ভ্রমণকথা

পাহাড় দেখতে হালুয়াঘাটে

একদিনে পাহাড় দেখে আবার রাজধানীতে ফেরা কি সম্ভব? অনেকের মতো এমন প্রশ্ন আমাদেরও ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গিয়ে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখে একদিনেই ফিরে আসা যায় খুব সহজে। ঈদের ছুটিতে রাস্তাঘাট থাকে ফাঁকা। সে সুযোগটাই নিই আমরা। কাকডাকা এক ভোরে রওনা হই পাহাড়ের পাদদেশ হালুয়াঘাটের উদ্দেশে।

নামের ইতিহাস

নামটি কেন হালুয়াঘাট? উত্তর জানতে দৃষ্টি ফেরাতে হবে বেশ পেছনের দিকে। ১৬৫০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো একসময়ের কথা। তখন দর্শা নামক নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সব ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালুয়া অর্থ চাষি। হালচাষিরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অর্থ দাঁড়ায় হালুয়াদের ঘাট। আবার অনেকেরই এ বিষয়ে মত একেবারে ভিন্ন। ঘাটটি হালুয়া নামক ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল বলেই নাকি এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। এ উপজেলার এক পাশ ঘিরে রেখেছে মেঘালয়ের মেঘছোঁয়া বড় বড় সব পাহাড়। মুক্ত আকাশে এখান থেকেই দেখা যায় বড় তুরা পাহাড়টিও।
তাই নাম নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কিন্তু কোনো মতভেদ নেই।

কোথায় ঘুরবেন

সূর্যপুর, পানিহাতা আর কড়ইতলী-হালুয়াঘাটের এ জায়গাগুলো থেকেই মেঘালয়ের সব পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের জায়গাটি কড়ইতলী। এখানকার বিজিপি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে শেরপুরের দিকে। আর অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউড়া উপজেলায়। এই দীর্ঘ রাস্তার একপাশের মেঘালয় সীমান্তে ছায়ার মতো ঘিরে আছে শুধুই পাহাড়। পাহাড় থেকে সীমানা অতিক্রম করে মাঝেমধ্যে দলভেদে নেমে আসে হাতি কিংবা মায়াবী হরিণ।

পাহাড়ে রোদবৃষ্টির খেলা

হালুয়াঘাটের শাপলা বাজার মোড় পার হতেই ভাগ হয়ে যায় রাস্তাটি। পাল্টে যায় চারপাশের দৃশ্যও। রাস্তার ওপাশে দূরে বড় বড় পাহাড়। দৃষ্টির দুই পরতেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একটির পেছনে আরেকটি। যেন একটি আরেকটির ছায়া। সব পাহাড় আকাশমুখী। কোনো কোনোটিকে ঘন মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে। সেখানে মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের যেন মিতালি চলছে। কোনো কোনো পাহাড়ে ঝুম বৃষ্টি। আবার মেঘের ফাঁক বুঝে একরাশ রোদের আলো এসে পড়েছে কোনো কোনোটিতে। এক পাহাড়ে বৃষ্টি, অন্যগুলোতে তখন রোদ। এভাবে হালুয়াঘাটে প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে চলে রোদ-বৃষ্টির খেলা।

যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি

আমাদের গন্তব্য ছিল কড়ইতলী। গ্রামটি গোবরাকুড়া ইউনিয়নে, হালুয়াঘাট শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার ভেতরে। বাজারকে পেছনে ফেলে আমরা উত্তরদিকে এগোতে থাকি। যতই সামনে যাচ্ছি, ততই যেন ভালোলাগা সব দৃশ্য আমাদের ঘিরে ধরছিল। একটি জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতেই হলো। বৃষ্টিতে রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে জমেছে হাঁটু অবধি পানি । লম্বা লম্বা পা নিয়ে সে পানিতে নিঃশব্দে মাছ ধরছে  একঝাঁক পাহাড়ি বক। সবুজের বুকে সাদা বক। কী যে অদ্ভুত! মনে হচ্ছিল সবুজ আঁচলে কোনো শিল্পী যেন ভালোবাসার তুলি দিয়ে সাদা আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে।

হালুয়াঘাটের কড়ইতলী

গারো নারী আর পাহাড়ি নদীর দেখা

গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা হয়ে কড়ইতলীর দিকে যতই এগোচ্ছি, ততই দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যাচ্ছে। কোনো স্বপ্নময় দেশে যেন আমরা চলে এসেছি। স্বর্গীয় পরশ নিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারপাশে। দৃষ্টির সামনে পাহাড়গুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রাস্তার পাশেই ফসলের মাঠ। গোটা মাঠেই ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত গারো নারীরা। হাঁটু অবধি কাদায় নেমে আশীর্বাদের পরশ দিয়ে  চারা রোপণ করছে তারা। পাহাড় দেখতে দেখতে আবিষ্কার করি মাঠের পাশে একটি ছোট্ট খালের। তার ওপরে বাঁশ বিছিয়ে বানানো হয়েছে একটি সাঁকো বিশেষ। খাল মনে হলেও এটি আসলে পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট্ট নদী। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের জলরাশি নিয়ে এটিই আছড়ে পড়ে কংস নদের বুকে। আর সে সময় ভেসে যায় দুই পাড়ের লোকালয়।

পাহাড়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া

কড়ইতরীতে আমাদের চোখের সামনেই পাহাড় থেকে উড়ে আসে বকের ঝাঁক। হঠাৎ দেখি দূর পাহাড়ে মেঘ ঝরছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় তা ধেয়ে আসে আমাদের দিকে। আমরা পিছু হটি। কিন্তু তার আগেই একপশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় শরীরটাকে। ভেজা শরীরে পাহাড়ের দিকে তাকাতে দেখি অন্য দৃশ্য। গোটা পাহাড়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উড়ছে। মনে হচ্ছে, পাহাড়ের বুকে যেন কষ্টের আগুন লেগেছে। প্রচণ্ড গরমের পর অল্প বৃষ্টি হলেই পাহাড়ে এ রকম ধোঁয়ার মতো বাষ্প ওঠে। হালুয়াঘাট থেকে তা দেখতে সত্যি অন্য রকম লাগে।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে হালুয়াঘাট যাওয়ার একাধিক বাস আছে। ভাড়া ২০০ টাকা। হালুয়াঘাট থেকে রিকশায় বা অটো ভাড়া করে ঘুরতে পারেন। দুপুরে খাওয়ার একাধিক হোটেল রয়েছে হালুয়াঘাট বাজারে। তবে থানার পাশে জসিমের ঘরোয়া ঢঙের ছোট্ট হোটেলটিতে মিলবে হাঁসের মাংস ও ভর্তা।

ছবি : মৃদুল আহমেদ

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button