রাইডশেয়ারিং সার্ভিস থাকুক রাইট পথে
রাইডশেয়ারিং নিয়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি প্রথমেই। কাফরুল থেকে শাহবাগে যাব। পাঠাওয়ের অ্যাপে মোটরসাইকেল কল করতেই এক রাইডারকে পাওয়া গেল। তিনি আসলেন। কিন্তু আমি চিনে নিতে পারলাম না। কেন? রেজিস্ট্রেশন করা গাড়ির নম্বরের সঙ্গে উপস্থিত গাড়ির কোনও মিল নেই। পরে ফোন করতেই বোঝা গেল পাশে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিই সেই রাইডার, যার ছবির সঙ্গেও চেহারার কোনও মিল নেই।
প্রথমে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাঠাওয়ের অ্যাপে রাইডার হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেলটির নম্বরের সঙ্গে উপস্থিত মোটরসাইকেলের নম্বর ও ব্যক্তির ছবির কেন মিল থাকবে না? ব্যস্ততার কারণে কেউ যদি অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ির নম্বর বা ছবি যাচাই না করেই চড়ে বসেন এবং পরবর্তী সময়ে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনও ঘটনা ঘটে তাহলে এর দায় আসলে কে নেবে? প্রশ্নগুলো শুনে ওই রাইডার যে উত্তর দিলেন তা যে কাউকেই চিন্তায় ফেলবে।
তিনি জানান, এক বন্ধুর মোবাইল ও মোটরসাইকেল অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করা ছিল। তার নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। মোটরসাইকেলটিও কিনেছেন নতুন। তাই বন্ধুর মোবাইলটি নিয়েই বেশ কিছুদিন তিনি পাঠাওয়ে নিজের মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছেন, যা পুরোপুরি রাইডশেয়ারিং নীতিমালার পরিপন্থী। বিষয়টি পাঠাওয়ে জানালেও অভিযোগ সংক্রান্ত কোনও উত্তর মেলেনি এখনও।
আরেক দিনের ঘটনা। উবারের মোটরসাইকেল কল করতেই এক রাইডারকে পাওয়া গেল। ম্যাপ অনুসারে তিনি তখনও অনেক দূরে, আনুমানিক দশ মিনিটের পথে। ফোন করে তিনি জানতে চাইলেন কোথায় যাব। নিয়ম অনুসারে সেটা কি জানতে পারেন? এমন প্রশ্নে হঠাৎ লাইনটি কেটে দেন। এরপর যে কাজটি তিনি করলেন তা মূলত হয়রানি বললেই ভালো শোনায়।
গন্তব্যে না এসে সেখানে বসেই তিনি অ্যাপে রাইড চালু করে দেন। এমন ঘটনায় খুব অবাক হলাম। কিন্তু বোকার মতো শুধু মোবাইলের দিকে তাকিয়েই থাকলাম। কারণ রাইডশেয়ারিং অ্যাপে রাইড চালু হওয়ার পর চালক ছাড়া যাত্রী সেটি বাতিল করতে পারেন না। মিনিট দশেক পর ওই রাইডারকে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেন। কিন্তু কোনও কথা না বলেই মোবাইলটি বন্ধ করে দেন। বিষয়টি উবারকে জানানোর পর তাদের কাছ থেকে কোনও বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি।
আরেকজন রাইডারকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে। গোটা পথই তাকে চিনিয়ে নিতে হলো। কারণ ঢাকা সিটিতে তিনি এসেছেন মাত্র তিনদিন আগে। গাড়ির ব্রেকও ঠিকভাবে ধরতে পারেন না। তার ওপর অচেনা পথ। জ্যামের রাস্তা। সবমিলিয়ে গন্তব্যে বেশ টেনশনে পৌঁছাতে হলো। রাইডশেয়ারিং সার্ভিসে রেজিস্ট্রেশন করতে ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারপরও এমন আনাড়ি লোক কীভাবে রেজিস্ট্রেশন করলেন সেটির উত্তর হয়তো সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই দিতে পারবে।
উবারের গাড়িতে বাংলামোটর থেকে যাব ক্যান্টনমেন্ট। রাইডারের কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি তা বাতিল করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে আসে নির্দিষ্ট পরিমাণ একটি টাকা পরিশোধের দাবি। কেন এমনটি ঘটল? উবারকে জানানোর এক সপ্তাহ পর তারা দুঃখ প্রকাশ করে একটি বার্তা পাঠায়। কিন্তু ওই এক সপ্তাহ তাদের সার্ভিস গ্রহণ থেকে বঞ্চিতই ছিলাম।
আবার রাইডশেয়ারিং সার্ভিস অ্যাপে তাদের ম্যাপ নিয়েও রয়েছে নানা জটিলতা। ম্যাপে যে পথ দেওয়া আছে সেই পথ ছাড়াও খুব কাছের পথে হয়তো আপনি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু রাইডার সে পথে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। অনেক সময় বেশি টাকাও দাবি করে। ম্যাপের বাইরে চললে তারা প্রকৃত রেট পান না বলেও যাত্রীদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়।
উল্লিখিত সমস্যাগুলো সব রাইডারের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অনেক ভালো রাইডারও আমরা পেয়ে থাকি। কিন্তু বর্তমানে রাইডশেয়ারিং সার্ভিসে যাত্রীসেবার নানা সমস্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে, যা গোটা সার্ভিসটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
এই সেবা চালু হওয়ায় এই ব্যস্ত নগরে খুব সহজে গাড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের সব সুবিধা কি যাত্রীরা পাচ্ছি? আগের থেকে তাদের ভাড়া বেড়েছে। বলা যায় তা সিএনজির কাছাকাছি। একই দূরত্ব অথচ ভাড়া একেক সময় একেক রকম। আবার কোম্পানি ভেদে ভাড়ারও ভিন্নতা রয়েছে। নীতিমালায় প্রাইভেটকারের ভাড়া নির্দিষ্ট করা নেই। ওই সেবার জন্য ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাড়া নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে, তবে তা কোনোভাবেই ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়ার চেয়ে বেশি হতে পারবে না। কিন্তু এ সার্ভিসে প্রাইভেটকারের ভাড়ার ক্ষেত্রে সাধারণ গাড়িতে চড়লেও বিলাসবহুল গাড়ির ভাড়া দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এছাড়া মোটরসাইকেলের ভাড়া বিষয়েও কিছুই বলা নেই নীতিমালায়। ফলে সে সুযোগে রাইডশেয়ারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া ঠিক করছে, যা এখনই সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
