মুক্তিযুদ্ধ

এই দেশকে অপমানিত হতে দিও না

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। প্রথম পা রাখি ঢাকাতে। ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বায়োক্যামিস্ট্রি বিভাগে। কয়েক মাস যেতেই যুক্ত হই ছাত্রলীগে। ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ) এর দাপট তখন তুঙ্গে। ওদের নেতা পাচপাত্তুর আর খোকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রাস। পাচপাত্তুরকে ওই সময় মারা হয় এসএম হলে। তৎকালীন সরকার তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়িয়ে আনে নামকরা সব ডাক্তার। কিন্তু তবুও তাকে বাঁচাতে পারেনি। পরে খোকারও লাশ মেলে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। এরপরই এনএসএফ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন ছাত্রলীগের ক্রম উত্থান শুরু হয়।

ফজলুল হক হলে আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। নাম ‘সূর্যসেন স্কোয়ার্ড’। বন্ধু আনোয়ার হোসেন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি) ছিল এর লিডার। আমি, জুলফিকার, তারিক, ফাত্তা, আশরাফ, হাবিবুল্লাহ, আমিনুল হক, ইয়াহিয়াসহ আরও দশ-বারোজন ছিলাম তার সঙ্গে। আনোয়ার খুব মেধাবী ছিল। ও সবসময় বলত-‘ওরা এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। একটা সময় যুদ্ধে যেতেই হবে। ওই যুদ্ধ হবে গেরিলা যুদ্ধ। তাই গেরিলার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’

আনোয়ারের কথায় আমরা উজ্জীবিত হতাম। এরপরই শুরু করি মলোটভ ককটেল বানানো। বাহির থেকে কিছু কেমিক্যাল এনে শ’ দুয়েক ককটেল বানিয়েছিলাম অসহযোগের সময়। তিনটা রাইফেলও জোগাড় হয়ে যায়। এভাবে মনেপ্রাণেই গেরিলা হয়ে উঠি আমরা।

প্রতিদিন বিকেলে ইকবাল হলে যেতাম। পরবর্তী নির্দেশনাসহ একটা ব্রিফিং হতো ওখানে। ছাত্রলীগের পক্ষে সাধারণত ওটা করতেন শাহজাহান সিরাজ।

২৪ মার্চ ১৯৭১। ইকবাল হলে গিয়ে কাউকেই পেলাম না। ব্রিফিংও হলো না। কেন? একজন বলল,‘আলোচনা সুবিধার হচ্ছে না। সরকার উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারে। তোমরা আজই নিরাপদ গন্তব্যে চলে যাও।’

২৫ মার্চ ১৯৭১। সকাল থেকেই ফজলুল হক হল ছাড়তে থাকে ছাত্ররা। শেষে ছিলাম মাত্র একচল্লিশ জনের মতো। একদিন আগেই রাইফেল আর ককটেল গুলো লুকিয়ে রাখি। কোনটি মাটির নিচে, কোনটা ছাদের ওপর। ওইদিনও বানালাম আরও কিছু ককটেল। দিন গড়িয়ে রাত আসে। ডাইনিং বন্ধ। তাই রাতের খাবারের জন্য চলে যাই সচিবালয়ের পেছনে, চিটাগাং রেস্টুরেন্টে।

ভিডিও: ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কী ঘটেছিল? জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন

হঠাৎ সাজোয়া যানের শব্দ। দেখলাম আর্মির কনভয় যাচ্ছে। অস্ত্র তাক করে চারপাশ দেখছে সেনারা। ওদের চোখেমুখে হিংস্রতার ছাপ। রেস্টুরেন্টে ছিলাম চারজন- আমি, আনোয়ার, তারিক আর জুলফিকার। চারপাশের এলাকা থমথমে। আনোয়ার বলল, ‘রিয়াজ, অবস্থা ভাল ঠেকছে না। আজই ক্রেক ডাইন হতে পারে। চল হলে ফিরি।’

তাই করলাম। কিন্তু হলের উত্তর গেইটের সামনে আসতেই শুরু হয় কামানের গর্জন। গোলাগুলিরও শব্দ পাই অবিরত। ওই সময়ের অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো যাবে না। আমরা তখন কী করব?

