মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীন দেশে বিচারের আগেই কেন মানুষকে হত্যা করা হবে?

“আমগো পরিবার ছিল বড়। ছয় ভাই আর দুই বোন। আমি পঞ্চম। লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল খুব। কিন্তু ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর বাবায় লেখাপড়া বন্ধ করে দিছে। আর্থিক সমস্যা ছিল। বড় ভাইরা লেখাপড়া করত। মাঠের কাজে লোক নাই। আমি আর আমার ছোট ভাই হাফেজ লেখাপড়া ছাইড়া তাই কৃষি কাজ ধরি। মনডা চাইতো না। পড়ার কথা বাবারে বলছি। উনি বলছেন- সবাই লেখাপড়া করলে সংসার চালাইব কে?”

“নিজেগো জমি ছিল অল্প। মাইনসের জমিই চাষ করতাম বেশি। কাজের ফাঁকে খেলতাম বন্ধু হাকিম, আবুল ও রমিজগো লগে। হাডুডু খেলছি। তবে পাখি খেলছি বেশি। দারিয়াবান্দা সিসটেমে খেলে ওটা। ৭জন করে দুইদলে ১৪জনের খেলা। মাঝখানে একজন থাকত ঘোড়া। দিনের বেলায় কামকাজ ছিল। তাই রাতেই খেলতাম খেলাডা।”

“দুইতিন গ্রাম মিলে যাত্রা পালা হতো। রূপবানের আবির্ভাব তখন। আমি ছিলাম রহিম বাদশা। আবার আপন-দুলাল পালায় দুলালের চরিত্রেও অভিনয় করছি। বাবায় ছিল মওলানা, মসজিদ চালাইতো গ্রামে। তাই যাত্রা করতে দিত না। কিন্তু মায় থাকত পক্ষে। গ্রামের মানুষও বাবারে বুঝাইয়া আমারে নিত।”

পঞ্চগড় এখন উত্তরবঙ্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জেলা। কিন্তু তখন তো এমন ছিল না। অভাব ছিল অনেক। এখন তো কামলাই পাওয়া যায় না। তখন হাইদা মানুষ পেডেভাতে কামলা দিছে। মানুষের মধ্যে এখন সচেতনতাও অনেক বাড়ছে।”

“গ্রামে তখন চুরি ছিল না। তখনকার মানুষ বেঈমানি, বাটপারিটা কম বুঝতো। বিশ্বস্ত ছিল। এখন তো কারে কেমনে মারা যায়, কারে খাদে ফেলা যায় এই চিন্তাই বেশি। বিশ্বাস কম, আন্তরিকতাও কমছে। আর্থিক জায়গায় আমগো উন্নতি হইছে। কিন্তু মানসিক জায়গায় তেমন উন্নতি দেখি না।”

স্বাধীন দেশে এগিয়ে চলা নিয়ে নিজের মতটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আক্কাস আলী। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় আমাদের।

আজগর আলী ও বানেছা খাতুনের পঞ্চম সন্তান মো. আক্কাস আলী। বাড়ি পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া উপজেলার গরিয়াগঞ্জ গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি শালবান প্রাইমারি স্কুলে। অল্প বয়সেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তাকে কাজে নামতে হয়। জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় দেশ নিয়ে চিন্তা করার উপায় ছিল না আক্কাস আলীর। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানা বৈষম্যের কথা শুনতেন লোকমুখে। মাঝে মধ্যে মিছিল হলে তাতে অংশ নিয়ে যেতেন থানা পর্যন্ত।

সত্তরের নির্বাচনের পর ক্ষমতা দেয় না পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন। সবাই তাকিয়ে থাকে শেখ মুজিবের দিকে। কী নির্দেশ দিবেন নেতা? ৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি আক্কাসরা শোনেন রেডিওতে।

তার ভাষায়- “ভাষণের সবটাই সমান লাগে। প্রতিটা বাক্যই অন্যরকম। শেখ সাহেব বললেন- ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল….. আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি……এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’ ওই ভাষণেই বুঝে যাই দেশকে স্বাধীন করতে হবে। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে তখন স্বাধীনতার কথা ছড়াইয়া পড়ে। তখন তো টাকা দিয়া মানুষকে আনা যেত না ভাই। বঙ্গবন্ধুর কথা শুইনাই মানুষ দেশের জন্য পথে নামছে।”

