একাত্তরে জিয়াউর রহমান কি জয়বাংলা বলেছিলেন?
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবার হঠাৎ টিবি রোগ হয়। এই রোগের চিকিৎসা ছিল না তখন। তিন বছর খুব কষ্ট করেছেন উনি। ঢাকায় গিয়ে ডাক্তারও দেখানো হয়। চিকিৎসার জন্য চৌদ্দ বিঘা ক্ষেত বিক্রিও করতে হয়েছে। কিন্তু তবুও বাবা বাঁচেন নাই।
বাবার কথা মনে হলে এখনও বুকটা হু হু করে উঠে। অনেক আদর করতেন আমাকে। টিবি রোগ ছোঁয়াচে ছিল। তাই তিনি আমাকে পাঠিয়ে দেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসলে কাছে ডাকতেন না। কিন্তু আমার মন খুব টানতো। কাছে যেতাম। তাঁর হাত ধরে রাখতাম, মাথায় হাত বুলাতাম। প্রথম উনি কিছু বলতেন না। খানিক পরেই হাসি দিয়ে বলতেন- ‘আমার নি:শ্বাস যেদিকে যায় ওইদিকে তুমি বইসো না বাবা। তুমি উজানে বসো। তুমি আমার হাত ধরছো, মাথা ধরছো- আমার অনেক ভাল লাগছে। এবার সাবান দিয়া ভাল করে হাতটা ধোও।‘ তার কথা শুনে তখন খুব মন খারাপ হতো। কিন্তু এখন বুঝি কেন তিনি আমাকে কাছে যেতে দিতেন না!
বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। যৌথ পরিবার ছিল। তবুও চাচারা আমাদের দেখতে পারতেন না। তখন সংসারের হাল ধরেন মা আর বড় বোন গোলাপ জান। অনেক কষ্টে তারা সংসারটা টেনেছেন। অভাবও গেছে খুব। চাচারা পাশে দাঁড়ান নাই। তেমন ভাল খেতে পারতাম না। অথচ চাচারা বাড়িতে আনতেন বড় বড় মাছ। মা তখন ঘরের দরজা বন্ধ রাখতেন। একবার বাড়ির বড় বড় গাছ চাচারা কেটে নিয়ে যান। আমাদের জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেন না। গাছগুলোর জন্য অনেক কাঁদছিলাম তখন। রাগ হতো। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। মা বলতেন-‘তুই গেলেই ওরা তোরে মারবো।’
সে সময় শ্রীপুরের টোটাল নেতৃত্বটা হতো আমাদের গ্রাম থেকে। কাজিমুদ্দিন সাহেব ছিলেন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। গ্রামে দুটি হাতি ছিল ব্রিটিশ আমল থেকেই। ওই হাতি পালতেন আহমেদ আলী পঞ্চায়েত। উনি মুসলিম লীগ করতেন। কাজিমুদ্দিন, নাসিরুদ্দিন আর আজিমুদ্দিন- গ্রামে এরা প্রথম ম্যাট্রিক পাশ করেন। মূলত কাজিমুদ্দিন সাহেবের মুখেই আমরা রাজনীতির খবর জানতাম। উনি মিটিং ডাকলেই আমরা উপস্থিত হতাম।
তখন ঢাকা যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল ট্রেন। বারো মাইল দূরে শ্রীপুর রেল স্টেশন। পায়ে হেঁটে আমাদের যেতে হতো। ঢাকা গেলে পশ্চিমাদের ব্যবহারে খুব মন খারাপ হতো। আমাদের ওরা ছোটলোক ভাবতো। অফিস, আদালত, প্রশাসন- সবখানে ছিল পাকিস্তানিরা। কাগজ তৈরি হতো এদেশে। অথচ সেটা আমাদেরই বেশি দামে কিনতে হতো। স্কুলে এসে ছাত্রনেতারা এসব বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। শুনে ঠিক থাকতে পারতাম না। মিছিলে যেতাম। মিছিল করেছি গাজীপুর বাজার, মাওনা বাজার, কাচিনা বাজার, লোহার বাজার, ফুলবাড়িয়া বাজার প্রভৃতি এলাকায়। স্লোগান তুলতাম-‘আইয়ুব-মোনায়েম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।
