মৃত্যু নয়, চাই মানুষ রক্ষার উদ্যোগ
সারা দেশ শোকাভিভূত। আমাদের ভাষাশহীদ দিবসের শোকের দিনটি এবার ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আরেক শোকের সংবাদে। হ্যাঁ, চকবাজারের শোকাবহ ঘটনাটির কথাই বলছি। যেখানে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৬৭ জন। আহত হয়েছেন অনেকেই। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে শুধু পোড়া লাশের ছবি দেখেছি। কেউ লাশ দেখিয়েছে, কেউ দেখায়নি। অনলাইন পত্রিকায় ঘুরছে পোড়া হাত, পোড়া পা আর পোড়া মুখের আবছা ছবিগুলো। বোন কাঁদছেন মৃত ভাইয়ের জন্য। যে ভাই প্রতি রাতে বাড়ি ফিরলেও সে রাতে বাড়ি ফেরেননি। মুঠোফোনে জানিয়েছিলেন একটু পরই ফিরে আসবেন।
দিপুও ছিলেন সেখানে। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় গামছাসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান ছিল তাদের। ভাতিজা আর ভাইকে রেখে আগুন লাগার ঠিক আগেই দোকান থেকে বেরিয়েছিলেন দিপু। নিজে বেঁচে গেলেও পুড়ে লাশ হন ভাই আর আদরের ভাতিজা। তাদের সঙ্গে হওয়া শেষ কথাগুলো মনে করে হাউমাউ করে কাঁদেন তিনি।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হাঁটতে পারবেন না। তাই তাকে সুরক্ষার জন্য ঘরের ভেতরেই ছিলেন এক স্বামী। স্ত্রীসহ কয়লা হয়ে গেছেন তিনিও। দুই অবুঝ শিশু তার আত্মীয়ের কোলে। তাদের বাবা আর ফিরে আসবেন না। নানা মানুষের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে শিশু দুটি। হয়তো বাবার কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষাতেই আছে তারা।
এক বন্ধু রাস্তার পাশের এক হোটেলে বসেই চা খাওয়ার জন্য ডেকেছেন তার বন্ধুকে। সেই বন্ধু এসে তার ঝলসানো লাশ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া এক ছাত্র তার ভাইয়ের সঙ্গে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন। আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল, রিকশায় বসে থাকা অবস্থাতেই এক দম্পতি তার শিশুসন্তানসহ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আর প্রথম যে ভবনে আগুন লাগে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের দোকানপাট ও গুদামে থাকা ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই এমনভাবে পুড়েছে, তা শনাক্ত করার উপায় নেই। এসবই গণমাধ্যমের খবর।
পুরান ঢাকার চকবাজারের বাতাসে এখন পোড়া লাশের গন্ধ। প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনায় কাঁদছে হাজারো মানুষ। তাদের সেই কান্না আমাদের হৃদয়কেও খামচে ধরছে। মৃত মানুষের আর্তনাদ কি আমরা শুনতে পাই? কতই না কষ্ট হয়েছে এই মানুষগুলোর! ভাই ফেরেননি তার বোনের কাছে। অথচ তার ফেরার কথা ছিল। স্বামী-স্ত্রী তাদের অনাগত শিশুকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নগুলোও পুড়ে ছাই হয়েছে তাদের দেহের সঙ্গে। এসব মানুষের মৃত্যু আমাদের মধ্যে রেখে গেছে অসংখ্য প্রশ্ন। কেন পুড়ে মরল এতগুলো মানুষ? আমরা কি চেয়েছিলাম এমন মৃত্যুকূপ নগরী? এই মৃত্যুর দায় আসলে কে নেবে? আমরা উন্নতির সোপানে পা রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। যদি তা-ই হয়, তবে কেন এত লোক এভাবে পুড়ে মারা যাবে? কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামেও মানুষ পুড়ে মরেছে। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, সেখানে পিকআপে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার পর প্রথমে রাস্তায় থাকা যানবাহনে এবং পরে আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার পাশের হোটেলেও ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। জায়গাটি পাইকারি পণ্যের বাজার হওয়ায় ওই ভবনগুলোর অধিকাংশ দোকানে প্লাস্টিক ও পারফিউমের গুদাম ছিল। দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। যদিও আগুন লাগার কারণ গ্যাস সিলিন্ডার নাকি কেমিক্যালÑ এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
যদি সিলিন্ডারই হয়, তাহলে ওই গ্যাস সিলিন্ডারগুলো কোন কোম্পানির, সেগুলো কেন বিস্ফোরিত হলো? যদি বিস্ফোরণের ঝুঁকিই থাকে, তবে কেন সরকার এখন ঘরে ঘরে ও পরিবহনে সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কোনো সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হবে না, সেটির নিশ্চয়তা কি সরকার দিতে পারবে?