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ইতিহাস বলেন আক্কাস আলী। তার ভাষায়, “পাকিস্তানি সেনারা তখন নেমে গেছে। চারদিকে চলছে গণহত্যা। আমার দুই ভাই থাকে দিনাজপুর টাউনে। ওদের জন্য মা তো পাগল। যুদ্ধ হইতেছে। ভাবছে দুইভাই-ই শেষ। তারে থামানো যায় না। আমি ক্ষেতে লাঙ্গল দিতেছি। বাবা আইসা কইলো- ‘তোর মা তো থামে না। এখন তোরেই দিনাজপুর যাইতে হইব।’ লাঙ্গল ধইরাই ক্ষেতের মধ্যেই বাবা মাথায় হাত বুলায়া কয়- ‘তোরে ছাইড়া দিলাম আল্লাহর ওয়াস্তে। কোনো দাবিদাওয়া নাই। আল্লাহই তোরে রক্ষা করবো।’

“মা দুইটা ভাত খাওয়াইলো। এরপরই হাঁটা দিলাম। গাড়ি নাই। একদিন পর ঠাকুরগাঁও আসছি। দুইদিন পর সন্ধ্যার দিকে পৌঁছাই দিনাজপুর। বড় ভাই ইদ্রিস ছিল সাংবাদিক। আর ইউসুফ একটা পরিবহনে কাজ করতো। দিনাজপুরে তখনও আর্মি আসে নাই। তারা ছিল সৈয়দপুরে। পরে আর্মিরা দিনাজপুর আক্রমণ করলে কাঞ্চন নদী পাড় হয়ে বিরল দিয়ে আমরা চলে যাই ভারতের রাধিকাপুরে।”

সেখানেই কি ট্রেনিং নেন ?

“না। যাওয়ার পথেই পরিচয় হয় জর্জ ভাইয়ের সাথে। উনি ছিলেন ইপিআরের লোক। তার নেতৃত্বেই রাধিকাপুরে ক্যাম্প হয়। আমার ভাইরা তখন অন্যত্র চলে যায়। জর্জ ভাই আমাদের রাইফেল চালানো শিখায়। এরপরই যুদ্ধের জন্য চলে যাই বর্ডারে, ঠুনঠুনি পাড়ায়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা সেখানে তুমুল মর্টার ছাড়ে। ফলে সন্ধ্যা পর্যন্তও টিকতে পারি না।”

“রাধিকাপুর থেকে আক্কাসরা আসেন কালিয়াগঞ্জে। তাদের ৩০জনের দলকে তখন পাঠানো হয় ভারতের রায়গঞ্জে। ওটা ছিল নিচু জায়গা। পানি উঠে যেত। ফলে তাদের নিয়ে আসা হয় প্রথমে কালিয়াগঞ্জ জঙ্গলে এবং এরপরই পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ট্রেনিং হয় আটাশ দিন। এক্সপ্লোসিভ, আর্মসের পুরো ট্রেনিং, এসএলআর, এলএমজি, টু-ইঞ্চি ও থ্রি-ইঞ্চি মর্টার প্রভৃতি শেখানো হয় ট্রেনিংয়ে। শিলিগুড়ির দ্বিতীয় ব্যাচে আক্কাস আলী ছিলেন চার্লি উইংয়ে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ১৩৮১।”

মুক্তিযুদ্ধ করলেন কোথায়?

আক্কাস আলীর উত্তর, “কসম প্যারড করে অস্ত্র দেওয়া হয় বরাহার ক্যাম্পে। বলা হলো যার যার এলাকায় ফিরে যেতে। ট্রেনিংয়ে দিনাজপুরের সবার সাথে আন্তরিকতা হয়ে যায়। তাই আর নিজ এলাকায় যাই না। আইয়ুব কমান্ডার ও মমতাজ খুব হেল্প করছে। এলাকা চিনি না। তাই যুদ্ধ করতেও কষ্ট হইছে।”

“বরাহার ক্যাম্প থেকে ৭-১০জনের গ্রুপ করে ভেতরে গিয়ে আবার ফিরে আসতাম। গেরিলা ছিলাম। একেকবার একেকজন কমান্ড করতো। এসএলআর আর গ্রেনেড ছিল অস্ত্র। টার্গেট দিয়ে পাঠাতো। ব্রিজ উড়ানো। রাজাকারদের উপর অ্যাটাক। রাতে অপারেশ করছি বেশি। পাকিস্তানি সেনার যে পথে চলত সেখানে গিয়ে তাদের ওপর হঠাৎ অ্যাটাক করতাম আমরা।”