হাউজ টিউটর এসে বলল, ‘তোমরা নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। তবে অবশ্যই হলের বাইরে যেও না।’

তখন হলের ছাদে অবস্থান নিই। সঙ্গে ছিল তিনটা রাইফেল আর কিছু ককটেল। চার বন্ধু হলের চারটা গম্বুজের নিচে পজিশন নিয়ে থাকি। কে কী দেখছি তা ক্রলিং করে এসে একজন আরেকজনকে বলি। এভাবেই কাটে গোটা রাত।

চারপাশ দেখতে ওরা আগে আলোর মতো একটা গুলি ছোঁড়ে। এরপরই ফায়ার করতে থাকে। রাত দুইটার পর দেখি পুরান ঢাকার দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চারপাশে শুধু গুলি, চিৎকার আর মানুষের কান্নার শব্দ। কিছু করতে না পারার বেদনায় ছটফট করতে থাকি। ফজরের আজান পড়েছে তখন। ভাবলাম, এবার হয়তো গোলাগুলি থেমে যাবে। কিন্তু আজানের সময়ও পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। কেন জানি ওরা ফজলুল হক হলে আসেনি। ফলে দৈবক্রমে বেঁচে যাই আমরা।

২৬ মার্চ ভোরবেলা। ছাদ থেকে নেমেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিই। কিন্তু গেইটের সামনে যেতেই দৌড়ে আসে দারোয়ান। জানায়- শহিদুল্লাহ হলে অ্যাটাক হয়েছে। ছয়জনের লাশও পড়ে আছে। আর্মিরা এদিকেই আসছে। শুনেই যে যার মতো লুকিয়ে থাকি। আমি চলে যাই তিনতলায়, আমার ৩৫২ নম্বর রুমের সামনের বারান্দায়। সেখানে বসে রেলিংয়ের দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি সবকিছু।

ওরা এসেই দারোয়ানকে ডাকে। সে বিহারী হলেও বাঙালিদের পক্ষে ছিল। পাকিস্তান আর্মিদের সে বলে, ‘এই হলে ভাল ছাত্ররা থাকে। তারা কেউ আন্দোলন করে না। ছুটির কারণে সবাই বাড়ি চলে গেছে। এখন কেউ নাই স্যার।’

১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি বিভাগ থেকে ঘুর্ণিঝড়ের ত্রাণ দিতে চাঁদপুরের হোমনায় যায় রিয়াজউদ্দিনসহ অন্যান্যরা

তার কথায় আর্মিরা প্রথম আশ্বস্ত হয়। কিন্তু হঠাৎ তাদের চোখ পড়ে পতাকার দিকে। প্রথম উড়ানো বাংলাদেশের পতাকাটি তখনও হলের সামনে পতপত করে উড়ছিল। তা দেখে আর্মিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘মাদারচোদ’ বলে গালি দিয়ে দারোয়ানের ওপর চড়াও হয়। এরপর পতাকাটি নামিয়ে বুটের তলায় কিছুক্ষণ মারিয়ে তাতে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। রাগে চারদিকে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুড়ে। একটি গুলি এসে পড়ে আমার ঠিক সামনেই। কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা তখন অন্যত্র চলে যায়। ফলে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকেই ফিরে আসি আমরা। এরপর কিছু সময় অডিটোরিয়ামে এবং পরে চলে যাই কার্জন হলে। ফজলুল হক হলেই থাকলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারতাম না। কেননা আর্মিরা আবারও এসে গোটা হল সার্চ করেছিল।’

২৭ মার্চ, সকালবেলা। চার ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। তখন হেঁটে চলে আসি সদরঘাটে। পথে পথে দেখি লাশ আর রক্ত। অনেক বাড়িঘরও ছিল পোড়া। নাজিমুদ্দিন রোডে রিকশায় পড়ে থাকতে দেখেছি কয়েকটি লাশ। সদরঘাটে গিয়ে দেখি লাখো মানুষের ভিড়। জীবন নিয়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। আমিও জনস্রোতে মিশে যাই। পায়ে হেঁটে প্রথমে মুন্সিগঞ্জ এবং পরে লঞ্চে আসি চাঁদপুরে। সেখানে এসেই শুনি মাইকিং। বিকেলের মধ্যেই আর্মি চলে আসবে। সবাইকে তাই সর্তক করা হচ্ছে। তখন কী করবো? মনে হলো মৃত্যু আমার পিছু নিয়েছে।

