একাত্তরে মরতে গিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম
মায়ের মুখটা এখন আর তেমন মনে করতে পারি না। মা যখন মারা যান আমি তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। টাইফয়েড হয়েছিল। গ্রামে তখন চিকিৎসা ছিল না। টাইফয়েড আর বসন্তেই লোক মরত বেশি। মা চলে গেলে দাদী জমিলা খাতুনই আমায় কোলেপিঠে মানুষ করেন। টানাটানির সংসার। কিন্তু তবুও কষ্ট করে লেখাপড়াটা চালিয়েছি আমরা।
ছোটবেলায় দুষ্ট ছিলাম। তবে ভাল ছাত্র হিসেবে নামও ছিল। বাল্যবন্ধু রফিক, নুরুল করিম, আবুল কালাম আর সেকেন্দারের কথা খুব মনে পড়ে। ওদের সঙ্গে ভলিবল খেলতাম স্কুল মাঠে। নাটকও করেছি। বছরে একবার নাটক হতো গ্রামে। তখন ওটাই ছিল বিনোদন। উদয়নালা ও সূর্যমহল নাটকে অভিনয় করেছিলাম। তা দেখে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষের সে কি প্রশংসা!
আমাদের বাড়ি ছিল সমুদ্রের পাড়ে। একটু দৌড় দিয়ে এগোলেই পা ভেজানো যেত। জোৎস্না রাতে সমুদ্রের পাড়েই চলত ডুডু (হা-ডু-ডু) খেলা। তখন খুব মজা হতো। তবে ভয় আর কষ্টও কম ছিল না। সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হতো আমাদের। বন্যা, সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস লেগেই থাকতো। আজ যে বেঁচে আছে সামনের দুর্যোগে সে বাঁচবে কিনা, তারই ঠিক ছিল না। চোখের সামনে দুই’শ লোককেও মরতে দেখেছি। একবার জলোচ্ছ্বাসে গাছের ওপর থেকে অনেকের লাশ নামিয়েছিলাম আমরা। শোকে চোখের পানিও তখন শুকিয়ে গিয়েছিল। পূর্বপুরুষদের জমিজমার অধিকাংশ এখন সমুদ্রের পেটে। একটুও ডেভোলপ করে নাই পাকিস্তান সরকার। যদি তখন বাঁধ দিত তাহলে আজ আমরা কোটিপতি থাকতাম। ওরা তো চাইতো আমরা সমুদ্রের জলে ভেসে যাই। আমাদের এখানে উন্নয়ন যা হয়েছে তার সবই স্বাধীন বাংলাদেশে।”
বাল্যস্মৃতি ও স্বাধীনতা লাভের আগে পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী (বীর প্রতীক)। এক সকালে তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ চলে আমাদের।
চার ভাইবোনের মধ্যে রুস্তম আলী দ্বিতীয়। বাবার নাম মোখলেসুর রহমান আর মা সাঈদা খাতুন। বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার উত্তর ঘোড়ামারা গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ঘোড়ামারা প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন রাজাপুর প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর চলে যান কুমিরা হাই স্কুলে। তিনি মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬৮ সালে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন চিটাগাং কলেজে।
স্মৃতি হাতরে তখনকার শিক্ষকদের কথা তুলে ধরেন রুস্তম। বলেন- ‘আদর্শ শিক্ষক পেয়েছিলাম আমরা। তারা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রাইমারিতে ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। হাই স্কুলে এসে জিএস হই। কুমিরা হাই স্কুলের শিক্ষক নজির আহম্মেদ চৌধুরী, খালেদ বেলাল আর মছিউদ্দোলা চৌধুরী স্যারের কথা খুব মনে পড়ে। উনারা নিজের ছেলের চেয়েও ছাত্রদের বেশি ভালবাসতেন। কঠোর শাসন যেমন করতেন তেমনি স্নেহ পেতাম অফুরন্ত। ওই সময় চলছে প্রচণ্ড আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। মিছিল মিটিং হতো নিয়মিত। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা কালো ব্যাচ পড়তাম। ঘণ্টা বাজিয়ে আগেই স্কুল ছুটি দিয়েছি অনেকবার। এই সব প্রতিবাদের ভাষা শিখেছিলাম শিক্ষকদের কাছ থেকেই।’
