মালন কড়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন বিরল হাসপাতালে। বয়স তার পঁয়ত্রিশ। পূর্বপুরুষদের জমি রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। হামলাকারীদের হাতে ছিল বড় বড় ধারালো সামরাইল (দা বিশেষ), যার আঘাতে তার বাম গাল কেটে দুই ইঞ্চি ক্ষত হয়ে যায়। রক্তাক্ত ক্ষতের যন্ত্রণায় হাসপাতালে শুয়ে ছটফট করছেন মালন। হামলাকারীদের আক্রমণে আহত হয়েছেন সাতল কড়া, কুলো কড়া, কেদু কড়া ও মিরন কড়াও। তারা চিকিৎসা নিয়ে ফিরে এসেছেন বাড়িতে।
অস্ত্র হাতে দখলকারীরা খোঁজ করছিলেন কৃষ্ণ কড়ারও। গ্রামের সবচেয়ে প্রতিবাদী ছেলে ছিল। জীবনের ভয়ে লুকিয়ে ছিল বাড়ির ভেতরে। তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসে তার মা কুলো কড়া। তাকে লাথি মেরে উঠানে ফেলে দেয় হামলাকারীরা। বারান্দায় শোয়া অবস্থায় ছিল কৃষ্ণর ছোট ভাই প্রশান্ত কড়ার অবুঝ শিশুটি। বয়স এক মাসের মতো। হামলাকারীরা শিশুটিকেও পায়ের নিচে ফেলে পিষে মারতে উদ্ধত হয়েছিল। ছুটে এসে তাকে রক্ষা করে তার নানি নান্দিয়া কুজুর। সে ঘটনার কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ এখনও কাটেনি তার।
কিনা কড়ার বয়স ষাটের ওপরে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সাত নম্বর সেক্টরে। ঘটনার দিন চোখের সামনেই তার স্ত্রী তিতো কড়াকে বুকে লাথি মেরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে হামলাকারীরা। মাটিতে পড়ে গেলে মাথায়ও আঘাত করে তারা। তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসে কিনা কড়া। কিন্তু জীবনের ভয়ে তিনিও থমকে যান। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে হামলাকারীরা বলে—‘তোকেও কাটে দিম’। অসহায় চোখে হামলাকারীর মুখগুলো দেখেন কিনা। স্ত্রীর কান্নার শব্দে বুকের ভেতরটাও খামচে ধরে তার। স্ত্রীকে রক্ষা করতে না পারার কষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধাকে নীরব করে দেয়।
ঘটনাটি গত ৬ মার্চ সকাল ১১টার। এভাবেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা দিবসের মাসেই নির্মম নির্যাতন আর হামলার ঘটনা ঘটে কড়া গ্রামটিতে। হামলার সময় হামলাকারীরা চিৎকার করে বলেছিল, ‘তোদের কেটে লাশ করে বস্তায় ভরে ভারতের বর্ডারে ফেলে দিয়ে আসবো! হামলাকারীদের এমন উক্তি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের প্রতি যেমন অবজ্ঞা ও অসম্মানের, তেমনি রাষ্ট্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এ দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে একটি জাতি। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য আর ধর্ম বিশ্বাসগুলো। এরাই কড়া জাতি। দিনাজপুরের একেবারে সীমান্তবর্তী ঝিনাইকুড়িতে এ জাতির শেষ গ্রামটির অবস্থান। একসময় এদের হাজার পরিবার বাস করতো দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় বাঙালিদের দ্বারা এদের পূর্ব পুরুষদের ভূমি দখল, ভূমিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ও প্রাণনাশের হুমকি এবং সীমাহীন দারিদ্র্যের কাছে পরাস্ত হতে থাকে কড়ারা। ফলে প্রায় বাধ্য হয়েই জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে তাদের অনেকে। চলে যায় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ভারতে।
বর্তমানে কড়াদের মাত্র ১৯টি পরিবার টিকে আছে। তার মধ্যে ঝিনাইকুড়ি গ্রামে ১৭টি পরিবারে ৮৫ জনের বাস। প্রায়ই তাদের অনেককেই হুমকি দেওয়া হয় ভারতে চলে যাওয়ার। কেননা, তাতে তাদের জমিগুলো দখলে নেওয়ার সুবিধা হয় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বাঙালির। সাত বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখছি নিশ্চিহ্নপ্রায় এ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষদের জীবনপ্রবাহ। একান্তভাবে মিশে জেনেছি তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ ও সংগ্রামের কথা ।
কড়া গোত্রের প্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। বয়স ৮০-এর মতো। তার দেওয়া তথ্যমতে, এ জাতির মানুষদের আগমন ব্রিটিশ আমলেরও আগে। তখন এখানটায় কোনও বাঙালির অস্তিত্ব ছিল না। চারপাশের গহীন বন কেটে কড়া, সাঁওতাল, ওরাওঁসহ অন্যান্য আদিবাসী এখানে আবাদি জমি তৈরি করে চাষবাস শুরু করে। আর এখন অধিকাংশ জমিই বাঙালিদের দখলে।
কড়ারা পরিশ্রমী ও কৃষি পেশায় পারদর্শী। ভাদ্র-আশ্বিন এদের অভাবের মাস। আগে এ সময়টাতে তারা জমির আগাছা পরিষ্কারের কাজ পেতো। কিন্তু রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমিতে এখন তেমন আগাছা হয় না। তাই এ সময় কৃষিপেশার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। এ সময়টায় সরকারের কোনও রিলিফ সুবিধাও পায় না তারা। ফলে মহাজনদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রি করে যা পায় তা দিয়েই পরিবার চালিয়ে নেয় কড়ারা। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাগ্যোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ তহবিল চালু থাকলেও তার কোনও সুফল তারা পায়নি। ফলে স্থানীয় এনজিও ও মহাজনদের সুতোর টানে ঘুরপাক খাচ্ছে কড়াদের জীবনপ্রবাহ।
৬ মার্চ কড়া গ্রামেই স্থানীয় কিছু বাঙালি কড়াদের জমিতে ঘর তুলতে গেলে প্রতিবাদ জানায় তারা। ফলে বাঙালিরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায় কড়া গ্রামে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় নানা সংবাদ।
কিন্তু কেন এই নির্মম হামলা?
