সব সিদ্ধান্ত কেন প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়?
“আমগো গ্রামটা ছিল বিলের মইধ্যে। কোটালিপাড়ার উত্তর পাশে, উত্তরের বিল বলি। ভাইগ্যের বিলের শাখা। ওইখানেই ছিল বাড়ি। গ্রামের নাম ধরাল গ্রাম। লেখাপড়া অল্প কিছু করতে পারছি। ক্লাস ফাইফ পর্যন্ত।
এক মেয়ের পর আল্লাহ ছেলে দিছে। তাই আমার আদর ছিল বেশি। বন্ধু লায়েক জাইরা, আজিজুল জাইরা, সোহরাব, তোবারক খাঁ, বারেক মোল্লার লগে থাকতাম। হাডুডু খেলতাম। বিকাল হইলেই গোল্লা দৌড় খেলছি, কড়ি আর মার্বেল খেলছি। উত্তরের বিলে যাইতাম মাছ ধরতে। চালন দিয়া খেওয়াইয়া আর বরসি দিয়া মাছ ধরছি অনেক।
আব্বা ছিলেন সংসারিক। মানে, কৃষি কাজ করত। জমি-জমা ছিল কম। তা দিয়াই পরিবার বাঁচাইত। অন্যের জমিও বোনাইত, হাল জোরাইত, হাল বিক্রি করত। আগে আমন ধান ছিল শুধু। অগ্রহায়ণ মাসে হইত। বিলের জমিতে ফসল হইত না। এক বছর হইলে দুই বছর চোয়া যাইত। বন্যার পানিতে তলায়াও যাইত জমির ধান।
অনেক কষ্ট করছি তহন। দুপুরে খাইতে পারলে বিকালে পারি নাই। এতো কষ্ট গেছে। এহন তো বছর বছর ইরি ধান হয়। ধানের অভাব নাই। অভাব শুধু মাইনসের মনে।
মা মারা গেছে ছোড থাকতেই, অসুখে। আব্বা আবার বিয়ে করছে। কিন্তু আপন মা যে রকমে ঠেহে সে রকম তো সতালো মা ঠেকবে না। দাদা বাঁইচা ছিলেন। উনি আমগো কিছু বলতে দিত না। বোন দুইডা ছিল, একবারে ছোড। ওগো কোলেপিঠে মানুষ করছি আমি।
মা নাই। তাই কেউ লেখাপড়ার কথা কইতও না। স্কুল কামাই দিয়া ডেংবাড়ি (ডাংগুটি) খেলা খেলতাম। আব্বা রাগ করতো। ফাইভের পর আর পড়তে যাই নাই। প্রথম আব্বা একটু আফসোস করছে। পরে আমারে নিয়াই কাজে যাইত। অন্যের জমিতে গেলে সঙ্গে থাকলে এক টাকা চার আনা বেশি কামাই হইত। কাজ ছিল ধান নিরানী, বন বাছা, ঝরা বাছা। জীবনটাই ছিল সংগ্রামের।
তখনকার মানুষ আর এখনকার মানুষে পার্থক্য অনেক। তহন মানুষ এতো চালাক ছিল না। মিথ্যা কথা বুঝতো না। মানুষ সরল ছিল। কেউ কারও অসুবিধা দেখলে ঝাপাইয়া আউগাইতো। এহন মানুষ অন্যেরে দেখে না। আমগো উন্নতি হইছে। কিন্তু মানসিক উন্নতি হয় নাই। বরং বেউন্নতিটা বেশি হইছে।”
জীবনের গদ্য নিজ ভাষাতে এভাবেই তুলে ধরেন একাত্তর বছর বয়সী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামান। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয়। বর্তমানে তার জীবন কাটছে শারীরিক নানা কষ্টে। তবুও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি অবিরত কথা বলে যান কয়েক ঘণ্টা। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য।
ইয়াকুব আলী শেখ ও সাহেরা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান আলিউজ্জামান। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার (সাবেক ফরিপুর জেলা) কোটালিপাড়া উপজেলার ধরাল গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধরাল প্রাইমারি স্কুলে। বয়স যখন আঠার তখনই বিয়ে করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একুশ বা বাইশ বছরের যুবক।
