মহানন্দার তীরে, চা বাগানের মাঝে
সুন্দর পাকা রাস্তা। যতই এগোচ্ছি ততই সবুজ ঘিরে ফেলছে। সীমান্তের কাঁটাতারও ঢাকা পড়েছে সবুজে। এই সবুজের ধরনটি ভিন্ন। সৌন্দর্যও অসাধারণ। সমতলের চা বাগানের কথাই বলছিল বন্ধু অরণ্য। ১৯৯৮ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াতেই গড়ে উঠেছে অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান। একসময় অলস পড়ে থাকত ওখানকার জমিগুলো। সেখানে প্রথম অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করে কাজী টি এস্টেট। এখন তেঁতুলিয়া চা করপোরেশন লিমিটেড, স্যালিন্যাল টি এস্টেটসহ প্রায় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান চা চাষ করছে।
ভ্রমণপাগল অরণ্যের মামাবাড়ি পঞ্চগড় শহরে। তার উৎসাহেই এক সকালে মৃদুল ও বাবলাসহ চার বন্ধু পা রাখি পঞ্চগড়ের মাটিতে। সকালের নাস্তা সেরেই দিই ছুট। তেঁতুলিয়ার পথে পথে ঘুরতে আমাদের অবলম্বন ভাড়া করা একটি মাইক্রোবাস। নিজেদের কথোপকথনের সঙ্গে গাড়িতে বাজছে সায়ানের গান। কিছু দূর যেতেই থেমে যায় গাড়িটি। অরণ্যের হুংকার। এবার নামতে হবে। আড়মোরা ভেঙে নামতেই থ হয়ে যাই। চলে এসেছি স্যালিন্যাল টি এস্টেটে। এটি অমরখানা ইউনিয়নে। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ চা বাগান। ১ থেকে ১৫ জন নারী কাঁধে সাদা ঝোলা ঝুলিয়ে অবিরাম চা পাতা তুলছেন। নয়নাভিরাম সে দৃশ্য। পায়ে হেঁটে আমরা ভিতরগড়ের পথ ধরি। অল্প সময়েই খুঁজে পাই সীমান্তঘেঁষা সুলতান হোসেন শাহ্ আমলের উঁচু গড়। এটিই ঐতিহাসিক ভিতরগড়। গড়ের দুদিকেই চা বাগান। চারদিক সুনসান। দূরে ডেকে চলেছে কোনো অজানা পাখি। ঘন সবুজ চা-গাছগুলোকে রোদ থেকে আগলে রেখেছে ছায়াতরু বা শেড ট্রি হিসেবে লাগানো ঔষধি গাছগুলো। কী যে অদ্ভুত! হঠাৎ মৃদুলকে খুঁজে পাচ্ছি না। দূরের পথ থেকে ভেসে আসে তার কণ্ঠ- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’।
হঠাৎ চা-গাছের ঝোপে কী যেন নড়ে উঠল। থমকে দাঁড়াই। হিস হিস শব্দ করতেই দেখি আরেক দৃশ্য। ছুটে পালাল ১০-১৫টি সাদা, কালো, বাদামি রঙের খরগোশ। বাগান থেকে আমরা উঠি উঁচু গড়টিতে। বহু দূর পর্যন্ত চলে গেছে এটি। ভিতরগড় ছাড়াও এ জেলায় রয়েছে হোসেইনগড়, মীরগড়, রাজাগড় আর দেবেনগড়। পাঁচটি গড় নিয়েই নাম হয়েছে পঞ্চগড়। গড়ে দাঁড়াতেই অন্যরকম লাগে। এই বুঝি রাজা এসে পড়বে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। এক যুবক জানাল খুব কাছেই মহারাজার দিঘি। দিঘির খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য বলে, এক সময় এই দিঘি থেকে ১৩৫ মিটার দূরে পৃথ্বীরাজের বাড়ি ছিল। ‘কামরূপ বুরুঞ্জি’তে রাজা জল্পেশ্বরকে বলা হয়েছে পৃথু রাজা। অমরখানা ছিল তার রাজধানী। প্রায় ৫৪ একর জমির বুকে টলমলে জলরাশি নিয়ে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে নয়াভিরাম এই দিঘি।
