মুক্তিযুদ্ধ

কাইয়ার গুদাম কি এখনও পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দখলে?

আপনি নিজেকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কিন্তু আপনার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে, বধ্যভূমি অরক্ষিত থাকবে, শহীদদের স্মৃতি নদীর জলে ভেসে যাবে- এটা তো ঠিক কথা নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য সেখানে ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগের এমপির বাবা ছিলেন একাত্তরে পিস কমিটির চেয়ারম্যান। সুতরাং তার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে অনেক আগেই কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করা যেত। তাছাড়া এখনও কেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ সেখানে নির্মাণ করা হলো না! এই লজ্জা আমাদের। এই লজ্জা আওয়ামী লীগেরও।’

“১৯৭১ সাল। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, পিপিএম হাই স্কুলে। সাজে রাণী দাস, সেবা রাণী দাস, জাহানারা বেগম, নাসিমা বেগম, শিউলি আক্তার- এরা ছিল খেলার সাথী। একটু দুষ্টু ছিলাম। ছিলাম প্রতিবাদীও। কেউ অন্যায় করছে দেখলেই এগিয়ে যেতাম। বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জে ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি।

দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। থানায় থানায় বসেছে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। ফেঞ্চুগঞ্জে তারা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। ওরা চিনিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের। যুবতী দেখলেই তুলে নিয়ে যেত পাকিস্তানি ক্যাম্পে। পাকিস্তানি সেনারা আসার পরই তারা হানা দেয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে। বাবা তখন পালিয়ে বেড়ায়।

বাবা না থাকায় তখন চাচা কালা মিয়াই দেখবাল করতেন আমাদের। এভাবে কাটে তিন চারমাস। অতঃপর একদিন গোপনে বাবা গ্রামে আসেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন পাল পাড়ার বানু মিয়া।

দুপুর দিকের ঘটনা। প্রথম তারা বানু মিয়ার বাড়িতে উঠে। খাওয়া-দাওয়া সেরে ওইবাড়িতে ডেকে নিবে আমাদের। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। বানু মিয়া ঘরের ভেতরে খেতে বসেছেন। ভাতের থালা সামনে। বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে, গাছের আড়ালে।

বাবার নিজের মামু ছিল রাজাকারের সভাপতি। তার ভয়েই তিনি বাড়িতে থাকতেন না। তারা গ্রামে ঢুকতেই কে যেন খবর দিয়ে দেয় রাজাকারদের। ওরা দ্রুত খবর পাঠায় পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পে। ফলে পাঞ্জাবিরা অ্যাটাক করে বানু মিয়ার বাড়িতে। বাবা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও বানু মিয়া পারেনি। খাওয়া নাকি কোরআন শরীফ পড়ার মতো! অথচ ভাত খাওয়া অবস্থায়ই তাকে গুলি করে মারে ওরা।

ভিডিও: একাত্তরে কাইয়ার গুদামে টর্চারের কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গণা লাইলি বেগম

এ খবর আমাদের জানা ছিল না। ওইদিন সন্ধ্যার পর বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-সাতজন রাজাকার। ফরিদপুর গ্রামের রাজাকার মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল। বাকিদের নাম মনে নাই। ওরা এখনও কিছু বেঁচে আছে, কিছু নাই।

আমি তখন পড়তে বসছি। ওরা আমার চাচারে ধইরা নিতে চায়। তারে উঠানে নিলেই আমি সাহস করে সামনে যাই। জানতে চাই তার অপরাধ কি? ওরা বলে- ‘ইন্ডিয়ার খবর শুনে কেনে। সভাপতি চেয়ারম্যানের কাছে নিয়া ছেড়ে দিমু।’ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়। যাওয়ার মতো আর কেউ নাই। তাই আমিও তাদের পেছন পেছন যাই। তখন চাচার লগে ওরা আমারেও তুইলা নেয়। নিয়ে যায় কাইয়ার গুদামে।

