মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেশের কাজে নিয়োজিত করা দরকার ছিল
দুই ভাই ও এক বোনের সংসারে আমি সবার বড়। বাবার কোনো সম্পত্তি ছিল না। টাকা-পয়সা ছিল কম। দিনমজুরি করতেন। তবে কাজের অভাব ছিল না– খেত-খামারির কাজ, মাটি কাইটা জমির বাউন্ডারি বানানের কাজ মিলত। বাবার সাথে মাঝে মাঝে আমিও কাজে যাইতাম।
“সাত্তার, খোকা, সুবাস, সাইফুল্লাহ আর রুহুল ছিল বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম। দুষ্টামি যা করতাম এই কয়জন মিলাই। মানুষের বাড়ির ডাব খাওয়া, শসা খাওয়া, আখ খাওয়া– সব ছিল এই গ্রুপের কাজ। ধরেন, আপনার কাছে একটা ডাব চাইছি, দেন নাই। সবাই মিলা এক রাতেই ডাব সাবাড় করছি। অনেক মুরগি আছে কারও। একটা চাইছি, দেয় নাই। রাতের মধ্যেই সব মুরগি ধরা শেষ। একটা রাইখা বাকি মুরগির মাংসগুলা ওই বাড়িতেই দিয়া আসতাম। তবে এইসব করতাম মজা কইরা।”
“গ্রামে একবার এক দাদার কাছে খাসি চাইছি। দেয় নাই। এক রাতে তারে দাওয়াত করি, ‘দাদা, বনভোজন করতেছি, তোমার দাওয়াত থাকল।’ উনি বলেন, ‘রাইতে যাইতে পারমু না। তোরা ঘরে দিয়া যাইস।’ এক পাতিল ভাত আর গোসত দিয়া আসছি। সকালে উইঠা সে তো খাসি পায় না খুইজা। দাদি কইতাছে, ‘খাও নাই তুমি? তোমার খাসি তোমারেই ওরা খাওয়াইছে।’ পরের সপ্তাহে তার সামনে আর পড়ি নাই।”
“ভালোই চলতেছিল দিনগুলা। কিন্তু সবকিছু থাইমা যায় মা মারা যাওয়ার পর। আমি তহন এইটে পড়ি। লেহাপড়া বন্ধ হইল। তিন মাসের মাথায় বাপে আরেকটা বিয়া করল। সংসারে নামল অশান্তি। বাবা ঘরে আইলেই আমগো নিয়া বিচার বসাইত সৎ মা। দিনে দিনে বাবাও বদলাইতে থাকল।”
“সৎ মায়ের নাম ছিল আলেয়া। একদিন একটা সোনার নাকফুল বিক্রি করতে দেয় আমারে। আমি তো কিছু বুঝি নাই। রাতে বাবা আইলে বলে, ‘তোমার ছেলে আমার নাকফুল নিয়া গেছে।’ সকালে ঘুম থেকে উইঠাই আমাকে ধরছে বাবায়। আমি সব খুইলা বলি। কিন্তু উনি বিশ্বাস করেন না। ‘মিথ্যা কথা বলছিস’ বইলাই মাইর শুরু করে। মাইরের চোটে আমি ওইখানেই পায়খানা কইরা দেই। আমার এক চাচি আইসা আমারে ছাড়ায়া নেয়। ওই যে মাইর খাইছি, এরপর আর বাবার কাছে ফিরা যাই নাই। নিজের মায়ের মতো কেউ হয় না ভাই। মা যে কী জিনিস না থাকলে বোঝা যায়। মা থাকলে সন্তানের মনে বেহেস্থ থাকে।”
জীবনের আনন্দ-হাসির গল্পগুলো এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আশরাফ আলী। বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ঝালবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আব্দুল জব্বার মোল্লা আর মা ছুটু বিবি।লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ঝালবাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি হন ফয়লাহাট হাই স্কুলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরই ইতি টানেন লেখাপড়ায়।
এরপর বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেছেন আশরাফ। সুপারি কেটে চালনার হাটে বিক্রি করতেন এক সময়। কাজের খোঁজে পরে চলে যান খুলনায়। কিছুদিন লঞ্চঘাটে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। ট্রেনে চড়ে একদিন চলে যান ঢাকায়। ঢালের রিকসা আর মালের ঠেলার কাজে যুক্ত হন সূত্রাপুরে। বাকি ইতিহাস শুনি আশরাফ আলীর জবানিতে।