অভাবের সংসারে আলিউজ্জামান কীভাবে রাজনীতিতে জড়ালেন? সে প্রশ্নে তিনি মুচকি হাসেন। এরপর তুলে ধরেন শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার প্রথম ঘটনাটি।
তার ভাষায়- “আমাদের ওখানে এক লোক ছিল খালেক জাইরা নাম। তাগো খুব ক্ষমতা। তারা মুসলিম লীগ করত। গ্রামে আমগো পছন্দের মানুষ ছিল শেখ আব্দুল আজিজ। উনি একদিন বললেন, ‘এক নেতা আসতে লাগছে। শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের। তোরা আওয়ামী লীগ করবি।’
আমরা বললাম- করমু।
উনি তহন বলেন, ‘এতো সুন্দর ভাষণ দেয় তা বলার মতো না। আমাগো কোটালিপাড়ায় আইসবে।’
শেখ মুজিব একদিন স্প্রিটবোর্ডে (স্পিডবোট) আসবেন। ঘাগোর বাজারে ঘাটলায় আমরা অপেক্ষায়। ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ, গফুর, মুজিবুল হকরাও।
কোটালিপাড়ার কাছে কুরপাড়া, পুনাতি, গোপালপুর এলাকা। ওইদিককার মানুষ ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে। তারা বলল, ‘না, আমাগো ওতো বড় নেতা লাগবো না। মুসলিমলীগই ভাল।’ শেখ মুজিব ওইদিকে গেলেন না।
একটু দুষ্ট ছিলাম আমি। দূর থিকাই চিৎকার দিয়া বলি, ‘আপনি আমাগো বাবা। আপনি আইসেন। আমরা থাকতে কেউ ধারে যাইতে পারবে না।’ উনি স্প্রিট বোর্ড থেকে দেখলেন। আইসাই ফাস্টে (ফার্স্টে) আমার মাথায় হাতটা বুলালেন। এরপর থিকাই শেখ মুজিবরে বাবা ডাকতাম।
ঘাগোর ডাকবাংলায় শেখ মুজিব বসেন। মিটিং হয়। উনি এরপর মাঝেমধ্যে আসতেন। সেকেন্দার নামে একজন আছিল। বাবায় (শেখ মুজিব) মরার পরে উনি পাগল হয়ে মারা গেছেন। বাবায় আসলে উনিই মিষ্টি কিনে আনতেন।
ঘাগোর থেইকা পুবের দিকে ছিল কোটালিপাড়া। শেখ মুজিব ওখানে যত মিটিং করছেন একটা মিটিংও বাদ দিই নাই। আব্বা কিছু বলত না। উনিও ছিলেন মুজিবের পক্ষে। মাইনসের কাছে বলতেন, ‘যদি শেখ মুজিব আইসে, তাইলে আমার আলিউজ্জামান সেখানে থাকবেই।’ শেখ মুজিব যেখানে আমি সেখানেই থাকতাম। কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। আমার কাছে ওটাই ছিল রাজনীতি।”
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আনসার ট্রেনিং নেন আলিউজ্জামান। উনি একদিন সবাইরে ডেকে বলেন, ‘এই দেশে বাঁচতে হলে আনসার ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে।’
১৯৭০ সালের শেষ দিকের কথা। গোপালপুরের নায়েক, পশ্চিমপাড়া থেকে ট্রেনিংয়ে যায় আরও কয়জন। তখন গোপালগঞ্জ স্টেডিয়ামে হতো ট্রেনিং। সকালে নাস্তার পর শুরু হতো পিটি। দুপুরে রেস্ট। বিকালে হতো রাইফেল ট্রেনিং। বিয়াল্লিশ দিন ট্রেনিং চলে। একবার ফায়ারে ফার্স্ট হন আলিউজ্জামান। তাদের ট্রেনিং করায় আনসার কমান্ডার জহুরুল হক। তখন অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন আনোয়ার কাজী। ওই আনসার ট্রেনিংই পরে কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধে।
কীভাবে?