ওটা ছিল পাঞ্জাবিদের টর্চার সেল। খুবই অন্ধকার জায়গা। ওই পরিবেশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। আরও নারীরা ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। সে নির্যাতন কোনও নারীই মুখে বলে বুঝাতে পারবে না।

প্রথম পাঁচ-ছয়দিন একটা রুমে রাখে ওরা। বাবা খবর পেয়ে কিছু পরিচিত মুরুব্বিকে পাঠায়। কিন্তু ওরা আমায় ছাড়ে না। আরেকটা রুমে সিফট করে দেয়। সেখানে রাখে এক মাস, চলে পালাক্রমে নির্যাতন। রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা ঘন্টায় ঘন্টায় আসা যাওয়া করতো। আমরা শব্দ পেতাম। খাবার দিত না ওরা। দুই তিনদিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজ গাঁও স্টেশনের পাশে। অতঃপর হাসপাতালে চলে দুই মাস চিকিৎসা।

কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল। সেখানে রাখা হতো শত শত নারী। স্বাধীনের পর আড়াই থেকে তিন’শর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল। পুরুষ কও আর নারী কও ওরা প্রথমে ঢুকাইতো কাইয়ার গুদামে। তারপর অন্য জায়গায় নিসে। আমার চাচারেও ওরা প্রথম নিয়ে টর্চার করছে কাইয়ার গুদামে। পরদিন নদীর পাশে কাঠের তক্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারছে। তার লাশ চলে গেছে কুশিয়ারা নদীর পেটে।

আমার মাথায় কাটার দাগ এখনও আছে। বাইশটা শিলি পড়ছিল। দেখেন মুখে ক্ষত। বেয়নেট দিয়ে পাঞ্জাবিরা গুতা দিছে। ডান হাতটা ভাঙ্গা। পায়ের ক্ষতি করছে। রানের ভেতরও বেওনেটের খোচার দাগ আছে অগণিত।

অনেক কথাই মনে আছে। অনেক কথাই বলতে পারি নাই। প্রজন্মের কাছে এখন তো টর্চারের কথা বলতে লজ্জা লাগে, ভয়ও লাগে। এখন তো কিছু মরা, কিছু জিন্দা হিসেবে বেঁচে আছি। সরকার যা দিচ্ছে তাতে ভাল আছি। কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে। একাত্তরটা মনে পইড়া যায়।

যেখানে আমার চাচাসহ শত শত লোককে গুলি করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কুশিয়ারা নদীর তীরের ওই জায়গায় এখন ময়লা ফেলা হচ্ছে। একটা স্মৃতিস্তম্ভ নাই। দেশ তো স্বাধীন হইছে অনেক বছর আগে। কিন্তু কাইয়ার গুদাম এখনও স্বাধীন হয় নাই। আমরা মইরা গেলেই এই ইতিহাস শেষ। কেউ মনেও রাখব না। ফেঞ্চুগঞ্জে একাত্তরের স্মৃতি রক্ষা করবে কে? যেমন এমপি, তেমন চেয়ারম্যান, তেমন মেম্বার! সব একই পাল্লার ওজন।”

কাইয়ার গুদামে একাত্তরে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গণা লাইলি বেগম।

সিলেট থেকে কুশিয়ারা নদীর ব্রিজে পেরোলেই বাম দিকের ঢালু পথ চলে গেছে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের দিকে। নদীর তীরঘেষা ইট বিছানো এবরোথেবরো রাস্তা। খানিক এগোতেই মিলে কাইয়ার গুদাম, একাত্তরে পাকিস্তান আর্মিদের টর্চার শেল।

একাত্তরে এখানেই গুলি করে হত্যা করা হতো মুক্তিকামি মানুষকে

সাধারণ ভাবে কাইয়ার গুদাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। নেই কোন স্মৃতিস্তম্ভ, নেই কোন সাইনবোর্ড। একাত্তরের আগে এটি ছিল পাটের একটি গুদাম। সম্মুখে কুশিয়ারা নদী। ফলে নদী পথে অন্যান্য থানার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল সহজ। তাই পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাশেই কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বড় একটি শিমুল তুলা গাছ। এই গাছের ওপরই কাঠের তক্তা বেঁধে তৈরি করা হয়েছিল ওয়াচ টাওয়ার। সেনারা দুরবিন নিয়ে সেখানে পাহাড়া দিত। গাছেই বসানো হয় ওয়ারলেসের যন্ত্র।