মুসলীম লীগের নেতা আহমেদ আলী পঞ্চায়েতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেন আমার চাচারা। কিন্তু আমি ছিলাম তাদের এন্টিতে। আওয়ামী লীগ করতাম, জয়বাংলার লগে থাকতাম। আমাকে নিয়ে তাই মা ভয়ে ভয়ে থাকত। মাঝেমধ্যে বলতেন- তোর বাবা নাই। যদি ওরা মিথ্যা মামলা দেয়।’ মিছিলে গেলেই চাচারা ঘরে এসে না যাওয়ার হুমকি দিতেন। বলতেন- ‘মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা কয়! বড় হইয়া তো ও ডাকাত হইব।’
দেশ স্বাধীন না হলে হয়তো তারা আমাকে ডাকাতই বানাতেন। ডাকাত হই নাই ভাই। দেশের টানে যুদ্ধে গেছি। দেশের জন্য রক্ত দিছি। গ্রামের মানুষ এখন সম্মান করে। দশ গ্রামের লোক চেনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এটাই পরম পাওয়া।
কৈশোরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ এভাবেই করছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল ইসলাম।
দুই ভাই ও দুই বোনের সংসারে নুরুল ইসলাম সবার বড়। বাবা আব্দুল জব্বার ব্যবসা করতেন। বরমী থেকে পান-সুপারি কিনে দোকানে দোকানে বিক্রি আর পাট ও ধান কিনে কালিয়াকৈরের ফুলবাড়িয়া বাজারে বিক্রি করতেন। ব্যবসা ও জমিতে ফসল ফলিয়ে যা আয় করতেন তা দিয়ে ভালভাবেই চলত সংসার। মা মিলন জান ছিলেন গৃহিনী। নুরুল ইসলামদের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট গ্রামে।
নুরুল ইসলামের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি শৈলাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অত:পর তিনি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন শৈলাট উচ্চ বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।
লেখাপড়া ওই সময় কষ্টকর ছিল। নুরুল ইসলামরা পড়তেন রাতে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাল বাইতে মাঠে যেতেন। তারপর পুকুরে গোসল সেরে, নাস্তা খেয়ে ছুটতেন স্কুলের দিকে। নাস্তা ছিল জাউ, খিচুরি বা পান্তা ভাত। স্কুলব্যাগ ছিল না। রশি দিয়ে বেঁধে নিতেন বইখাতা। ওটাই ছিল ব্যাগ। সকাল দশটায় শুরু হতো স্কুলের ক্লাস।
তার ভাষায়- ‘কখনও কখনও কানের মধ্যেই পুকুরে ডুবানো প্যাক লাইগা থাকত। স্যার আইসা কইতেন- ‘কিরে তোর কানের ভিতরে প্যাক কেন?’ বলতাম-‘স্যার সকালে একটু হাল বাইছিলাম।’
“তহন ক্লাসে যে অংকটা করতাম সেটা আর বাসায় করতে হইত না। না পারলে স্যাররা আবার বুঝাইয়া দিতেন। বিরক্ত হতেন না। ছাত্র না পারলে স্যার সেটা নিজের ব্যর্থতা মনে করতো।“
“স্কুল থেকে ফিরাই খেলতে যাইতাম। হা-ডু-ডু, দারিয়াবান্দা আর ফুটবল ছিল প্রিয়। একবার মাওনায় গেছি ফুটবল খেলতে। মাওনা হাই স্কুল বনাম শৈলাট হাই স্কুলের মধ্যে খেলা। আমরা জিতেও যাই। ওরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠিসোটা নিয়া মারতে আসে। কোনওরকমে পালাইয়া আসি ওইদিন। যেকোনও খেলা হইলে তখন অনেক দূর থেকে মানুষ দেখতে আসতো। খেলাধূলা তো এখন তেমন নাই। বিকেল মানেই খেলাধূলার। লেখাপড়ার সময় সেটা না। এটা সবাইকেই বোঝাতে হবে।”