“হিট করেই সরে পড়তাম। সাধারণ মানুষ পারলে সহযোগিতা করত। তবে ভয় ছিল খুব। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আসছে এ খবর পেলে পাকিস্তানি ও রাজাকারেরা পুরো গ্রামই তখন জ্বালায়া দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করাটাও ছিল আরেক যুদ্ধ। এভাবে আমরা গেরিলা অপারেশন করি সাত নম্বর সেক্টরের ঠুনঠুনি পাড়া, দশ মাইল, বিরল ও বোচাগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়। পুনন্দরানা, এক মাস্টার, জয়নাল , আবুল, হাকিম, ছুটো ভাই প্রমুখ ছিলেন সহযোদ্ধা। শেষের দিকে অংশ নিই সম্মুখযুদ্ধে।”

বাম হাতের বাজুতে স্প্লিন্টার লেগে রগ ছিঁড়ে গেছে। ওই হাত এখন অকেজো।

কয়েকটি অপারেশনের কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলীর জবানিতে। তার ভাষায়-

“মোহনপুর ব্রিজের পাশে বিওপিতে আমরা অ্যাটাক করেছিলাম। ওটা ছিল প্রথম অপারেশন। সন্ধ্যার পর বরাহার ক্যাম্প থেকে নদী পাড় হয়ে আসি। কাভারিং ফায়ার করে ইন্ডিয়ান আর্মিরা। তবুও সাকসেস হতে পারি নাই। তুমুল গোলাগুলি চলে। ওরা আমাদেরকে প্রায় ধরে ফেলছিল। পরে নদীতে পড়ে প্রাণ বাঁচাই।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। আমরা তখন অ্যাডভান্স হচ্ছি ইন্ডিয়ান রেজিমেন্টের সঙ্গে। মোহনপুর ব্রিজের কাছে এসে একটা গ্রুপ চলে গেল দিনাজপুরের দিকে। আরেকটা গ্রুপের সাথে গাইডার হিসেবে আমরা ৭-৮জন চলে যাই ফুলবাড়ির দিকে। ফুলাবাড়ি ক্যাপচার করে পলাশবাড়ি, সেখান থেকে গাইবান্ধা যাই। গাইবান্ধা মুক্ত হলে আবার ব্যাক করি পালাশবাড়িতে। এরপর আমাদের গন্তব্য হয় বগুড়া।”

“তেরটা ট্যাংক থাকতো সামনে। পাকিস্তানি সেনারা ছিল বগুড়ার ভেতরে। বগুড়ার পূর্বপাশ দিয়ে অগ্রসর হই। আমরা অ্যাডভান্স করতেছি ওরা ডিফেন্স করতেছে। তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। তখন মারা যেতে পারতাম। মৃত্যু নিয়া চিন্তা ছিল না। ভাবতাম নিজের কাছে না মরে শত্রুর কাছে মরা ভাল।”

“চার-পাঁচ দিন যুদ্ধের পরেই দেশ স্বাধীন হয়। সিস ফায়ার দেওয়া হলো। ওটা হলেই শত্রুকে আর মারতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক নিয়ম। ওরা সারেন্ডার করে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ছোটছোট যুদ্ধ তখনও হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের খবরটায় ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। অবাক হয়েছি। বুকের ভেতরটা কেমন হালকা হয়ে গিয়েছিল।”

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী অস্ত্র জমা দেন বগুড়ায়। অতঃপর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান গ্রামে। নয় মাস পর মাকে কাছে পাওয়ার অনুভূতির কথা বললেন আক্কাস আলী-

“বাড়ি পৌঁছাতে রাত হইছে। আমি বাড়িত গিয়া মা বইলা ডাকি। মা ঘর থেকে পাগল হয়ে বাইর হয়। আমারে জড়াইয়া ধইরা সে কি কান্না। মা আমারে না পাইয়া হইছে এক পাগল, পাইয়া হইছে আরেক পাগল। তখন কেমন লাগছে বুঝাতে পারমু না ভাই। গরিয়াগঞ্জ গ্রামে আমিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামের মানুষ আমারে দেখতে আসছে তখন। কয়েকদিন গ্রামে থাকার পরই চলে যাই দিনাজপুর শহরে, যোগ দিই মিলিশিয়া ক্যাম্পে।”

দিনাজপুর মহাজারা গিরিজানাথ স্কুলে খোলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মিলিশিয়া ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ছিলেন ক্যাম্পটির দায়িত্বে (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী)। সেখানে থাকতো মুক্তিযোদ্ধারা। বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেও রাখা হতো সেখানে। মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী ওই ক্যাম্পে রিপোর্ট করেন জানুয়ারির ৪ তারিখ, ১৯৭২। একদিন পরেই আসে সেই রক্তাক্ত দিনটি। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত হন এই বীর যোদ্ধা। আমরা তখন নিরব থাকি।