রাইডশেয়ারিং সার্ভিস গ্রহণ করতে গেলে প্রায়শই অনেক যাত্রীকেই নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- কোথায় যাবেন, কোনও ডিসকাউন্ট আছে কিনা, পেমেন্ট বিকাশে দেবেন নাকি ক্যাশে, কোনদিক দিয়ে যাবেন ইত্যাদি। কিন্তু সার্ভিসটির শুরুতে যাত্রীরা কিন্তু এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও সার্ভিস প্রদানকারী কোম্পানিগুলো কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা যাত্রীকে জানানো হয় না। ফলে যাত্রীসেবার নামে যাত্রী হয়রানির বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে। এভাবেই চললে রাইডশেয়ারিং সার্ভিসও সিএনজি ড্রাইভারদের মতো যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে রাইডশেয়ারিং সার্ভিসকে রাইট পথে রাখার।
রাইডশেয়ারিং সার্ভিস কেন এদেশে চালু করা হলো তার একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাস হওয়া ‘রাইডশেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’তে। শুরুতেই সেখানে বলা হয়েছে-‘দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন হালকা মোটরযান যেমন মোটরসাইকেল, মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি সাধারণত একজন বা একক পরিবার ব্যবহার করে থাকে। ব্যক্তি মোটরযানের এরূপ সীমিত ব্যবহারের কারণে দেশে হালকা মোটরযানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান এ সংখ্যা মহানগরীতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে যানজট সৃষ্টি করছে। এতে জনসাধারণের মূল্যবান শ্রমঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয়সহ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোটরযান ব্যক্তিমালিক কর্তৃক ব্যবহারের পর অতিরিক্ত সময়ে ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী বহনের সুযোগ পেলে একদিকে সড়কে মোটরযানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে অন্যদিকে যানজট হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ রাইডশেয়ারিং সার্ভিস হলো এমন একটি পরিবহন সেবা ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিগত মোটরযানের মালিক নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ব্যক্তিগত মোটরযানকে ভাড়ায় পরিচালনা করবেন।
কিন্তু এ সার্ভিস চালু হওয়ার পর লাভের আশায় যে হারে রাজধানীতে যত্রতত্র মোটরযানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা যানজটের নতুন কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিনা সেটিও লক্ষ রাখা বিশেষ প্রয়োজন। সরকারের উচিত শহরে কতগুলো মোটরযান আছে, আরও কতগুলো মোটরযান নতুন করে এ সার্ভিসের আওতায় আসতে পারে তা নির্ধারণ করে দেওয়া।
বলা হচ্ছে এটি রাইডশেয়ারিং সার্ভিস। কিন্তু বেকারত্ব ঘোচাতে নতুন যুক্ত হওয়া রাইডারদের অনেকেই আদৌ বুঝে না শেয়ারিং কী? বরং তারা যাত্রীদের সঙ্গে ড্রাইভারসুলভ আচরণ করে বসে। আবার অনেক রাইডারের গুগল ম্যাপ সম্পর্কেই পরিষ্কার ধারণা নেই। চেনেন না ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গাও। অথচ নীতিমালার অনুচ্ছেদ (খ)-এর দুই নম্বর ধারায় বলা আছে-মোটরযান চালককে রাইডশেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ইনস্টলেশন, এর ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে রাইডশেয়ারিং মানসিকতার রাইডারের মাধ্যমে যাত্রীসেবা দিতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকারভাবে কী করছে?
এছাড়া সড়কে কোনও কোনও মোটরসাইকেল রাইডারের রয়েছে নিয়ম ভাঙার প্রবণতাও। সিগন্যাল না মানা, জোরে গাড়ি চালানো, ফুটপাতের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেওয়া, ওভারটেকিং প্রভৃতি, যা একজন যাত্রীকেও মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
নীতিমালার (ক) অনুচ্ছেদের নয় ধারায় বলা হয়েছে,এক গাড়ি এক অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি আমরা দেখছি না। আবার দশ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে একটি গাড়ি নিবন্ধনের এক বছরের মধ্যে কেউ রাইডশেয়ারিং সেবায় যুক্ত করতে পারবে না। কিন্তু সেটিও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।
রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত যাত্রীদের অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করা। এর জন্য সরকারকেও এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। গণপরিবহনের সঙ্কটের এই শহরে রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনি প্রকৃত রাইডশেয়ারিং মানসিকতার রাইডারের মাধ্যমেই এ সেবা কার্যক্রমটি পরিচালনা করা জরুরি। তাহলে যাত্রীসেবা যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বাড়বে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ১ এপ্রিল ২০১৯
© 2019, https:.