শিক্ষকদের কথা বলতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন- “সুবেদ আলী স্যার ইংরেজি পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এক পাশ থেকে উনি ইংরেজি পড়া ধরেন। এক ছাত্র না পাড়ায় সেকি পিটুনি। ওর মাইর দেখেই পড়া ভুলে যাই। গোটা ক্লাস ওইদিন মার খাইছে। ক্লাস ফোরে অংক পড়াতেন আজিমুদ্দিন স্যার। অংক না পারায় উনি একটা থাপ্পর দিয়েছিলেন। চোখে তখন সরিষার ফুল দেখছি। এরপর আর অংক ভুল করতাম না। এখন তো মারারই বিধান নাই। শিক্ষকরাও হয়ে গেছে কর্মাশিয়াল। এখন সব পড়া হয় প্রাইভেটে।”
ছাত্রাবস্থা থেকেই নুরুল ইসলাম যুক্ত হন ছাত্র রাজনীতিতে। তিনি যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখনই শ্রীপুরের গাজীপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন।
তার ভাষায়- “১৯৬৯ থেকে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আমি যখন ছাত্রলীগ করি তখন গাজীপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন সাইদুর রহমান আর সভাপতি ছিলেন ইদ্রিস।
স্লোগানের কণ্ঠ আমার ভাল ছিল। টিনের চোঙ্গা হাতে কণ্ঠ আকাশে তুলে স্লোগান দিতাম- ‘আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, ঢাকা না পিণ্ডি- ঢাকা, ঢাকা, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ৬ দফা আর ১১ দফা- মানতে হবে, মেনে নাও… । একবার মিটিং করি শৈলাট হাই স্কুলের মাঠে। পরদিন সকালেই শরাফত আলী চেয়ারম্যান পচা চকিদারকে পাঠায় আমাকে ধরে নিতে। উনি ছিলেন মুসলিম লীগার। পচা চকিদারকে দেখেই রক্ত গরম হয়ে যায়। ওর দিকে পানির বদনা ছুড়ে দিয়ে আমি পালিয়ে যাই। গ্রামের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগাররা তখন কাজ করতো পাকিস্তানিদের পক্ষে।”
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন রেসকোর্স ময়দানে। নেতাদের মুখে সে খবর পেয়ে নুরুল ইসলাম ট্রেনে করে চলে আসেন ঢাকায়। সঙ্গে ছিলেন মান্নান, লুৎফর, আফতাব উদ্দিন, হারিছ উদ্দিন প্রমুখ।
অত:পর কী দেখলেন সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে।
তিনি বলেন- “আমরা আসি দুপুর ১২টার দিকে। রেসকোর্স মাঠের পূর্বপাশে ছিলাম। হাজার হাজার মানুষ সেখানে। বাঁশের লাঠি হাতে হাতে। ওইদিনই শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখি। বক্তৃতা শুনেই মনে হইছে- ‘ব্যাডা তো আসলেই বিশাল বড় নেতা।’ বঙ্গবন্ধু বললেন-‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…।’ ভাষণ শুনেই রক্তটা গরম হয়ে যায়। মনে হইছে তখনই যুদ্ধ শুরু করি।”
গ্রামে ফিরে এসেই নুরুল ইসলামরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। তারা বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং শুরুর প্রস্তুতি নেন শৈলাট হাই স্কুল মাঠে। কছিমুদ্দিন ছিলেন আর্মিতে। তিনিই ট্রেনিং করান প্রায় ৬০-৬৫ জনকে। ওই ট্রেনিং তেমন কাজে না দিলেও নুরুল ইসলামদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। শত শত মানুষ তখন পালিয়ে যেতে থাকে নুরুল ইসলামদের গ্রামের পাশ দিয়ে। তাদের মুখে গণহত্যার খবর শোনেন তারা। পানি, মুড়ি ও খাবার দিয়ে সাহায্যও করেন। আপনজন হারানো মানুষের কান্না স্পর্শ করে তাদের হৃদয়কে। এক সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গাড়ে শ্রীপুর উপজেলায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির লোকেরা।
আপনারা তখন কী করলেন?