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল রুস্তমের। বড় ভাই মোহাম্মদ আলী তখন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। ফলে মুসলিম লীগাররা তাদের ভালো চোখে দেখত না। নানা বিষয়ে প্রতিবাদ হলেই ওরা ওত পেতে থাকতো। তখন এলাকায় চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতব্বরসহ এলিটরা ছিলেন মুসলিম লীগার। তাদের মধ্যে সিরাজুদ্দৌলা চৌধুরী ছিলেন নামকরা।
যুদ্ধদিনের কথা বলছেন বীর প্রতীক রুস্তম আলী
রুস্তম আলী তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। গ্রামে একটা মারামারির ঘটনা ঘটে। সেখানে উপস্থিত না থাকলেও সুযোগ বুঝে মুসলিম লীগের নেতারা তার নাম ঢুকিয়ে দেয়। ফলে ছাত্রাবস্থাতেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় রুস্তমকে। ওই মামলাটি চলেছিল তিন বছর। এ কারণে নির্ধারিত বছরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেন না রুস্তম আলী।
ম্যাট্রিকের পরেই তিনি চাকুরি নেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। লোক নেওয়ার খবরটি পান বন্ধু আবু সাঈদের কাছে। অতঃপর কী ঘটল সে ইতিহাস শুনি রুস্তমের জবানিতে।
তাঁর ভাষায়- ‘তখন ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র, চট্টগ্রাম কলেজে। থাকি চট্টগ্রাম বহদ্দারহাটে। এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং সেন্টার ছিল মেহেদিবাগে। লিখিত পরীক্ষায় টিকতেই ভাইবা হয়। সেটাতেও পাস করলাম। অতঃপর বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, কোয়েটা ট্রেনিং সেন্টারে। বিমানবাহিনীতে যোগ দিই ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে। বেসিক ট্রেনিংয়ের পরই ট্রেড বাছাই চলে। ট্রেডভিত্তিক ট্রেনিংয়ে ওরা আমাকে পাঠিয়ে দেয় করাচি করংগিক্রিকে। অতঃপর পোস্টিং হয় সারগোদায়। সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি ছিল ওটা। ছিলাম এলএসসিতে। ফ্লাইট লাইনে কাজ করতাম। কাজ করেছি সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বিমানেও। বিমানে রকেট, বোম, মিশাইল, মেশিন গান প্রভৃতি ফিট করাই ছিল কাজ। পদ ছিল এলএসিএম। সার্ভিস নম্বর ছিল ৮৩১৮৯।’
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ভেতরে কর্মরত বাঙালিদের তখন কাজ করতে হতো নানা প্রতিকূলতায়।
কি ছিল সেই প্রতিকূলতা?
রুস্তম বলেন- “যুদ্ধ তো আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই শুরু করেছিলাম। ট্রেনিং নিয়ে তখন করাচিতে আছি। বরিশালের একটা ছেলে ছিল। নাম জাহাঙ্গীর। ওর সাথে কথা কাটাকাটি হয় শাহজাহান নামের এক পাঞ্জাবির। দেশ নিয়ে কথা উঠতেই উত্তেজিত হয় জাহাঙ্গীর। ওরা দুজন তুমুল মারপিট করে।
পাঞ্জাবিদের আচরণ তখন ভাল ছিল না। দশ বারজন আমরা একসাথে থাকতাম। বাঙালিদের ওরা টিটকারি করে বলতো- ‘বাঙ্গাল কা বাচ্চা। মুজিব কা বাচ্চা।’ আমরাও রেগে বাংলা ভাষায় খাস গালি দিতাম। ওরা কিছুই বুঝত না। শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে হা করে থাকত। প্রত্যেক জায়গায় চলত এমন গালাগালি। এক সময় নিয়ম করা হয়। মাদার ল্যাঙ্গুয়েজে কেউ কথা বলতে পারবে না। আমরা তখন ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা গালি দেওয়া শুরু করি।”
“বাথরুমে ঢুকলে দুই মিনিটও হয় নাই, ওরা দরজায় বাড়ি দেওয়া শুরু করত। আর ওরা বাথরুমে ঢুকলেই সময় নিত অনেক। ভাবটা ছিল ওদেরই এলাকায় আছি। সব সময় চলত এটা। আমরা কিছু বলতেও পারতাম না। কারণ অফিসাররা ছিল ওদের সার্পোটে। সহজে আমাদের প্রমোশনও দেওয়া হতো না।”
এরপর দেশে ফিরলেন কবে?