গ্রাম প্রধান জগেন কড়া জানান, সরকারি রেকর্ড মোতাবেক হালজায় মৌজার ১৮৮১নং দাগের ৭১ শতাংশ জমি তাদের। এ জমি নিজেদের বলে দাবি করে স্থানীয় বাঙালি আব্দুল আল কাফি, কামরুজ্জামান, কিবরিয়া, মান্নান, মোশারফ, তামু প্রমুখ প্রথমে অভিযোগ করে সেটেলমেন্ট অফিসে। সেখানে শুনানিতে কড়ারা জমির মালিকানার রায় পায়। এরপরও এ নিয়ে কয়েকবার সালিশও বসে বিরল থানায়। সেখানেও তারা জমির মালিকানা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপরই তারা মামলা করেন দিনাজপুরে সহকারী জজ আদালতে (মামলা নম্বর-০৮-২০১৯-অন্য)। জজ আদালত অভিযোগ শুনানির দিন ধার্য করে ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে। শুনানির তারিখ উল্লেখ করে আদালত নোটিশও জারি করে। কিন্তু আদালতে শুনানির আগেই উল্লেখিত বাঙালি দখলদাররা জোরপূর্বক ওই জমিতে ঘর তুলতে যায়। যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও এক অর্থে আদালতকে অবজ্ঞা করার শামিল। দখলদাররা ধারালো অস্ত্র নিয়ে কড়াদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের বাড়িগুলোও ভেঙে দেয়। এ ঘটনায় বিরল থানায় মামলা হয়েছে (নম্বর: ৫২৩(৩)-১)।
১৯৭১ সালে কড়াপাড়ার থোপাল কড়া, কিনা কড়া ও সাতান কড়া অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুঁড়ির পানিঘাটায় ‘হায়ার ট্রেনিং’ শেষে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সাত নম্বর সেক্টরে। কিন্তু নানা কারণে এই তিন মুক্তিযোদ্ধা কোনও কাগুজে সনদ পাননি। এ নিয়ে অবশ্য তাদের কোনও খেদও নেই।
ভ্যানগাড়ি চালিয়ে উপার্জন করতেন মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া। কিন্তু এখন তিনি অসুস্থ। চলছেন লাঠিতে ভর দিয়ে। কেউ তার খোঁজও রাখে না। নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে কিনা কড়ারও। যেটুকু জমি আছে তা নিয়েও চলছে মামলা। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন সেই স্বাধীন দেশ থেকে তাঁকেই ভারতে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কথা বলতে গিয়ে এ মুক্তিযোদ্ধা অঝোরে কাঁদেন।
স্থানীয় সাংসদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কড়াসহ অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের জন্য বেশ আন্তরিক বলে জানা যায়। কড়াদের সরকারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে তিনিই প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। বিরলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য আলাদাভাবে রিলিফও প্রদান করেছেন বিভিন্ন সময়। তা সত্ত্বেও কড়া গ্রামের এ আক্রমণের ঘটনা আমাদের হতাশ করেছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রীর নির্দেশে কড়া পাড়ায় এখন বসেছে পুলিশের পাহারা। তাদের ঘরগুলো পুনরায় নির্মাণে দেওয়া হয়েছে সরকারি টিন। একজন আসামিকে ধরা হলেও বাকিরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে আসামিকে ধরা হয়েছিল সে একদিন পরেই জামিনে বেরিয়ে এসে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে কড়াদের। ঘটনার আগেই বিষয়টি নিয়ে যেহেতু কয়েকবার সালিশ হয়েছিল তাই হামলার আগেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল প্রশাসনের। যা অনেকাংশেই তাদের ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে।
কড়ারা এ দেশেরই নাগরিক। এ দেশের ভূমির ওপর তাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তবুও কারা অন্যায়ভাবে কড়াদের ভূমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে? কারা হুমকি দিচ্ছে তাদের লাশ করে ভারতে ফেলে দিয়ে আসার? এদের ক্ষমতারইবা উৎস কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে।
সারাদেশে ভূমি প্রশাসনের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জমিগুলো দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালিরা। এ নিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অধিকার রক্ষায় আলাদা কার্যকর ভূমি কমিশন গঠন করা এখন জরুরি। সে সঙ্গে জমির ওপর তাদের প্রথাগত মালিকানারও স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। তাহলেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সত্তা ও সংস্কার নিয়ে টিকে থাকার প্রণোদনা পাবেন।
এ দেশে কড়ারা টিকে না থাকলে একটি জাতি হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আচারগুলো, যা আমাদের জন্য লজ্জা ও অপমানের। তাই উচিত কড়াদের রক্ষায় সরকারের বিশেষ সুরক্ষা কার্যক্রম হাতে নেওয়া।
কড়া গ্রামে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। আহতের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাসহ কড়াদের নিরাপত্তা ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ সরকারের ওপর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা আস্থা হারাবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ১৪ মার্চ ২০১৯
© 2019, https:.