আলিমুজ্জামানের উত্তর, “তহন তো যুদ্ধ শুরু হইছে। আমগো গ্রামেই মুরুবিরা পিস কমিটি গঠন করে। চেয়ারম্যান ছিল মকবুল হোসেন। মজিদ (মইজা মুন্সি), সৈয়দ আলি মেম্বার এরাও কমিটিতে ছিল। সৈয়দ আলীর ছেলে মিলেটারি নিয়া ঘুরতো। গাছ থিকা নারকেল পাইরা খাওয়াইতো ওগো। আর্মিরা আসছে তিন-চারবার।’
তহন থানার দরোগা আনসারগো বাড়ি বাড়ি যাইত। কইত, ‘একমণ চাল আর একমণ গম পাইবা সপ্তাহে। পিস কমিটির কাজ করতে হইব।’
উনি এদিন আসছে রাতে। তহন গাব গাছে লুকাইয়া ছিলাম। পরে তিনদিন বাড়িতে পুলিশ পাঠায় ডাকতে আর ধরতে। তবুও আমারে পায় নাই।’
এরপরই তো আসে হেমায়েত সাহেব। আমগো বাড়ির দক্ষিণ সাইডে ছিল তার বাড়ি। কান্দিগ্রাম বলি আমরা। চাচা কইতাম তারে। উনার সাথে তো তখন মেশিনগান । সঙ্গে সাতজন সঙ্গিও। সাতজনের কাছেও রাইফেল ছিল।
উনি শেখ আব্দুল আজিজের বাড়িতে আসেন। জানতে চান, ‘ট্রেনিংম্যান কে কে আছে?’ তখন আমার কথা শোনেন। এরপরই হেমায়েত বাহিনীর লগে মিশা গেলাম। কোটালিপাড়া থানাও দখল করি কয়েকবার।’
ওইসময় মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ দিতে পারলেই পুরস্কার থাকত- একমণ চাল আর একমণ গম। জায়গায় জায়গায় ফাইট কইরা একটু শক্তিশালী হই। আক্রমণ কইরাই সইরা পড়তাম। ওই জায়গায় মিলিটারিরা তহন গোলাগুলি শুরু করত জম্মের মতো।
এরপর অস্ত্রসহ বরিশাল থেকে আসে ষোল জন। দল তহন বড় হতে থাকে। আমাদের কোন ঠিকানা ছিল না। থাকতাম মাঝপাড়া, নারকেল বাড়ি, কুইমাইরা, বান্দাবাড়িতে। গেরিলা অপারেশন করতাম। আফ প্যান্ট আর গেঞ্চি পড়ে। রেইকি করত দুইজন।
এরপর দল বড় হইতে থাকে। আনুমানিক ৩০০-৩৫০জন ছিল। কমান্ড করতেন হেমায়েত সাহেব নিজেই। আমরা অপারেশন করি- ঘাগোর,কালকিনি, কালিন্দি, কোটালিপাড়া ও বাঁশবাইরায়। আষাঢ় মাস থিকা কার্তিক মাসভর অপারেশন করছি। তহন পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সহযোদ্ধারাই ছিল সবচেয়ে আপন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলি তার ঘাড় দিয়ে ঢুকে ডান চোখের রগ ছিঁড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত ওই ইতিহাসের কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যোদ্ধা খানিক অশ্রুসিক্ত হন। অতঃপর তুলে ধরেন দিনটির আদ্যপান্ত।
ভিডিও: গুলি আমার ঘাড় দিয়ে ঢুকে ডান চোখের রগ ছিড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায় -আলিউজ্জামান
আলিউজ্জামানের ভাষায়, ‘কোটালিপাড়া ও ঘাগোরের সব জায়গায় আমরা ঘের দিব। এইটাই সিদ্ধান্ত। মিয়ারহাটখোলার উত্তর পাশে একটা বাড়ি ছিল আমির আলীর বাড়ি। ওখান থেকে রাত আটটার দিকে নদী দিয়া রওনা হই। সাতজন ছিলাম অ্যাডভান্স পার্টিতে। ঘের দিলে পাকিস্তানিরা গুলি ছুড়তে থাকে। মনে হইছে যেন খৈ ফুটছে।’
