কলাম

আসক্তি নয়, ফেইসবুক থাকুক প্রয়োজনে

আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনযাপনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেইসবুক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা যেন মারাত্মক নির্ভরতা। দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবই ফেইসবুকে তুলে দিয়ে বন্ধুদের জানানো, লাইক, কমেন্টস, মতামত প্রকাশধর্মী চিহ্ন উপভোগ করাটাই এখন আমাদের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাছাড়া দেশ ও জাতির ঘটে যাওয়া নানা বিষয়ে নিজেদের মতামত বা অবস্থান জানানো তো রয়েছেই।

মার্ক জাকারবার্গ বন্ধুদের নিয়ে কী উদ্দেশে ফেইসবুক চালু করেছিলেন? সেটি জানার তেমন প্রয়োজন নেই এদেশে। এখন কোনো কিছু ঘটলেই সে বিষয়টি নিয়ে আমরা ফেইসবুকে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই বেশি ভালোবাসি। বর্তমান সময়ে নানা বিষয়ে আমাদের প্রতিবাদ, মতামত, বিপ্লব, প্রেম, ভালোবাসা, মানবতা প্রকাশের একমাত্র প্লাটফর্ম যেন ফেইসবুক! প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াই যেন স্মার্টনেস! কিন্তু কেন? অনেকেই বলেন সহজে মতপ্রকাশের সুবিধার জন্যই ফেইসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো কিছু লেখা বা প্রকাশ মানেই কি মতপ্রকাশ?

কিছুদিন আগে শমী কায়সারকে নিয়ে ঝড় উঠেছিল ফেইসবুকে। মোবাইল চুরি নিয়ে সাংবাদিকদের আটকে রেখে তিনি অবশ্যই ঠিক কাজটি করেননি। কিন্তু এই ঘটনায় ফেইসবুকে তার চরিত্র নিয়ে ব্যবচ্ছেদ, পরিবারের নানা ঘটনা অতিরঞ্জন করে তুলে ধরা, এমনকি তার শহীদ পিতাকে নিয়েও যেভাবে গালাগাল দেওয়া হলো, সেটি কি আমাদের ক্রোধের আগুনে আরেক অপরাধের জন্ম দেয়নি।

শমী কায়সারের ওইদিনের ঘটনা নিয়ে সমালোচনা বা প্রতিবাদ হতেই পারে। কিন্তু সেটিকে সামনে রেখে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আক্রমণটা কি ঠিক ছিল? অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সাংসদ মাশরাফী তার নিজ এলাকার হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে চার চিকিৎসককে পাননি। তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। এ অভিযোগে পরে তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়। যে কোনো সরকারি কর্মচারীর ক্ষেত্রেই  সরকারি নিয়মে তার কর্মস্থলে থাকা বাধ্যতামূলক, তা ওই স্থান যতই অনুন্নত হোক না কেন। কিন্তু এই ঘটনার পর অনুপস্থিতির মূল বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে দেশজুড়ে বিভিন্ন চিকিৎসকরা ফেইসবুকে মাশরাফীকে অশালীন ভাষায় গালাগাল দিয়ে পোস্ট দিতে থাকলেন। গালাগালের যে ভাষা তারা তুলে ধরেছেন তা কি ডাক্তারির মতো সেবামূলক একটি পেশাজীবী শ্রেণির সম্মানহানি ঘটায়নি? সাংসদদের কাজ সাংসদরা করবেন। চিকিৎসকদের যে দায়িত্ব সেটিও তাদেরই পালন করতে হবে। কেউই আমাদের কাছে অগণ্য নয়।

যুক্তি দিয়ে আপনি যুক্তি খণ্ডন করতেই পারেন। কিন্তু তেমনটা ঘটে না ফেইসবুকে। বরং মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে বুঝে, না বুঝে ব্যক্তিকে আক্রমণ করাটাই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ কাজে যারা যুক্ত থাকছেন তারা কি ভেবে দেখেছেন ফেইসবুকে প্রতিফলিত হচ্ছে আপনাদের চারিত্রিক গুণাবলি। ফেইসবুকে প্রত্যেকেই তার ওয়ালে নিজের চিন্তা বা মত প্রকাশ করেন। সেটি আপনার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলতে পারে, আবার নাও মিলতে পারে। সেটি মানতে হবে এমনটা তো নয়। তবুও আমরা প্রায়ই বিরুদ্ধচারণ করতে থাকি। এক সময় সেটি ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে গিয়েও ঠেকে। যেটি মোটেই কাম্য নয়। ফেইসবুকে আমরা কী পোস্ট করি? নিজের ছবি, পরিবারের ছবি, বেড়াতে গেলে সেখানকার ছবি, ভালো কোনো লেখা বা সংবাদ, নিজের অনুভূতি বা মত প্রভৃতি। যারা লেখালেখি করেন তারা প্রায়ই নিজের লেখাটি খুঁজে পান অন্যের পোস্টে, যেখানে ওই লেখাটিকে তিনি নিজের বলেই চালিয়ে দিচ্ছেন। কবিতা ও আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে এটি ঘটছে প্রবলভাবে।