“১৯৭০ সালে একবার বড় বন্যা হয়েছিল। আমি তখন সারগোদায়। ঘোষণা করা হলো চাইলে ছুটিতে যেতে পারব। দরখাস্ত দিতেই দুই মাসের ছুটি মিলল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ফিরি। ঢাকায় নেমে সোজা চলে যাই গ্রামে।”
দেশ তখন উত্তাল। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। মিছিল আর মিটিং সবখানে। কুমিরা স্কুলে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ায় ছাত্ররা। কী হবে সামনে! পাকিস্তানিরা কি ক্ষমতা দিবে বঙ্গবন্ধুকে? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় রুস্তমের মনে। ছুটি তখন শেষ হয় হয়। পনের দিন ছুটি বাড়ান তিনি। তবুও ফিরতে মন টানে না তার। অশান্ত মন নিয়েই রুস্তম ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসেন ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টে।
পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন?
রুস্তম আলী উত্তর- “না। এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করি। অতঃপর বাইরে আসতেই লোকমুখে শুনি একটি খবর। একদিন পরেই রেসকোর্সে ভাষণ দিবেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন সিভিল ড্রেসেই চলে যাই সেখানে। দেখি সবার হাতে হাতে লাঠি। দুপুরের পর শেখ সাহেব উঠলেন মঞ্চে। সবার মুখে মুখে একদফা। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’ এরপর আর কোন ঘোষণার প্রয়োজন হয়নি। বঙ্গবন্ধু তখন একমাত্র নেতা। পৃথিবীর ইতিহাসে নেতা না থাকলে কোন জাতির পক্ষে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি অপারেশনে ওই ভাষণই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা। তার ওই ভাষণই জীবনের গতি পাল্টে দেয়।”
আপনি তখন কী করলেন?
“যারা আমাদের শক্রু তাদের ওখানে ফিরে যাব না। তাই কাউকে কিছু না জানিয়েই ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসি কমালপুরে। অতঃপর ট্রেন ধরে সোজা গ্রামের বাড়িতে। রিপোর্ট হলে থানা থেকে পুলিশ আমার খোঁজ নিতে আসে। সবাই জানায় চলে গেছি। কিন্তু আমি তখন ছিলাম আত্মগোপনে, গ্রামের ভেতরই।”
২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় তখন গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাদের একটা কনভয় মার্চ করে আসতে থাকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ওদের টার্গেট ছিল চট্টগ্রামে ম্যাসাকার করার। ফেনি, মিরেরসরাই পাড় হয়ে এগোতে থাকে ওরা। অন্যদিকে সব ক্যান্টনমেন্ট আর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালিদের নিরস্ত্র করতে থাকে পাকিস্তানিরা। ফলে চট্টগ্রামে ব্যারাকগুলোতে শুরু হয় যুদ্ধ। বাঙালি সেনাদের কেউ মারা যায় আবার কেউ অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া কিছু অফিসার ও অস্ত্রসহ সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের পথ পেরিয়ে অবস্থান নেয় কুমিরায়। তাদের সঙ্গে ছিল মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল প্রভৃতি। সে সময় পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের মারার জন্য এক শিপ অস্ত্র আসে, এমভি সোয়াত জাহাজে। ওটা আনলোড করে নিয়ে আসা হবে চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে। ইপিআরদের একটা গ্রুপ সোয়াতের দুই ট্রাক অস্ত্র দখল করে নিয়ে আসে কুমিরায়। কুমিরা স্কুলের পেছনের খালেই সেগুলো আনলোড করা হয়। স্থানীয় জনগনসহ এদের সঙ্গেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন রুস্তম আলী।
