গোখরা সাপের পেটে ব্যাঙের জন্ম হয় না
নিজের শরীরের সঙ্গে এখনও যুদ্ধ করছেন এক মুক্তিযোদ্ধা। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। দুচোখ নেই তাঁর। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশকে অনুভব করেন অন্যভাবে। স্বাধীন দেশের পতাকা, দেশের উন্নয়ন, মানুষের আনন্দ-বেদনার মুখগুলো মনের পটে ছবি এঁকে নেন তিনি।
একাত্তরে তাঁর ডান হাতটি কনুইয়ের নিচ থেকে উড়ে গেছে। হাতের মাংস বিশেষভাবে আঙুলের মতো কেটে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ডাক্তাররা। মাইনের গ্যাস ঢুকে দুটি চোখই তাঁর অকেজো। তাই নিজ চোখে দেখতে পাননি স্বাধীনতার লাল সূর্যটা। তবুও আফসোস নেই। ওই চোখে তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন, শুনেছেন তাঁর বজ্রকণ্ঠের সাত মার্চের ভাষণটি।
স্বাধীন দেশে জীবনের হিসেব মিলে না এ যোদ্ধার। দেশের স্বাধীনতার জন্য দুই চোখ হারালেও মানুষ এখন বিদ্রুপ করে তাঁকে ‘কানা’ ডাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘বীর’ সম্বোধন করে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন দুই হাজার টাকা। তাঁর চোখের আলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিদেশেও। কিন্তু তবুও চোখ ফিরে পাননি। এখন তাঁর সারাটা দিন কাটে অন্যের সাহায্যে। মন থেকে তা মেনে নেওয়া কষ্টকর।
দেশের স্বাধীনতার জন্য মেনে নিয়েছেন পরাধীনতার জীবন। তাঁর জীবনযুদ্ধ যেন দুঃখ আর ক্ষোভের ইতিহাস। বয়সের সঙ্গে মানসিক চাপ আর কষ্ট বাড়ছে অবিরত। নিজের সঙ্গে নিজের এ যুদ্ধ চলবে মৃত্যু অবধি। তাই এ যোদ্ধার দৃষ্টিহীন চোখে অশ্রুবৃষ্টি ঝরে প্রতিদিন। স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পর কার কাছে বলবেন মনেচাপা কষ্টের কথা?
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের খবরটি জানান তাঁরই এক সহযোদ্ধা। আগ্রহী হতেই ঠিকানাটিও জানিয়ে দেন। অতঃপর এক সকালে পা রাখি রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডার ক-১৭১ নম্বর বাড়িটিতে।
আব্দুর রশিদ ও হালিমা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান আব্দুর সাত্তার। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী, পাবলিক হেল্থ ইনস্টিটিউটের অ্যাকাউন্টেন্ট। সাত্তারের জন্ম ঢাকার মহাখালিতে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ভোলা প্রাইমারি স্কুলে। পরে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই ক্লাস টেইনের ছাত্র।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ফুটবল খেলতেন, বাড্ডার আলাতুন্নেছা স্কুল মাঠে। বন্ধু বজলুর রহমান, নুর ইসলাম ছাড়াও বাড্ডার ওসমান কমিশনারও ছিলেন খেলার সাথী। তখন সাত্তার ফাইভে পরেন। বনানী পানির ট্যাংকির মাঠে স্কুল পর্যায়ের খেলা হচ্ছিল। সেখানে ভোলা স্কুল টিম চ্যাম্পিয়ন হয়। কাপ নিয়ে ফিরছে সবাই। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়িতে কিছু বলে আসেনি সাত্তার। মনে অজানা ভয়। বাবার কাছে মার খাওয়া ছাড়া গতি নেই। ছেলের জন্য তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন দক্ষিণ বাড্ডা বাজারের কাছে। অতঃপর কী ঘটল? শুনি সাত্তারের জবানিতে।
“আমি তো ভয়ে আছি। সঙ্গে হেড মাস্টার সাহেব। উনি আব্বাকে দেখেই বললেন- ‘আপনার ছেলে খুব ভাল খেলছে। গোলও করেছে। স্কুলের সুনাম বাড়াইছে।’ সবার মুখে প্রশংসা শুনে আব্বাও মুচকি হেসে বললেন, বলে যাসনি কেন!”
