স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
না-ফেরার দেশে চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য আবদুল খালেক। কয়েক মাস আগে তার পায়ে গ্যাংগ্রিন হলে অপারেশনে একটি পা কেটে ফেলা হয়। এ অসুস্থতা নিয়ে চরম আর্থিক সংকটে চলছিল তার জীবন। সে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে গত শনিবার। একটি আক্ষেপ নিয়েই চলে গেছেন এই ফুটবলার-মুক্তিযোদ্ধা। বুকের ভেতর এই একই আক্ষেপ নিয়ে এর আগে পৃথিবী ছেড়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের লালু, আইনুল, আলী ইমাম, অমলেশ, শিরু, সাঈদ, পেয়ারা, ননী বসাকও। কী সেই আক্ষেপ? তা জানার আগে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ইতিহাসটি জানা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধে এই ফুটবল দলের অবদানই বা কতটুকু ছিল?
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার সুবাদে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিষয়ে আগ্রহী হই বছরখানেক আগে। কথা হয় এই দল গঠনের পরিকল্পনাকারী সাইদুর রহমান প্যাটেলের সঙ্গে। তার জীবনের গদ্য দিয়েই শুরু হয় ইতিহাস জানা। রাজনীতির পাশাপাশি প্যাটেল ছিলেন একজন ফুটবলারও। ১৯৬৮ সালে চান্স পান সেকেন্ড ডিভিশনে, ফরাসগঞ্জ স্পোর্টিংয়ে। এক বছর পরই যোগ দেন পাকিস্তান স্পোর্টিং ক্লাবে এবং পরে পিডাব্লিউডিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লুৎফর রহমান, মুজিবর রহমান ও মোহসিনসহ তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানেই গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। কীভাবে? তার ভাষায় ‘১৯৭১। মে মাসের মাঝামাঝি হবে। আমরা তখন কলকাতায়, সুবোধ সাহার বাসায়। হঠাৎ চিন্তা আসে ফুটবল প্লেয়ার হিসেবে কীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখতে পারি? ভাবতে থাকলাম। মনে মনে একটা ফুটবল দল গঠনের ইচ্ছাও জাগে। সে দলের খেলা থেকে যে তহবিল আসবে তা দিয়ে দেওয়া হবে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়তেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সেটি। পরিকল্পনাটি শেয়ার করলাম সবার সঙ্গে। শুনে লুৎফর রহমান বলেন পাগল হয়েছিস। দেশে পাকিস্তানি সেনারা লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করছে, মা-বোনদের টর্চার করছে। আর তুমি এখানে ফুটবল খেলবা! পাবলিক পিটায়া মারবে।’
একটু রাগ হলো। তবুও দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝিয়ে বললাম ‘একটা মিন্তি দিয়ে সারা দিন কাজ করলে একজন শ্রমিকের যে পরিশ্রম হয়। মাঠে যতক্ষণ ফুটবল খেলি এর চেয়ে কম পরিশ্রম তো হয় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে পয়সা পাব সেটা দিয়ে দেব মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে। এর চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে। খেলোয়াড়রা দেশের অ্যাসেট। তাদেরও তো দেশের জন্য কাজ করতে হবে।’ সব শুনে প্রস্তাবে তিনজনই সম্মতি দেয়। দেশপ্রিয় পার্কের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের হোটেল। সেখানে বসেই ফুটবল দল গঠনের আইডিয়া নিয়ে ওই চারজন একটা ড্রাফট তৈরি করে। এরপর সেটা নিয়ে যাওয়া হয় প্রবাসী সরকারের এ এইচ এম কামারুজ্জামানের কাছে। পরিচয় দিয়ে প্যাটেল প্রস্তাবটি প্রথম তুলে ধরেন তার কাছে। শুনে ভীষণ খুশি হলেন তিনি। পরে সামসুল হক সাহেব প্যাটেলদের নিয়ে যান তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে, আট নম্বর থিয়েটার রোডে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাবটি শুনে তাজউদ্দীন আহমেদ প্রথমে উদ্দেশ্যটি জানতে চান। ম্যাচের গেট মানিটা মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে যাবে। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এটা ভূমিকা রাখবে। আর খেলোয়াড়রাও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। এমন উত্তর দেন প্যাটেলরা। শুনে উনি খুশি হলেন। বললেন ‘এতো সুন্দর চিন্তা তোমাদের। কী করতে হবে বলো?’ ‘ইন্ডিয়ান সরকারের অনুমোদন লাগবে। ভারতব্যাপী খেলব আমরা। তাই লাগবে ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (আইএফএফ) এবং অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ) এর অনুমতিও।’ উনি সব সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রাথমিক খরচের জন্য চৌদ্দ হাজার রুপি তুলে দেন।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামটা হলো কীভাবে? প্যাটেলের উত্তর “আসলে অফিশিয়ালি গঠন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। শুধু ফুটবল নয় সাতারসহ অন্যান্য খেলারও আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিল সেখানে। কলকাতায় আমাদের বেতার কেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ফলে যখন খেলতে নামলাম স্থানীয়রাই বলতে থাকল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। মানুষের মুখে মুখেই এভাবে নামকরণ হয়ে যায় দলটির।” খেলোয়াড় সংগ্রহের ইতিহাসটাও জানান প্যাটেল তখন একমাত্র খেলোয়াড় আমিই। কলকাতার রাস্তাতে দেখা হয় আবাহনীর আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে। উনি খেলতে আগ্রহী হলেন। জানালেন ট্রামে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রতাব শংকর হাজরার, আলী ইমাম আছেন মোহনবাগান ক্লাবে, ইস্ট বেঙ্গলে আছে ওয়ারীর লুৎফর। এরই মধ্যে বন্ধু মঈন সিনহাকে পাঠালাম ঢাকায়। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বিখ্যাত খেলোয়াড় শাহজাহান, লালু ও সাঈদকে নিয়ে চলে আসে কলকাতায়। এদিকে খেলোয়াড়দের আহ্বান জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত অ্যানাউন্স করা হচ্ছিল। তা শুনে আগরতলায় আসেন অনেকেই। নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল হক ভাই ছিলেন নামকরা খেলোয়াড়। ভারত সরকারের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে তাদেরও আনা হয় বিমানে। আমি গেলাম আলী ইমাম ও প্রতাব দা-কে আনতে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে প্রথম যোগ দেন আলী আশরাফ ভাই। দ্বিতীয় প্রতাব দা, নুরুন্নবী ভাই। তৃতীয়- আলী ইমাম ভাই। চতুর্থ লুৎফর। ইমাম ভাই আসেন তার দুইদিন পর। এভাবে ১৮-২০ জনের মতো চলে এসেছেন। অলরেডি দল সেট হয়ে গেছে। পার্ক সার্কাস পার্কের ভেতরের মাঠে চলছে প্র্যাকটিস। অতঃপর ২৬ বা ২৭ দিন পর বালুঘাট থেকে আসেন জাকারিয়া পিন্টু। আসে তান্নাও। সে বেশ স্মার্ট ছিল। তাই ম্যানেজার করা হয় তাকে। পরে সিনিয়র বিবেচনায় জাকারিয়া পিন্টুকে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভাইস ক্যাপ্টেন করা হয় প্রতাব শংকর হাজরাকে। প্রথম ম্যাচ খেলেন কোথায়? ‘নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে, ২৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে। প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া একাদশ। প্রথম লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইব এবং জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে খেলা শুরু করব- এমনটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। কিন্তু প্রবাসী সরকারকে তখনো স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। আট নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী অফিসেও ওড়েনি বাংলাদেশের পতাকা। ফলে পতাকা ওড়ানো ও জাতীয় সংগীত বাজানোতে আইনি জটিলতা দেখা দেয়। পরিকল্পনার কথা শুনে নদীয়া জেলার তৎকালীন ডিসি ডি কে বোস বললেন ‘আমার চাকরি থাকবে না।’ আমরাও বেঁকে বসলাম। কেউ খেলব না। সারা মাঠে তিল পরিমাণ জায়গা নাই। হাজার হাজার লোক খেলা দেখার অপেক্ষায়। পরে ডিসি সাহেব সাহস করেই অনুমতি দিলেন। প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে খেলা শুরু করি। ওটাই আজ ইতিহাস। দুই দুই গোলে ড্র হয় ম্যাচটি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সারা ভারতে মোট ১৬টি খেলা খেলে।’
একাত্তরের ক্রীড়াঙ্গনের যোদ্ধারা খেলার মাধ্যমেই স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন, যা তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলেছিল। সেই ফুটবল যোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সম্মান পেলেও সংগঠন হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ এখনো কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের যোদ্ধারা এই স্বীকৃতিটা দেখে যেতে চান।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশরূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৮ জুন ২০১৯
© 2019, https:.