তাঁর ভাষায়- “সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সুবেদ আলী ভূঁইয়া, একটা হাফ শার্ট পড়া। পাকিস্তানি সেনাদের খবর রাখছিলেন ওয়াকিটকিতে। নিজের পরিচয় দিতেই তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ওরা কুমিল্লা পাড় হয়ে এক ইউনিয়ন ওপারে চলে এসেছে তখন। আমার এলাকা। তাই দায়িত্বও ছিল বেশি।”
“গ্রামের লোকেরা বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে। কুমিরা থেকে এক মাইল উত্তরে মোগল আমলের একটা বিরাট বটগাছ ছিল। সবাই সেটাও কেটে রাস্তায় ফেলে রাখে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় এগোতে পারে না। ওখানেই থেমে যায়। আমরা তখন মেশিন গান এনে গোরামতলে ঢাকা চিটাগাং রোডে অ্যাম্বুশ করি। মেশিন গান একটা পাহাড়ে, একটা গুদাম ঘরে আর একটা রাস্তার পাশের মসজিদের নিকট বসাই। ইউ শেপে অ্যাম্বুস। বেলা তখন ডুবুডুবু। ওরা রেঞ্জের মধ্যে আসতেই আমাদের ফায়ার ওপেন হয়।”
“সারারাত চলে যুদ্ধ। কুমিরায় তিনদিন ওদের ঠেকিয়ে রেখেছিলাম আমরা। এরপর ক্রলিং করে ওরা পাহাড়ের দিকে চলে আসে। মর্টার শেল ছুড়তেই আমারও পাল্টা আক্রমণ করি। ফলে ওদের কয়েকজন অফিসার মারা পড়ে। এতে ফেরোসাস হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা। কুমিল্লা থেকে আরও সৈন্য আনে ওরা। অতঃপর রাস্তার দুই পাশের গ্রাম জ্বালিয়ে ম্যাসাকার করে এগোতে থাকে। শত শত সাধারণ মানুষ মারা যায় তখন। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা উত্তরদিকে সরে পড়ি।”
ভারতে গেলেন কখন?
তিনি বলেন- “কালু নামে এক ছেলে ঘুরে এসেছে ইন্ডিয়ায়। তার থেকে পাই নানা খোঁজখবর। অতঃপর একদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে মিরেরসরাইয়ের গোরলগঞ্জ হয়ে চলে যাই ভারতের হরিণা ক্যাম্পে। ডিফেন্সের লোক শুনতেই দুইদিন পর আমাকে পাঠিযে দেওয়া হয় আগরতলায়। দেশ থেকে তখন শত শত ছাত্র-যুবক আসছে ট্রেনিং নিতে। তাদের ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ক্যাম্পে। আমরাও একটি গ্রুপকে ট্রেনিং করাই ও বর্ডারে অপারেশন করি।”
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করা হবে। সে কারণে চলছে বিভিন্ন ট্রেডের লোক সংগ্রহ। রুস্তম তখন আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্পে। সঙ্গে খন্দকার আর সার্জেন্ট মনির। ক্যাম্প থেকেই বাছাই করে নেওয়া হয় রুস্তমদের।
ট্রেনিং হলো কোথায়?
“আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ডিমাপুরে, আসামের নাগাল্যান্ডে। চারিদিকে পাহাড়। মাঝখানে একটা ব্রিটিশ আমলের রানওয়ে। সেখানেই কয়েক মাস চলে ট্রেনিং। একটা এলইউট আর ছিল একটা অর্টার। এলইউট হলো হেলিকপ্টার। আর অর্টার হচ্ছে বিমান। একটি বিমানে রকেট, বোমবিং, গানারিং- এই তিনটা সেট করা থাকত। আমি ছিলাম এয়ার গানার। বিমানবাহিনীর তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শামসুল আলম (পরে বীর উত্তম উপাধী পান) ছিলেন পাইলট। কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম। আমি এয়ার গানার আর সার্জেন্ট হক ছিলেন বোম ড্রপিংয়ের দায়িত্বে। ট্রেনিংয়ের সময় পাহাড়ের মধ্যে আমাদের টার্গেট দেওয়া হতো। সেটি ধ্বংস করতাম। এলইউট বা হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ফ্লাইট লেফটেনেন্ট বদরুল আলম। আরেকটা বিমান ছিল ডাকোটা। সেটার পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেক। সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন ও আব্দুল মুহিতও। সবাই ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াড্রের সদস্য। মেইন অপারেশন ছিল আমাদের। আমি এলইউট ও অর্টার দুটিতেই কাজ করেছি। একটি শেষ করেই উঠতাম আরেকটিতে। আমাদের গ্রুপটির নাম ছিল কিলোফ্লাইট। গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন সুলতান মাহমুদ।”
