গণ্ডগোল নয়, হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ
“৭ মার্চ ১৯৭১। আমার বয়স তখন আঠারো। ক্লাস টেইনে পড়ি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন রের্সকোস ময়দানে। সে ভাষণটি শুনি রেডিওতে। তিনি বললেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে…।’ ওই ভাষণই আমাদের মনে ঝড় তোলে। অতঃপর সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। ঐক্যবদ্ধ হয় ছাত্র সমাজ। ছাত্র নেতা নিজাম ভাই, ফজলু ও তোফাজ্জল আমাদের একত্রিত করেন। পরিকল্পনা হয় সাঁথিয়া থানা আক্রমণের। থানা থেকে অস্ত্র লুট করে আমরা অবস্থান নেই পাবনায়।”
“স্কুলে থাকতেই থ্রি নট থ্রি চালানো শিখেছিলাম, আনসার ট্রেনিংয়ে। ২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামে। তারা গণহত্যা চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল ও পুরনো ঢাকায়। সারা দেশের জেলা শহরগুলোও আর্মিরা দখলে নিতে থাকে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পরে সবখানে। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।”
“আমরা তখন দলবেঁধে পাবনা পুলিশ লাইনে ঢুকি। এ সময় নেতৃত্ব দেন রফিকুল ইসলাম বকুল ভাই, বগা মিয়া ও উদ্দিন ভাই প্রমুখ। আগেই সেখানকার অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায়। ফলে পুলিশ লাইনের হাতিয়ারগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তখন মিটিং হয় পাবনা টেকনিক্যাল কলেজে। পরিকল্পনা চলে প্রতিরোধ যুদ্ধের। আমরা তখন অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়ি নগরবাড়িতে। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা প্রবল বোম্বিং করে এগোতে থাকে। সাজোয়া বাহিনীর গোলাগুলির মুখে আমরা টিকতে পারি না। ওরা তখন কাশিনাথপুর দিয়ে ঢুকে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে ও বাড়িঘরে আগুন দিতে থাকে। এভাবে দখল হয়ে যায় পাবনা। আমরা তখন আত্মগোপনে থাকি।”
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনা প্রবাহের কথা তুলে ধরছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাইনুল হক। তার বাবার নাম মসলেম উদ্দিন এবং মায়ের নাম সৈয়তন নেসা। পাঁচ ভাই ও সাত বোনের সংসারে মাইনুল চতুর্থ। তার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। লেখাপড়ায় তার হাতেখড়ি সাঁথিয়া প্রাইমারি স্কুলে। বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর গ্রামে।
ছোটবেলা থেকেই খানিকটা দুরন্ত ছিলেন মাইনুল। ফুটবল আর হা-ডু-ডু খেলাতেই ছিল তার জোঁক। দলবেঁধে চলত তাদের নানা অভিযান। কোন বন্ধু কোনো বিপদে পড়লেই তার পাশে এসে দাঁড়াতেন মাইনুলরা।
প্রতি সন্ধ্যায় তারা রেডিও শুনতে যেতেন শাহপাড়ায়। বড়দের আলোচনা ও রেডিওর নানা সংবাদ তাদের জ্ঞানকে ঋদ্ধ করতো। জেনে যেতেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নানা বৈষম্যের খবরগুলো। পাকিস্তানিরা নানাভাবে বাঙালিদের অবহেলা ও অত্যাচার করতো। পুলিশ ও আর্মিতে উচ্চপদে ছিল তাদের লোক। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হলেও উন্নয়নটা হত অনেক কম। এ সব বিষয়ে মাইনুলরা সচেতন ছিলেন।
আপনাদের ওখানে আর্মি ঢুকে কি করলো?
মাইনুলের উত্তর- “ওরা এসেই অত্যাচার শুরু করে হিন্দু পাড়াতে। অকারণেই নিরীহ বাঙালিদের বন্দুকের বাঁট আর বুটের লাথিতে ছিটকে ফেলতো। বনগ্রাম হাটে ওরা নিরীহ মানুষের ওপর গুলিও চালায়। একবার হাটের মধ্যেই পুরুষদের ন্যাংটো করে দেখতে থাকে কে মুসলমান, কে হিন্দু! হিন্দু হলেই তাকে ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে। পরে তার লাশ মিলতো নদীর পাড়ে। খানদের ভয়ে সবাই তটস্থ থাকতো। ‘আর্মি আসছে’- এ খবর শুনলেই গ্রামের মহিলা ও শিশুরা আশ্রয় নিত ইছামতি নদীর ওপারে। ফলে দিনে কয়েকবারই তাদের শরীর ভিজতো নদীর জলে। অনেকেই জীবন বাঁচাতে বাপ-দাদার ভিটে ছেড়েই চলে যেতে থাকে ভারতে।”
আপনারা তখন কী করলেন?
