খড়ি নাই, দেহও তাই পোড়াই না
উপজেলার নামটি কেন হালুয়াঘাট? তা জানতে বেশ পেছন ফিরে তাকাতে হয়। ১৬৫০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ের কথা। তখন দর্শা নামক নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সকল ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালুয়া অর্থ চাষি। হাল চাষিরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অর্থ দাঁড়ায় হালুয়াদের ঘাট। আবার অনেকেরই মত একেবারেই ভিন্ন। ঘাটটি হালুয়া নামক ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। নাম নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে নেই কোনো মতভেদ।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে সুমনা চিসিমদের বাড়ি। তার আমন্ত্রণেই এসেছি দিন দুয়েক আগে। মনছোয়া প্রকৃতি আর সবুজাভ দৃশ্যের পাশাপাশি ঘুরে বেরাচ্ছি আদিবাসী গ্রামগুলোতে। সকালে মোটরবাইক নিয়ে যথারীতি তৈরি চাষং। এই গারো যুবকটিকে নিয়েই ঘুরছি হালুয়াঘাটের আদিবাসী পাড়াগুলোতে। আজ আবারও যাব ডালু পাড়াতে। তেমনটাই পরিকল্পনা।
আকাশটা বেশ ফকফকে। কিন্তু শ্রবাণ মাস বলে কথা। কখনও মেঘ আবার কখনও বৃষ্টি। বৃষ্টি শুরুর আগেই আমরা বেড়িয়ে পরি। আচকি পাড়া থেকে কড়ইতলী বিজিবি ক্যাম্প হয়ে চলে আসি জয়রামকুড়ায়।
জয়রামকুড়ায়তেই ডালুদের পাড়াটি। এখানেই টিকে আছে আদিবাসী ডালুদের মাত্র বারটির মতো পরিবার। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন গোত্রের সবচেয়ে প্রবীণ লোকটি। নাম শুকনা ডালু। বয়স আশি। মাটি আর ছনে ছাওয়া একটি ঘর। গোবর-মাটিতে লেপে রাখা ঘরের বারান্দা। সেখানে মাদুর বিছিয়ে আমাদের বসতে দেয়া হলো। ঘরের ভেতরে নাতীকে নিয়ে ভাত খাওয়ায় ব্যস্ত এক বৃদ্ধা। শুকনা ডালুর বোন তিনি। নাম অমিও ডালু। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে আমাদের স্বাগত জানালেন।
বাংলাদেশে বসবাসকারী ডালুরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস অতীতে ডালুদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল। সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর আগ্রাসনে সে ভাষা আর সংস্কৃতি আজ আর নেই। শুকনা ডালুর মতে, ‘মনিপুরী ডালুদের আসল ভাষা’।
ডালুরা বর্তমানে হিন্দু সনাতন ধর্মের পুরোপুরি অনুসারী। ফলে এ প্রজম্মের ডালুরা জানে না তাদের আদি দেবতাদের নাম। আমাদেরও প্রশ্ন ছিল ডালুদের দেবতাদের নিয়ে। উত্তরে শুকনা ডালু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন,‘কেড়েং-কুড়ি, পথ-খাওরি, হয়দৈব প্রভৃতি’। এদেশে ডালুরা কবে গ্রহণ করল সনাতন হিন্দু ধর্ম? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই জয়রামকুড়াতেই ডালুরা প্রথম সনাতন হিন্দধর্মের দীক্ষা নেয়। শুকনা ডালুর কথায় আমাদের চোখ ওঠে কপালে। তার মুখে শুনি ঘটনাটি।