প্রথম এয়ার ফাইটের কথা শুনি বীর প্রতীক রুস্তম আলীর জবানিতে। তাঁর ভাষায়- “ইন্ডিয়ান বর্ডারে ছিল কৈলাশহর এয়ারপোর্ট। আমাদের নিয়ে আসা হয় সেখানে। এক রাতের পরই বলা হলো অপারেশনের কথা। গোপনীয়তা রক্ষায় কোথায় অপারেশন করতে হবে জানানো হলো না। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাত তখন বারটা। সবাই প্রস্তুত। বিমান যুদ্ধ ওটাই ছিল প্রথম। বিমান বা অর্টারে ফ্লাই করার আগে জানানো হয় চট্টগ্রাম অ্যাটাক করতে হবে। আমরা চারজন। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শামসুল আলম পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম, এয়ার গানার আমি আর সার্জেন্ট হক বোম ড্রপিংয়ে। রাত তখন দশটা। কৈলাশহর থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার দিয়ে বিমানটি উড়ে যায়। যাতে পাকিস্তানি রাডারে তা ক্যাচ না করে। চিটাগাং দিয়ে ঢুকতেই সীতাকুণ্ড, পরে পাহাড়। যখন পাহাড় ক্রস করছিলাম তখন সামসুল আলম সাহেব বলেন- ‘রুস্তম, নাউ উই আর ক্রসিং সীতাকুণ্ড হিল।‘ আমি বলি- ‘ইয়েস স্যার। দিস ইজ মাই নেটিভ থানা। অতঃপর আমরা বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করি, একেবারে নিচে নেমে।”
“অনেক নিচ দিয়ে ফ্লাই করছি আমরা। চাঁদের আলো ছিল। নিচে সব দেখা যাচ্ছে। আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়েই আসি চিটাগাং, ইস্ট পাকিস্তান ওয়েল রিফাইনারিতে। ওটা ধ্বংস করাই ছিল টার্গেট। ওটা উড়িয়ে দিতে হবে।”
“প্রথম বারেই রকেট, মেশিন গান, বোম একসাথে শুরু করলাম। আমি মেশিন গানের গুলি আর বোম ড্রপ করে সার্জেন্ট হক। প্রথম অ্যাটাকেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল। বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। শামসুল আলম সাহেব বলেন- ‘সুড আই টেক এনাদার অ্যাটেম্ট। আমি বলি- ‘নো স্যার, উই আর সাকসেসফুল।’ পাকিস্তানিরা প্রথম মনে করেছে এগুলো তাদের বিমান। তাই ওরা প্রথমে কিছু করেনি। ধ্বংস আর আগুন দেখে ওরা পাগল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম তখন ওদের নেভালের দুর্গ। নেভি আর আর্মিরা অ্যান্টি এয়ার ক্রাফ্ট গান দিয়ে গুলি করতে থাকে। একটা লাগলেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। মইরতু আই বাছি গেই আণ্ডা।”
ফেরার সময় রুস্তম আলীরা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের কুম্বিরগ্রামে ল্যান্ড করে। তাদের সফলতা দেখে ভারতীয়রা বিশ্বাসই করতে পারেনি। কারণ বিমানটি আসলে সত্যিকারের যুদ্ধবিমান ছিল না। ওরা অবাক হয়ে বলত- ‘এগুলো দিয়া তোরা কেমনে যুদ্ধ করলি।’
রুস্তমদের মতো যোদ্ধারা তখন দেশের জন্য পাগল। তাই অসম্ভবও সম্ভব হয়েছিল। এরপর রুস্তমদের ফুল ব্যাচকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে এয়ার অ্যাটক করা হয় সিলেট, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকায়। দেশ যখন স্বাধীন হয় রুস্তম তখন আগরতলায়। খুব ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার খবরে বুকটা ভরে গিয়েছিল।
যে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
প্রশ্ন শুনে এই বীর প্রতীক চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে বলেন- “দেশ পেয়েছি কিন্তু স্বপ্নের দেশ হয়নি। আমি তো সব সময় বলি, এটা সোনার খনি দেশ নয়। বিমানবাহিনীতেই ছিলাম। পঁচাত্তরের জুনে বেসরকারি চাকুরি নিয়ে চলে যাই ওমানে। এরপর জাপান, লন্ডনসহ পৃথিবীর প্রায় ২৫টি দেশ ঘুরেছি। এদেশের মতো উৎপাদন, আবহাওয়া, মাটি, পানি আপনি কোথাও পাবেন না। এতো মানুষ থাকার পরেও অল্প টাকায় চাল আর সবজি খেতে পারি। এটা কোথাও নেই।”
স্বপ্ন কি ছিল?
