কলাম

কাইয়ার গুদাম বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ হোক

১৯৭১ সাল। লাইলি তখন ক্লাস এইটে পড়েন, পিপিএম হাই স্কুলে। ছোটবেলাতেই প্রতিবাদী  ছিলেন। কেউ অন্যায় করলেই এগিয়ে যেতেন। বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। থানায় থানায় বসেছে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। ফেঞ্চুগঞ্জে তারা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের লোকেরা। ওরা চিনিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের। ফলে লাইলির বাবা তখন পালিয়ে বেড়ান। একদিন সন্ধ্যায় বাবার খোঁজে বাড়িতে হানা দেয় পাঁচ-সাতজন রাজাকার। ফরিদপুর গ্রামের রাজাকার মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল চেনামুখ। বাবা আব্দুল লতিফকে না পেয়ে চাচার সঙ্গে লাইলিকেও তারা তুলে নিয়ে যায় কাইয়ার গুদামে।

কাইয়ার গুদাম ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের টর্চার সেল। সেখানে লাইলির ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। প্রথম পাঁচ-ছয়দিন একটা রুমে রাখে। পরে আরেকটা রুমে। পালাক্রমে এক মাস ধরে চলে নির্যাতন। রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করত। দুই-তিনদিন পর মন চাইলে লাইলিকে এক বেলা খেতে দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে লাইলি। ওরা তখন তাকে ফেলে দেয় মাইজগাঁও স্টেশনের পাশে। একইভাবে কাইয়ার গুদামে নির্যাতন চালানো হয় খোদেজা আর মনু বেগমের ওপরও।

সেখানে বড় বড় বাঙ্কারে রাখা হতো শত শত নারীকে। লাইলির চাচাকেও ওরা প্রথম নিয়ে নির্যাতন করে কাইয়ার গুদামে। পরদিন নদীর পাশে কাঠের তক্তায় দাঁড় করিয়েই গুলি করে মারে। তার লাশ ভেসে যায় কুশিয়ারা নদীর বুকে। লাইলির মাথা আর শরীরে পাকিস্তানি সেনাদের বেয়োনেটের খোঁচানো দাগ আছে অগণিত। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লাইলি এখন ভালোই আছেন। কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই তার বুকের ভেতরটা ধক্ করে ওঠে।

সাধারণভাবে কাইয়ার গুদাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ, নেই কোনো সাইনবোর্ড। একাত্তরের আগে এটি ছিল পাটের একটি গুদাম। সম্মুখে কুশিয়ারা নদী। ফলে নদীপথে অন্যান্য থানার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল সহজ। তাই পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাশেই কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বড় একটি শিমুল তুলার গাছ। এই গাছের ওপরই কাঠের তক্তা বেঁধে তৈরি করা হয়েছিল ওয়াচ টাওয়ার। সেনারা দুরবিন নিয়ে সেখানে পাহারা দিত। গাছেই বসানো হয়েছিল ওয়্যারলেস যন্ত্র।

গুদামটি অনেক বড়। কালচে ছাপ পড়া উঁচু তার দেয়াল। পেছনের দুটি দরজা কাঠ মেরে বন্ধ করা। সামনে টিন দিয়ে ঘেরা দুটি ঘর। নতুন দরজা খুলে একটি রুম ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হিসেবে। বাকি রুম ও গোটা গুদাম তালাবদ্ধ। গুদামের ঠিক সামনেই বহমান কুশিয়ারা নদী। যেখানে একাত্তরে মুক্তিকামী মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেখানেই মিলে ময়লার স্তূপ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফেঞ্চুগঞ্জে অবহেলিত, অরক্ষিত। একাত্তরের শহীদদের আত্মা ওখানে নীরবে কাঁদছে।

গণহত্যার ইতিহাস জানতে ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়েছি কয়েকমাস আগে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের উদ্যোগ ও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আন্তরিকতায় এখন কাইয়ার গুদামের পাশেই একটি সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে মাত্র। কিন্তু কাইয়ার গুদাম সংরক্ষণ করাসহ ফেঞ্চুগঞ্জের কোথাও নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ!