সময়টা ছিল ধান কাটার। বরিশাল থেকে ধানকাটার একটি দল নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল সুনামগঞ্জের দিকে। কেনাকাটার জন্য ওরা নামে চাঁদপুরে। নিজের অসহায়ত্বের কথা বলতেই তারা আমায় তুলে নিল। গুন টানা নৌকাতেই শুরু হয় যাত্রা। কিন্তু বিপদ তখনও পিছু ছাড়েনি। ভৈরবে এসে পাকিস্তানিদের গানবোটের মুখে পড়ি। নৌকায়ও চেকিং হয়। মাঝি গোপন পাটাতনের নিচে আমাকে শুইয়ে রেখে জীবন রক্ষা করে। এভাবে পথে পথে মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে এগারদিনে পৌঁছি গ্রামে। সবাই ভেবেছিল মরে গেছি। মা আমার পাগলের মতো হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে তার সেকি কান্না! ওইদিনই ভেবেছি, লাখো মায়ের চোখের জল দূর করতেই যেতে হবে যুদ্ধে।“

একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একাত্তরের পঁচিশ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।

মুজাহিদ আলী ও আফতাবুন্নেসা বেগমের বড় সন্তান রিয়াজউদ্দিন। বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মৌলিনগর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মৌলিনগর প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ষষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হন সুনামগঞ্জ সরকারি জুগলি হাই স্কুলে। সেখান থেকে মেট্রিক পাশের পর চলে যান চট্টগ্রামে, চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে। অতঃপর ভর্তি হন চিটাগাং গভর্মেন্ট কলেজে। ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরই তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র।

শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিচারণ করেন রিয়াজউদ্দিন। তার ভাষায়, ‘গ্রামে খুব মজা করতাম। হাওর অঞ্চল। বর্ষা থাকত ছয় মাস। নৌকায় করে স্কুলে যাওয়াটাই ছিল আনন্দের। একবার দুই মামার সাথে রাতে বের হই মাছ ধরতে। হ্যাজাক লাইট নৌকার সামনে রেখে কোচ হাতে মাছ খুঁজে এক মামা। অন্যজন বৈঠা চালায়। ওই রাতে নৌকার অর্ধেকই ভরে গিয়েছিল মাছে। গইন্না মাছ ধরছি সবচেয়ে বেশি।‘

‘ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আসবেন পাখি শিকারে, পাগলা বাজরের পেছনের হাওরে। সে কারণে এক বছর আগে থেকেই পাখি মারা নিষেধ করা হয়। ফলে নিরাপদ ভেবে ঝাঁকেঝাঁকে পাখি নামে ওখানে। শিকারির বেশে আইয়ুব খান আসেন স্প্রিডবোটে। হাওর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা তার কীর্তি দেখি। যেখানে অন্ধও পাখি শিকার করতে পারবে প্রেসিডেন্ট সেখানে পাখি শিকার করেন বীরের বেশে। এ নিয়ে গোটা গ্রামেই দিন কয়েক চলে হাসি-তামাশা।‘

‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে তখন। নির্দেশ দেওয়া হয় প্রত্যেক বাড়ির সামনে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার। স্কুল হোস্টেলের সামনেই আমরা দুটি ট্রেঞ্চ করেছিলাম। সন্ধ্যায় পর ব্ল্যাক আউট হতো। তখন হারিকেন জ্বালিয়ে তাতে কালো কাপড়ে মুড়িয়ে দিতাম। এক হাবিলদার তখন রাইফেল চালানো শেখায়। স্কুলের শিক্ষকরাও যুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে ক্লাস করাতেন।‘

‘একদিন এক বাঙালি এক স্কোয়াড্রন লিডারকে নিয়ে রেডিওতে সংবাদ প্রচারিত হয়। উনি একাই ৫-৬টি ভারতীয় প্লেন ভূপাতিত করেছিলেন। সংবাদটি শুনে সে কি আনন্দ! ওই যুদ্ধে আমাদের একমাত্র হিরো ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার আলম।’

ভিডিও: ৭ মার্চের ভাষণই ছিল বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত নির্দেশনা-মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন

‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাস আর অগাধ আস্থা ছিল মানুষের। বাঙালিরা যে সত্যিই বঞ্চিত- এটা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন। ফলে মানুষ তার মাধ্যমেই বঞ্চিত অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখে। যার প্রমাণ মিলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। নির্বাচনে জয় লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার ক্ষমতা দেয় না। সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।’