“স্বপ্ন ছিল সুখী, সমৃদ্ধি ও শান্তির বাংলাদেশ হবে। কিন্তু আন্তজার্তিক চক্রান্তে বলেন আর নিজেদের কারণেই বলেন আমরা উল্টো দিকে চলেছি। মানুষের মধ্যে এখন দেশাত্ববোধের বালাই নাই। ন্যূনতমও নাই। যদি থাকত তাহলে দেশ আরও এগোতো। এখন আছে শুধুই আত্মপ্রেম। স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার অধিকার পৃথিবীর কোনও দেশেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র পায় না। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়েছে এবং এখনও আছে। ফলে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করতে ওরা কাজ করেছে বছরের পর বছর। এটা আমরা কোনদিন স্বপ্নে ভাবিনি।”
বঙ্গবন্ধুর শাসনামল সম্পর্কে এই বীর যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়- “একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পেয়েছিলাম আমরা। কিছুই ছিল না। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতে পাঁচটা ফেরি পাড় হতে হতো। এমন দেশ গড়ার দায়িত্ব এসে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর। উনার চেষ্টা ছিল। কিন্তু চারপাশে ছিল দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র।”
“যুদ্ধের সময় আমরা উঠলাম ইন্ডিয়ায়। ওরা খাওয়ালো। অস্ত্র ছিল বেশিরভাগই রাশিয়ার। আমাদের সাহায্য না করে উপায় ছিল না ইন্ডিয়ার। স্বাধীনের পর শেখ সাহেব আসলেন। এসেই ভারতকে বললেন- সৈন্য কবে যাবে? বিষয়টা খেয়াল করেন। গোটা পৃথিবী তখন কমিউনিস্ট ও আমেরিকান- দুই গ্রুপে বিভক্ত। তাহলে শুরুতে দেশ কোনদিকে যাবে? বঙ্গবন্ধু হয়তো বুঝতে পারেননি আমেরিকার ভূমিকা। বলা হলো সমাজতন্ত্রে গেলে দেশ আরো এগোবে। কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে তো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না। সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হেনরি কিসিঞ্জার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন- ‘আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি’। তাই আমি মনে করি আমাদের আন্তজার্তিক পলিসিটা তখন ভুল ছিল।”
বঙ্গবন্ধুর সময়ের দুর্ভিক্ষ আমেরিকার তৈরি ছিল বলে মনে করেন এই বীর প্রতীক। তাঁর ভাষায়- “খাবারের শিপ তখন মাঝপথ থেকে তারা ফেরত নিয়ে গিয়েছিল। ফলে রেশনিং ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়। সারা বিশ্বকে খাবার না দিতে গোপনে নাও করে দেয় আমেরিকা। এভাবে দুর্ভিক্ষ চরমে তুলে শেখ সাহেবকে মারার পথ তৈরি করেছিল তারা। কথায় বলে পেটে খাইলে পিঠে সয়। খাওয়াইয়া দুটি লাথি দিলেও সহ্য করে মানুষ। কিন্তু সেটা তো হয়নি তখন।”
স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীর প্রতীক উপাধি লাভ করলেও রুস্তম আলী এখনও পাননি মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ। মুচকি হেসে এ প্রসঙ্গে তিনি শুধু বললেন- “আমি বীর প্রতীক। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা না। এখনও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই না। কাগুজে সনদও নেই। এয়ারফোর্সের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম আছে। থানা কমাণ্ডাররা বললেন, দেশে ছিলাম না। তাই তালিকায় নাম উঠে নাই। কিন্তু দেশে না থাকলে কি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কারও নাম থাকবে না? মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ছেলেমেয়েরাও কোনো সুবিধা নেয় নি। বরং সার্টিফিকেট না থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি করতে পারিনি। এ নিয়ে আক্ষেপ নাই। তবে কষ্ট আছে।”