ছোটবেলার নানা স্মৃতির কথা তুলে ধরেন সাত্তার, “মানুষ তখন অনেক বিলাসী ছিল না। আব্বাকে দেখেছি ভাল কাপড় ধুয়ে খারাপটা পড়ে ঘুমাতেন। আমরা সেটা দেখেই শিখছি। এখন তো ওই সময় নাই। শিক্ষকরা তখন অন্যরকম ভাল ছিল। মন উজার করে তারা ছাত্রদের শিখাতেন। প্রাইভেট পড়ার বিষয় ছিল না। বাসায় ইংরেজি পেপার রাখা হতো। আমরাও ইংরেজিতে ভাল ছিলাম। এখন ইংরেজি মানেই ভয়ের ব্যাপার।”
“পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ছিলেন মোনায়েম খান। আমাদের স্বাধীনতারও বিরোধী তিনি। তার একটা বাড়ি ছিল গুলশান এক নম্বরে। বাড়ির গেইটের দুইদিকে লাইটপোস্ট। গেইটে ইংরেজি ও উর্দুতে লেখা থাকতো নাম। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতেই মোনায়েম খানের বাড়িতে ঢিল ছুড়তেন সাত্তাররা। এর নেতৃত্বে ছিলেন বাড্ডার ওসমান গনি, বজলুর, হাবিব ও সাচ্চা ভাই।
সাত্তারের ভাষায়, “উনি তো পাকিস্তানের দালাল। রাস্ট্রভাষা বাংলারও বিরোধী ছিল। তাই ফেব্রুয়ারি আসলেই আমরা দলবেঁধে বেরুতাম। রিক্সা ছিল। তবুও রাগে আর ঘৃণায় ওই বাড়িতে ঢিল মেরে লাইটপোস্ট ভেঙে দিয়ে আসতাম। এখন শুনি তার নাতিদেরকে (জোবায়ের ও তারেক আহমেদ আদেল) হকি ফেডারেশনের কমিটিতে নেওয়া হয়েছে। এ কোন দেশ স্বাধীন করলাম ভাই! একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আর দালালদের রক্তের মানুষদের কি আওয়ামী লীগ চেনে না! আমার না হয় চোখ নাই। কিন্তু এ সরকারের চোখও কি নষ্ট হয়ে গেছে?”
ছোটবেলায় সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না সাত্তার। পলিটেকনিক স্কুলে আসতো ছাত্রনেতারা। আ স ম আব্দুল রব, নুর আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদরা বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। স্কুল শেষে মিছিলেও যেতেন সাত্তার। কণ্ঠে স্লোগান তুলতেন, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সময় সাত্তার ছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। সেদিনের অনুভূতি জানাতে তিনি বলেন, “গুলিস্থান সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়ে ৭ মার্চের কর্মসূচীর পোস্টার ও দেয়াল লিখন দেখি। ওইদিন রামপুরা দিয়ে হেঁটে গিয়েছি রেসকোর্সে। তখন দুুপুর বেলা। লাখো মানুষ। হাতে হাতে লাঠি। বিকেলের দিকে ভাষণ দিলেন শেখ মুজিব ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমাদের অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো… আমি যদি হুকুম দেবার না পারি…মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি , রক্ত আরও দেব…’। এই কথাগুলোতে মনে ঝড় ওঠে। ঠিক থাকতে পারি না। মানুষের মনের কথাগুলোই উচ্চারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মুখে। ভেবেছিলাম ওইদিনই যুদ্ধ লাগবে।”
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে বাড়ি থেকেই গোলাগুলির শব্দ পান সাত্তাররা। ভয়ে সবাই তটস্থ। দুদিন পরেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরে আসেন তাঁর বড় ভাই আব্দুর রহিম। ১ এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা খুব ভোরে ঘেরাও করে মধ্যবাড্ডা আর দক্ষিণ বাড্ডায়। এরপর কী ঘটেছিল ওইদিন?