রিয়াজউদ্দিনের ভাষায়, “৭ মার্চ ১৯৭১। ফজলুল হক হল থেকে সকালেই রেসকোর্সে আসি। সঙ্গে ছিল জুলফিকার, তারিক, খোকন, সাত্তার প্রমুখ। দূরের মানুষেরা চলে এসেছে তখন। সবার হাতেহাতে বৈঠা আর বাঁশের লাঠি। মাথায় লাল কাপড় পড়ে এসেছে শ্রমিকরা। বঙ্গবন্ধু স্টেইজে উঠলেন। উনি যখন-‘ভায়েরা আমার’ বললেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে আকৃষ্ট করার মতো এমন ভাষণ তো নাই। সাধারণ মানুষ তন্ময় হয়ে শুনেছে বঙ্গবন্ধুকে। আজও আমরা শুনি। উনি সব ঘটনাই তুলে ধরলেন। মাঝেমধ্যে মহাসমুদ্রে যেন তালির ঢেউ ওঠে। আমার কাছে ওই ভাষণ একটা পুরিপূর্ণ কবিতা। ভাষণ নয় বঙ্গবন্ধুর মনের ভেতর থেকে উচ্ছারিত কথাই যেন বেরিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের চূড়ান্ত মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল ৭ মার্চ।’

ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে কী করলেন?

তিনি বলেন,‘আর্মি তখন চলে এসেছে জামালগঞ্জে। গ্রামে শান্তি কমিটিও গঠিত হয়। মুসলেউদ্দিন ছিলেন নেতা। উনি ইসলামি ছাত্র সংঘ করতেন। একজন মেম্বারও ছিলেন সক্রিয় কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় ওরা প্রায়ই আমার খোঁজ করতো। তাই আমি বিভিন্ন আত্মীয়র বাড়িতে লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একদিন বালাট বর্ডারের কাছে মামার বাড়িতে চলে যাই। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।’

জুন মাস তখন। পুরো বর্ষা চলছে। রিয়াজউদ্দিন, বরকত, আসাদসহ মোট পাঁচজন দেশের টানে ঘর ছাড়েন। মামা ফজলুল করিম তাদের নৌকা ভাড়া করে দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথ বলে দেন। এরপর কী ঘটল সে ইতিহাস শুনি রিয়াজউদ্দিনের জবানিতে-

“হাওর থেকে একটা খাল পেরিয়ে বালাটে ঢুকব। সেখানে গিয়ে ভয় পেয়ে যাই। দেখলাম, খালের চারপাশে ভাসছে শত শত লাশ। লাশ সরিয়ে নৌকা এগোয়। মাঝি জানায় বালাট শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে হাজারো মানুষ। লাশগুলো তাদের একাংশ। শুধু অস্ত্রের আঘাতেই নয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নানা কারণে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ। যা ত্রিশ লক্ষ হিসাবটাকেও পেছনে ফেলবে।’

“বালাট মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে প্রথম নাম লেখাই। সেখানে দুইবেলা খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হয়। চাটাই ছিল বিছানা আর ইট ছিল বালিশ। ওখানকার ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাব। ট্রেনিংয়ের আগেই ওখানে ভলান্টিয়ারের কাজ করি। স্থানীয়ভাবে দশ-বারোদিন রাইফেল চালানোর ট্রেনিংও দেওয়া হয়। যৌথ কমান্ড তখন শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় মেজর ডি গমেজ ছিলেন ওখানকার কমান্ডে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। ইংরেজি কিছুটা বলতে পারতাম। তাই ক্যাপ্টেন আফতাব মেজর ডি গমেজের সাথে যোগাযোগের জন্য আমাকে লিয়াজো অফিসার বানিয়ে দিলেন।’

একদিন ওই ক্যাম্পে আসেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক। উনি ছিলেন রিয়াজউদ্দিনের পূর্ব পরিচিত। তিনি তাকে পরিচয় করিয়ে দেন মো. আব্দুল হামিদ (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) এর সঙ্গে। তাদের মুখেই তিনি প্রথম শুনেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফন্ট বা বিএলএফ এর কথা। রিয়াজউদ্দিনসহ একটি কমিটিও করা হয় তখন।

আপনার কাজ কী ছিল?