স্বাধীনতার এতো বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর উত্তর- “পয়সা খেয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা সনাক্ত করেছে তারা অসৎ। দেশপ্রেম যার নাই তার কোন দায়িত্বজ্ঞানও নাই। স্বজনপ্রীতির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ছে। সীতাকুণ্ড ইন্ট্রাস্ট্রিয়াল এরিয়া। যুদ্ধের সময় বড় ভাই ছিলেন আওয়ামী লীগের ইউনিয়নের সেক্রেটারি। ছোটভাই ইউসুফ আলী ছিলেন সীতাকুণ্ড থানার দক্ষিণ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। স্বাধীনের পর উনিও তিন বছর বেকার ছিলেন। অথচ তখন সকল ‘পাওয়ার’ ছিল আমাদের হাতে। কিন্তু অবৈধভাবে কিছু করি নাই। নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার আছি। সরকারি টাকার মালিক দেশের জনগণ। সরকারি সম্পত্তি পড়ে থাকুক, সরকার সেটা জবাব দিবে। আমি কেন সেটা অবৈধভাবে ভোগ করব। অথচ স্বাধীনের পর রেলওয়ে ও বিহারিদের সম্পত্তি দেদারসে দখল হয়েছে। আমরা কোনও ভাই তা করি নাই। তাই নিজের কাছে নিজে চোর নই।”
দেশ কেমন চলছে?
তিনি বলেন- “ভাল চলছে। কিন্তু বড় বড় মানুষরা আল্লাহর ওয়াস্তে মনে মিনিমান দেশপ্রেম রাখুক। মিনিমাম সততা থাকুক। বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকারকে অনুরোধ করি- বড় বড় রাঘব বোয়াল যারা দেশের ক্ষতি করছে, দুর্নীতি করছে- তারা যে দলেরই হোক শায়েস্তা করতে হবে। ক্ষমতা যাক আর থাক- এটা রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। বরং ওদের শায়েস্তা করলে আল্লাহও সাহায্য করবে। আবার এদেশে ধর্ম যেন কেউ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।”
অনেকে বলে দেশ স্বাধীন হয়ে কি পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের অমর্যাদাও করেন কেউ কেউ। তখন কষ্ট পান বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী । বললেন- “একটা পতাকা আর দেশ পেয়েছি। নিজের দেশেরও পাসপোর্ট পাই। অথচ স্বাধীনতার মূল্যায়ন যখন কেউ করে না। তখন খারাপ লাগে। স্বাধীনতা তো অনেকে হাতের মোয়া হিসেবেই পেয়ে গেছে। কষ্টটা চোখে দেখেনি। ভিয়েতনামে যুদ্ধ হয়েছে বাইশ বছর। আমরা আরও দশ-বার বছর যুদ্ধ করে দেশটা পেলে, সবাই স্বাধীনতার অর্থটা বুঝতে পারত।”
শত বাধা পেরিয়ে দেশটা একদিন উন্নত বাংলাদেশ হবে এমনটাই বিশ্বাস বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর। মনেপ্রাণে তাঁর বিশ্বাস লাখো শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশ কখনও পথ হারাবে না। এই যোদ্ধা তাই স্বপ্নের বীজ বোনেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে।
তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বলেন- “দেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে এই তিন বিষয়ে তোমরা আপোষ করো না। দেশের বীরত্বের ইতিহাসটি জেনে নিও। দেশটাকে ভালোবেসো। মনে রেখো, নিজের কাজটা সততার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই বড় দেশপ্রেম।”
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী (বীর প্রতীক)।
ছিলেন: পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। পদ ছিল এলএসিএম। সার্ভিস নম্বর ছিল ৮৩১৮৯। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানের এয়ারগানার হিসেবে ট্রেনিং করেন ডিমাপুরে, আসামের নাগাল্যান্ডে।
যুদ্ধ করেছেন : সীতাকুণ্ডের কুমিরায় প্রতিরোধ যুদ্ধসহ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম এয়ার ফাইটে অংশ নেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই ২০১৮
© 2018, https:.