ছেলেশিশু ধর্ষণ বন্ধেও সোচ্চার হতে হবে
ছেলে বা মেয়েশিশুদের ধর্ষক আসলে কারা? আপনার আমার সম্পর্কের মুখোশ পরা কোনো পরিচিতজন। কখনো সে পরিচিত ভাই, কখনো কাকা, কখনো নানা-দাদা-চাচা কিংবা ওঁৎ পেতে থাকা যেকোনো মানুষ। যার বা যাদের কাছে আমাদের শিশুটি খুব সহজভাবেই যেতে পারে। আপনার ও আমার সম্পর্কের মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনো না কোনো ধর্ষক। ঘটনা ঘটার আগে যাদের আমরা সহজে চিহ্নিত করতে পারি না। কিন্তু যখন তার পশুরূপটি উন্মোচিত হয়, তার আগেই আমাদের শিশুটি ক্ষতবিক্ষত হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে।
দেশে প্রতিদিনই যেভাবে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, তাতে সন্তানের বাবা-মায়েদের উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষত শিশু ধর্ষণের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের অসহায়ত্ব ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলার মতো পাশবিকতা কীভাবে মেনে নিচ্ছি আমরা। এই পরিস্থিতিতে মেয়েশিশুদের ওপর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি ছেলেশিশু ধর্ষণের বিষয়েও আমাদের সোচ্চার হওয়াটা জরুরি। কেননা, কী শহর, কী গ্রাম, বছরজুড়েই ঘটছে ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনা, কিন্তু সেসব খুব একটা সামনে আসছে না।
কয়েক বছর আগের প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। ঢাকা মহানগরের কাফরুলে বসবাস করেন এক বন্ধু। সফল ব্যবসায়ী। তার সারা দিন কাটে ব্যস্ততায়। একমাত্র ছেলেকে তেমন সময় দিতে পারেন না। কিন্তু সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে এতটুকু ঘাটতি রাখতেও রাজি নন তিনি। ছেলের বয়স ছয় পেরোলে ব্যবস্থা হয় আরবি শিক্ষার। বাসায় পড়ানোর জন্য রাখা হয় স্থানীয় স্কুলের এক আরবি শিক্ষককে। তার নাম তাজুল ইসলাম। প্রতিদিন দুপুরে এক-দুই ঘণ্টার জন্য পড়াতে আসেন তিনি। নিরিবিলি একটি কক্ষে চলে আরবি পড়া। কিন্তু মাসখানিক যেতেই বেঁকে বসে বন্ধুর ছেলেটি। কিছু না বলেই বাবা-মাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সে। বলে, ‘এ হুজুর ভালো না, ওনার কাছে পড়ব না।’ তার কথায় গুরুত্ব দেন না বাবা-মা। বরং আরবি না পড়ার জন্যই হুজুর সম্পর্কে খারাপ ধারণা দিচ্ছে সে- এমনটা ভেবে সন্তানকে অবিশ্বাস করেন তারা।
দোতলা বাড়ির বারান্দাতে পার্টিশন দেওয়া একটি কক্ষে চলত শিশুটির আরবি পড়া। হুজুর যখন আসতেন, তখন নীরবতার স্বার্থে রুমের দরজাটিও ভিড়িয়ে দেওয়া হতো। এভাবেই আরবি শিক্ষা চলে বছরখানিক। দিনে দিনে ছেলেটি শারীরিকভাবে রোগাপাতলা হতে থাকে। খাওয়া-দাওয়াও যায় কমে। চোখের কোণে জমে কালো দাগ। সন্তানের কষ্টের কথা অজানাই থেকে যায় বাবা-মায়ের কাছে। কিন্তু এক দুপুরে সত্যটি উন্মোচিত হয়। প্রতিদিনের মতোই ওই দিন পড়াতে আসেন শিক্ষক। মিনিট পনেরো পড়ানোর পরই ছেলেটি চিৎকার দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সন্তানের চিৎকারে ছুটে আসেন মা। পরিস্থিতি ঠাহর করতে পেরে পালিয়ে যান ওই আরবি শিক্ষক। ছেলেটি তখন পায়ুপথের প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছে। এক বছর ধরে এভাবেই ছেলেশিশুটিকে ধর্ষণ বা অস্বাভাবিক যৌন নির্যাতন করেছেন ওই আরবি শিক্ষক। শুধু তা-ই নয়, কারও কাছে মুখ না খুলতে নানাভাবে ভয়ও দেখাতেন তিনি। এভাবে ছেলেটির একেকটি দুপুর ছিল একেকটি অভিশাপ। মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ওই দিন সব কথা বলে দেয় সে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় যুবকরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধরে আনে আরবি শিক্ষক তাজুলকে। দণ্ডবিধি ৩৭৭ ধারায় মামলা করে শিশুটির পরিবার। থানায় গণমাধ্যমের সামনেই তাজুল ইসলাম অকপটে স্বীকার করেন তার অপকর্মের কথা। বিকৃত রুচির এই আরবি শিক্ষকের যৌন নির্যাতনে শিশুটি মানসিক ট্রমার মধ্যে পড়ে, যা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর।
গণমাধ্যমে উঠে আসা এ রকম ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনা নেহাত কম নয়। এ বছরের জানুয়ারি মাসের কথা। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একজন স্কুলপড়ুয়া ছেলের লাশ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তে উঠে আসে ছেলেটিকে যৌন নিপীড়নের পর হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে এপ্রিলে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে এক ছেলেশিশু, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের এক এতিমখানার দুই ছেলেশিশু এবং রাজশাহীর পুঠিয়ায় এক মাদ্রাসার ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করা হয়। ওই ঘটনাগুলোয় মামলাও হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের ৩ আগস্ট রাঙ্গুনিয়ার পোমরা ইউনিয়নের শান্তিরহাট বাজারের একটি রেস্তোরাঁ থেকে ১১ জন শিশুকে উদ্ধার করে র্যাব। যাদের দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন চালাচ্ছিল কামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি বেসরকারি গবেষণায় দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১০ জন ছেলেশিশু যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার ছেলেশিশুর সংখ্যা ছিল ১৩ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। কেননা, লোকলজ্জা আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ে অনেক ছেলেশিশু ও তার পরিবারের কষ্টের চাপা কান্নার খবরগুলো উঠে আসে না পত্রিকার পাতায়।
এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে ছেলেশিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টিকে আমরা প্রায় বিবেচনার মধ্যেই রাখছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পরিবারে মেয়েশিশুটির করণীয় বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়া হলেও ছেলেশিশুটি কীভাবে ধর্ষণকারী বা যৌন নির্যাতনকারীর হাতে থেকে রক্ষা পেতে পারে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা তারা পায় না। ফলে নিরাপদ থাকছে না আমাদের ছেলেশিশুরাও। ছেলেশিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কোন আইনে বিচার হবে? সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই অনেকেরই। একসময় এ অপরাধ স্থানীয়ভাবে সালিশের মাধ্যমে সমাধান করা হতো। তখন উপযুক্ত বিচার থেকে বঞ্চিত হতো ভুক্তভোগীরা। ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হলে আগে দণ্ডবিধি ৩৭৭ ধারায় মামলা হতো। কিন্তু বর্তমানে ছেলে বা মেয়েশিশু হোক, ধর্ষণের মামলার বিচার হবে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ অনুযায়ীই। এর সব কটি ধাপ মেয়েশিশু ধর্ষণের মামলার মতোই। সচেতনতার জন্য আইনের এ বিষয়টির আরও অধিক প্রচার হওয়া প্রয়োজন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ছেলে বা মেয়ে যেই ধর্ষণের শিকার হোক, ধর্ষণকে ধর্ষণই বলা উচিত। ‘বলাৎকার’ বা অন্য কোনো প্রতিশব্দ এ ধরনের অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া সচেতনভাবেই আমরা ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিই না। ফলে ছেলেশিশুর সুরক্ষার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমও তেমন নেই, যা সরকারিভাবেই হাতে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।’
শিশু ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা অতিদ্রুত নিশ্চিত করে তা কার্যকরের কোনো দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা যায়। বরং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে নিশ্চিত জীবনে ফিরে এসেছে অনেক ধর্ষক। ফলে বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে সমাজে ক্রমেই বাড়ছে শিশু ধর্ষণজনিত অপরাধ। এমনটা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাই রাষ্ট্র শিশু ধর্ষণের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাক।
ছেলে বা মেয়েশিশুদের ধর্ষক আসলে কারা? আপনার আমার সম্পর্কের মুখোশ পরা কোনো পরিচিতজন। কখনো সে পরিচিত ভাই, কখনো কাকা, কখনো নানা-দাদা-চাচা কিংবা ওঁৎ পেতে থাকা যেকোনো মানুষ। যার বা যাদের কাছে আমাদের শিশুটি খুব সহজভাবেই যেতে পারে। আপনার ও আমার সম্পর্কের মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনো না কোনো ধর্ষক। ঘটনা ঘটার আগে যাদের আমরা সহজে চিহ্নিত করতে পারি না। কিন্তু যখন তার পশুরূপটি উন্মোচিত হয়, তার আগেই আমাদের শিশুটি ক্ষতবিক্ষত হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে। এসব গুপ্ত ও বিকৃত মানসিকতার মানুষের থাবা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পরিবারের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে সচেতনতা। আপনার ছেলে বা মেয়েশিশুটিকে বিশ্বাস করুন, তার কথাকে গুরুত্ব দিন, আত্মরক্ষার কৌশলটি তাকে শেখান। ছেলেশিশু বলে ধর্ষিত হবে না- এমন ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি শিশুটির পরিবার যেন হয় তার সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। এই বোধটি শিশুর মনে গেঁথে দিতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবাইকেই। মেয়েশিশু বা ছেলেশিশু নয়, সব শিশুর জন্যই নিরাপদ এবং স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে হবে আমাদের।
ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৯ জুলাই ২০১৯
© 2019, https:.