তিনি বলেন- “ওদের অত্যাচার দেখলে ঠিক থাকতে পারতাম না। স্বাধীনের চিন্তা তখন মাথায় ছিল না। চিন্তা ছিল একটাই- পাকিস্তানিগো পিটিয়ে দেশ ছাড়া করবো। তা না হলে মুক্তি নেই। সন্টু, মসলেম, জাফর ও টেনাসহ আমরা পনের জন গোপনে পরিকল্পনা করি ভারতে যাওয়ার। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়েই এক ভোরে ঘর ছাড়ি। পাবনা থেকে প্রথমে সুজানগর ও ফরিদপুর হয়ে চলে আসি কুষ্টিয়ায়। পরে কেচোয়াডাঙ্গা শিকারপুর বর্ডার পার হয়ে চলে যাই ভারতে। শিকারপুর ক্যাম্পে এসে আমরা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাই। ওখান থেকে বনগ্রাম হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় আসাম মেঘালয় প্রদেশের তেলঢালা নামক জায়গায়। জঙ্গল কেটে সেখানে তৈরি করা হয় ট্রেনিং ক্যাম্প। দেড় মাসের ট্রেনিংয়ে এলএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড, স্টেনগানসহ গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের কৌশল শেখানো হয় আমাদের। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৫৮৬।”
ট্রেনিং শেষে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে এগার নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হক। তিনি ছিলেন বি কোম্পানিতে। তাদের কমান্ড করতেন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী অপারেশনে রক্তাক্ত হন এই যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারি ও গুলির আঘাতে তার ডান পা ভেঙে সামনে চলে আসে, পায়ের মাংস ছিঁড়ে যায় এবং বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের মাংসও উপড়ে পড়ে। ওইদিনটির কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে যায় মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হকের। সহযোদ্ধাদের মুখগুলো ভুলতে পারেন না তিনি। রক্তাক্ত ওই দিনের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো মনে হলে ঘুমাতে পারেন না এই বীর। আজো বুকের ভেতর সবকিছু জীবন্ত হয়ে আছে তার।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে? জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকেন রক্তমাথা দিনটির আদ্যপান্ত। তার ভাষায়-
“পাকিস্তানি সেনারা সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ছিল কামালপুর। এখান থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ বকশীগঞ্জ-জামালপুর-টাঙ্গাইল সড়কটি। ঢাকা দখলের সর্বাত্মক আক্রমণে এই সড়কটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই পাকিস্তানি বালুচ রেজিমেন্ট কামালপুর বিওপি এলাকায় শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিট দিয়ে তারা বাংকার গড়ে তোলে। এর চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পেতে রাখে অ্যান্টিট্যাংক ও অ্যান্টি-পারসোনেল মাইন। তবুও সেখানেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে।”
“৩১ জুলাই ১৯৭১। গারো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে তেলঢালা হয়ে আমরা এসে পজিশন নিই ধানুয়া কামালপুর গ্রামে, শক্রঘাঁটি থেকে পাঁচশো গজ দূরে। ভারতীয় সেনারা আমাদের আর্টিলারী সার্পোট দিবে, উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করবে ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানি, পেছনে ব্লক পজিশন নিবে আলফা কোম্পানি- এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।”
“প্রথমে ভারতীয় সেনারা ওদের দিকে আর্টিলারি ছোড়ে। কিন্তু সেগুলো সব লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বরং শক্ররা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গোলাগুলি শুরু করে। তবুও আমরা পিছ পা হই না। ওরা কামানের গোলা দিয়ে আমাদের ঠেকাতে চায়। আমার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আগে বাড়ি।”
“রাত তখন আনুমানিক তিনটা অর্থাৎ আগস্ট মাসের প্রথম প্রহর। হাফিজ স্যারের নির্দেশে আমরা ক্রলিং করে সামনে এগোই। অন্য দল তখন কাভারিং ফায়ার করে। এভাবে এক সময় চলে আসি ওদের মাইন ফিল্ডের ভেতরে। মাইন নিষ্ক্রিয় করে আমরা ধীরে ধীরে এগোই। হঠাৎ ওৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের ওপর আক্রমণ করে। ওদের আর্টিলারি ও গুলির আঘাতে আমরা টিকতে পারি না। চোখের সামনে একে একে মারা পড়ছিল সহযোদ্ধারা। তাদের আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠছিল আশপাশের বাতাস। চোখের সামনেই দেখি সহযোদ্ধাদের মৃত্যুযন্ত্রণা। পাশেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সিপাহি মোস্তফা ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন মমতাজ। চোখের সামনেই ঘটে মৃত্যুগুলো।”
