বাংলার প্রভাব ও আদিবাসী ভাষার বিপন্নতা
দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম ঝিনাইকুড়ি। এ গ্রামেই বসবাস কড়া আদিবাসীদের। গোটা দেশে এরা টিকে আছে মাত্র উনিশটি পরিবার। নিশ্চিহ্নপ্রায় এ জাতির ভাষা, সংস্কৃতি আর আচার একেবারেই ভিন্ন। গ্রামের শিতা কড়া আর কোলো কড়ার আদরের সন্তান কৃষ্ণ কড়া। লেখাপড়ায় তার হাতেখড়ি স্থানীয় একটি এনজিও স্কুলে। সেখানে ছিল আদিবাসী ভাষার শিক্ষক। ফলে অভয়েই চলে শিক্ষা লাভ। নানা কারণে একসময় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। কৃষ্ণ তখন ভর্তি হয় নিকটবর্তী রাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সেখানে গিয়ে সে যেন সাগরে পড়ে! মায়ের কড়া ভাষায় বিদ্যালয়ের কেউই কথা বলে না। শিক্ষকসহ সবাই বাঙালি। প্রথম দিকে জাত যাওয়ার ভয়ে কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে অনেকেই। তাদের আচরণ আঘাত করে তার শিশুমনে। কিন্তু মায়ের উৎসাহে সাহস হারায় না। বাংলা ভাষা তার কাছে ভিন্ন ভাষা। তা বুঝেই পরীক্ষায় পাস করা—শিশু বয়সে এ ছিল দুরূহ ব্যাপার! তাই পাস-ফেলের মধ্যেই কেটে যায় আটটি ক্লাস।
কৃষ্ণ এখন রপ্ত করেছে বাংলা ভাষা। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও বাঙালি। বাংলা ভাষাভাষীর আধিক্য ও পারিপার্শ্বিকতার প্রয়োজনে গোত্রে এ প্রজন্মের সবার মাঝেই বাংলা বলার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এভাবে কড়ারা হারিয়ে ফেলছে তাদের মাতৃভাষাটি।
রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারীদের এই দেশে, আদিবাসীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে—এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখের ও অপমানের।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কিছু কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করলেও তা চলছে ঢিমেতালে। প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা হয়—প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো—এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাওঁ (কুড়ুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষায়ও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে।
সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের পাঁচটি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। এ বছরও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ একই দেশে বাঙালি শিশুরা পড়াশোনা করছে চিরচেনা মায়ের ভাষায়। তাই সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকছে।
আবার আদিবাসী ভাষাগুলো কতটা বিপন্ন—এ নিয়ে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক সংগঠন সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকের বাংলাদেশ শাখা প্রায় ৩০টি আদিবাসী ভাষার ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপ চলে ‘ফিশম্যান মানদণ্ড’ মোতাবেক। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদণ্ডের রয়েছে আটটি স্তর। কোনো ভাষা চতুর্থ স্তরের পরের স্তরে চলে গেলেই ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ওই মানদণ্ডের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয় ছিল, ভাষাটি ঊর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি না। বিপন্নতার শুরু যে পঞ্চম স্তরে, সেখানে বিচার্য বিষয়—ভাষাটির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃৎতি এবং ওই ভাষায় সাহিত্য রয়েছে কি না। মানদণ্ড মোতাবেক প্রায় সব আদিবাসী মাতৃভাষাই আছে বিপন্নের স্তরে।
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না আদিবাসীরা। আবার এসব ভাষায় বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রবলভাবে। বয়সে প্রবীণ আদিবাসীরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষাটির কোনো ব্যবহারই জানে না। দেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের ভাষায় সাহিত্য রয়েছে। কিন্তু ওই সাহিত্য খুব কম লোকের কাছেই পৌঁছে। জরিপে অংশ নেওয়া চাকমাদের পঞ্চাশ শতাংশ বলেছে, তারা নিজ ভাষার নানা উপকরণ পড়েছে; কিন্তু সেগুলো তাদের কঠিন মনে হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ বলেছে, শুধু প্রার্থনার সময় তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করে।
জরিপে দেখা যায়, আদিবাসীরা প্রয়োজনীয়তার চাপে পড়ে নিজ মাতৃভাষা থেকে এখন বাংলাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এর প্রভাব সমতলের আদিবাসীদের মধ্যেই বেশি। সাঁওতালদের ৪৯ শতাংশই মনে করে, নিজ মাতৃভাষার চেয়ে আজ বাংলাই বেশি প্রয়োজনীয়। উত্তরবঙ্গের কোদা ও কোল জাতির কেউই এখন আর নিজ ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের কোচ ও দিনাজপুরের কড়া, ভুনজার, মুসহরদের।
আবার বেশির ভাগ আদিবাসী তাদের মাতৃভাষা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে দ্বিতীয় আরেকটি ভাষা হিসেবে বাংলা জানে বা লিখতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ তিনটি ভাষাও জানে। যেমন—বান্দরবানের খুমিরা নিজ ভাষা ছাড়াও মারমা ও বাংলা জানে। উত্তরবঙ্গের ওরাওঁরা বাংলা, সাঁওতালি এবং সাদরী ভাষায় কথা বলে।
সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা—এই প্রধান পাঁচটি আদিবাসী ছাড়া অন্যদের ভাষা বিপন্নের দ্বারপ্রান্তে। ঘরের মধ্যে ছাড়া তাদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। নতুন প্রজন্মের আদিবাসীরা শিক্ষার সুযোগ ও বাস্তবতার কারণে নিজের ভাষার চেয়ে বাংলা ও ইংরেজি চর্চাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ফলে এখন আদিবাসীদের ভাষার উচ্চারণে শুধু পরিবর্তনই ঘটছে না; বরং তাদের শব্দভাণ্ডারে অনেক বাংলা শব্দও স্থান করে নিয়েছে। আবার যেসব আদিবাসী দীর্ঘদিন ধরে শহরে বসবাস করছে, পারিপার্শ্বিকতার নানা কারণে তাদের মাতৃভাষা আজ তারা প্রায় ভুলতে বসেছে।
বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন ২০১০’ প্রণীত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আদিবাসী ভাষার যে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা জরিপ শুরু করেছিল, তা এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে এ দেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে, তাদের ভাষার সংখ্যা কত—এসব ভাষার অবস্থাই বা কেমন, তা নিয়ে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য এখনো আমরা পাইনি।
তাই প্র্রতিটি আদিবাসী পরিবারকে মাতৃভাষার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন অতিদ্রুত আদিবাসীদের ভাষাগুলো রক্ষার পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান পুরোপুরি নিশ্চিত করা, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন এবং সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ। আর এর জন্য সত্যিকারভাবে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। তবেই ভাষার এ দেশে রক্ষা পাবে মাতৃভাষাগুলো।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকণ্ঠে, অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা-২০১৯
© 2019, https:.