আদিবাসী

ত্রিপুরা বিয়ে: মদের বোতল শৌর্য-বীর্য ও শক্তির প্রতীক

টিপ্রা কথাটি এসেছে ত্রিপুরা শব্দটি থেকে। বিষ্ণুপুরাণে কিরাত ভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিপুরা নামে এক ব্যক্তি ওই কিরাতভূমিতে রাজত্ব করতেন। তাঁর নামানুসারেই ত্রিপুরারাজ্যের নামকরণ হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। ত্রিপুরা ভাষায় টুই অর্থ পানি এবং প্রা অর্থ আধিপত্য। পার্বত্য ত্রিপুরা পূর্বে ছিল পানিদ্বারা বেষ্টিত। এখানে যারা আধিপত্য করত তাদের বলা হতো টুইপ্রা। গবেষকরা মনে করেন এই টুইপ্রা শব্দটিই কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে টিপ্রা হয়েছে।

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে ত্রিপুরাদের বসবাস রয়েছে। এদের ৩৬টি গোত্রের মধ্যে এ দেশে বসবাস করছে চৌদ্দটির মতো গোত্র। যেমন : দেনদাউ, গাবিঙ,খালি, নাইতুঙ,ফাদুঙ,হারবাঙ, পুরাণ, কেওয়া, ওসই, কেমা, রিয়াং, মাইপালা, আসলং, নবতিয়া। ত্রিপুরা সমাজে পিতার পরিচয়েই সাধারণ সন্তানের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। তবে কোনো কোনো গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হয়।

এদের একই গোত্রে বিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। গোত্র মিলিয়ে তারা বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে। যেমন : পুরাণ গোত্রের সঙ্গে রিয়াং, রিয়াং গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, নবতিয়া গোত্রের সঙ্গে ওসই, ওসই গোত্রের সঙ্গে পুরাণ, ওসই গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, পুরাণ গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, রিয়াং গোত্রের সঙ্গে পুরাণ, ওসই গোত্রের সঙ্গে রিয়াং। যেসব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিয়ে নিষিদ্ধ থাকে সেগুলো হচ্ছে— ১. আপন ভাইবোন; ২. আপন খালা, চাচা-চাচি, মামা-মামি; ৩. আপন খালাতো ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন, মামাতো ভাই বোন এবং ৪. সৎ মা, সৎ ভাইবোন ইত্যাদি।

ত্রিপুরা আদিবাসী সমাজে সাধারণত দুই ধরনের বিয়ে রীতির প্রচলন রয়েছে। যেমন— হিকনানানী বা গন্ধর্ব বিয়ে এবং কাইজগন্নী বা প্রাজাপত্য বিয়ে। এ ছাড়া এদের গোত্রভেদে বিভিন্ন বিয়ে আচারের প্রচলন রয়েছে।

বর-কনে পরস্পরকে ভালোবেসে পছন্দ করে যে বিয়ে করে তাকে হিকনানানী বা গন্ধর্ব বিয়ে বলা হয়। এই বিয়েতে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা বা উৎসবের প্রয়োজন হয় না। পরস্পরকে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে গ্রহণই একমাত্র আনুষ্ঠানিকতা। তবে বিয়েতে অনেক সময় অভিভাবকদের অনুমতি থাকে না। বিয়ের পর নবদম্পতিকে সমাজে ফিরতে হলে গ্রাম প্রধানের অনুমতি নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করতে হয়। তবে সবার জন্য এই ভোজের বাধ্যবাধকতা নেই।