‘ঘাগোরের উত্তর পাশে একটা ভিটা, তালুকদারদের কল বাড়ি। কল তখনও ছিল না। ওখানে পাকিস্তানিগো বান্কার। আমরা নদী দিয়া আগাই। একজনের পেছনেই আরেকজন। ফায়ার চলছে। কিন্তু মাথা নিচু করে থাকি। ফায়ার করতাম না। কচুরিপানা মাথায় রেখে পানির ভেতর লুকিয়ে থাকতাম।’
‘রাইতভর নদীতে। বেয়ান রাইতে এগোই। সঙ্গে সহযোদ্ধা শহর আলী। পাকিস্তানিরা নদীর কিছু অংশে টিন দিয়া বেড়া দিছে, গোসল করার জন্য। আমি একটারে দেইখাই ফায়ার কইরা দিই। ওখানে বান্কার আছে প্রথম বুঝি নাই। সাতজনের কাছেই গুলি আর গ্রেনেড ছিল দুইটা কইরা। পাড়ের কাছে আইসা মাথা তুলে দেখি বান্কারে পাকিস্তানি সেনাগো রাইফেলের ব্যারেল দেখা যায়। দুইটা ইটের মাঝখান দিয়া ব্যারেল বেরিয়ে আছে। কি করা যায়?’
‘ওই রাইফেলের নলের ভেতর আমগো রাইফেলের নল দিয়া ফায়ার করতে পারলে ওগো ম্যাগজিনে আগুন ধরবো। বানকারে যারা থাকবো সব পুইড়া তামা হইয়া যাইব। কিন্তু ওখানে কেমনে যাই? ছাদের ওপর ছিল আরেকটা বান্কার। ওটাই ছিল ভয়।’
‘শরীর থেকে সব খসাইয়া রাইফেল নিয়া আমি এগোই। ক্রলিং করলে মাথা জাগে। তাই রোলিং করা শুরু করি। ওরা ছিল উঁচু ভিটার ওপর। তাই রোলিং করে ওঠা খুব সহজ কাজ না। তা করতে গিয়া হাত দুটো ছিলে যায়। গোলাগুলি তখনও চলছে। একটা গইড় দিয়াই ফায়ার করব ওগো বান্কারে। হিসাব কইরা নিলাম। খানিক জিরাইয়া যেই গড়ই দিলাম অমনি ছাদের উপরের বান্কার থেকে সমানে গুলি এসে লাগে। ছিটকে গিয়ে নদীতে পরি। কাডা পাতা ছিল নদীর পানিতে। পইরাই ছটফট করছি। রক্তে নদীর ওপাড় পর্যন্ত পাইয়া গেছে। সহযোদ্ধা মান্নান গিয়া আমার চোয়ালে এক হাত আর মাথায় এক হাত দিয়ে চেপে ধরে। দেখলেন দম আছে। কচুরি পানা মাথায় দিয়া নদীর পেছনের দিকে আমারে নিয়া আসেন। গুলিটি আমার ঘাড় দিয়া ঢুকে ডান চোখের রগ ছিড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়।
নদী থেকে উঠতেই দেখি চোয়াল দিয়া গলগলাইয়া রক্ত পড়ছে। শার্ট দিয়া চোয়ালটারে বেঁধে দেয় সহযোদ্ধারা। স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল। তাই প্রচুর রক্ত গেছে। গরু জবাইয়ের মতো। মেয়ারহাট খোলা, খুসলে বাজারে যখন আনছে তখন চোহে দেখি না কিচ্চু। হেমায়েত সাহেব আইসা বলেন- আলিম, তুমি চাইয়া দেখ, দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে। আমি শুধু বলি- জয়বাংলা।
চিকিৎসার জন্য আমারে নিয়ে যায় দীঘলিয়া গ্রাম, রাধাগঞ্জে। সেখানেও ডাক্তাররা দেখে বলে- ‘ঘণ্টা খানেক টিকবে। খালি খালি ওষুধগুলো ফলায়া লাভ নাই।’ তখন মৃত্যুর প্রহর গুনছি। নারকেল বাড়িতে একটা মিশন হাসাপাতাল ছিল। সেখানে এক মহিলা ডাক্তার দেখে বলে- ‘রাত ৪টা যদি কাটাতে পারে তাহলে রোগি মরবে না। ইনজেকশন দিতে থাকেন।’ কিছুক্ষণ পর পরই ইনজেকশন চলে। একটা নার্স কথা বলে বলে আমারে সজাগ রাখে। এভাবেই ওই রাত কাটাই। প্রাণেও বাঁইচা যাই।
