ফাইভ পাঞ্জাবি সেনাদের ওপর।

“লাহোরেই আরেকবার নিয়াজী নামে এক ননকমিশন অফিসার চড়াও হয় সিপাহি নজরুলের ওপর। তাকে গালি দিয়ে সে বলে: ‘মাদারচোদ। বাঙালিকা বাচ্চা। তোম কাহাছে আয়া। কোন বাইনচোদকা বাচ্চা তুম।’

“নজরুল গালিটা হজম করতে পারেনি। সুযোগ পেয়ে এক রাতে গুলি করে মারে ওই অফিসারকে। পরে সামরিক আইনে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। ব্যারাকের ভেতর কঠোর আইন মেনে চলতে হত। তবুও বাঙালি সেনাদের মনের ভেতরের ঝড় কিন্তু থামানো যায়নি।”

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে। সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় সবাই।

 ৭ মার্চ ১৯৭১। রোসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু দিলেন ঐতিহাসিক ভাষণটি।

আপনারা তখন কোথায়?

“আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। রেডিওতে শুনি ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বললেন,‘আর যদি একটি গুলি চলে… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

“বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশনাগুলো ব্যারাকে বাঙালি সেনাদের মনে স্বাধীনতার ঝড় তোলে। ভেতরে ভেতরে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।”

আপনারা তখন কী করলেন?

“ফোর বেঙ্গল ছাড়াও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিল পাঠান, পাঞ্জাব ও বেলুচ রেজিমেন্ট। তারা ক্যান্টমেন্টের বিভিন্ন স্থানে বাংকার তৈরি করতে থাকে। মনে তখন সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকল। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। একসময় এমার চৌধুরীকে বদলি করে ফোর বেঙ্গলের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয় খালেদ মোশাররফকে। চারপাশের অবস্থা আঁচ করতে পেরে তিনি পুরা ব্যাটালিয়ান, গোলাবারুদ, রসদসহ আউট প্যারেডের কথা বলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোর বেঙ্গল রেজিম্যান্টকে বের করে আনেন। পাঁচটা কোম্পানির প্রতিটিতে দেড়শ করে সেনা ছিল ফোর বেঙ্গলে।

“২৩ মার্চ ১৯৭১। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পশিজনে চলে যাই। ২৬ মার্চ থেকে প্রথম ফাইট শুরু করে ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্ট। পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লা থেকে আর্টিলারি আক্রমণ চালায় প্রথম। পরে তিনটি প্লেনে বোমবিং চালালে আমরা সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় এবং পরে আগড়তলায় চলে যাই।”

কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

“১১টি সেক্টরে ভাগ করে ফোর বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মতিন সাব, গফ্ফার হাওলাদার, অলি আহম্মেদ, আহাদ চৌধুরী, আমিন আহমেদ সাব, হায়দার সাব ও দিদারুল সাবকে বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাকে রেখে দেয় ২ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কোনাবনে। সাব সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল গফ্ফার হাওলাদার। প্রথম দিকে মূল দায়িত্ব ছিল মেলাঘরে গিয়ে যুবক ছেলেদের ট্রেনিং দেওয়া। এভাবে ট্রেনিং দিয়ে প্রত্যেক থানায় থানায় আমরা মুক্তিযোদ্ধা পাঠাতাম। এরপর শুরু হয় ফ্রন্ট ফাইট। আমরা অপারেশন করি কসবা, শালদা নদী, দেবীপুর, আখাউড়া প্রভৃতি এলাকায়।’

মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীর বুকের বাম পাশে স্প্লিনটারের আঘাতের ক্ষত

 এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই সূর্যসন্তান। সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি বিদ্ধ হয় তাঁর বাম হাতের কনুইয়ের ওপরে। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওইদিনটিতে? প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলী আনমনা হন। অতঃপর বলেন:

“পাকিস্তানি সেনারা ছিল শালদা নদীর বাংলাদেশ অংশে। আমরা ভারতের দিকে। ওখানে ওদের শক্তিশালী ডিফেন্স ছিল। নদীকে সামনে রেখে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় ওরা শক্ত ডিফেন্স গড়ে তোলে। কয়েকবার অ্যাটাক করেও ওদের কিছুই করা যায়নি।

“পরে প্ল্যান চেঞ্জ করা হয়। ছয়জনকে লাইট এলএমজি ও মেশিনগান দিয়ে দুই কিলোমিটার উত্তর দিক দিয়া অ্যাটাকের জন্য পাঠানো হয়।