“আঘাত পেয়েছি, প্রথমে টের-ই পাইনি। দাঁড়াতে যাব, পায়ে হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হয়। উল্টে পড়ে যাই। ডান পা ভেঙে আমার বুকের ওপর উঠে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার চোখে-মুখে ছিটকে আসে নিজের শরীরেরই লাল রক্ত। যন্ত্রণায় আমি কাতরাচ্ছিলাম। পাশ থেকে মোস্তফা চিৎকার করে বলে, ‘ভাই, আমার চোখ নাই।’ মান্নানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর রানের মাংসও উড়ে গেছে। সে আল্লাহর নাম জপছে। ভেবেছিলাম মরে যাব। মায়ের কথা শুধু মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের মুখটা। ক্রমেই তা ঝাপসা হয়ে আসে। এরপর আর কিছুই মনে নেই। ওই অপারেশনে আমাদের ৩০জন সহযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হয়েছিলেন ৬৬ জন।”
মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হকের চিকিৎসা চলে প্রথমে ভারতের তুরা হাসপাতালে। পরে চিকিৎসার প্রয়োজনে তাকে পর্যায়ক্রমে নিয়ে যাওয়া হয় গোহাটি, ব্যারাকপুর এবং লখনৌ আর্মি হাসপাতালে। তিন মাস জ্ঞান ছিল না তার। শরীরের পশম ঝলসে গিয়েছিল। হাসপাতালে তাকে রাখা হতো আলাদাভাবে।
মাইনুল বলেন- “তখন শুধু মাকেই স্বপ্ন দেখতাম। দেশে ফেরার জন্য মনটা ছটফট করতো। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমি লখনৌ হাসপাতালে। ভারতীয়রা ফুল নিয়ে ওইদিন আমাদের দেখতে আসে। নয় মাসে স্বাধীনতা পেয়ে আমরা হয়ে যাই বীরের জাতি। হাসপাতালে সবাই আমাদের খুব সেবা করেছে। এখনো মনে পড়ে তাদের কথা। একাত্তরে ভারতীয়দের এ ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না!”
স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হককে সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রুমানিয়া ও জার্মানিতে। সেখানে চিকিৎসার পরেই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। জার্মানিতে চিকিৎসাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে মাইনুলকে দেখতে যান কর্নেল এম এ জি ওসমানী। সে সময়কার ছবিগুলো দেখলে আজও তিনি নীরব হয়ে যান।
দেশের জন্য মাইনুল যখন রণক্ষেত্রে তখন তার পরিবারের দিকে চোখ পড়ে রাজাকারদের। ঘটে আরেক ঘটনা। ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে শান্তিবাহিনী ও রাজাকাররা আর্মি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় তার বাবাকে। নানাভাবে তারা পাশবিক টর্চার করে তাকে। বাবার কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন এই সূর্যসন্তান। বলেন- “স্বাধীনের পর আমার বন্ধুরা ফিরে আসে গ্রামে। বাবা-মা ভেবেছিল আমি মরে গেছি। আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে বাবা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় বাবাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছিল রাজাকারেরা। স্বাধীনের পরও বাবার অনেক কষ্ট গেছে। যখন ফিরে আসি তখন চার-পাঁচ বছর কিছুই করতে পারতাম না। বাবাই পাশে থেকে আমার সেবা করতেন। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আত্মত্যাগও কম ছিলনা। অথচ সে ইতিহাসটা কোথাও লেখা হয়নি।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হক বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এদের বিচার করা উচিত ছিল। তাহলে এদের বিচার নিয়ে জাতিকে আর বিভ্রান্তিতে পরতে হত না। বঙ্গবন্ধু বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাকেও সপরিবারে হত্যা করা হলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিবর্তে জিয়াউর রহমান তাদের পুনর্বাসিত করেছেন। এভাবে বিএনপি-এর হাত ধরেই যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারেরা তিলে তিলে তাল হয়ে উঠে। ফলে রগকাটা, গ্রেনেড মারার সংস্কৃতিও চালু হয় এদেশে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো সাহসী কাজের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হক ধন্যবাদ জানান বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি মনে করেন এ সরকার থাকলেই মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হন। শেখ হাসিনার সরকারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে মনে করেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধের পরপরই চূড়ান্ত করা দরকার ছিল বলে মত দেন মাইনুল হক। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “তালিকার কথা উঠলে তো লজ্জায় মুখ লুকাই ভাই। এখন বেয়াল্লিশ বছর বয়সী লোকও সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলে- আমি মুক্তিযোদ্ধা। এই তালিকা আর না বাড়িয়ে সরকারের উচিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাসকে ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা?