কাইয়ার গুদামের জায়গাটি খাস হলেও এটির দখল নিয়ে সরকারের সঙ্গে চলছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের মামলা। এ নিয়ে স্থানীয় সাংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ও কার্যকরী উদ্যোগ কোনো গ্রহণ করেনি। কথা হয় রাজনপুর গ্রামের সৈয়দ আমিনুর রশিদের সঙ্গে। ‘মুক্তি’ সন্দেহে একাত্তরে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কাইয়ার গুদামে। দুদিন ধরে চলে নির্যাতন। আজও তিনি বাম কাঁধ ও হাতে কোনো শক্তি পান না। তিনি বলেন ‘সব কথা তুলে ধরতে ভয় করে। একটা গ্রুপ তো গুদাম দখলের চেষ্টা করছে। তারা নানাভাবে হুমকি দেয়। এখন কাইয়ার গুদাম নিয়ে মুখ খুললে জীবনও চলে যেতে পারে।’

একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে রাজাকাররা কাইয়ার গুদামে ধরে নিয়ে যায় আলেয়া বেগমের বাবা আফতাব আলীকেও। আজও ফিরে আসেননি তিনি। প্রতি শ্রাবণ মাসের সাতাশ তারিখ আলেয়া বেগম তার বাবার জন্য দোয়া পড়ান। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন ‘আব্বাকে কাইয়ার গুদামে নিয়া টর্চার করে ওরা। পরে তাকে কুশিয়ারার তীরে মেরে পানিতে ফেলে দেয়। পাশে এক গ্রামের জেলের জালে আব্বা আটকে যান। তখনো জান ছিল কিছু কিছু। খবর পেয়ে রাজাকাররা যায় সেখানে। দম আছে দেখে ওরা তখনই গুলি করে তাকে আবার নদীর জলে ফেলে দেয়। আব্বার লাশ আমরা পাইনি। এখনো মনে হয় আব্বা বুঝি আবার ফিরে আসবেন।’

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে কাইয়ার গুদামে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা আজমল হোসেন রউফসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। তার ভাষায় ‘আমরা তো কাইয়ার গুদামে ঢুকেই ভয় পেয়ে গেছি। রক্তমাখা হাতের ছাপ। মানুষকে ওয়ালে ঝুলিয়ে টর্চার করেছে ওরা। দেয়ালে রশি বাঁধা। প্রথম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি ঘর। মেঝেতে পা পড়তেই পা আটকে যায়। আঠার মতো কী যেন! মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি মানুষের রক্ত জমাট হয়ে গেছে। কুলাউড়া ও সিলেট থেকেও অনেক লোক ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। মানুষের হাড়গোড়ও পেয়েছি কাইয়ার গুদামে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সাতচল্লিশ বছরেও এখানে রক্ষা করা হয়নি। এভাবে চললে একদিন একাত্তরের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কাইয়ার গুদামের ইতিহাস।’

ফেঞ্চুগঞ্জের গণহত্যার ইতিহাস কেন সরকারিভাবে সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে না এ প্রসঙ্গে কথা হয় সিলেট জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মির্জা জামাল পাশার সঙ্গে। তিনি অকপটে বলেন ‘আমরা সত্যকে সত্য বলব, মিথ্যাকে মিথ্যা। আপনি নিজেকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কিন্তু আপনার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে, বধ্যভূমি অরক্ষিত থাকবে, শহীদদের স্মৃতি নদীর জলে ভেসে যাবে এটা তো ঠিক কথা নয়।’

দেশ স্বাধীন হলেও সাতচল্লিশ বছরেও কাইয়ার গুদাম স্বাধীন হয়নি। এমনটিই মনে করেন স্থানীয়রা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি এখন ক্ষমতায়। বীরের দেশে বীরত্বের ইতিহাস যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিহাসও তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই ফেঞ্চুগঞ্জের কাইয়ার গুদামের গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা হোক নতুন প্রজন্মের কাছে। মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের ইতিহাস ধরে রাখতে কাইয়ার গুদামে নির্মিত হোক একটি শ্রদ্ধার স্মৃতিসৌধ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৯ মার্চ ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button