“২৪ নভেম্বর ১৯৭১। ভোর সোয়া পাঁচটা। আমরা ওদের মুখোমুখি অ্যাটক করি। ওরা এদিকে লক্ষ করলে ওই ছয়জন পেছন দিয়ে অ্যাটাক করে। ফলে পাকিস্তানিরা কিছু বাংকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমার পজিশন নদীর পাশে বাঁধের ঢালে। ওদের মুখোমুখিতে। আমরা তখন ফায়ার বন্ধ রাখছি। খানিক পরেই ওরা আর্টিলারি মারতে থাকে। ওদের বাংকারগুলোর ব্রাশও গর্জে ওঠে। প্রথমে একটা সেলের টুকরা এসে লাগে খালেদ মোশাররফের মাথায়। উনি আহত হন।

“আমার কাছে ছিল এলএমজি। বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল বাম হাতে কেউ যেন জোরে একটা বাড়ি দিল। বাম হাতে ঝাকি লাগে। আমি কিছুই বুঝি না। তবুও গুলি চালাই। বাম পাশ থেকে মঞ্জু কয়: ‘শাহজাহান তুই ‘পিন ডাইন’ কর তাড়াতাড়ি।’

“আমি হেসে কই: ‘কেন?’

“মঞ্জু কয়:‘তোর হাতে গুলি লাগছে।’

“আমি পাত্তা দিই না। পাশ থেকে খোরশেদও চিৎকার দিয়া একই কথা কয়। দেখলাম বাম হাতে রক্তে ভেজা। মাথাডা নিমিষেই একটা পাক দিল। বিড়বিড় করে বললাম: ‘শালাগো শেষ করতে পারলাম না!’

“খোরশেদ আমাকে টেনে পেছনে নিয়ে যায়। প্রথম কোনাবন ব্যাটালিয়ান হাসাপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। পরে ভর্তি করা হয় আগরতলা বিশ্রামগড় হাসপাতালে। বুকের বামে স্প্লিনটারও লাগে। শরীর থেকে অনেক রক্ত গেছে। তবুও জ্ঞান হারাই নাই। হাসাপাতালে সুধির আর শংকর নামে দুই হিন্দু যুবক রক্ত দিয়া আমারে বাঁচাইছে। হাতে ঘা হয়ে গেছিল। ওয়াশ করত গজ ঢুকায়া। কী যে কষ্ট হত তহন! ওই অপারেশনে হাবিলদার বেলায়েতও শহীদ হয়। ওর মুখটা এহনও মনে ভাসে। স্বাধীনতা তো এমনি এমনি আসে নাই ভাই।”

মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মোশাররফের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বীর যোদ্ধা কান্না ধরে রাখতে পারেন না। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলেন:

“তাঁর মতো যোদ্ধা হয় না। কোন অফিসারটা মাঠে নেমে যুদ্ধ করেছে দেখান তো ভাই? অধিকাংশই তো পেছনে পেছনে বিরানি আর পোলাও খাইছে আর কমান্ড করছে। কিন্তু খালেদ মোশাররফ ফিল্ডে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন আমিন সাহেবও। দুইবেলা খবর নিতেন আমাদের। খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। যদি ফোর বেঙ্গলকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নিয়ে না আসতেন তাহলে সবাইকেই মরতে হত।

“তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ফোর বেঙ্গলের অধিকাংশ অফিসারই বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মোশাররফ ও ফোর বেঙ্গলের অবদান অনেক। অথচ স্বাধীনের পর এই বীর যোদ্ধাকেই মেরে ফেলেন জিয়াউর রহমান। তাঁর আমলে শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনাকেও হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীতে সেসব গণহত্যারও বিচার হওয়া উচিত।’

শাহজাহান আলীর অনুকূলে সেনাবাহিনীর প্রত্যয়নপত্র

স্বাধীনতা লাভের পর শাহজাহানকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে, ১৭ বেঙ্গলে। তাঁর হাতের ক্ষত তখনও ঠিক হয়নি। ইনফেকশন হওয়ায় ডাক্তাররা হাতটি কেটে ফেলতে চাইল। তিনি তখন ছুটি নিয়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে। ফলে শুরু হয় এ যোদ্ধার আরেক জীবনযুদ্ধ। সে ইতিহাস বেশ বেদনাবহ। হাতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সবকিছু বিক্রি করে দেন শাহজাহান। একসময় নাম লেখান হতদরিদ্রের তালিকায়। নিজেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয়ও দিতেন না। স্ত্রীর ছোট একটি চাকরিতেই অনেক কষ্টে চলত পরিবার।

একদিনের এক ঘটনা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। তাঁর ভাষায়:

“সামান্য সাহায্যের জন্য ফোর বেঙ্গলের অফিসারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কী কমু ভাই, তারা আমারে দেহা পর্যন্ত দেন নাই। সবাই ব্যস্ত নিজেরে নিয়া। প্রিয় লোক ছিল মতিন সাব। তিনিও সাক্ষাৎ দেয় নাই।