“প্রথমে গেলাম সদরঘাটে, কুলির কাজ করতে। কিন্তু ওইখানে বরিশাল আর চাঁনপুরের লোকেরা নতুন কাউরে কাজ করতে দেয় না। আমি চইলা যাই সোয়ারিঘাটে। ওইখানেও একই অবস্থা। কাজ পাই না। সূত্রাপুরে রাস্তার পাশে বইসা কানতাছি। শাহ আলম নামে পুলিশের এক অয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন। উনি আমারে ডাইকা সব কথা শুনলেন। এরপর ওইদিনই ঢালের রিকশা আর মালের ঠেলায় লাগায়া দিলেন।”
“কাজ করতাম খুব। এক বছরে শাহ আলম স্যারের কাছেই ছাব্বিশ শ টাকা জমাই। উনি বদলি হয়ে গেলে আনসার আলী নামে আরেক পুলিশের কাছে টাকা দিয়া যায়। তার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ মুক্তাগাছায়। উনি লোক ভালো ছিলেন না। আমারে বললেন, ‘আশরাফ, মুক্তাগাছায় চল। জমি কিনে দিব। বিয়ে দিয়ে দিব।’ আমিও রাজি হইলাম। উনার লগে ঢাকা থেইকা ট্রেনে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে নামি। মুক্তাগাছার ট্রেন আইব, এই কথা বইলা আমারে বসায়া উনি সইরা পড়েন। তহন জানতাম না মুক্তাগাছায় কোনো ট্রেন যায় না। উনিও আসেন না। দুপুর থাইকা রাত বারটা পর্যন্ত স্টেশনে বইসা কানতে থাকি। জীবনে কষ্ট যেমন করছি ঠকছিও কম না।”
এরপর কী করলেন?
“পুলিশের সব লোক তো আর খারাপ না। স্টেশনে আমারে দেইখা আগায়া আসেন আইনউদ্দিন হাবিলদার। তারে সব হিসট্রি বলি। উনার ওইখানে পোস্টিং ছিল। বাসা ছিল ময়মনসিংহের নতুন বাজারে। সব শুইনা তাঁর বাসার কাজে আমারে রাখলেন। তাঁর মেয়েরে স্কুলে দিয়া আসা আর নিয়া আসা আর বাড়ির একটা গাভির জন্য পুলিশ লাইন থেইকা প্রত্যেক দিন এক বস্তা কইরা ঘাস কাইটা আনা– এই আমার ডিউটি। খাই-দাই আর মনের আনন্দে ঘুইরা বেড়াই শহরে।”
শ্রমজীবী মানুষ আশরাফ। দেশ নিয়ে অত চিন্তা ছিল না তার। তবে মিছিল-মিটিং দেখলেই ঠিক থাকতে পারতেন না। ময়মনসিংহ নতুন বাজারের মেইন রোড দিয়ে তখন মিছিল যেত। আওয়াজ পেলে আশরাফও দৌড়ে যেতেন মিছিলে। কণ্ঠ আকাশে তুলে স্লোগন তুলতেন, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’
দিনে দিনে হাবিলদার আইনউদ্দিন আশরাফের কাজ আর সততার গুণে মুগ্ধ হন। পরিবারের একজন সদস্যের মতোই তিনি সবসময় তাঁকে কাছাকাছি রাখতেন। এক সময় তিনি আশরাফকে পুলিশে ভর্তি করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
আশরাফ বলেন, ‘পুলিশে ভর্তির আগেই উনি ট্রেনিং করান একাত্তরের পুরা জানুয়ারি মাস। পুলিশ লাইনে খুব সকাল থেইকা শুরু হইত ট্রেনিং। প্রথম পিটি-প্যারেড, এরপর ক্রলিং, লাইন পজিশন, রাইফেল চালানো। বিশটা গুলি দিছিল। উনিশটাই টার্গেট হইছিল আমার। খুশি হইয়া উনি বলেন, ‘আশরাফ তুই পারবি’। তহন তো বুঝি নাই ওই ট্রেনিং-ই দেশের কাজে লাগব।”
আশরাফ দেশের খবরাখবর জেনে যেতেন বিভিন্ন পত্রিকা পড়ে। ৭ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন রেসকোর্স ময়দানে। সে ভাষণ তিনি শোনেন রেডিওতে। ওই ভাষণই আশরাফকে দেশপাগল করে দেয়।
তাঁর ভাষায়:
“শেখ মুজিব বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়– তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…’। ভাষণ শুইনাই তো কাইন্দা দিছি। গায়ের ভিতর মনে হয় আগুন জ্বলছিল। ওইদিন বুঝছি কিছু একটা ঘটব।”