অতঃপর চোখের কোণে জল ভরিয়ে স্মৃতি হাতড়ে তুলে ধরেন ওইদিনের আদ্যোপান্ত-

“মিলিশিয়া ক্যাম্পে আমাদের তেমন কাজ ছিল না। ফলিং করাতো আর নাম ডেকেই ছেড়ে দিত। থাকি আর খাই। ৬ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের ঘটনা। সন্ধ্যার সময় ফলিংয়ের জন্য বাঁশি দিছে। আমি তখন নাস্তা খাইতে গেছি। এরপর ফলিংয়ে না গিয়া মসজিদে নামাজ পড়তে আসি। আজান হয়ে গেছে। ভেতরে একটা মসজিদ ছিল। আমি হাতের ঘড়ি খুইলা পকেটে নিয়া পানি তুলছি এক বালতি। ওজু করমু। এরপরই বিকট একটা শব্দ হয়। তখন চোখের সামনের সবকিছু মিলিয়ে যায়। কিছুই কইতে পারমু না আর।”

স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন

“মাটির নিচ থাইকা আমার ঘোঙানির শব্দ আসে উপরে। দিনাজপুরের এক সহযোদ্ধা মাটি কাইটা চিৎকার দিয়া বলছে- ‘আক্কাস চিন্তা করিস না।’ ওরা মাটি খুঁড়ে আমারে বের করে আনে। ওই সময় যদি মারা যেতাম একেবারে ঘুমন্ত মৃত্যু হইতো। আমারে একটা গাড়িতে তুলতেই শরীরটা ঝাঁকি মারছে। এরপর আর কিছুই মনে নাই। যখন জ্ঞান ফিরছে তখন আমি দিনাজপুর সদর হাসপাতালে। হাতে-পায়ে স্প্লিন্টার ঢুকে গেছে অনেক। বাম হাতের বাজুতে স্প্লিন্টার লেগে রগ ছিঁড়ে গেছে। ওই হাত অকেজো, কিছুই করতে পারি না। এভাবেই চলবে বাকী জীবন। বয়স উনসত্তর চলছে। হাই প্রেসারও হইছে। বেশি কথা বলা বারণ। কিন্তু একাত্তরের কথা বলতে গেলে তো ঠিক থাকি না।”

মহারাজা স্কুলের মিলিশিয়া ক্যাম্পে কীভাবে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও অজানা। এটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা ছিল, সে রহস্যও রয়ে গেছে। ওইদিন ওখানে শহীদ হয়েছিলেন প্রায় আটশ’ মুক্তিযোদ্ধা। প্রাণে বেঁচে গেলেও এক হাতেই চলছে আক্কাস আলীর জীবনপ্রবাহ।

মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী আক্ষেপের সুরে বলেন, “মহাজারা গিরিজানাথ হাই স্কুলের শহীদদের তালিকা আজও সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দুই’শ চল্লিশ জনের নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও বাকিরা রয়েছেন অজ্ঞাত। এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে!”

ভিডিও: আহত হওয়ার ঘটনা বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী

স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকা শহরেই তিন বছর রিকশা চালিয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর এক সহযোদ্ধার সহযোগিতায় কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরি পান তিনি। গেইট কিপার হিসেবে কাজ করেছেন মুন ও নাজ সিনেমাহলে। পরে চলে আসেন তাবানীতে। এখন অবসর আছেন।

যে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

“দেশ তো পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীনতা। কিন্তু স্বপ্নের দেশ এখনো হয় নাই। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই হবে না। জুলুম নির্যাতনও বন্ধ করতে হবে। মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকেও গুরুত্ব দিতে হবে।”

স্বাধীনতার এতো বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?

তিনি বলেন- “এর জন্য দায়ী তো সরকার একা না। মুক্তিযোদ্ধারাও আজ বিক্রি হয়ে গেছে! এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘুরতে ঘুরতেই অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। এই দুঃখ আমরা কোথায় বলবো বলেন।”

স্বাধীন দেশে রাজাকারদের উত্থান বিষয়ে অকপটে নিজের মতটি তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী। তিনি বলেন, “এর জন্য আমরাই দায়ী, নেতারাও দায়ী। অস্ত্র জমা না দিয়ে ছয় মাস যদি মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে অপারেশন করানো হতো, তাহলে তো রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী থাকত না। সাধারণ ক্ষমা করাটাও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হলো যার যার কাজে ফিরে যেতে। আগে ডাকাতি আর চুরি করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করছে। সেও ফিরে গেল আগের কাজে। আবার অস্ত্র ছিল দুইটা। জমা দিয়েছে একটা। আরেকটা রেখে দিছে মাটির নিচে। এমন ঘটনাও কম ঘটেনি। দেশ স্বাধীন করছে যারা দেশ চালাবে তারা। কিন্তু স্বাধীনের পর সেটাতো হলো না।”