“একদিন আমার বড় ছেলে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের গল্প পড়তেছে। আমি পাশে বসা। তারে বলি সে তো আমার ব্যাচের। আমরা একসাথে ট্রেনিং করছি। মুক্তিযুদ্ধও করছি। শুইনাই ছাওয়াল আমার ওপর গরম হয়ে যায়। বলে: ‘আপনি ফাউ কথা কন। মুক্তিযুদ্ধ করছেন তার প্রমাণ কই? কথাটায় আমার খুব হিট লাগে।’

“কোন উত্তর দিতে পারি নাই ওইদিন। লিচুগাছের তলায় বইসা খুব কানছিলাম। পরে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে গিয়া সব রেকর্ড উঠাই। মুখের কথার কোনো দাম নাই ভাই। এহন রক্তের চেয়ে কাগজের দামই বেশি!”

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান তুলে ধরেন নিজের মতামত:

“সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা স্বাধীনের পরেই করা যেত। এফএফ আর এমএম নম্বরও ছিল। সবার তালিকা ছিল সরকারের হাতে। আর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মুক্তিযোদ্ধা করা হলে বির্তকটা হত না। তালিকায় এহন ভাইরাস ঢুকে গেছে। ভিক্ষুক, তার হাত নাই পা নাই. ওরাও এসে যুদ্ধাহত হইতেছে। গুলি আর রাইফেল কিছুই চিনে না তারা। গুলি খাইছে এমন রাজাকারও হয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তো কথাই বলতে পারি না। সাধারণ মানুষ বলে; ‘ধুর সব ভুয়া।’

“তহন চোখ দিয়া পানি আইসা যায়। মনে হয় কী করলাম? কার জন্য করলাম? সুবিধা দরকার নাই। মুক্তিযোদ্ধাগো সম্মানটুকু বাঁচিয়ে রাখুন।”

শাহজাহান আলীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ

স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থানে সামরিক সরকারগুলো বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। পাশাপাশি তাঁর নির্ভরতা শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের ভাষায়:

“আটটা বছরে দেশ যতটুকু আগাইয়া গেছে। এগো মতো যদি সব সরকার কাজ করত তাইলে আমগো দেশ পৃথিবীর বুকে এক নম্বরে থাকত। ওরা তো দেশটারে ধ্বংস কইরা পাকিস্তান বানানোর কাজে লিপ্ত ছিল।”

 যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

খানিক নীরব থেকে এই বীর যোদ্ধা উত্তর দেন:

“বাংলাদেশ নামে মাটি পাইছি। কিন্তু প্রশাসন পাই নাই। প্রশাসনে ছিল ঘাপলা। দেশ গড়ার সুযোগ দেওয়া হইল না বঙ্গবন্ধুকে। শয়তানের বড় ওস্তাদ ছিল খন্দকার মোশতাক। পাশে ছিল জিয়াউর রহমান। ওরাই হত্যা করল শেখ মুজিবকে। যে দেশে বঙ্গবন্ধু নাই সে দেশ তো আমরা চাই নাই ভাই।”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

“যখন তরুণরা দেশের টানে জেগে ওঠে তখন তৃপ্ত হই। যখন রাজাকারদের ফাঁসি হয় তখন বুক থেকে কষ্টের মেঘগুলো সরে যায়। ভালো লাগে খুব।”

খারাপ লাগে কখন?

“যখন জঙ্গিবাদ দেখি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা আর হেফাজতের তাণ্ডব দেখি। তখন কষ্ট লাগে।”

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

“শেখের বেটি টিকলে জঙ্গিবাদ টিকব না। তবে তাঁর দলের দুর্নীতিবাজদেরও শাস্তি দিতে হবে। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে যারা লুটতরাজ করে তাদের দল থেকে অবশ্যই বের করে দিতে হবে। কারণ, স্বার্থের জন্য দল বেইচা ওরাই দেশের ১২টা বাজায়।”

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা ধারণ করতে পারলে প্রজন্মের ভেতর দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। তাই বুকভরা আশা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান আলী বলেন:

“যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রজন্মও বাঁইচা আছে। ওগো দলও নিষিদ্ধ হয় নাই। ওরা কিন্তু কামড় দিবই। দেশের ইতিহাসটা যেন ওরা বদলাইতে না পারে সে দায়িত্ব প্রজন্মের হাতেই দিয়ে গেলাম। বিশ্বাস করি তোমরা সফল হবে। কারণ তোমাদের শিরায় মুক্তিযোদ্ধাগো রক্ত বহমান।”

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান আলীর কথা শুনতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে:
https://www.youtube.com/watch?v=XWjyqnUVUk0

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৫ জুলাই ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button