দেড় মাসের মতো খাবার খাইতে হইছে নাক দিয়া। হাসপাতালে বসে একদিন আয়নায় নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠি। ফুলে চোয়াল চলে আসছে কানের কাছে। এই বিভৎস চেহারা নিয়া বেঁচে লাভ কি? গলায় পোজ দেওয়ার জন্য ব্লেড খুজছিলাম। এক ডাক্তার এসে ওইদিন ঠেকায়।
চোয়াল সেট করতে ঢাকা মেডিকেলেই অপারেশন হয়েছে কয়েকবার। ডান চোখের রগটার বারো আনিই ছিড়ে গেছে। বাকিটাও শুকিয়ে গেছে। অপারেশন করায় চোখও নষ্ট হয়ে যায়। চোখ তুলে ফেলতে চেয়েছিল । আমি দেই নাই। এভাবেই এখন বেঁচে আছি। আয়নার সামনে দাঁড়াইলেই চোখ আর চোয়ালের জখমটা দেখা যায়। তহন একাত্তরটা বুকের ভিতরে খামচে ধরে ভাই।’
স্বাধীনতা লাভের পর ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলিউজ্জামান এসেছিলেন ঢাকায়, বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখনও তার মুখ ফোলা। চেনার উপায় নেই। সহযোদ্ধারা তাকে সামনে রেখে বলে, ‘নেতা দেখেন, গুলি কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে বের হইছে।’ বঙ্গবন্ধু তাকিয়েই চিনে ফেলেন। জড়িয়ে ধরে বলেন- ‘ধরালের আলিউজ্জামান না তুই।’
একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মনা, এই কার্ড কেউ পায় নাই। তুই কোটালিপাড়ায় আগে পাইছস। পরে দেখা করিস।’ নানা কষ্টে পরিবার চললেও বাবার (শেখ মুজিব) কাছে আর যাওয়া হয় না আলিউজ্জামানের। কেটে যায় কয়েক বছর। একবার নায়েক আর আজিজুলের সঙ্গে দিনক্ষণ ঠিক করেন। ওই কার্ড নিয়া দেখা করবেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু আগেরদিন বিকেল বেলায় রাজাকার মকবুল আসে বাড়িতে। তামাশা করে বলে- ‘তোমাগো মুজিব, ফুট্টুস। কুখ্যাত মুজিব।’ শুনে আলিমুজ্জামান মুষড়ে পরেন। প্রতিবাদ করে বলেন- ‘আমার বাবা কুখ্যাত না। তুমি অন্য শেখ মুজিবের কথা শুনছো। আমার বাবায় মরে নাই।’ উনি দৌড়ে যান আজিজ সাহেবের বাড়িতে। গিয়ে দেখেন সেও কাঁদছে। পরে নায়েকের বাড়িতে গিয়েই আলিউজ্জামান বেহুঁশ হয়ে পড়েন।’
ভিডিও: জড়ায়া ধরে বঙ্গবন্ধু কয়-তুই ধরাইলের আলিউজ্জামান না?
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই বীর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়- ‘আমরা তো নিজের কাজেই সৎ না। স্বাধীনের পর কমান্ডারা টাকা খাইছে আর মুক্তিযোদ্ধা বানাইছে। আমার এলাকায় হেমায়েত বাহিনীতে বেশি হলে সাড়ে তিনশ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এখন হইছে হাজার হাজার। এতো বেশি সনদ দেওয়া হেমায়েত সাহেবের ঠিক হয়নি। আসলে যারা অরজিনাল যোদ্ধা তারা কিন্তু শিক্ষিত না। তারা প্যাঁচও বুঝে না। সনদও নেয় নাই অনেকে। আর শিক্ষিতরা চালাক ছিল। সইরা সইরা থাকত। কিন্তু নিজের সুবিধাটা ঠিকই বুঝতো।’
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সেই দেশ কি পেয়েছেন?