ডালুদের হিন্দধর্ম গ্রহণের মূল কারণ ছিল পাগলপন্থিদের সংগ্রাম। করম শাহ ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এ অঞ্চলের আদিবাসী ও কৃষকদের মধ্যে পাগলপন্থার প্রচার শুরু করেন। কৃষকেরা এতে প্রবলভাবে সাড়া দিয়ে পাগলপন্থার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করম শাহের মৃত্যু হলে তাঁর শিষ্য টীপু গারো (টীপু পাগলা) পাগলপন্থিদের নেতা নির্বাচিত হন। টীপুর নেতৃত্বে কৃষকেরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিককার কথা। ব্রিটিশ সরকার ও জমিদার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। টীপু গারো ছিলেন এর মূল নায়ক। তিনি সে সময় গারোদের পাশাপাশি ডালুদেরকেও সংঘবদ্ধ করে তোলেন। টীপু গারোর নির্দেশ ডালুরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। তার নেতৃত্বে ডালুরাও ব্রিটিশদের অনুগত জামিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সে সময় জমিদারদের সাহায্যে এগিয়ে আসে ব্রিটিশ সরকার । আন্দোলন দমাতে তারা প্রথমেই বন্দি করে টীপু গারোকে। কথিত আছে, টীপু গারো বন্দী হওয়ার পূর্বে তিনি ডালুদের জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়ে যান। কি নির্দেশনা? শুকনা ডালু বলেন, ‘ডালুরা যেন হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নেন। সেটিও নিতে হবে- মানিকগঞ্জের উথুলী গ্রামের দীনেশচন্দ্র লাহিড়ীর কাছ থেকে।’ ডালুরা টীপুর কথামতো দীনেশচন্দ্র লাহিড়ীকে হালুয়াঘাটে আমন্ত্রণ জানায়। উনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে দীনেশচন্দ্র হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়ায় আসেন এবং ডালুদের সনাতন হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করেন।
মনমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম শুকনা ডালুর কথা। রুপালী ডালুর পায়ের শব্দে আবার খেয়াল ফিরে পাই। কোলে তার ছোট বাচ্চা। নাম প্রেমজিত ডালু। আমাদের চোখ পড়ে তার মাথায়। মাথার কিছু অংশে চুল যেন কাটা হয়নি। তা বেশ লম্বা হয়েছে সেটি। কি এটি? প্রশ্ন করতেই রুপালীর উত্তর, ‘মানতের টিক্কি’। ছোটবেলা থেকে খিঁচুনি হয় বলে সন্তানের জন্য মানত করেছেন রুপালী। ১৮ মাসের আগে এই টিক্কি কাটা হবে না। রুপালীর বিশ্বাস এখন তার সন্তান বেশ ভালো আছে। ডালুরা নবজাতক জন্মানোর পর পরই মা ও শিশুকে সবার নাগালের বাইরে রাখে। এগারো দিনের দিন বাড়িতে নাপিত ডেকে শুদ্ধি করানো হয়। নাপিত নবজাতকের চুল কেটে দেয় আর মা ওইদিনই সন্তানের মঙ্গলের জন্য সূর্যপুজা দেন। অতঃপর উভয়কে পরিষ্কার ঘরে তোলা হয়।
নবজাতককে দেখতে পাড়ার লোকেরা আসে বিকেলের দিকে। মুড়ি, বাতাসা ও পানসুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় তাদের। একমাস পর পরিবারের দাদা বা বয়ঃজ্যৈষ্ঠ ব্যক্তি নবজাতকের নাম রাখেন। এটি ডালুদের নিয়ম। নবজাতক যদি পুত্র সন্তান হয় তবে বার বছর পূর্ণ হলে আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ডালুরা সেটিকে ‘পৈতা নেওয়া’ বলে। ডালুদের বিয়ের নিয়মটি জানতে চাই রুপালীর কাছে। খানিকটা মুচকি হেসে তিনি জানালেন বিয়ের তথ্যগুলো। ডালুদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ নিতে হয় ছেলের মাকেই । তিনি বা মাতৃস্থানীয় কেউ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনসহ কনের বাড়িতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব করেন। ডালুরা একে বলে ‘বউজোড়া’।