রিয়াজউদ্দিনের উত্তর, “বিএলএফের জন্য রিক্রুট করা। প্রতি সপ্তাহে একটা বাস আসতো। সেটাতে করে ট্রেনিংয়ের জন্য যুবকদের বাছাই করে পাঠিয়ে দিতাম খেড়াপাড়া ক্যাম্পে। ছাত্রলীগ বা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সদস্য হওয়াই ছিল যোগ্যতা। আমি ১১০জন  পাঠিয়েছিলাম ট্রেনিংয়ে। মেজর জেনারেল ওভানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল বিএলএফে। মূল ফোর্সেও উনি বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন। মেজর ডি গমেজের মাধ্যমে বিএলএফকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। সেটার স্লিপও দিতাম আমি। নিজের কাছে অস্ত্র হিসেবে থাকত একটা রিভেলবার। এছাড়া মূল বাহিনীর লিয়াজো অফিসার হিসেবেও কাজ চালিয়ে গেছি। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন আফতাব বিএলএফ ট্রেনিংয়ে পাঠানোটাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি বাধাও দেননি। পরে মেজর শওকত যখন দায়িত্বে আসেন তখন বিএলএফকে সমন্বয় করেই অপারশেন পরিচালিত হতো। সুনামগঞ্জে বিএলএফের অপারেশনে কমান্ডার আমি আর ডিপুটি কমান্ডার ছিল মুজিব। সার্বিকভাবে পুরো ময়মনসিংহ ও সিলেট জোনের লিডার ছিলেন আব্দুল হামিদ ভাই। সুনামগঞ্জ সাব অঞ্চলে আমি ছিলাম ডিপুটি লিডার।’

ভিডিও: মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ এর অবদানের কথা তুলে ধরা হয়নি-মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন

একটি অপারেশনের কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন-

“পাকিস্তানি সেনাদের একটা বড় ক্যাম্প ছিল ছাতকে। সেখান থেকেই ওরা বর্ডার কাভার করতো। ওদের দুর্বল করে দিতে অভিযান চালাতে হবে। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের ঘটনা। বিএলএফকে রেইকির নির্দেশ দিলেন মেজর শওকত। বিএলএফে তখন বত্রিশজন। আমি আর হামিদ ভাই মিলে পাঁচজনকে সিলেক্ট করলাম। ছাতক শহরের অবস্থা আর যেখানে ওরা ঘাঁটি গেরেছে সেখানকার তথ্য নিয়ে আসতে হবে। ছয়দিনের মতো লাগল। রেইকির সমস্ত তথ্যগুলো একত্রিত করে আমরা ম্যাপ তৈরি করি। অতঃপর বসি মেজর শওকত সাহেবের সঙ্গে। তারা নিজেরাও একটা রেইকি করিয়েছিলেন। মিলিয়ে দেখলেন বেশির ভাগের সঙ্গেই আমাদের মিল রয়েছে। এরপর অ্যাটাকের পরিকল্পনা হয়।’

“সিলেট থেকে ছাতকের রাস্তায় গেরিলা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএলএফকে। বর্ডার থেকে নিয়মিত গোলাগুলি তো চলছেই। সিলেট থেকে পাকিস্তানি সেনারা যেন কাউন্টার অ্যাটাক করতে না পারে- সেটিরও দায়িত্ব থাকে বিএলএফের। মেইন ফোর্সটা অ্যাটাক করেই সামনে এগিয়ে যায়। আমরা দুইপাশে রাজাকারদের ফাঁড়িগুলো উড়িয়ে দিতে থাকি। ওই আক্রমণের কারণে ছাতক থেকে পাকিস্তানিরা সরে যায় সিলেটের কাছাকাছি। অপারেশনে আবু তালেব ও আবু সালেকসহ মূল ফোর্সে শহিদ হয়েছিল ছাব্বিশ জনের মতো।’

“এছাড়াও আমরা গেরিলা অপারেশন করি জামালগঞ্জ আর বিসমবরপুরে। বিএলএফের গ্রামীণ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল রাজাকারদের অত্যাচার থেকে মানুষকে বাঁচানো। গোটা সুনামগঞ্জে বিএলএফের যোদ্ধা ছিল ১১০জন। আটটি থানাতে ভাগ করে দেওয়া হয় তাদের। প্রথাগত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই তারা অপারেশন করতো।’

মূল ফোর্সে না গিয়ে বিএলএফের যোদ্ধারা কেন আলাদা বাহিনী করল?