আক্কাস আলী আরও বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করেছেন জিয়াউর রহমান। তার আমলে মধু ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজকে বঙ্গভবনে মারতেও গিয়েছিলাম। আপনি ওদের ঘুমাবার দিছেন, আমি সাথে নিয়ে নিছি। আমি নিয়া নিছি তো আরেকজন ওগো মাথায় তুলে নাচছে। এইভাবেই রাজাকারগো শিকড় গজাইছে এদেশে।”

মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, রক্ত দিয়েছেন। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই অর্থাৎ ২০০৯ সালের ৫ মে তারিখে তার ছেলে নূর আলম বাবু র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে নিহত হন। বাবু কোনও সন্ত্রাসী নন, বরং যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ নিয়ে সেসময় গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদনও প্রকাশ ও প্রচারিত হয়। ফলে সরকারের শক্তিশালী তদন্ত টিম অনুসন্ধানে নামে। তদন্তে প্রমানিত হয় মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলীর ছেলে বাবুকে ক্রস ফায়ারে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১/১১/২০১২খ্রিস্টাব্দে তারিখে ২৭৩নং স্মারক পত্র মোতাবেক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু সে নির্দেশনা আজও কার্যকরী হয়নি। তাই স্বাধীন দেশে ছেলে হারানো ও ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়ার কষ্ট নিয়েই কাটছে এই যোদ্ধার জীবন।

বুকে জমানো কষ্ট নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন- “আমার ছেলেটা মগবাজারে যুবলীগ করতো। তারে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরা আসছে লাশ হয়ে। তিনদিন পর পাইছি লাশ। ছেলে মারা যাওয়ার পর এলাকার মানুষও কাঁদছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি দেওয়ার পরও বিচার পাইনি এখনও। ছেলের ঘরে একটা নাতি আছে। তার দিকে তাকালেই বুকটা ফাইটা যায়। ও বড় হয়ে যখন প্রশ্ন করবে- কেন মারা হয়েছে তার বাবাকে? কি বলব আমরা। ভাইরে, মনে দুঃখ আছে। কিন্তু দুঃখের কথা বলতেও পারি না। ছেলেটা অপরাধী হলেও নিজেরে বুঝ দিতাম। কিন্তু অপরাধী কিনা যাচাই না করেই তাকে কেন হত্যা করা হলো! স্বাধীন দেশে বিচারের আগেই কেন মানুষকে হত্যা করা হবে? এই দেশ তো আমরা চাই নাই। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যার সাহায্য চাই। আমার ছেলে হত্যার সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার চাই আমি।”

আইডি

মুক্তিযোদ্ধা আক্কাসের মতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আমলে দেশ ভাল চলছে। উন্নতিও হচ্ছে অনেক। তিনি মনে করেন প্রধানমন্ত্রী একাই সৎ ও ভাল হলে চলবে না। তৃণমুলের নেতাদেরও প্রধানমন্ত্রীর মতো সৎ ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। তাহলেই দেশটা সত্যিকারের সোনার বাংলা হবে।

পরবর্তী প্রজন্ম একদিন দেশকে আরও এগিয়ে নিবে- এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আক্কাস আলীর। তবে সে সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বুকভরা আশা নিয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, ‘তোমরা নেশাগ্রস্ত হইও না। সঠিক পথে থেকে দেশের জন্য কাজ করো। দেশ উন্নত হলে নিজেরও উন্নতি হবে। তবে মেহনত করতে হবে। মনে রেখ- পুণ্যে আছে সুখ। আলস্য দারিদ্র্য আনে। পাপে আনে দুঃখ।”

সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আক্কাস আলী।

ট্রেনিং: ভারতের শিলিগুড়ির পানিঘাটায় আটাশ দিন ট্রেনিং করেন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ১৩৮১।
যুদ্ধ করেছেন: গেরিলা অপারেশ করেন সাত নম্বর সেক্টরের ঠুনঠুনি পাড়া, দশ মাইল, বিরল ও বোচাগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তীতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন গাইবান্ধা ও বগুড়ায়।
যুদ্ধাহত : ৬ জানুয়ারি ১৯৭২। সন্ধ্যায়। দিনাজপুরে মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলের মিলিশিয়া ক্যাম্পের বিস্ফোরণে তার হাত ও পায়ে স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। বাম হাতের বাজুতে স্প্লিন্টার লেগে রগ ছিড়ে গেছে। ওই হাত এখন অকেজো।

ছবি ভিডিও : সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ মার্চ ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button