কয়েকদিন আগের কথা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নিজের একটি লেখা পোস্ট হিসেবে খুঁজে পাই আরেকজনের ওয়ালে। প্রায় দু’হাজার ওয়ার্ডের লেখাটি একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পোস্টকারী ছবিসহ লেখাটি নিজের হিসেবে পোস্ট দিয়ে তা তার ষাটজন বন্ধুকেও ট্যাগ করেন। বন্ধুরা ওই লেখা পড়ে তার ভূয়সী প্রশংসাও করেন। আড়াইশ’ জন তার পোস্টে কমেন্টস করেছিলেন। তিনি প্রত্যেককে তার উত্তরে আলাদাভাবে ধন্যবাদও দেন। নিজের পোস্টটিকে অন্যের ওয়ালে এভাবে দেখে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, অবাকও হয়েছি। মানুষের পক্ষে আসলে কতটা নিচে নামা সম্ভবÑ তাই ভাবছিলাম। এভাবে ফেইসবুকে নিজের তোলা ছবি বা ভিডিও চলে যাচ্ছে অন্যের ওয়ালে, অন্যের নামে। ফেইসবুক যেন অপরের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম ও সৃজনশীলতার এমন চৌর্যবৃত্তির বিকশিত হওয়ার এক অনন্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

ফেইসবুক ব্যবহারে কর্তৃপক্ষ বয়সের সীমা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বয়স বাড়িয়ে আইডি খুলে ফেইসবুক ব্যবহার করছে এদেশের হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীও। ফলে মিথ্যা তথ্য দিয়েই শুরু হয় তাদের ফেইসবুক জীবন। অনেক শিক্ষিত অভিভাবকই তার সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন। সে সুযোগে তারা সারাক্ষণ ডুবে থাকছে ফেইসবুকে। সেখানে নানা মিথ্যা তথ্য উল্লেখ করে নিজেকে বড় কিছু জাহির করানো ও নতুন নতুন বন্ধুত্ব স্থাপনে ব্যস্ত থাকছে তরুণ সমাজ। ফেইসবুকে এক ঘণ্টার চ্যাটিং মুঠোফোনেই আপনি সেরে নিতে পারেন মাত্র পাঁচ মিনিটে। অথচ তরুণদের অনেকেরই সারাক্ষণ কাটে চ্যাটিংয়ে। ফলে অল্প বয়সেই ঘাড় ও চোখের সমস্যাসহ লেখাপড়ায় উদাসীনতা এবং তাদের মনোজগতে তৈরি হচ্ছে বিরূপ প্রভাব, যা মাদকের আসক্তি থেকেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। স্মার্টফোন কিনে দেওয়া নয় বরং প্রত্যেক পরিবারের উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, তাদের বোঝানো ও সন্তানের ফেইসবুক ব্যবহারকে সীমিত বা বন্ধ রাখা। তা না হলে সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো ফেইসবুকেই মুখ থুবড়ে পড়বে।

এ তো গেল সন্তানদের কথা। সম্প্রতি একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেইসবুকের কারণে সংসারে অশান্তি ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে সন্দেহপ্রবণতা। স্বামী-স্ত্রী তাদের সম্পর্কের কাছে আর বিশ্বস্ত থাকছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিয়ে-বিচ্ছেদের পরিমাণও, যা মোটেও কাম্য নয়।

ফেইসবুকে আপনি সার্চ করেই খুঁজে পেতে পারেন আপনার কাক্সিক্ষত বন্ধুটিকে। এভাবে মিলে যায় হারানো বন্ধু, বান্ধবী, প্রেমিক, প্রেমিকা, নতুন কোনো বন্ধু। কিন্তু কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন বা কাকে বন্ধু তালিকায় রাখবেন সেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত বর্তমানকে ঘিরেই। ফেইসবুককে যদি একটি বাজার ভাবেন, তবে সেই বাজারে কেউ যাবে প্রয়োজনে, কেউ যাবে অপ্রয়োজনে, আবার কেউ কেউ যাবে বিভ্রান্তি ছড়াতে। তাই এসব কিছু বিবেচনায় রেখেই ইতিবাচক অর্থে ফেইসবুককে প্রয়োজনেই ব্যবহার করতে হবে।

ফেইসবুকে আমরা যা করি তা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই স্পষ্ট করে। তাই চলুন, ফেইসবুক আচরণে সংযত হই, যুক্তি দিয়েই নিজের যুক্তিকে প্রকাশ করি। আসক্তি নয়, ফেইসবুক থাকুক প্রয়োজনে। অধিক বন্ধুত্ব নয়, ভালো চিন্তার, ভালো মতের বন্ধুরাই থাক আমাদের ফেইসবুকে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৪ জুন ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button