সাত্তার বলেন, “ওদের সঙ্গে ছিল বাড্ডার বিহারীদের একটি দল। তখন বসতি ছিল খুব কম। ওরা বাড়ি বাড়ি যায়। ওগো দেখে আমি সিলিংয়ের ওপরে লুকিয়ে থাকি। আব্বা উচ্চকণ্ঠে কোরআন পড়ছিলেন। কিন্তু সেটাও থামিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। বলে- আজআও, আজআও, কিতাব বনকরকে আজআও।”
“আব্বার সঙ্গে বড় ভাইকেও তুলে নিয়ে রাখে সুটিং পার্কের পাশের ফাঁকা জায়গায়। শত শত মানুষ। বয়স্ক বেশি। চারদিকে এলএমজি ফিট করা। নাওয়া-খাওয়া নাই। পানি দিলে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। দূর থেকে আমরা তা দেখি। বিকেলের দিকে ‘ভাগো’ বলেই সবাইরে ছেড়ে দেয় ওরা। আব্বা আর ভাইরে পেয়ে আমরা যেন জীবন ফিরে পেয়েছিলাম!”
এরপরই কি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন?
“না, আমরা তখন হুজুগে বাঙালি না। ওরা মারছে তাই আমগোও মারতে হইব। আমাদের তো দর্শন তেমন ছিল না। আমগো বাড়িতে মাঝেমধ্যে আর্মি আসতো। ফুটবল খেলতাম। পায়ে-হাঁটুতে দাগ ছিল। ওরা মনে করতো ট্রেনিং নিছি। বলতো, ‘তুম মুক্তি হ্যা।’ অনেককে ধরে মারছে। অনেককে নিয়া মাটি কাটাইছে। বাড্ডাতে পরিচিত অনেক বিহারী ছিল। ২৫ মার্চের পর ওরা আমগো দিকে চোখ বড় করে তাকাতো। গালাগালি করতো। সহ্য করতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কথা মনে পড়ত। তখনই সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার।”
ট্রেনিংয়ে নিলেন কোথায়?
“জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আব্বা বেতন পেয়েছেন মাত্র। পকেট থেকে চুরি করে ৫০ টাকা নিয়েই ঘর ছাড়ি। আজিজ নামে এক বন্ধু ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। এ খবর দেন বজলু ভাই। আগেই প্ল্যান ছিল। খুব সকালে বের হই নৌকায়। রাজাকারদের পাহারা ছিল সাতারকুলে। তাদের চোখ এড়িয়ে প্রথমে কাঠালদিয়া ও বেরাইদ হয়ে চলে আসি আজিজদের ক্যাম্পে। ওখানে আউয়াল কমান্ডার আমাদের কয়েকজনকে দুই সপ্তাহ ট্রেনিং করান। স্টেনগান, থ্রি নট থ্রি আর গ্রেনেড মারা শিখি। ট্রেনিংয়ের জায়গাটা ছিল রূপগঞ্জ থানায়। পরে আউয়াল কমান্ডারের আন্ডারে অপারেশন করি দুই নম্বর সেক্টরের ডেমরা, রামপুরা টিভিস্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়।”
একাত্তরের এক অপারেশনের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার।
তাঁর ভাষায়, “অক্টোবর মাসের ঘটনা। রামপুরা টেলিভিশন ভবন থেকে চৌধুরী পাড়ার দিকের রাস্তায় ছিল হাবীব ব্যাংক। সে ব্যাংকে অপারেশন করতে হবে। আমরা ১০-১২জন। কমান্ডে আউয়াল সাহেব। ৫ জন বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করবে। আমরা ব্যাকআপে।
টেলিভিশন ভবন পর্যন্তই তখন রাস্তা ছিল। বাকিটা পুরো বিল। আমরা নৌকা নিয়ে আসি। হাবীব ব্যাংকের পেছন দিয়ে এসে সামনে এগোই। দাড়োয়ানের হাতে বন্দুক। তাই পরিকল্পনা ছিল প্রথম তাকেই নিরস্ত্র করতে হবে। কিন্তু গুলি করা যাবে না। কারণ টেলিভিশন ভবনের ওখানেই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের বড় ক্যাম্প। ওরা টহল দিতো নিয়মিত।”
“পরিকল্পনা মতো আলাউদ্দিন, এ কে এম হাবীব, হাবিবুর রহমান সাচ্চাসহ পাঁচজন ব্যাংকে ঢোকার আগেই দূর থেকে দাড়োয়ান বুঝে ফেলে। ওরা ঢুকতেই সে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আলাউদ্দিন। বাকীরাও গুলি করতে করতে পিছু হটে। গুলির শব্দে আর্মিরাও ছুটে আসে। আমরা তখন চারপাশ থেকে একত্রিত হয়ে নৌকা দিয়ে সরে পড়ি।
সেদিন আলাউদ্দিনের লাশটা আনতে পারিনি। মুক্তিবাহিনীর পরিণতি দেখাতে আর্মিরা ওর পা জিপের সঙ্গে বেধে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মৌচাক পর্যন্ত। ওর কথা মনে হলে কষ্টে এখনও বুকটা চেপে ধরে।”