নুরুল ইসলামের উত্তর- “ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সঙ্গে ছিলেন সোহরাব, শাহজাহান, মতিন, মালেক, মফিজ প্রমুখ। মে মাসের ঘটনা। আমাদের সঙ্গে ছিল এক দালাল। সে অলরেডি দুই-তিনটা গ্রুপকে রেখে আসছে ইন্ডিয়াতে। চতুর্থ গ্রুপে আমরা ৬৫ জন। সবাই কৃষক সেজে একত্রে চলছি। ২-৩জন করে দূরত্ব রেখে এগোই। কিন্তু সাতখামাইর রেল স্টেশনের কাছে আসতেই পাঞ্জাবি ও রাজাকাররা আমাদের ওপর গুলি চালায়। সবাই পালিয়ে আশ্রয় নেয় জঙ্গলে। পরে গোপনে সরে পড়ি যার যার বাড়িতে।“
“বাড়ি ফিরে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। কি করব বুঝতে পারছি না। খবর পেলাম ভালুকায় মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধাদের দল গড়ছেন। উনি থানা আক্রমণ করে এগারটা রাইফেল জোগাড় করেন। অত:পর ছাত্র, পুলিশ, ইপিআর ও আনসারদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কছিমুদ্দিন আফসার সাহেবের দলে যোগ দিলে আমরাও সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। একদিন সকালে মা চিড়া ভাঁজছিলেন। আমি দুই মুঠা চিড়া আর মায়ের একটা কাঠের বাক্স থেকে ৪০ টাকা নিয়ে ঘর ছাড়ি।“
ভিডিও : ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ঘটনার কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল ইসলাম
“ভালুকার মল্লিকবাড়িতে জঙ্গলা গজারী বাগানে ছিল আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। ক্যাম্পে আর্মি অফিসার শামসুদ্দিন সাহেব, হাকিম সাহেবকে পাই। কোম্পানি কমান্ডার মজিবুর রহমানও ছিলেন সেখানে। ওখানে আমাদের রাইফেল, গ্রেনেড থ্রো শিখানো হয়। ৪-৫ দিনেই সব রপ্ত করে ফেলি। অত:পর হাতে দেওয়া হয় থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর দুটি গ্রেনেড। স্বল্পকালীন ওই ট্রেনিং নিয়েই অপারেশন করি ভালুকার চানপুর ও ধামশুর এলাকায়।
জুলাই মাসে মেজর আফসারের সঙ্গে আমরা ৮০ জন চলে যাই ইন্ডিয়ায়। মেঘালয়ের তুরা ক্যাম্পে চলে আমাদের ২০দিনের হায়ার ট্রেনিং। সেখানে শেখানো হয় এলএমজি, এসএলআর চালানোসহ বিশেষ কিছু রণকৌশল। প্রশিক্ষক গুরচরণ সিংয়ের কথা এখনও মনে পড়ে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৯৪৭।”
ট্রেনিং শেষে কোরআন শপথ করানো হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। রাগের বশীভূত হয়ে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবো না, দেশের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতেও দ্বিধা বোধ করবো না, দেশের সাথে বেঈমানি করবো না- এমনটা ছিল সে শপথ। অত:পর অস্ত্র হাতে নুরুল ইসলামরা শ্রীবর্দী ও হালুয়াঘাট হয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহে, অবস্থান নেন মধুপুর জঙ্গলে। এগার নম্বর সেক্টরের আফসার ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক ছিলেন মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ। তার অধীনেই মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর ব্রিজ ধ্বংস করা, ফুলবাড়িয়ায় লোহার ব্রিজ উড়ানো, ভালুকার চানপুরের অপারেশন প্রভৃতি যুদ্ধে অংশ নেন।
এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন এই বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার বাম হাঁটু ও কপালে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারেন না এই মুক্তিযোদ্ধা। পায়ে ব্যথা হয় প্রায়ই। হাঁটতে গেলে হঠাৎ বসে পড়েন। পা তখন কাজ করে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলবে দেশের জন্য এই বীরের কষ্টের অনুভূতি।
কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনটিতে?
জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম প্রথমে অশ্রুসিক্ত হন। অত:পর নিজেকে সামলে নিয়ে জানান রক্তাক্ত ওই দিনটির আদ্যপান্ত। তার ভাষায়-
“১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমাদের ক্যাম্প তখন মল্লিকবাড়ির ধামশুরে। পাকিস্তানিরা আসছিলো ময়মনসিংহের দিক থেকে। ওদের সঙ্গে আমাদের তুমুল গোলাগুলি চলে পারাগাঁও এলাকায়। ওখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন মেজর আফসারের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নাজিমুদ্দিন আহমেদ। আমরা তখন ঠিক থাকতে পারি না। পাকিস্তানিরা এগোতে থাকে। সে অনুসারে আমরাও পজিশন বদলাই এবং ওদের ওপর আক্রমণ করি। ওরা চলে আসে কাচিনা মাদ্রাসায়। সেখানেও তুমুল যুদ্ধ চলে। ওরা ছিল ৫০-৬০ জনের মতো। আমরা প্রায় ডাবল। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য গ্রুপও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
ভিডিও : একাত্তরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার কথা বলেছেন মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম
গোলাগুলিতে এক সময় মারা পড়ে ওদের ৮ জন, জীবিত ধরা পড়ে আরও ৪ জন পাকিস্তানি সেনা। বাকিরা গুলি করতে করতে গাজীপুরের দিকে এগোতে থাকে। আমরাও ওদের পিছু নিই।মাওনার কাছে একটা পাথার আছে। ওটা লবলং সাগর হিসেবে পরিচিত। আমরা এর পূর্ব পাশে গিয়ে ওদের ঘেরাও করি। পাকিস্তানি সেনারা ছিল পশ্চিম পাশে। ওখানে যুদ্ধ শুরু হয় বিকেল ৪টায়। আমাদের সঙ্গে ছিল এলএমজি, মর্টার আর এসএলআর। একটা পুকুরের পাশে খেজুর গাছের আড়ালে ছিল আমার পজিশন।
রাত তখন ৮টার মতো। খুব গোলাগুলি চলছে। হঠাৎ একটা খবর আসে। মেজর আফসার মর্টারের আঘাতে আহত হয়েছেন। খবরটা শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। জয়বাংলা বলে উঠতে যাচ্ছিলাম। অমনি পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটা গুলি এসে লাগে।
প্রথম ছিটকে পড়ে যাই। বাঁ পা-টা তুলতে পারছিলাম না। একটা গুলি বা হাঁটুতে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েও পড়ে গেলাম। কপালেও গুলি লাগে একটা। তবে সেটা মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে আজও বেঁচে আছি। কপালের রক্তে মুখ ও বুক তখন রক্তাক্ত হয়ে যায়।
সহযোদ্ধা মজিবুর, কসিমুদ্দিন, নুরুল ইসলাম, এনামুল হক, মালেক প্রমুখ আমাকে তুলে নেয় মাওনা বাজারের উত্তর পাশে, আহসানউল্লাহ সাহেবের বাড়িতে। ওখানে সন্তোষ চন্দ্র দাস আমার চিকিৎসা করেন। পায়ে ও কপালে উনি ব্যান্ডেজ করে দেন। ফলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।
পরদিনই আবার চলে আসি রণাঙ্গণে। যুদ্ধ করি ইজ্জতপুরে। সেখানে মারা পড়ে পাকিস্তানিদের আরও ৫ জন। অতঃপর রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত হলে শামসুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সেখানে অবস্থান নেয়।
প্রকৃতপক্ষে মেজর আফসার গুরুতর আহত হননি। ফলে তার নেতৃত্বেই আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হই। ১৫ ডিসেম্বর রাতে নতুন এয়ারপোর্ট হয়ে চলে আসি তোপখানা রোডে, সালাম সাহেবের বাড়িতে। উনি ছিলেন আফসার সাহেবের বিশেষ পরিচিত। ওইদিন তার বাড়ির দোতলাতেই আমরা রাত্রিযাপন করি।
পরে আমার পা প্রচণ্ড ফুলে যাওয়ায় ১৮ ডিসেম্বর আমাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেলে। চিকিৎসা হয়েছে অনেক। এখনও হাঁটতে গেলে হঠাৎ বসে পড়ি। পা তখন কাজ করে না। মানুষের সামনে খুব লজ্জা পাই। তবে রক্ত দিয়ে স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এটা ভেবেই আজ সব কষ্ট ভুলি।”
অনেকেই তো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেনি, আপনি কেন গেলেন?
মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন-‘আমরা তো মরতে গেছি ভাই। দেশ স্বাধীন হবে, আমারে টাকা দিবে, থাকার বাড়ি দিবে- এই চিন্তা কি তখন ছিল! বাবা নাই। পশ্চিমারা অত্যাচার করছে। জিদ্দে গেছি। দেশ স্বাধীন কবে হবে আমরা তো জানতাম না। তবে হায়নাদের রুখতে হবে। এদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে। এটাই ছিল উদ্দেশ্য।’
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?
চোখে মুখে আলো ছড়িয়ে এই বীরের উত্তর- ‘স্বাধীন দেশ পেলাম। একটা পতাকা পেয়েছি। জয়বাংলা স্লোগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে মানুষের উল্লাস দেখি। এটা অনেক বড় পাওয়া। তবে স্বপ্নের সোনার বাংলা এখনও হয়নি। তবে এখন আমরা সে পথে চলছি।’
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা প্রসঙ্গে এই যোদ্ধা বলেন- ‘রেডিওতে শুনি সংবাদটি। বাঙালি জাতির জন্য এটা কলঙ্কজনক অধ্যায়। আপনি আপনার বাবাকে কি গুলি করে মারতে পারেন? আপনি যদি আপনার পিতাকে মারেন তাহলে আপনি পৃথিবীর কোন দেশে গিয়েও শান্তি বা সম্মান পাবে না। জাতির জনককে যারা মারছে তার মানুষ না। বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষের আসলে মৃত্যু হয় না। ব্যক্তি এখন নাই। কিন্তু শেখ মুজিবের চেতনা তো এখনও বেঁচে আছে। হাজার বছরেও তা হারাবে না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন প্রজন্মের মাঝে।’
সে সময়কার একটি ঘটনার কথা মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম উল্লেখ করেন ঠিক এভাবে- “পঁচাত্তরের পর শ্রীপুরে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনের অনুষ্ঠানে তখন তেমন লোক পাওয়া যায়নি। ভয়ে কেউ ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ করত না। বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম-ফারুক একবার আসে শ্রীপুরে। আমরা তখন মাত্র ২০-২৫জন পথে নামি। বঙ্গবন্ধুর জন্য বুকভরা কষ্ট নিয়ে স্লোগান তুলি- ডালিম তুমি যেই হও শ্রীপুর ছেড়ে চলে যাও, শেখ মুজিব হত্যার বিচার চাই।”
জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে নারাজ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত।
তার ভাষায়- “জিয়া কেমন মুক্তিযোদ্ধা সেটা আপনারাই ভাল জানেন। একাত্তরে জয় বাংলা স্লোগান না দিলে কোন মুক্তিযোদ্ধার রক্ত গরম হয় নাই। অপারেশনের সময় আমরা জয়বাংলা বলতাম। সকল বাঙালির স্লোগান এটা। জয়বাংলা স্বাধীনতার স্লোগান। একাত্তরে জিয়াউর রহমান কি জয়বাংলা বলেছিলেন? এটা আপনারাই গবেষণা করে বের করেন। যে জয়বাংলা বলে না আমার মতে সে মুক্তিযোদ্ধা না। তাছাড়া উনি তো রাজাকারকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে আবার জিন্দাবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে তার আমলেই নি:শব্দে হত্যা করা হয়েছে। রাজাকারদের উত্থানের পেছনেও জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী দায়ী। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের তারা মাথায় তুলে রেখেছেন। স্বাধীন দেশের মন্ত্রী পরিষদে স্থান দিয়েছে রাজাকারদের। ইতিহাসকে করেছেন কলঙ্কিত। তাহলে বলেন, এটা কি কোন মুক্তিযোদ্ধার কাজ হতে পারে?”