এমন প্রশ্নে এই যোদ্ধা মুচকি হাসেন। এরপর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়, “বিএলএফ অর্গানাইজড হয়েছে ডিঅর্গানাইজডলি। শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল ভাই আর রাজ্জাক ভাই- এই চারজনের সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেবের সম্পর্ক ততটা ভাল ছিল না। তারা এটাকে মুজিব নগর সরকারের প্যারালাল হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল দেশের মানুষের মুক্তি আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ। তাই রাজনৈতিক আদর্শে থাকা কিছু মানুষের হাতে যেন এর নেতৃত্ব থাকে সে কারণেই বিএলএফের সৃষ্টি। কিন্তু দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আবার সংকটও তৈরি হয়নি যুদ্ধের নেতৃত্বে। ফলে বিএলএফের বিকাশটাও তেমন ঘটেনি। অথচ সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও ছোটখাট বহু অপারেশন করেছে বিএলএফ যোদ্ধারা। শহিদ আর আহতও হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফের সে অবদানের কথা আজও তুলে ধরা হয়নি। দেশের জন্য যুদ্ধ করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেকেই এখনও স্বীকৃতি পায়নি। এটিও আরেক কষ্টের ইতিহাস রচনা করেছে।’

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা লাভ থেকে বিরত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ম্যানেজার হিসেবে তিনি চাকুরি করেন মিল্কভিটায়। এরপর ১৯৮৩ সালে ডিপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দেন পরিবেশ অধিদপ্তরে। দেশের পক্ষে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বহু সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। সবশেষে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তার দুই মেয়ে রোমানা রিয়াজ ও রেজওয়ানা রিয়াজ। ছোটমেয়ে বর্তমানে বুয়েটের শিক্ষক। পয়সার জন্য তারা বিদেশে পড়ে থাকবে না, দেশে থেকেই দেশের ছেলেমেয়েদের তৈরি করবে। মেয়েদের নিয়ে এমনটাই ভাবনা মুক্তিযোদ্ধা পিতার।

মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন মনে করেন দেশের উন্নতি হয়েছে অনেক কিন্তু স্বাধীন দেশে হানাহানিটা এখনও কমেনি। গণতান্ত্রিক চর্চায় আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকতে হবে। জোর করে ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বানানোর প্রবণতা বাড়লে দেশটা কখনই সোনার বাংলা হবে না বলে মত দেন তিনি।

পচাঁত্তর পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে এই সূর্যসন্তান বলেন, “জাতির জনককে হত্যার পর দেশটা তো অন্ধকার পথে চলতে থাকে। একাত্তরের দালালেরা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসে। সমাজে হঠাৎ করেই অতি মুসলিম ভাব শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মের সাথে মিলানোটাও শুরু হয় পঁচাত্তরের পর থেকেই। জিয়াউর রহমান হাত মেলান যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন অপরাধির চোখেই দেখা হতো। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরও উত্থান ঘটে। এখন তো সেটা অনেক ডালপালা মেলেছে। পাকিস্তান আমলেও এতো হিজাবধারী দেখিনি যা আমরা এখন দেখছি। অথচ দাবি করি আমরা বাঙালি। তাহলে তো আমাদের পোশাক হওয়ার কথা শাড়ি। মানসিকভাবে পাকিস্তান চিন্তাধারা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

পরিবারে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন

পরবর্তী প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন বলেন, “তোমরা নিজের কাজটাকে ভালভাবে করো। দেশকে ভালবাসার প্রকাশ সেটাই। বিবেকের কাছে সৎ থেকো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করো। দেশের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসটি জেনে নিও। কখনও কোথাও এই দেশকে অপমানিত হতে দিও না। দেশকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব তোমাদেরই নিতে হবে।’

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম : মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন

ট্রেনিং: ভারতের বালাট ক্যাম্পে স্বল্পকালীন ট্রেনিং করেন।

যুদ্ধ করেছেন : বিএলএফের সুনামগঞ্জ সাব অঞ্চলের ডিপুটি লিডার ছিলেন। অপারেশন করেছেন ছাতক, জামালগঞ্জ আর বিসমবরপুরে।

ছবি ভিডিও : সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৭ এপ্রিল ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button