ওই ভবনের নিচে কেমিক্যালের গুদামও ছিল। যেখানে ভাগ্যক্রমে পৌঁছায়নি আগুন। যদি তা-ই হতো, তবে পুরো বিল্ডিং উড়ে যেত বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কিন্তু ভবনের দোতলায় দাহ্য কেমিক্যাল ছিল, ছিল একটি বডি স্প্রের কারখানাও, যা আগুনকে আরও দাউ দাউ করে জ্বলতে সাহায্য করেছে।
কারখানায় কতটুকু দাহ্য পদার্থ রাখা যায়, তার কি কোনো সরকারি বিধিবিধান সেখানে মানা হয়েছিল? ওই বডি স্প্রে বা পারফিউমের কারখানাটির কি কোনো অনুমোদন ছিল? নাকি এরা নকল পারফিউম তৈরি করত। এসব এখনো বেরিয়ে আসেনি তদন্তে। হয়তো আসবেও না। আরেকটি আলোচিত ঘটনায় চাপা পড়ে যাবে!
অনেকেই বলবেন সরকারকে তো সময় দিতে হবে। সেটি কয় বছর? নয় বছর আগেও পুরান ঢাকার নিমতলীতে আগুন লেগেছিল। সে সময় কয়েক পরিবারের মেয়ের দায়িত্বও নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই ঘটনার তদন্ত করে কি কোনো ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে?
২০১০ সালের ১৫ জুন তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ১৭টি সুপারিশ করে। যার মধ্যে প্রধান ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো সরানো। এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র গণমাধ্যমে বলছেন, তদন্ত রিপোর্টের সাত বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের মার্চে তিনি একবার অভিযান শুরু করলেও শিল্প মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনের অনুরোধে তা আর এগোয়নি। মেয়রের এই বক্তব্য যদি সত্য ধরে নিই, তবে এ ঘটনার দায় তিনিও এড়াতে পারেন না। একইভাবে দায় বর্তায় ব্যবসায়ীদের সংগঠন ও শিল্প মন্ত্রণালয়েরও।সে সময় যদি সরকার পুরান ঢাকাসহ আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের কোনো গুদাম বা দোকান না রাখত,
কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হতো, রাসায়নিক ও এসিড জাতীয় দাহ্য পদার্থের দোকান ও বিক্রির সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকত তাহলে হয়তো এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। চকবাজারের আগুনের সূত্রপাত যেখান থেকেই হোক না কেন, কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুনের তীব্রতা যে অনেক বেড়েছিল, এটা তো সত্য।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলছেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ রাখার সব কারখানা তিনি এবার অবশ্যই সরিয়ে নেবেন। নয় বছর আগেও একই কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু কিছুদিন পরই সব মানুষ ভুলে যাবে। সে সুযোগে মেয়র, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের কার্যক্রমও গতিহীন হয়ে পড়বে এমনটা আমরা বারবার দেখতে চাই না।
এরই মধ্যে পুরান ঢাকার বাড়ির মালিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তারা কিছুতেই কেমিক্যালের গোডাউন সরাতে রাজি নন। আমরা চাই না এ দেশে মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ হোক। মানুষকে রক্ষার স্বার্থে যেকোনো ভালো উদ্যোগ সরকার বাস্তবায়ন করুক কঠিন হস্তে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জানেন আপনজন হারানোর কষ্টটা কেমন। তাই তার প্রতি আমাদের আস্থাটাও বেশি। আমরা আর নিমতলী বা চকবাজারের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না। দুর্ঘটনা হয়তো ঘটবে। কিন্তু সরকারের নানা উদ্যোগের মাধ্যমে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা আর হতাহতের পরিমাণ কমিয়ে আনার মধ্যেই সরকারের প্রকৃত সফলতা নির্ভর করবে। তা না হলে সরকারের উদ্যোগগুলো সবার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকবে। আমরা আর মৃত্যু চাই না। চাই মানুষ রক্ষার উদ্যোগ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
© 2019, https:.