আবার পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী পাত্রপাত্রী নির্বাচনপূর্বক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে কাইজগন্নী বা প্রাজাপত্য বিয়ে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। আদিতে অভিভাবকের মাধ্যমে বর-কনে ঠিক হয়ে গেলে নির্দিষ্ট একটি দিনে বরের কয়েকজন বন্ধু বরকে দুবোতল মদ ও কিছু পান-সুপারিসহ শ্বশুড়বাড়িতে রেখে আসত। ওখানে বর দুবছরের জন্য শ্বশুড় পরিবারের সদস্য হিসেবেই থেকে যেত। এ সময় তাকে জমিতে কাজকর্ম করে প্রমাণ করতে হতো ভবিষ্যতে সংসারজীবনে সে সমর্থ কি না। শ্বশুড়বাড়ি থাকাকালীন তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে থাকার অধিকার পেত। কিন্তু বর্তমানে ত্রিপুরা সমাজে এ বিয়ে প্রথার প্রচলন একেবারেই দেখা যায় না।

বর যদি কনে পক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে কনের বাড়িতেই বিয়ে সম্পন্ন করে এবং ঘরজামাই হিসেবে শ্বশুড়বাড়িতে বসবাস করে তবে ওই বিয়েকে কাইজালাই কুসুর বিয়ে বলে। আবার কোনো কনে বিয়েতে রাজি না হলেও জোরপূর্বক তাকে তুলে এনে তিনজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে যে বিয়ে সম্পন্ন হয়, সেটিও কাইজালাই কুসুর বিয়ে। তবে আধুনিক ত্রিপুরা সমাজে এ ধরনের বিয়েরও এখন তেমন প্রচলন নেই।

ত্রিপুরা সমাজে বিয়ে রীতিতে ঘটকের মাধ্যমে প্রাথমিক আলোচনা করা হয়। এরপর বরপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য দুবোতল মদ, এক জোড়া নারকেল, এক পণ সুপারি, দুই বিড়া পান সঙ্গে নিয়ে কনের বাড়ি যেতে হয়। কনে পাড়ার মুরুব্বীদের জন্যও এক বোতল মদ সম্মানী হিসেবে নেওয়া হয়। কিন্তু এ সময় বরপক্ষ সরাসরি কোনো বিয়ের প্রস্তাব তুলে না। কনেপক্ষও সরাসরি সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশ করে না। সব কথাই হয় রূপক অর্থে। বরপক্ষের প্রস্তাবে মেয়ের বাবা সম্মতি প্রকাশ করলে বরপক্ষকে দ্বিতীয়বার আরো বেশি পরিমাণ মদ ও উপহার নিয়ে কনেপক্ষের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। ওইদিন বিয়ের দিনক্ষণ ও পণ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সব বিষয়ে আলোচনা করে নেয় ত্রিপুরা আদিবাসীরা।

বিয়ের দিন কনেবাড়ি যাত্রার আগে কাথারক দেবতার পূজা ও ভোগ দেয় এরা। এ পূজার আচার হিসেবে বরের বাড়ির উঠানে বাঁশের বেদী সাজিয়ে সেখানে একটি মোরগ ও একটি মুরগি বলি দিয়ে দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করা হয়। কনে বাড়িতে পৌঁছানোর পর কনেপক্ষের যুবতী ও কিশোরীরা মাথায় বোতল ও প্রদীপ জ্বেলে ভরা কলসির ওপর থালায় দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় কাথারক নৃত্য পরিবেশন করে। অতঃপর একটি কুলায় ঘট বসিয়ে তাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে হাত পাখার বাতাস দিতে দিতে কনের বাবা-মা বরযাত্রীদের বরণ করে ঘরে তোলেন। অতঃপর কনের জন্য আনা বিয়ের কাপড় ও জিনিসপত্র সবার সামনে খোলা হয় এবং সবার আশীর্বাদ নেওয়া হয়।