কোন অপারেশনে আহত হলেন? প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা নিরবতা নামে। অতঃপর
মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার বলেন সেদিনের আদ্যপান্ত- “মধ্যবাড্ডার পূর্বদিকে পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে সাতারকুলের রাস্তায় নিয়মিত টহল দিত পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকাররা। ওই রাস্তায় রাতের অন্ধকারে মাইন ফিট করতে হবে। এটাই ছিল পরিকল্পনা। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা তখন কায়েত পাড়া ক্যাম্পে। সন্ধ্যা হয় হয়। অপারেশনে বের হবো। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমান্ডার আউয়াল পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমি মাইন নিতে গেলেই ঘটে ভয়াবহ ঘটনা। মাইনে ডেটোনেটর থাকে। সেটা সরিয়ে চাপ দিলেই বিস্ফোরণ ঘটে। মাইন তুলতে গিয়ে কীভাবে যেন সেটি ধুম করে বিস্ফোরিত হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ছিটকে পড়ি দূরে।”
“দেখলাম ডান হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে উড়ে গেছে। চোখে গ্যাস ঢুকতেই সব আলো নিভে যায়। ওই সময় থেকেই অন্ধ আর জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই। স্থানীয়ভাবে হাতের চিকিৎসার পর ১৭ ডিসেম্বর সহযোদ্ধারা আমাকে নিয়ে আসে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে এবং পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।”
“সেখানে ডা. আর জে গাস্ট অপারেশন করে হাতের মাংস কেটে আঙুলের কাজ করানোর ব্যবস্থা করে দেন। পরে চোখের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাঠানো হয় রোমানিয়া ও জার্মানিতে। কিন্তু চোখের আলো আর ফিরি আসেনি। চলছি অন্যের সাহায্যে। আব্বা আর বড় ভাইয়ের সাহায্য না পেলে বেঁচে থাকতেই পারতাম না। এখন সবসময় পাশে থাকে স্ত্রী রুবিনা। একজন অন্ধ মুক্তিযোদ্ধাকে বিয়ে করে সেও আরেক মুক্তিযুদ্ধ করছে।”
যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
“দেশ তো স্বাধীন। পতাকা পেয়েছি। রাষ্ট্র পেয়েছি। স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি। সকল জায়গাতেই আমার দেশের মানুষ। কিন্তু সোনার বাংলা এখনও হয়নি।”
স্বাধীন দেশে কষ্টের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই বীর যোদ্ধা।
অতঃপর কষ্ট নিয়ে বলেন, “আফসোস নাই কোনো। সুখ হলো বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছি। কষ্ট হলো দেশের স্বাধীনতা নিজ চোখে দেখতে পারি নাই। তার চেয়েও বড় কষ্ট স্বাধীন দেশে মানুষ এখন দেখলে ‘কানা’ বলে। এটা তো ভাবি নাই ভাই। এখন তো সরকার অনেক ভাতা দিচ্ছে। তাই ভালভাবে খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু চোখ ও হাত তো ফিরে পাব না। সেটা চাইও না। মনের চোখ দিয়ে এখন দেশকে দেখি।”
রাজাকারদের গাড়িতে যখন স্বাধীন দেশের পতাকা উড়েছে তখনকার কথা অকপটে বললেন মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার। তাঁর ভাষায়, “কষ্ট লাগছে তখন। এ জন্য তো দেশ স্বাধীন করি নাই। স্বার্থের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই তখন ওগো পক্ষে চলে গেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে মারবে আর রাজাকারদের গাড়িতে লালসবুজের পতাকা উড়বে, এটা কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মেনে নিতে পারে না।”