কনের অভিভাবক বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হলে অন্য একদিন কনের বাড়ি উপস্থিত হন ছেলের বাবা। ছেলের বাবা কনের বাড়িতে যাওয়ার অর্থই হলো বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য্য হওয়া। সেদিন পণের বিষয়েও চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। বাঙালি সমাজে যৌতুকপথার প্রচলন থাকলেও ডালু সমাজে এখনও পণপ্রথা চালু রয়েছে। বিয়ের সবকিছু চুড়ান্ত হলে কনেপক্ষের লোকেরা সদলবলে ছেলের বাড়িতে আসে ছেলে দেখতে। এসময় ছেলেপক্ষ তাদের খুশি করতে সাধ্য মতো আপ্যায়ন করান। বিয়ের দিন ছেলের সামনে তারপক্ষের বয়ষ্ক কোন সধবা মহিলা কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরায়। এভাবেই শেষ হয় ডালুদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
পুজো নিয়ে আলাপ উঠতেই শুকনা ডালু বলেন তাদের আদি উপাস্য দেবতা বাস্তুদেবতার কথা। অগ্রহায়ণ মাসেই এরা সম্মিলিতভাবে ধুমধামের সাথে গ্রামের বাস্তুপূজা করে থাকে। হিন্দু ধর্মে দিক্ষা নিলেও ডালুরা এখনও এ আদি পুজোটি পালন করে থাকে।আর কি কি পুজো হয়? শুকনা ডালু বলতে থাকেন- শ্রাবণ মাসে হয় মনসা পুজা। মনসাদেবী ডালুদের কাছে সৌভাগ্যদেবী। পুজো ছাড়াও এ সময়টাতে এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে কীর্তনের আয়োজন করে থাকে। ডালুরা বিশ্বকর্মা পুজো করে ভাদ্র মাসের শেষ দিন । বিশ্বকর্মা হলো শ্রমজীবীদের দেবতা। এদিন লাঙ্গল কাঁচিসহ সমস্ত কৃষিযন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে দেবতার সম্মুখে উৎসর্গ করা হয়। আশ্বিন মাসে হয় দুর্গাপুজা। এ পুজার অনুষ্ঠান ঘট পূজার মাধ্যমে ডালুরা পালন করে থাকে। কার্তিক মাসে-শক্তিপুজা বা শ্যামাপুজা। অসংখ্য ছোট ছোট দীপ জ্বালিয়ে গোটা গ্রামকে আলোকিত করে রাখা হয় এ পুজায়। বলিও দেয়া হয় পাঁঠা।
আর কোন উৎসব আছে কিনা? জানতে চাইলে শুকনা ডালু মুচকি হেসে বললেন- কার্তিকের শেষ দিনে হয় আরেকটি উৎসব। কি এটি? এটি- মশা বিতাড়ন উৎসব। মশা যেন সারাবছর গরু- মহিষের ক্ষতি বা কামড়াতে না পারে সে কারণেই এ উৎসবের আয়োজন। ওইদিন সন্ধ্যায় যুবক- যুবতীরা মশাল জ্বালিয়ে গোটা ডালু গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। অতঃপর মশাল এনে নিভানো হয় প্রতি বাড়ির গোয়াল ঘরের পাশে।
আমরা ডালু পাড়াটি ঘুরে দেখতে চাই। শুকনা ডালুও উঠে দাঁড়ান। তিনি চলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। জানালেন, তার সমবয়সী কেউ আর জীবিত নেই। মৃত্যুর পর সবাইকেই দাহ করা হয়েছে। মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে দাহ করাই ছিল ডালুদের নিয়ম।
শুকনা ডালু দুঃখ করে বলেন, এক সময় মৃতব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও সমাজের লোকেরা কাঠ দিয়ে দাহকাজে সহযোগিতা করত। কিন্তু সেই নিয়মটিও এখন আর নেই। ডালুরা সকলেই এখন দরিদ্র। তাই কাঠ কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে অভাবের কারণে আজ পাল্টে গেছে ডালুদের আদি রেওয়াজটি। এখন মৃতদেহ কি করেন? এমন প্রশ্নে শুকনা ডালু নীরব হয়ে যান। অতঃপর মৃদুকন্ঠে উত্তরে বলেন, ‘অভাব, তাই দেহ মাটি চাপা দেই। খড়ি নাই, দেহও তাই পোড়াই না।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ মে ২০১৮
© 2018, https:.