বিয়েতে কনের বাড়ি ও দরজার দুই পাশে দুটি কলাগাছ পুঁতে দুটি ঘটে আমপাতা ও সিঁদুর এবং নানা রঙের কাগজের ঝালর কেটে সাজানো হয়। একইভাবে সাজানো হয় গেট ও মণ্ডপ। এরপর বিয়ের বেদীতে বসানো হয় বরকনেকে। কনে বসে বরের বামদিকে। বিয়ের কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব থাকে একজন বিশুদ্ধ নারীর। যিনি বিয়ের আগে বিশুদ্ধ যুবতী ছিলেন এবং বিয়ের পর বিধবা হননি। এ ছাড়া বিয়েতে দুজন বালককে বরের সঙ্গে এবং দুজন বালিকাকে কনের পাশে বসানো হয়। তাদের সামনে রাখা হয় আমপাতায় সিঁদুর দেওয়া জলভরা ঘট, কিছু চাল ও কার্পাস তুলা, অচাই বা পুরোহিতের জন্য এক বোতল মদ। একটি পাত্রে থাকে ভাতের দলা ও রান্না করা দুটি মুরগির রান। এ ছাড়া বর-কনের সামনে দুটি বাঁশের চোঙায় একটিতে পানি ও অপরটিতে মদ রাখা হয়।

প্রথমে বরকনেকে একটি চাদরে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরোহিত লামপ্রা দেবতার উদ্দেশে মোরগ ও হাঁস বলি দিয়ে শুরু করেন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর তিনি চাল ও তুলা হাতে চোঙা থেকে সামান্য পানি নিয়ে চন্দ্র, সূর্য, গঙ্গা ও বসুমতিকে স্মরণ করে সবাইকে সাক্ষী রেখে সাত পাক ঘুরিয়ে পানি, চাল ও তুলা বর-কনের মাথার ওপর ছিটিয়ে দেন। ত্রিপুরারা বিশ্বাস করে বর-কনের বিয়েতে যদি কোনো বাধা-বিপত্তি থাকে তবে ওই আচারের মাধ্যমে তা দূর হয়ে যায়। অতঃপর বরের কোলে কনেকে বসানো হয়। পুরোহিত তখন উভয়ের দীর্ঘায়ু ও সুখী হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার পানি, চাল ও তুলা তাদের মাথায় ছিটিয়ে দেন এবং পিতামাতার নাম উল্লেখ করে বরকনের দুদিকের চাদরের কোণা একত্রে বেঁধে দেন। তখন উপস্থিত প্রবীণদের মধ্য থেকে তিন বা সাতজন চাল ও তুলা হাতে তাদের আশীর্বাদ করলেই বিয়ের আনুষ্ঠানিক কাজ সমাপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। সাথে সাথেই বরকে কনের কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর দিতে হয়। অতঃপর কনে মদের অর্ধেক পান করার পর বাকি অর্ধেক বরকে পান করিয়ে দেয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে নব দম্পতি সবার সামনে তাদের ভোজন পর্ব শেষ করে এবং সবার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। এ পর্বটিকে ত্রিপুরারা যাগ সংগীই মাই চানাই বলে থাকে। বিয়েতে ত্রিপুরারা গান গায়—

‘ডারামায় থায়চুমু হালাপ বারা অ বরোই

ঘালাপ বারা অ থায়ৈ।

ববার সিকলা কানলিআ

বাথাই চেরাওক রাওক থুংলিআ।

লামানি বোর্কুংগ থায়তালাই

ববার সিকালা কান্ খামো

বথার চেরাওক রাওক থুংখামো।’

ভাবার্থ

কেন ফুল ফোটে এই বনের বাগানে

এখানে আসে না কেউ সে ফুল খোঁপায় গুঁজে নিতে,

সেই কথা কেউ কভু জানে?

যে ফুল ফুটে না এই মনের বাগানে

যে ফুল জানে না হায় আমার প্রেমের কোনো মানে-

কী লাভ সে ফুল দিয়ে, যে ফুল একাকী ঝরে যায়

যদি বা ফুটত ফুল আমার প্রিয়ার বাগিচায়

তবে সে গুঁজত ফুল কী উল্লাসে আপন খোঁপায়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button