গৌরীপুর গণহত্যার স্মৃতি রক্ষা হয় নাই
দুই নদীর মিলনস্থল গৌরীপুরে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ গ্রামটি। মাছ ধরা, নদীর জলে আনন্দ সাঁতার আর বর্ষায় স্রোতের সঙ্গে সংগ্রাম- এভাবেই নদী এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে শান্ত এই নদীগ্রামেই গর্জে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতিয়ার। নদীর ওপারেই ভৈরব। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। ১১ নভেম্বর ১৯৭১। বিকেলবেলা। দুটি লঞ্চ আর গানবোট নিয়ে তারা হানা দেয় গ্রামটিতে। সঙ্গে ছিল রাজাকার ও আলবদরের লোকেরা। এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৬০টি বাড়ি প্রথমে তারা কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়। অতঃপর ধরে আনে মুক্তিকামী নিরীহ-নিরপরাধ ১৭ জনকে। বুড়ো মানুষও রক্ষা পায় না। সবাইকে হাত বেঁধে লাইন করে দাঁড় করানো হয় নৌকাঘাটে। এরপর পাকি কমান্ডারের নির্দেশ ‘ফায়ার’।
নিরীহ মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণার চিৎকারও সহ্য হয় না পাকিস্তানি সেনাদের। বেয়নটের খোঁচায় তারা স্তব্ধ করে দেয় তাদের আর্তনাদ। সবার মৃত্যু নিশ্চিত করেই ওই দিন গৌরীপুর ত্যাগ করে পাকিস্তানি সেনারা।
গ্রামের আব্দুর রহমান ব্যাপারি ও আব্দুল সোবহানসহ অনেককে মারা হয় আগুনে পুড়িয়ে। ৮০ বছরের বুড়োকেও রেহাই দেয়নি তারা। রাস্তার ওপর থেকে নদী পর্যন্ত পড়েছিল অনেক লাশ। আর নৌকাঘাটে হত্যা করা হয় গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, হাদিস মিয়া, দারোগ আলী মিয়া, সামু, জিন্নত আলী, মোসলেম ও রফিক মিয়াসহ সতেরোজনকে।
কেন এই গণহত্যা? সে উত্তর মিলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের জবানিতে- ‘ওরা কোনো আবস্থাতেই ভৈরব থেকে মুভ করতে পারত না। আমরা কোহিনূর জুট মিলের বাউন্ডারির ভেতরে অবস্থান নিয়ে থাকতাম। সেখান থেকে ছোট ছোট দলে অপারেশন করেই সরে পড়তাম। ভৈরব থেকে ওরা মুভ করলেই নদীপথে আমরা ওদের ওপর আক্রমণ করে ভয় দেখাতাম। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশেষ জেদ ছিল এ গ্রামটির প্রতি।’
ছোটবড় অনেক নৌকা ভেড়ানো ঘাটে। উঁচু বাঁধের মতো রাস্তা। ঘাটে নামতে তৈরি করা হয়েছে পাকা সিঁড়ি। প্রতিদিন এ পথেই কয়েক হাজার মানুষের যাতায়াত। কিন্তু তারা জানে না ১৯৭১-এ কী ঘটেছিল এখানে। নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা সাইনবোর্ড। একাত্তরে শহীদদের রক্তভেজা মাটিতে পা দিয়েই চলছে এখানকার জনযাত্রা।
এ ঘাটেই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে মোসলেম উদ্দিনের ভাইকে। লাশের জায়গাটিকে দেখিয়ে তিনি বলেন- ‘আমার ভাই খুব কষ্টে মারা গেছে। কোহিনূর মিলে চাকরি করত। পাকিসানিরা আইসা গোলাগুলি শুরু করল। ওরে বাজারে পায় ওরা। সেখানে মেরেছে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। ও মাথা তুলতে গেলে পায়ের বুট দিয়া ওরা পাড়া দিছে। তার নাকের মাংসও তুলে ফেলে। ওই লাশই আমরা পাইছি। এই মৃত্যুর তো কোনো দাম নাই এহন। স্মৃতিসৌধের জন্য দাবি তো করছি। কই, কিছুই তো হয় নাই।’
দুই নদীর মিলনস্থল হওয়ায় ১৯৭১ সালে এই ঘাটেই ভেসে আসত শত শত লাশ। কোনো কোনোটি পচে দুগন্ধ ছড়াত। গ্রামের মানুষ বাঁশ দিয়ে সেগুলো স্রোতের দিকে ভাসিয়ে দিত। যেগুলো দাফনের অবস্থায় পাওয়া যেত, গ্রামবাসী তা তুলে মাটিচাপা দিত। তাই গৌরীপুর গণহত্যার স্মৃতি রক্ষা করা জরুরি। তা না হলে একাত্তরের রক্তাক্ত ইতিহাস হারিয়ে যাবে নদীর জলে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮
© 2019, https:.