২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ময়মনসিংহে ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নেয় বাঙালিরা। পুলিশের পাঞ্জাবি সিপাইরাও পালিয়ে যায়। তখন আইনউদ্দিন হাবিলদারের মাধ্যমে আশরাফও পুলিশ লাইনে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা ময়মনসিংহ অআক্রমণ করলে প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তিনিও হালুয়াঘাট পার হয়ে চলে যান তুরার ডালুতে। সেখান থেকে একটি দল পাঠানো হয় এগার নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে, ধানুয়া কামালপুরে। কিন্তু আশরাফ থেকে যান ডালুতেই, সুবেদার জিয়াউল হকের সঙ্গে।
তাদের কাজ ছিল বর্ডার পাহারা দেওয়া আর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা যুবকদের নিরাপদে ভারতের ভেতর নিয়ে আসা। ডালু ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে পরে ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হত ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে। পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন এগার নম্বর সেক্টরের ডালু বর্ডার ও হাতিপাগার এলাকায়।
এক অপারেশনে মারত্মকভাবে আহত হন এই যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তাঁর বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত সে স্মৃতি মনে করে আজও অশ্রুসিক্ত হন। একজন যোদ্ধার জলেভেজা চোখ আমাদেরও আবেগতাড়িত করে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী বলেন:
“২৪ মে, ১৯৭১। আমরা ছিলাম ডালু বাজারে। ট্রেনিং থেইকা চারটা কোম্পানির ফিরা আসার কথা। প্রচণ্ড বৃষ্টি হইলে তারা আর আসতে পারে না। আমরা ওইখানেই পজিশনে। ছাত্র, পুলিশ, আনসার মিলা ৪৭ জনের মতো। বিএসএফ সদস্যও ছিল দেড়শর ওপর। সীমান্তে টুকটাক ফায়ার চলতাছে। পূর্বদিকে নদী। নদীর ওই পারে হালুয়াঘাটের সাইড দিয়া পাকিস্তানি সেনারা অ্যাটাক করে। শেরপুর থেইকা কড়ইতলি হইয়া ওগো আরেকটা গ্রুপ হাতিপাগার ক্যাম্পে আসে। আমরা সেইটা বুঝতে পারি না। ওরা পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণ– তিন দিক দিয়া অ্যাটাক করে।”
“২৫ মে ভোরবেলা বৃষ্টির মতো গোলাগুলি চলতেছে। আমি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালাই। আবার এলএমজিম্যানের ম্যাগজিনেও গুলি ভইরা নেই। আমাদের কমান্ড করেন সুবেদার জিয়াউল হক ও কোম্পানি কমান্ডার মেজবাউদ্দিন আহমেদ। নদীর ওইপার থেইকা পাকিস্তানি সেনারা এলএমজির ফায়ার দেয়। ওরা আসলে আমাদের ব্যস্ত রাখছিল। পিছন দিয়া ওগো আরেকটা গ্রুপ ভারতীয় অংশে ঢুইকা পড়ে। আমরা টের পাই নাই।”
“পূর্বদিকের নদীপাড়ে সবাই। মোতালেব নামের পুলিশের এক সিপাহি ছিলেন পাশেই। উনি বললেন, ‘আশরাফ, তুই পশ্চিম দিকে পজিশনে যা।’ আমিও দৌড় মারি। পশ্চিমে একটা গর্তে পজিশন নিয়ে দেখি কিছু নাই, খালি পাটক্ষেত।”