গুদামটি অনেক বড়। কালচে ছাপ পড়া উঁচু তার দেওয়াল। পেছনের দুটি দরজা কাঠ মেরে বন্ধ করা। সামনে টিনে ঘেরা দুটি ঘর। নতুন দরজা খুলে একটি রুম ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হিসেবে। বাকি রুম ও গোটা গুদাম তালাবদ্ধ।

গুদামের ঠিক সামনেই বহমান কুশিয়ারা নদী। যেখানে একাত্তরে মুক্তিকামি মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেখানেই মিলে ময়লার স্তুপ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফেঞ্চুগঞ্জে অবহেলিত, অরক্ষিত।  একাত্তরের শহিদদের আত্মা এখানে নিরবে কাঁদছে। সেই কান্নার আকুতি এখনও স্পর্শ করেনি সরকার কিংবা দায়িত্বশীলদের।

পাকিস্তানিদের টর্চার সেল কাইয়ার গুদামের পেছন অংশ

কিন্তু কেন?

স্থানীয়রা বলছেন এটির দখল নিয়ে সরকারের সঙ্গে চলছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের মামলা। সেই চক্রটি চায় না কাইয়ার গুদামের ইতিহাস তুলে ধরা হোক। এ বিষয়ে কথা বলেন রাজনপুর গ্রামের সৈয়দ আমিনুর রশিদ। ‘মুক্তি’ সন্দেহে একাত্তরে তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় কাইয়ার গুদামে। দুদিন চলে টর্চার। হান্টার (এক ধরনের চাবুক) দিয়ে মারার ফলে আজও তিনি বাম কাঁধ ও হাতে শক্তি পান না। তিনি বলেন- ‘সব কথা তুলে ধরতে ভয় করে। একটা গ্রুপ তো গুদাম দখলের চেষ্টা করছে। তারা নানাভাবে হুমকি দেয়। এখন কাইয়ার গুদাম নিয়ে মুখ খুললে জীবনও চলে যেতে পারে।’

ভিডিও: শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকদের সহযোগিতায় গণহত্যা হয় কাইয়ার গুদামে

আলাপ হয় কবি মফজ্জিল আলীর সঙ্গে। একাত্তরে কাইয়ার গুদামে কি দেখেছেন তিনি? সে ইতিহাসই বললেন, কাইয়ার গুদামে দাঁড়িয়ে। তার ভাষায়- ‘ফেঞ্চুগঞ্জের চারদিকে আরও চারটা থানা আছে। সড়ক, রেল ও নদী পথের সুবিধা ছিল এখানে। তাই নদীপথে বোট দিয়ে আশপাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এখানেই টর্চার করত পাকিস্তানিরা। নারীদের এনেও শারীরিক নির্যাতন চালাতো। গুদামের সামনেই কুশিয়ারা নদীর কাছে নিয়ে বেওনেট চার্জ ও গুলি করে মানুষকে হত্যা করে ওরা নদীতে ফেলে দিত। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আনসারী ছিল এই ক্যাম্পের দায়িত্বে। লোকাল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ফিরু মিয়া। সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান কনাই মিয়া। এ কাজে এরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

আমার মামা ইজ্জত আলী শাহ, মায়ের চাচাতো ভাই রবিউল ইসলাম শাহ, খালাতো ভাই নাসিরুদ্দিন রতন, কলা মিয়া, একদিনে সাত-আটজন লোককে পাকিস্তানিরা ধরে আনে কাইয়ার গুদামে। অনেক টর্চার করছে ওরা। ওরা বলত- ‘তোদের আমরা গুলি করে মারব না। তোরা ধুকে ধুকে মরবি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই।’ তাই হয়েছিল। আমার মামাও তেমনি কয়েক মাসের মধ্যে মারা যায়।