তিনি আরো বলেন, “রাজাকার, আলবদর, আলশামসের লোকেরা ছিল বলেই একাত্তরে এতো গণহত্যা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা না থাকলে ওরা আরও মানুষ মারত। তখন মাদ্রাসার ছাত্র ও হুজুরেরা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। রাজকারদের বিচার তো বঙ্গবন্ধুই শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে সেটা বন্ধ করে দেয়। আজ বঙ্গবন্ধুর মেয়ে ক্ষমতায় না থাকলে রাজাকারদের বিচার এখনও হতো না। শেখের মেয়ে ইতিহাসের অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। জঙ্গিবাদের পক্ষে স্বাধীনতার বিপক্ষ চক্রের ইন্ধন আছে।”
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার পর কেন জঙ্গিবাদ শুরু হয়েছে- প্রশ্ন রেখে সাত্তার বলেন, “দেশ স্থিতিশীল থাকুক এটা পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষরা চায় না। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। ধর্মের ব্যাপারেও তারা বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। তাই জঙ্গিবাদের উত্থান এখানে হবে না। তবে এটা মোকাবেলা করতে ঘরে ঘরে সর্তক থাকতে হবে। মুসলমান হয়ে বোম ফাটিয়ে মারছে নিরীহ মুসলমানকে। জঙ্গিদের এটা কোন ধর্ম!”
দেশ কেমন চলছে?
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের উত্তর, “সার্বিকভাবে দেশ ভাল চলছে। তবে জিনিসপত্রের দামে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। দুর্নীতি বেড়েছে অনেক। আগে চাকুরিজীবীরা সহজসরল জীবনযাপন করতো। এখন তো কেউ বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হলেই তার ভাব থাকে আলাদা। সময় অনেক বদলেছে। এখন ওই ভাব থাকলে কাজের কাজ হবে না। সরকারকেও কঠোর হতে হবে। সৎ লোককে যোগ্য জায়গা দিতে হবে। সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে এগিয়ে যাবে দেশ। শেখ হাসিনা সরকার চেষ্টা করছে অনেক। তারা কী কী ভালো কাজ করেছে সেটাও মানুষ অবশ্যই মনে রাখবে। পৃথিবীতে ভালটাই বেঁচে থাকে।”
রাজনীতির কথা উঠতেই এই বীর যোদ্ধা অকপটে বলেন, “গোখরা সাপের পেটে কিন্তু ব্যাঙের জন্ম হয় না। সাপের পেটে সাপই হয়। তাই রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধী ও দালালের বংশধরদের স্থান দিলে তা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের মৃত্যু ডেকে আনবে। এ বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে। নেতা হলেই কোটিপতি বনে যায় কীভাবে? দলীয় লোকদের দুর্নীতি ও অপরাধের কঠোর সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই দেখবেন রাজনীতিতে ভালদের অংশগ্রহণ বাড়বে।”
সব বাঁধাকে পেছনে ফেলে পরবর্তী প্রজন্ম একদিন এ দেশকে অনেক এগিয়ে নিবে- এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন ইতিহাস গড়ার তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “তোমরাই আমার চোখের আলো। যা আমি হারিয়েছি একাত্তরে। সে চোখ দিয়ে তোমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখো। দেশকে পেছনে ফেলে তোমরা এগোতে পারবে না। তাই এ দেশটাকে ভালবেসে তোমরাই সোনার বাংলা গড়ো।”
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার।
ট্রেনিং: রূপগঞ্জ এলাকায় দুই সপ্তাহ ট্রেনিং নেন আউয়াল কমান্ডারের কাছে।
যুদ্ধ করেন : দুই নম্বর সেক্টরের আওতায় ডেমরা, রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়।
যুদ্ধাহত: ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যায়। সাতারকুল অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় কায়েদপাড়া ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে তাঁর ডান হাত কনুইয়ের নিচ থেকে উড়ে যায় এবং চোখে গ্যাস ঢুকে দুই চোখও নষ্ট হয়।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
© 2018, https:.