“আমার কাছে ১৫-২০ রাউন্ড গুলি ছিল। তাই দিয়া এই দিক ওই দিক ফায়ার করি। গুলি তখন প্রায় শেষ। দেখি খুব কাছে পাটক্ষেতে পাকিস্তানিগো মাথার হেলমেট দেখা যায়। কিছু বুইঝা ওঠার আগেই ওরা আইসা আমারে ঘুষি মাইরা ফালাইয়া দেয়। এক সৈনিক দ্রুত আমার ওপর আইসা গলা চাইপা ধরে। আমিও ধাক্কা দিয়া ওরে ফালাইয়া দিই। দাঁড়াইতে যামু অমনি চায়নিজ রাইফেল দিয়া সে গুলি চালায়। গুলিটা আমার বুকের বাম সাইড দিয়া ঢুইকা পিছন দিক দিয়া বাইর অইয়া যায়। তখন ওরা পূর্বদিকে অ্যাটাক করে। ওই অপারেশনে আমাদের ১৫০ জনের মতো শহীদ হন। আমি বাঁচছি ভাগ্যের জোরে।”
কীভাবে?
“গুলি লাগার পর প্রচণ্ড ব্লিডিং হইতেছিল। কিন্তু আমার জ্ঞান ছিল। প্রথম কিছু বুঝতে পারি নাই। বুকটা এক সময় ভার ভার লাগে। উপুড় হইয়া পইড়া থাকি। আমারে মৃত মনে কইরা ওরা চইলা যায়। তখন কোনো রকমে ওইখান থেইকা হাইটা আগাইতে থাকি। পিপাসায় গলা শুকাইয়া আসে। বুকের ভিতর গড়গড় শব্দ হয়। পথ যেন শেষ হয় না। মনে হইতেছিল যেন কারবালার প্রান্তর। একটু পরেই হয়তো মারা যামু। মায়ের মুখটা বারবার ভাইসা উঠল চোখে।”
এভাবে কোনোমতে একটা গির্জার সামনে এসে লুটিয়ে পড়েন আশরাফ। ওখানকার গারো মেয়েরা ছুটে আসে। টিনের ওপর তাঁকে শুইয়ে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় বারাঙ্গাপাড়া থানা হাসপাতালে। ওখানে ডাক্তার বোস প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আশরাফকে পাঠিয়ে দেন তুরা হাসপাতালে। গুলিটি বেরিয়ে গেলেও হাড় ভেঙে টুকরোটি ভেতরে রয়ে যায়। হাসপাতালে খুব খিঁচুনি হত তাঁর। ভেবেছিলেন মরেই যাবেন বুঝি। আমিন আহম্মেদ চৌধুরী ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (বর্তমান ধর্মমন্ত্রী) আশরাফকে হাসপাতালে দেখেতে যান। হাসপাতালে তখন ওষুধের সংকট চলছিল। বারশ টাকা দিয়ে তাঁরা আশরাফের জন্য ওষুধ কিনে যান। ওই ওষুধ না হলে হয়তো বাঁচতেই পারতেন না এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ সিপাহী হিসেবে যোগ দেন পুলিশে। দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন তিনি। অথচ স্বাধীন দেশে সে কারণেই চাকুরি হারাতে হয় তাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বুকে গুলি লাগার কারণ উল্লেখ করে মেডিকেলে আনফিট করা হয় তাঁকে। শুধু তিনিই নন, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে পুলিশের চাকুরি হারান আরও তের জন। তাই দেশ নিয়ে তাঁর অভিমান, ক্ষোভ আর কষ্ট অনেক।
অকপটে বলেন:
“বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গেছি। অথচ দেশ স্বাধীনের পর তিনিই বললেন, ‘তোরা যার যার কাজে ফিরে যা।’ এইটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেশের কাজে নিয়োজিত করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা তো হইল না। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা দূরে সইরা গেল। জাসদ গঠন হইল। রক্ষীবাহিনীও করা হইল। এই সব কিছু ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। বঙ্গবন্ধুকে একলা কইরা দেওয়ার পদ্ধতি। তাঁরে হত্যার পথ তৈরি করা।”
যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে তাদের পশুর চেয়েও অধম আখ্যা দিয়ে এ সূর্যসন্তান বলেন:
“বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশ– ভাবন যায় না। যে মানুষটা সারাজীবন বাঙালির অধিকারের জন্য সংগ্রাম করল, যারে একাত্তরে পাকিস্তানিরাও মারতে পারল না– স্বাধীন দেশে তারেই মাইরা ফেলল বাঙালি সৈন্যরা। এর চেয়ে লজ্জা, অপমান আর পরাজয়ের ইতিহাস আর কী হইতে পারে? বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সবাইরে সাজা দিতে করতে না পারলে বাঙালির ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হইব না।”
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তাঁর হাত ধরেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় মন্ত্রী হন শাহ আজিজ ও মওলানা মান্নানের মতো যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা। সে সময়কার একটি ঘটনার উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী বলেন:
“বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ আমাদের দিকে হাত বাড়াইয়া নিজের পরিচয় দেন। বলেন, ‘আমি আজিজ’। সঙ্গে থাকা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হানিফ সরকার জানতে চান, ‘কোন আজিজ? কুষ্টিয়ার আজিজ। আপনি কি শাহ আজিজুর রহমান?’ উনি চুপ থাকেন। তখন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল মামুন আর মোদাচ্ছের হোসেন মধু জোরে জোরে বলেন, ‘আপনারা দেখেন একাত্তরের রাজাকারকে।’ সে সময় হানিফ তাঁর মুখে জুতা ছুইড়া মারে। পরে জিয়া আইসা বলেন, তিনি নিজেই নাকি এইডাতে অপমানিত হইছেন! রাজাকাররে অপমান করলে যে নিজে অপমানিত হন তিনি কেমন মুক্তিযোদ্ধা? উনার ঘোষণাতেই নাকি দেশ স্বাধীন হইছে– তাইলে দেশ স্বাধীন কইরা যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধীদের কীভাবে তিনি দেশের মন্ত্রী বানান?”
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলীর উত্তর:
“রাষ্ট্র, পতাকা, মানুষ পাইছি। এইডা অনেক। তবে সোনার বাংলা পাই নাই। যদিও বঙ্গবন্ধুর কন্যা আসার পর আমরা সেই রাস্তায় হাঁটতেছি। দেশের ক্ষতি হোক সে কোনোদিন চাইব না। আমার বিশ্বাস, বাঙালি জাতি মাথা উঁচু কইরা দাঁড়াইব। তবে শয়তান সব জায়গাতেই বিরাজ করে। দলের লোক খারাপ কাজ আর লুটপাট করে। কিন্তু বদনাম হয় শেখ হাসিনার। তাই দল থেইকা শয়তান তাড়াইতে হইব।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই তাঁর কাছে। আগে মুক্তিযোদ্ধা বললে অনেকেই হেসে হেসে বলত, ‘চুক্তিযোদ্ধা’– জানালেন আশরাফ। এখন মুক্তিযোদ্ধা শুনলে মানুষ সম্মান করে বসতে দেয়, তখন ভালো লাগে। আশরাফের মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছেন শেখ হাসিনা সরকার। তবে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কারণে তাঁরা অনেক অসম্মানিত হয়েছেন বলে তাঁর মত। তদন্ত ছাড়াই উনি কথায় কথায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরও বলেন, ‘ভুয়া’। দায়িত্বশীল একটি জায়গায় থেকে তাঁর কাছ থেকে এটা আশা করেন না আশরাফের মতো মুক্তিযোদ্ধারা।
পরবর্তী প্রজন্মই এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবে, এমন বিশ্বাস মনে লালন করেন যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:
“তোমরা কোনো জাতি বা কোনো ধর্মের লোকরে ঘৃণা কইর না। দেশের ইতিহাস রক্ষা করতে সবসময় চেষ্টা কইর। দেশ ও জাতির জনকের ইতিহাস জানবা। মনে রাখবা, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২০ আগস্ট ২০১৭
© 2017 – 2018, https:.