পাহাড়িয়া বিদ্রোহ-০১: জীবন রক্ষায় বিদ্রোহ করেছিল পাহাড়িয়ারা
১৭৮৯ থেকে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, তিন বছর বীরভূম, বাঁকুড়া জেলায় এক ব্যাপক গণবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। ওই অঞ্চলের উঁচুভূমি ও জঙ্গলের আদিবাসীদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজ প্রশাসন ও জমিদার-জোতদাররা নানাভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছিল। ফলে একসময় তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে, যা পাহাড়িয়া বিদ্রোহ নামে অধিক পরিচিত।
বিদ্রোহের সময় পাহাড়িয়া আদিবাসীরা ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বাঁশের তৈরি তীর-ধনুক ও দেশীয় বন্দুক ও তলোয়ার ব্যবহার করে। তাদের আক্রমণে ওই অঞ্চলের ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।
এই বিদ্রোহীরা কারা ছিল, সে বিষয়ে সরকারি ইতিহাস ও গেজেটিয়ার রচয়িতা উলিয়াম হান্টার নিজের মতামত তুলে ধরেছেন এভাবে—তারা ছিল বীরভূমের পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ উচ্চভূমির অধিবাসী। তাদের জাতিগত উৎপত্তি, ভাষা,ধর্ম প্রভৃতি ছিল সমতল ভূমির অধিবাসীদের জাতিগত উৎপত্তি, ভাষা, ধর্ম থেকে একেবারেই আলাদা।
আবার ইংরেজ শাসনের প্রথম যুগের রাজস্ব-কর্মচারী ক্যাপ্টেন সেরউইল এদের পার্বত্য-অরণ্যচারী ও লুটতরাজকারী অভিহিত করে লিখেছেন—এই জেলাগুলোর অধিবাসীদের নিকট হতে এরা বলপূর্বক অর্থ আদায় করত, যখন অর্থ পেত না, তখনই তারা সশস্ত্র অবস্থায় সংগঠিত হত এবং বাঁশের তীর-ধনুক নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসত। কেউ বাধা দিলে তাকেই তারা হত্যা করত। তারা লুটতরাজ করে আবার জঙ্গলের নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যেত। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসত প্রতিবছর শীতের শুরুতে, যখন বছরের প্রধান ফসল কাটার সময় হতো।
এ ছাড়া সেরউইল তার সরকারি রিপোর্টে এই পাহাড়িয়াদের সমতলভূমির অধিবাসীদের নিকট মূর্তিমান বিভীষিকা এবং তাদের শত্রু বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রামাণ্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে উলিয়াম হান্টার দেখিয়েছেন যে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সমতলভূমির অধিবাসীরা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ওই পাহাড়িদের সঙ্গে হাত মেলায়। শুধু তাই নয়, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাহাড়িয়া মানুষগুলো বাঁশের তীর-ধনুকের পরিবর্তে দেশীয় বন্দুক এবং তলোয়ারও ব্যবহার করে।
উল্লেখিত সরকারি তথ্যে এটা স্পষ্ট হয় যে, পাহাড়িয়া আদিবাসীরা সমতলে বসবাসকারী কৃষকদের শক্র ছিল না। বরং ইংরেজ শাসকগণই ছিল ওই অঞ্চলে পাহাড়িয়া ও সমতলভূমির কৃষকদের একমাত্র শক্র। পাহাড়িয়া আদিবাসীদের সঙ্গে বীরভূম ও বাঁকুড়ার চাষিরাও নানা প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিল। এরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে তীর-ধনুক ছাড়াও তলোয়ার ও বন্দুক ব্যবহার করে। এ থেকে বোঝা যায় বিদ্রোহীরা শিল্পকৌশলেও এগিয়ে ছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও মহামারীর ফলে পশ্চিমবঙ্গ, বীরভূম ও বাঁকুড় জেলার সমতল অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক ও অন্যান্য জাতির মানুষ মারা যায়। ফলে একেবারেই ভেঙে পড়ে গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা। সে সময় যে অল্প সংখ্যক গ্রামবাসী বেঁচে ছিল, তাদের জীবনও ইংরেজ শাসক ও জমিদারদের অত্যাচারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফলে কৃষক ও কারিগর শ্রেণির অধিবাসীরা ইংরেজ ও জমিদারদের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে একসময় জঙ্গল ও পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। অতঃপর ফসলের সময় তারা যৌথভাবে পাহাড়িয়া আদিবাসীদের সঙ্গে সমতলে নেমে এসে ফসল লুটের মাধ্যমে জীবনধারণ করে। ইংরেজ শাসক ও জমিদারগণ তাদের এই একমাত্র জীবনধারণের উপায়টি জেনে তা সামরিক শক্তিতে বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। ফলে জীবন রক্ষার তাগিদে ইংরেজ ও জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে তারাও সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।
১৭৮৮খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে বিদ্রোহীদের আক্রমণ শুরু হয়। বীরভূম জেলার উত্তর প্রান্তে গঙ্গার তীর বরাবর প্রায় একশ মাইলজুড়ে বিদ্রোহীরা ছোট ছোট দলে আক্রমণ চালায়। তাদের টার্গেট ছিল বীরভূম জেলার উত্তরে গঙ্গার তীরবর্তী ইংরেজ বণিকদের কুঠি, ব্যবসায়ীদের নৌকা ও জমিদারদের কাছারি।
ইংরেজরা তা বুঝতে পেরে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি হিসেবে সেখানে সেনা পাঠায় এবং ওই অঞ্চলকে বীরভূম ও বাঁকুড়া দুটি আলাদা জেলা গঠন করে। প্রত্যেক জেলায় একজন কালেক্টর নিযুক্ত করা হয়। যারা রাজস্ব আদায়ের প্রধান কর্তা ছাড়াও সেনাবাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব পান। সে সময় ক্রিস্টোফার কিটিং নামে একজন ইংরেজ বীরভূমের শাসনভার গ্রহণ করে। তিনি বিদ্রোহ দমনে ওই অঞ্চলে একটি সৈন্যবাহিনী নিযুক্ত করে।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। বিদ্রোহীরাও কৌশলে পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কয়েক দফায় বীরভূমে আক্রমণ চালায়। তারা জেলা প্রশাসকের প্রধান ঘাঁটির নিকটবর্তী একটি বাজার ও মহাজনদের আড়ত, ত্রিশ-চল্লিশটি গ্রামের জমিদারদের গোলা, ইংরেজদের কুঠি লুটে নেয়। তাদের প্রবল আক্রমণের কাছে ইংরেজ সৈন্যদল টিকতে পারে না। ইংরেজ বাহিনীর পক্ষে এই বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে জেলা শাসক নিয়মিত সেনাদের সঙ্গে অনিয়মিত সেনাও নিযুক্ত করে। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। বরং বিদ্রোহ ক্রমশ বীরভূমের সীমানা ছাড়িয়ে বাঁকুড়া, বিষ্ণপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ইংরেজরা তখন কৌশল পাল্টায়। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ জেলাগুলোর একটি বিশেষ অঞ্চল নির্দিষ্ট করে ওই অঞ্চলের কালেক্টরদের নিয়ে একযোগে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। এ সময় বিদ্রোহ দমনের বিশেষ দায়িত্ব পড়ে বীরভূম ও বিষ্ণপুরের কালেক্টর কিটিংয়ের ওপর। কিন্তু এতো আয়োজনের পরও ইংরেজদের পক্ষে বিদ্রোহ দমণ করা সম্ভব হয় না। বরং বিদ্রোহ ক্রমশ বীরভূমের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ছড়াতে থাকে।
ওই সময় ঘটে আরেক ঘটনা। রাজস্ব বা কর বাকি পড়ার অপরাধে বিষ্ণপুরের রাজাকে ইংরেজ শাসকগণ বন্দি করে এবং সেখানে কর তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় হেসিলরিজ নামে এক ইংরেজকে। এর ফলে বিষ্ণুপুরের প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯
© 2019, https:.