খারাপ লাগে কখন?
“যখন এদেশে পাকিস্তানি অনুসারী ও রাজাকাররা মন্ত্রী হয়েছিল, তাদের গাড়িতে যখন লাল-সবুজের পতাকা উড়তো- তখন খুব কষ্ট পেতাম। ওটা ছিল আমাদের পরাজয়। মুক্তিযুদ্ধকে অনেকে বলে গণ্ডগোল। স্বাধীনতাটাই তখন অর্থহীন মনে হয়। গণ্ডগোল নয় হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ”- ক্ষোভের সঙ্গে বলেন তিনি।
আমাদের সঙ্গে কথা হয় মাইনুল হকের ছেলে ইকরামুল হক মৃদুলের।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইকরামুল বলেন- “বাবা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন। আমরা তাই গর্বিত। তিনি সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা সব সময় চিন্তা করতেন। বাবার মতো আমিও মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।”
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মৃদুল। রাজনীতি প্রসঙ্গে অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি।
তার ভাষায়- “দলের ভেতরের ঘরটা ঠিক না হলে তো দেশ এগোবে না। যারা ত্যাগী, দলের অসময়েও পাশে ছিলেন, রাজনীতিতে তাদেরকেই মূল্যায়ন করতে হবে। যারা গরম ভাত খেয়েই সরে পড়েন তাদের নেতা নির্বাচন করলে দল মহাবিপদের মধ্যে পড়বে। দলের নাম ভাঙিয়ে যারা চাঁদাবাজি করছে, যারা বিএনপি আর জামায়াতের রাজনীতি থেকে দলে এসে ঢুকছে- তাদের নিয়ে সোনার বাংলা গড়া যাবে না।”
জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ হলে এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হক। তবে দেশটাকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে হলে তরুণ প্রজম্মকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের নানা সমস্যাকে অতিক্রম করে এ প্রজম্ম দেশটাকে একদিন অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে- এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাইনুল হকের। তিনি মনে করেন, তারা দেশের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখবেন দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের লোকেরা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারবে না। কেননা ইতিহাস বিকৃতি ঠেকাতে সজাক থাকবে পরবর্তী প্রজন্ম।
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাইনুল হক।
ট্রেনিং: দেড় মাসের ট্রেনিং নেন ভারতের আসাম মেঘালয় প্রদেশের তেলঢালা নামক জায়গায়। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৫৮৬।
যুদ্ধ করেন : প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে এগার নম্বর সেক্টরের কামালপুরে তিনি যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধাহত : ১ আগস্ট ১৯৭১। প্রথম প্রহরে। কামালপুরে রক্তক্ষয়ী অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারী ও গুলির আঘাতে তার ডান পা ভেঙে সামনে চলে আসে, পায়ের মাংস ছিঁড়ে যায় এবং বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের মাংসও উপড়ে পড়ে।
(ইন্টারভিউটি নেওয়ার কিছুদিন পরেই মর্মান্তিক এক সড়ক দুঘটনায় মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মাইনুল হক। তাই দেশ নিয়ে তাঁর বলা সর্বশেষ কথাগুলোই ইতিহাস হয়ে থাকলো।)
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১২জানুয়ারি ২০১৮
বই সংবাদ:
এই লেখাটিসহ আরও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসীক কাহিনি নিয়ে সময় প্রকাশন ‘১৯৭১: রক্তমাখা যুদ্ধকথা’ নামক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি আকরগ্রন্থ প্রকাশ করছে। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় গ্রন্থটি পাওয়া যাবে সময় প্রকাশনের প্যাভেলিয়নে।
© 2018, https:.