ফেঞ্চুগঞ্জ যেদিন মুক্ত হয় সেদিন প্রথম এসে কাইয়ার গুদামে ঢুকি। প্রথম রুমে দেখি মেঝেতে রক্ত জমাট। পেছনে একটা ছোট্ট ড্রেন ছিল। সেটা ছিল মানুষের রক্তে ভর্তি। বড় ড্রেনে রক্ত আর মাছিতে ভরা। এতো লোক মারা হলো একাত্তরে। অথচ সে ইতিহাসই এখন মৃতপ্রায়। দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়নি। খুব খারাপ লাগে ভাই। লেখালেখি করেছি অনেক। কিন্তু কোন কাজ হয় নাই। অথচ দেখেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়! কাইয়ার গুদাম নিয়ে আসলে দুষ্টামি রাজনীতি চলছে।’

ভিডিও:  নানাকে আনতে কাইয়ার গুদামের রুমে ঢুকেই রক্ত দেখে আতৎকে উঠি

একই মত দেন পিটাই টিকর গ্রামের মো. ইসমর আলী। একাত্তরে তার নানা জায়েদুর রহমানকে নৌকায় করে কাইয়ার গুদামেই ধরে নিয়ে আসে পাঞ্জাবিরা। নানাকে ছাড়াতে তিনিও আসেন পিছন পিছন। তার ভাষায় পাঞ্জাবিরা উনাকে বলে, ‘তুমি কি মুক্তি।’ সে বলে- ‘আমি সাধারণ মানুষ। মাছ মেরে খাই।’ ওরা তখন লাঠি দিয়া কয়েকটা বাড়ি মেরে নানারে ছাইড়া দেয়। তখন আমি গুদামে ঢুকছি। দেখি খালি রক্ত আর রক্ত। রক্ত দেইখা ডরাইয়া গেছি। পাকার মইধ্যে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্ত ছিল। এখানে একটা স্মৃতি থাকুক এটা তো চাই আমরা।’

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে কাইয়ার গুদামে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা আজমল হোসেন রউফসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধার।

ভিডিও: পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে কাইয়ার গুদামের ইতিহাস

কী দেখেছিলেন ওইদিন?

তিনি বলেন, “ইন্টার ফেঞ্চুগঞ্জের এটা ছিল কন্ট্রোল রুম। আমরা তো কাইয়ার গুদামে ঢুকেই ভয় পেয়ে গেছি। রক্তমাখা হাতের ছাপ। মানুষকে ওয়ালে ঝুলিয়ে টর্চার করছে ওরা। দেওয়ালে রশি বাঁধা। প্রথম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি ঘর। মেঝেতে পা পড়তেই পা আটকে যায়। আঠার মতো কি যেন! মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি মানুষের রক্ত জমাট হয়ে গেছে। কুলাউড়া ও সিলেট থেকেও অনেক লোক ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। মানুষের হাড়গোড়ও পেয়েছি কাইয়ার গুদামে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সাত চল্লিশ বছরেও এখানে রক্ষা করা হয়নি। এভাবে চললে এমন একদিন আসবে যখন একাত্তরের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কাইয়ার গুদামের কথা।”

আমাদের কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গণা খোদেজা বেগম আর মনু বেগমের সঙ্গে। তাঁরা দুই বোন। বাড়ি মোমিনপুরে। একাত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রাজাকারদের সহযোগিতায় একদিন পাঞ্জাবিরা তুলে নেয় দুইবোনকেই। তিনদিন রাখে কাইয়ার গুদামে। ওই দিনগুলো আজও তাদের কাছে অভিশপ্ত মনে হয়। তাদের ভাষায়- “কাইয়ার গুদামে বহুত পাকিস্তানি আছিল। আমাদের অত্যাচার করে ওরা মরার মতো ফালাইয়া রাখছে। অনেক মানুষ ছিল ওইখানে। খাবার দিত না। বহুত মানুষকে নিয়া নির্যাতন করছে ওরা। আমাগো টর্চার করে আদমরা করে ফেলে রাখত। কাঁদলেই রাইফেল দিয়া বাড়ি দিত। পরে মুক্তিযোদ্ধারা আমগো উদ্ধার করছে।”