দেখলাম, এর পাড়জুড়ে শত শত গাছ। কোনো কোনোটির অবয়ব শতবর্ষী। নানা পাখপাখালির বাঁধভাঙা কণ্ঠ দিঘিপাড়ের নীরবতা ভাঙছে। আমাদের অবাক করে দিয়ে দিঘিতে নামে পানকৌড়িদের ঝাঁক। মাঝেমধ্যে ঝাঁপ দেয় মাছরাঙাও। এক বৃদ্ধ জানালেন প্রচলিত এক কাহিনী- দিঘির পানি কখনো শুকায় না। পৃথু রাজা একবার ‘কীচক’ দ্বারা আক্রান্ত হন। নিচু জাতের সংস্পর্শে তার জাত-ধর্ম নাশ হয়। রাজা তাই এই দিঘিতেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। তাই দিঘির ঘাটে এসে আগে কিছু চাইলেই নাকি মিলত সব। কাহিনী শুনে মৃদুল মুচকি হাসে। অতঃপর আমরা সোজা বাংলাবান্ধার পথ ধরি। জিরো পয়েন্টে নানা ঢঙে সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকে বাবলা। এদিকে পেট বাবাজি তো বিদ্রোহ করে আছে। আমরা তাই দুপুরের খাবার সারি তেঁতুলিয়া বাজারে, এক ছোট্ট হোটেলে। দুপুরে পেরুতেই মহানন্দা নদীর তীরে আড্ডা জমাই। এ জায়গাটি অন্যরকম। সীমান্তের কাঁটাতারের ওপাশে ভারতের একটি পাকা রাস্তা সোজা চলে গেছে শিলিগুড়ির দিকে। দূরে দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলো যেন মৌনী সাধু! আকাশের সঙ্গে তাদের জন্ম-জন্মান্তরের মিতালী যেন। এপারে বাংলাদেশ অংশে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মহানন্দা নদী। শত শত লোক কোমর পানিতে নেমে পাথর তুলছে। সাদা, কালো, বাদামি নানা রঙের পাথর। নদীর পাশেই উঁচু টিলাতে একটি ডাকবাংলো। সেখান বসে আমরা চারপাশের চমৎকার সব দৃশ্য দেখি। কেয়ারটেকার জানালেন, দূর থেকে দার্জিলিংয়ের পাহাড়, মহানন্দার কলকল ধ্বনি আর সীমান্তের সৌন্দর্য দেখতে এ বাংলোতেই দুদিন কাটিয়েছিলেন প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান। তার অমর কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ এখানে বসেই রচনা করেছিলেন।
নদীর পাড় ঘেঁষা রাস্তায় আমরা হাঁটতে থাকি অচেনা পথে। সন্ধ্যা হতেই নিঝুম হয়ে আসে চারপাশ। কিছু সময় পর স্নিগ্ধ আলোয় ভরে যায় চারদিক। চাঁদের আলোয় তখন অপরূপা হয়ে ওঠে মহানন্দা। দূরে শিলিগুড়ি আর দার্জিলিংয়ের বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। আমরাও যেন হারিয়ে যাই কোনো স্বপ্নলোকে।
কীভাবে যাবেন : ঢাকার আসাদগেট ও কল্যাণপুর থেকে পঞ্চগড়ের একাধিক বাস ছেড়ে যায়। এখন ট্রেনেও যাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে তেতুলিয়া বাস ভাড়া ৭০০-১৮০০ টাকা, ট্রেনে ৬০০-১১০০। তেতুলিয়ায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও অনুমতি নিতে হয়। উপজেলা ডাকবাংলোয় থাকতে ইএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মোবাইল : ০১৭৭০০০৮১৮৭
ফোন (অফিস) : ০৫৬৫৫-৭৫০০১ তবে পঞ্চগড় শহরে থাকার একাধিক হোটেল রয়েছে। ভাড়া ৮০০-২০০০ টাকা। পঞ্চগড় থেকে ভাড়া করা মাইক্রোবাস বা লোকাল বাস ও অটোরিকশায় ঘুরতে পারেন তেঁতুলিয়া।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ জানুয়ারি ২০১৯
© 2019, https:.