আপনি তো ছাত্রলীগ করতেন, এখনকার ছাত্রলীগ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন- “পার্থক্য তো অনেক। আমরা আগে ব্যবসা করতাম না। তখন ছাত্রলীগের ছেলেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। এখনকার ছাত্রলীগ নেতারা অধিকাংশ ব্যবসা আর টেন্ডার নিয়ে ব্যস্ত। সরকারে কিছু মন্ত্রী আর শেখের মেয়ের টাকার নেশা নাই। এখন যারা ছাত্রলীগ করছে তারা কি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শের মানুষ হতে চায়? দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কিন্তু অবশ্যই সৎ হতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধের সাতচল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
তিনি বলেন, “সনাক্তকারী মুক্তিযোদ্ধারাই প্রথম দায়ী। টাকার লোভে আমরা আমাদের চরিত্রটাকে ঠিক রাখতে পারিনি ভাই। এই তালিকা এখন যত বাড়বে, বির্তকও তত বাড়বে।”
চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল নয় বরং সংস্কার করা উচিত বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার যুক্তি,”আমরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ভাতা দিতে গিয়েও সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়। তবুও কেন করছে। কারণ যারা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, স্বাধীন এই দেশের সরকার তাদের এক ধরণের সম্মানিত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর সময়কার কোটা বাতিল করার অর্থ কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এক ধরনের অসম্মান করাই। সরকার নিশ্চয়ই এটা ভেবে দেখবে।”
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাললাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে যুদ্ধাহত বীর নুরুল ইসলাম বলেন, “দেশের উন্নয়ন, মানুষের মুখের হাসি আর সোনার বাংলা গড়ার সরকারি পরিকল্পনা দেখলে মন ভরে যায়।”
খারাপ লাগে কখন?
“যখন কোন পরিবারের যুবককে মাদকাসক্ত হতে দেখি তখন খুব খারাপ লাগে। মাদক আমার সন্তানকে নষ্ট করার চক্রান্ত। দেশকে উন্নত করতে চাইলে মাদকে ধ্বংস করতে হবেই।”
প্রজন্মের হাত ধরেই এই দেশটা একদিন উন্নত বাংলাদেশ হবে- এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল ইসলামের। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন- ‘তোমরা প্রজন্ম, জাতির বিবেক। তোমাদের কাছেই আমরা দেশ দিয়ে যাচ্ছি। দেশটাকে সন্তানের মতো ভালবেসো। লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে দেশটাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরো। বাংলাদেশ যেন হয় সত্যিকারের সোনার বাংলা। এই দাবি তোমাদের কাছে রেখে গেলাম।”
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল ইসলাম।
ট্রেনিং: ভালুকার মল্লিকবাড়িতে স্বল্পকালীন ও পরবর্তীতে মেঘালয়ের তুরা ক্যাম্পে ২০ দিনের উচ্চতর ট্রেনিং নেন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৯৪৭।
যুদ্ধ করেছেন : এগার নম্বর সেক্টরের আফসার ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ এর অধীনে। টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর ব্রিজ ধ্বংস করা, ফুলবাড়িয়ায় লোহার ব্রিজ উড়ানো, ভালুকার চানপুরের অপারেশন প্রভৃতি যুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধাহত : ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাত তখন ৮টা। শ্রীপুরের মাওনায় লবলং সাগর এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে তাঁর বা হাঁটু ও কপালকে রক্তাক্ত করে। এখনও তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারেন না।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৭ অক্টোবর ২০১৮
© 2018, https:.