ভিডিও: ফেঞ্চুগঞ্জের কাইয়ার গুদামে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয় আমাদের দুই বোনকে

একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে রাজাকারেরা কাইয়ার গুদামে ধরে নিয়ে যায় আলেয়া বেগমের বাবা আফতাব আলীকে। আজও ফিরে আসেননি তিনি। প্রতি শ্রাবণ মাসের সাতাশ তারিখ আলেয়া বেগম তার বাবার জন্য দোয়া পড়ান। সাতচল্লিশ বছর পর বাবাকে ধরে নেওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন তিনি। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে থাকেন বাবা হারানো ইতিহাসের আদ্যপান্ত।

তার ভাষায়- ‘আমগো বাড়ি বিয়ালী বাজার, কায়স্ত গ্রাম আছিল। শ্রাবণ মাস। একদিন সন্ধ্যা বেলা নামাজ পইড়া আব্বা গেছেন বাইরে। তখন তিনজন লোক আইছে। মাথায় ছাতা। লুঙ্গিপড়া। ঝোলাঝালা লগে। ওইগ্রামের মহিব চৌধুরী বলছে- ‘চাচা আজকের রাইতের জন্য আমাদের একটু জায়গা দিবা। রাতটা কাটাইয়া আমরা যামু বিআইডিসি (সার কারখানার পাশের সেতু) শ্যাম বাজারে। সকালে ওইদিকে যাওয়ার রাস্তাটা আমারে দেখাইয়া দিবা।’

আব্বা বলছে- ‘চাচা যেহেতু কইছো। বাড়ি তো ভাঙ্গাচোরা। যেটা আছে সেখানেই থাক। আব্বা তখন বাড়ির একটা মুরগি জবাই করে, মা রেঁধে খাওয়াইছে ওগো। ফজরের নামাজ আব্বাসহ তারা পড়েন ঘরে। সকালে নাস্তা করিয়া আব্বা বাগান দিয়া তাদের টিলার ওপর নিয়া দেখান দূরের শ্যাম বাজারের রাস্তাটা। তারা চইলা যায়।

ফেরারা সময় আব্বার দেখা হয় দুই চকিদারের লগে। একজন গাজীপুরের মকর। আরেকজন বিয়ালী বাজারের বেলাই চকিদার। তারা বলে- ‘দেখলাম তুমি দুইতিনজন নিয়া যাইতেছো। এখন তুমি একা আইছো। ওরা কারা আইছিলো?’

আব্বা তখন মিছা মাইতেছে। বলছে- ‘এরা আমার আত্মীয়স্বজন।’

এই ঘটনা ওরা জানায় রাজাকার মকইর কমান্ডার ও শেরপুরী মাওলানাকে।

তখন বিকাল বেলা। আমার নানীবাড়ি ছিল আমার আব্বা। সেখানে গিয়া নানাকে বলছে তোমার জামাই নিয়া তুমি কাল সকালে বিয়ালী বাজার যাইবা। সকালে আব্বাসহ নানা যায় বিয়ালী বাজার। রেজাকার কমান্ডার মকই আর শেরপুরী মাওলানা কইছে এদের দুজনকেই গাড়িতে তোলো। পরে একজন মুরব্বীর কথায় নানাকে ছেড়ে ওরা আব্বাকে নিয়া যায়।

নানা বাড়ি আইসা আমাগো নিয়া গেছে শেরপুরী মাওলানার বাড়িত। সবাই তখন কান্নাকাটি করছি। শেরপুরী মাওলানা তার বাড়িতে একটা চেয়ারে বসা। নানাসহ আমার মা তার পা জড়িয়ে ধরে। মিনতি করে আব্বাকে ছাড়িয়ে আনার। শেরপুরী মাওলানা এক লাথি দিয়া ফেলে দেয় আমার আম্মারে। বলে- ‘তোমরা মুক্তিগো রাখছো, খাওয়াইছো আর এখন আইছো ছাড়াইতে। যাও।’

