চাকমাদের গেরিলা হামলা ও ইংরেজদের কৌশল
বিদ্রোহের ঘটনা জানার পর ইংরেজ শাসকরা ওই অঞ্চলে সামরিক অফিসারসহ একদল সেনা পাঠায়। চাকমারা তখন তীর-ধনুক ও বর্শা নিয়ে গেরিলা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ইংরেজ সেনাদল যখন আক্রমণ করতে আসত, তারা তখন গভীর পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে থাকত। আর সুযোগ বুঝে সমতলে নেমে এসে ইজারাদারদের ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালিয়েই সরে পড়ত। এ রকম গেরিলা আক্রমণের ফলে বহুদিন সেনারা তাদের কোনো নাগাল পায়নি।
ইংরেজ শাসকরা তখন নতুন কৌশল আঁটে। তারা জানত, তুলার বিনিময়ে চাল, লবণ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পাহাড় থেকে সমতলের বাজারে চাকমাদের আসতেই হবে। সুযোগ বুঝে ইংরেজরা তখন সমতলের বিভিন্ন বাজারে সেনাদের পাহারা বসায়। ফলে বহুদিন চাকমারা সমতলে আসতে পারে না। কিন্তু খাদ্য ও লবণ ছাড়া তাদের বেশিদিন লুকিয়ে থাকাও সম্ভব ছিল না। ফলে একসময় তারা ইংরেজদের এই কৌশলের কাছে ধরা দেয়। চাকমারা তখন বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। রামু খাঁ বছরে ৫০১ মণ তুলা ইংরেজ শাসকগণকে কর হিসেবে দিতে রাজিও হয়। এভাবেই চাকমাদের প্রথম বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
পুরোপুরি বিজয় না ঘটলেও এই প্রথম চাকমা বিদ্রোহ এবং তার প্রধান নায়ক রামু খাঁর নাম এখনো চাকমারা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। প্রথম বিদ্রোহের পর ইজারাদাররা আগের মতোই চাকমাদের ওপর অত্যাচার ও শোষণ চালাতে থাকে। ফলে অল্প কয়েক বছর বিরতি দিয়ে তারা আবারও বিদ্রোহের ডাক দেয়।
১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে চাকমা দলপতি সের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে চাকমাদের দলপতি বা রাজা হন তার পুত্র জানবক্স খাঁ। তিনি দলপতি হয়েই চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারগণের প্রবেশ বন্ধ করে দেন। ১৭৮৩ হতে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোনো ইজারাদারই ওই অঞ্চলে প্রবেশ করতে বা রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। ইংরেজরা এবারও আগের মতোই অর্থনৈতিক অবরোধ করে জানবক্স খাঁর বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু ওই তিন বছরের কর তারা মওকুফ করতে বাধ্য হয়।
জানবক্স খাঁর সময়ের বিদ্রোহ ও এর কারণ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন লুইন লিখেছেন—ইজারাদারগণ এই উপজাতির ওপর ভীষণ অত্যাচার করত। ফলে বহু চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অঞ্চলেও পলিয়ে গিয়েছিল। চাকমাগণ জানবক্স খাঁ’র নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। কিন্তু স্থানীয় শাসকগণ পূর্বের মতোই অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে তাদের বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হয়।
এই বিদ্রোহের সময়েও ইংরেজ বাহিনী চাকমাদের দমন করতে পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করে। কিন্তু জানবক্স ও সকল চাকমা গহিন পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে থেকে অভিযান ব্যর্থ করে দেয়।
জানবক্স খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা আবার বিদ্রোহ করে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। ওই বিদ্রোহটি চলে কয়েক বছর । অতঃপর ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে একই কারণে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন।
আবার হাচিন্সনের লেখা বিবরণ থেকে দেখা যায়, ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দেই আরেকজন শের দৌলত খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা আরেকটি বিদ্রোহ ঘটায়। যা দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁর বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁও বশ্যতা স্বীকার করে ইংরেজদের কাছে।
ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয়দের অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে বিদ্রোহী চাকমারা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সময়ে আপস করলেও যত দিন ওই অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের ইজারা প্রথা চালু ছিল, তত দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৭৬ হতে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তারা বিদ্রোহ করেছিল।
বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সেনারা চাকমা গ্রামগুলোতে যখন প্রবেশ করত, তখন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে পার্বত্য গহিন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত। এটা ছিল সেনাদের জঙ্গলে নেওয়ার একটি কৌশল। সেনারা চাকমাদের কাউকে না পেয়ে বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে, তাদের খুঁজতে গহিন জঙ্গলে প্রবেশ করত। কিন্তু তাদের না পেয়ে জঙ্গল থেকে ফেরার পথেই চাকমারা বড়গাছ, ভারী পাথর ফেলে ফাঁদ পেতে সেনাদের অবরুদ্ধ করে, চারদিক থেকে তীর মেরে হত্যা করত।
ইংরেজ শাসকগণ অস্ত্রের জোরে বিদ্রোহী চাকমাদের কখনো পরাজিত করতে পারেনি। পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাব থাকায় সমতলে এসে খাদ্য ও লবণ সংগ্রহ এবং অর্থনৈতিক অবরোধের জন্যই তারা ইংরেজদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। চাকমাদের বিদ্রোহ ও সংগ্রামে কেটে যায় দীর্ঘ চৌদ্দ বছর। একসময় ইংরেজ শাসকদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারে, পার্বত্য অঞ্চলে ইজারাদারদের অত্যাচার ও শোষণ ও বর্বরসুলভ উৎপীড়নই চাকমা বিদ্রোহের কারণ। তাই এই ইজারাপ্রথা চালু থাকলে চাকমাদের বিদ্রোহ চলবেই।
তাই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্য-কর্তা হ্যারিস সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে রেভিনিউ বোর্ডের কাছে একটি সুপারিশমালা প্রেরণ করেন। তাতে প্রধান বিষয় ছিল, ইজারাদারদের হাতে থাকা পার্বত্য অঞ্চলের কার্পাস বা তুলার একচেটিয়া বাণিজ্যপ্রথা তুলে দিয়ে ঝুমিয়াদের বা চাকমা দলপতির সঙ্গে বন্দোবস্ত বা চুক্তি করা।
হ্যারিসের সুপারিশ ও প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইজারাপ্রথা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর তুলা কর একই রেখে তা সরাসরি চাকমা দলপতির মাধ্যমে সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইংরেজ শাসকরা সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। সে সময় আরো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, চাকমাদের কাছ থেকে কর স্বরূপ তুলা আদায় করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একজন কর্মচারী নিযুক্ত করা হবে। ওই কর্মচারী কর বাবদ প্রাপ্ত সমস্ত তুলা আদায় করে তা নিলামে বিক্রি করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা না করে সমস্ত তুলা ইংরেজরা ঢাকাস্থ কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দিতে থাকে।
১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলের গণআন্দোলনগুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর চাকমা আদিবাসীরা ইংরেজ সেনাদের ওপর যে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাহসের ভীত ভেঙে দিয়েছিল, তা ছিল ইতিহাসে বিরল ঘটনা। চাকমাদের এ লড়াই-সংগ্রামই পরবর্তীকালে অন্য বিদ্রোহীদেরও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
ছবি : সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২০ জুলাই ২০১৮
© 2018, https:.