‘গাড়ি পামু, টাকা পামু, বাড়ি পামু- এমন চিন্তা তো একাত্তরে ছিল না। চিন্তা ছিল একটাই, পাঞ্জাবিগো এই দেশ থেকে তাড়াইতে হবে। দেশরে স্বাধীন করতে হবে। সেই দেশ তো পাইছি। চাকরি বাকরি সব আমাদের ছেলেরাই করছে। এখন স্বাধীন দেশে অফিসারদের দেখলেও ভাল লাগে। এই যে তুমি সাংবাদিক আইছো কথা কইতে। বাজান, তোমারে পাইয়া জম্মের মতো খুশি লাগছে।’
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যোদ্ধা বলেন, ‘গুন্ডা পান্ডা আর খুনাখুনি দেখলে খারাপ লাগে। কুত্তায় কুত্তা মারে। মানুষ মারে মাইনসে! এটা তো খারাপ। বিচারটা আরও দ্রুত করতে হইবো।’
দেশ কেমন চলছে?
‘দেশ তো এহন খুব ভাল চলছে। শেখ হাসিনা যদি না আসতো তাইলে তো মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্য থাকতো না। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাবার সৈনিক’- এ হিসেবে তিনি আমাদের মূল্যায়ন করছে। তা না তাইলে তো আমরা বাঁচতাম না। পথে নামতে হইতো। দোয়া করি, আল্লাহ তার আয়ু বাড়িয়ে দিক। তার সাথে দেখা হলে বাবার (শেখ মুজিব) ওই কার্ডটা তারে দেখাইতাম।’
কী করলে দেশ আরও এগোবে?
মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামানের উত্তর- ‘আমরা তো শিক্ষিত না। আমগো কথা কে শুনবো। এই সরকারকে ভালবাসি। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত কেন প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়? দায়দায়িত্ব তো অন্য মন্ত্রীদের বা সচিবদের আছে। তাহলে বাকীরা কি কাজ করেন? উনি এখনও সঠিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। কিন্তু এইভাবে চললে ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীকেও বির্তকিত করার সুযোগ তৈরি হবে। এই দিকে খেয়াল রাখা দরকার। ঘুষটা যদি উইঠা যাইত এই দেশের থাইকা, কিন্তু ঘুষ উঠে না তো। আগে হাতে দিতে হইতো, এখন পাঠায় মোবাইলে ডিজিটালি । আর দলের লোকদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর হইতে হবে। খাই খাই কর্মীরাই দলের জন্য ক্ষতিকর। এরাই দলের বারোটা বাজায়। তাদের কাছে স্বার্থ বড়, আওয়ামী লীগ না।’
দেশকে একদিন সোনার বাংলায় পরিণত করবে পরবর্তী প্রজন্ম। তেমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামানের। তাই বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন শেষ কথাটি- ‘তোমরা কাজে সৎ থেকো। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসটা জেনে নিও। অনেক রক্ত আর অনেক মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সেই স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটাকে তোমরাই প্রতিষ্ঠা করো।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামান ।
ট্রেনিং: ১৯৭০ সালে গোপালগঞ্জ থেকে বিয়াল্লিশ দিনের আনসার ট্রেনিং করেন।
যুদ্ধ করেছেন : ৮ নম্বর সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর অধীনে যুদ্ধ করেছেন ঘাগোর, কালকিনি, কালিন্দি, কোটালিপাড়া ও বাঁশবাইরা প্রভৃতি এলাকায়।
যুদ্ধাহত : ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলি তার ঘাড় দিয়ে ঢুকে ডান চোখের রগ ছিড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়। ফলে ডান চোখটি সারাজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারায়।
ছবি ও ভিডিও : সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৮ জুন ২০১৯
© 2019, https:.