ভিডিও: কাইয়ার গুদাম গণহত্যা-একাত্তরে আব্বাকে টর্চার করে মেরে ফেলা হয় ওখানে

আব্বাকে কাইয়ার গুদামে নিয়া টর্চার করে ওরা। সঙ্গে আমার এক চাচা ছিল। পাঞ্জাবিরা তারে বাড়ি দিয়া ছেড়ে দিছে। আব্বাকে রেখে দেয়। চাচা এসে বলে তোমার আব্বারে তো আর পাইবা না। ওরা আব্বাকে কুশিয়ারা তীরে মেরে পানিতে ফেলে দিছিলো। পাশে এক গ্রামের জেলের জালে আব্বা আটকে যায়। তখনও জান ছিল কিছু কিছু। খবর পেয়ে তখনই রেজাকারের লোকেরা যায় সেখানে। ধম আছে দেইখা ওরা তখন গুলি করে তারে আবার নদীর জলে ফেলে দেয়। আব্বার লাশ আমরা পাইছি না। আব্বা ওই যে বের হয়ে গেছে- সেই স্মৃতিটাই মনে আছে। এখনও মনে হয় আব্বা বুঝি আবার ফিরা আসবো। সাতচল্লিশ বছরে কেউ আব্বার কথা জিগায় নাই। আজ আপনাকে বলতে পাইরা বুকটা একটু হালকা হইছে। যারা আব্বারে ধইরা দিছে তাগো বিচার কে করবো?’

ফেঞ্চুগঞ্জের গণহত্যার ইতিহাস কেন সরকারিভাবে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে না? এ প্রসঙ্গে কথা বলেন সিলেট জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মির্জা জামাল পাশা। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। বলেন- ‘দেখেন, আমরা সত্যকে সত্য বলব। মিথ্যাকে মিথ্যা। আপনি নিজেকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কিন্তু আপনার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে, বধ্যভূমি অরক্ষিত থাকবে, শহীদদের স্মৃতি নদীর জলে ভেসে যাবে- এটা তো ঠিক কথা নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। তাকে বুকে ধারণ করেছি। আমরা তো ক্ষমতার জন্য সত্যি বলা বাদ দিব না। ফেঞ্চুগঞ্জের কাইয়ার গুদাম এখনও কি পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দখলে? সরকারের কাছে এটা আমার প্রশ্ন। আমাদের দুর্ভাগ্য সেখানে ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগের এমপির বাবা ছিলেন একাত্তরে পিস কমিটির চেয়ারম্যান। সুতরাং তার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে অনেক আগেই কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করা যেত। তাছাড়া এখনও কেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ সেখানে নির্মাণ করা হলো না! এই লজ্জা আমাদের। এই লজ্জা আওয়ামী লীগেরও।’

এ প্রসঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন বলেন, ‘কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অনেক আগেই আমরা আবেদন পাঠিয়েছি। এমপি সাহেবও এ বিষয়ে আন্তরিক। কিন্তু তবুও সরকার থেকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা চাই দ্রুত কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্মম্ভ তৈরি করা হোক।’

বীরের দেশে বীরত্বের ইতিহাস যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিহাসও তুলে ধরা প্রয়োজন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। তাই ফেঞ্চুগঞ্জের সচেতন মানুষ চায় একাত্তরে কাইয়ার গুদামের গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা হোক প্রজন্মের কাছে। শত প্রশ্নের মাঝেও তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরাসরি হস্তক্ষেপে কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। শহীদদের স্মৃতিতে কুশিয়ারা নদীর তীরেই একদিন নির্মিত হবে স্মৃতিস্তম্ভ। সে স্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে প্রজন্ম।

শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে তারা বলবে, ‘এক সাগরও রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা- আমরা তোমাদের ভুলব না।’

লেখাটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত, প্রকাশকাল: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button