কলাম

রূপনগরের বস্তিতে আগুন এবং রাষ্ট্রের দায়

দুদিন ধরেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ছবি চোখে আটকে যাচ্ছিল। ছোট্ট একটি শিশু। তার সামনে পড়ে আছে কয়েকটি বই। কোনোটি সম্পন্ন আবার কোনোটি আংশিক পোড়া। একটি বই তুলে নিয়েছে সে। ভেতরের পাতায় অক্ষরগুলোতে হাত বুলাচ্ছে শিশুটি। ওই লেখাটি হয়তো তার প্রিয় ছিল। প্রিয় লেখার প্রিয় অক্ষরগুলো পুড়েছে আগুনে। মলিনমুখে বইগুলো নিয়ে তাই নানাকিছু ভাবছে শিশুটি। হয়তো তার মনে কয়েকটি প্রশ্ন গুমরে কাঁদছে কেন পুড়ে গেল তাদের ঘরটি, কেন পুড়ল তার প্রিয় বইগুলো? এমন ছবি আমাদের বুকের ভেতরটাকে খামচে ধরে। আমাদের উন্নতির অহমিকাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে, মানবতাবোধকে বৃৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়।

শিশুর ওই ছবিটি মিরপুর রূপনগরের বস্তির। শুক্রবার সেখানে চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগার পর তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ঝিলপাড়, আরামবাগ ও টবলক বস্তিতে। ফলে অগ্নিকান্ডে পুড়ে গেছে বস্তিগুলোর ১৫ হাজারের ওপর ঘর। ঝিলের ওপর মাটি ভরাট করে বানানো বাঁশ ও টিনের ছোট ছোট ঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে আগুনে। মানুষ কোনোরকম প্রাণে বেঁচে গেলেও সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের চোখেমুখে আজ নানা শঙ্কা। শুধু পনের হাজার ঘরই নয়, এই আগুনে পুড়েছে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নগুলোও।

এই নগরে কি বস্তির প্রয়োজনীয়তা আছে? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে বস্তিতে কারা বাসিন্দা সেটির মূল্যায়ন করলেই। শুধু রাজধানীতে ৩০ লাখ লোক বিভিন্ন বস্তিতে বাস করে। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে শহরে আসে খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষগুলো। যারা নানাভাবে প্রয়োজন মেটায় উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষদের। কম খরচে থাকতে এদেরই প্রধান ঠিকানা হয় রাজধানীর বস্তিগুলো। গৃহকর্মী, পোশাকশ্রমিক, রিকশাচালকসহ দিনমজুর শ্রেণির লোকজনই অধিকাংশ বস্তির বাসিন্দা।

২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৯ হাজার ১১৩টি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি। চট্টগ্রামে এ সংখ্যা ২ হাজার ২১৬টি।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বস্তিবাসীর অধিকাংশই নগর অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। বস্তির বাসিন্দাদের ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ পোশাকশ্রমিক, ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ রিকশা বা ভ্যানচালক, ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ গৃহপরিচারিকা, ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ দিনমজুর ও ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন। সে অর্থে, কোনো না কোনোভাবে বস্তিবাসীদের প্রয়োজনীয়তা এই নগরে রয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে এই শ্রেণির নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা পরিষেবা কি সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছে? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। বরং বলা যায় রাষ্ট্রের ন্যূনতম অধিকারগুলো থেকেও আজ তারা বঞ্চিত।

নগরের বস্তিগুলো গড়ে ওঠে অবৈধভাবেই। মিরপুরের রূপনগরের বস্তিগুলোও সেভাবেই গড়ে উঠেছিল, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জায়গায়। গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যায়, নগরের বস্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ বরাবরই থাকে ক্ষমতাসীন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে। এরাই বস্তিতে মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজে যুক্ত থাকে। অবৈধ টাকার লোভে এদের সহযোগিতা করে প্রশাসন ও সরকারের একশ্রেণির কর্তাব্যক্তিরা। রূপনগরের বস্তিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চলন্তিকা বস্তিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ঘর আছে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও ক্ষমতাসীন দলীয় নেতা, ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড সভাপতিসহ প্রভাবশালীদের। মাসোহারা ছাড়াও শুধুমাত্র অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি বাবদ বস্তিগুলো থেকে মাসে দেড় কোটি টাকা তুলে তারা তা ভাগাভাগি করত নিজেদের মধ্যে। এমন খবরগুলো সরকারের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করে। সচরাচর দেখা যায়, নগরের বস্তিগুলোই আগুনে পুড়ে বেশি। ২০১৪ সালে রাজধানীর মিরপুরে জেনেভা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে ১০ জন। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ রাজধানীর গুলশানের কড়াইল বস্তিতেও গভীর রাতে আগুন লাগে। একইভাবে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত  চট্টগ্রামের বস্তিগুলোতে আগুন লেগেছে প্রায় ৮৭২ বার, ঢাকাতে ১৭৮ বার এবং রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রংপুরে ১৪৬ বার।

কিন্তু কেন এই আগুন?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, বড় বড় ভবন তৈরির জন্য জমি খালি করতেই মিরপুরের রূপনগরে চলন্তিকা বস্তিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবি, আগুন লাগার সময় তারা কেরোসিনের গন্ধ পেয়েছেন এবং বস্তির উত্তর-দক্ষিণ দুদিক থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখেছেন। অনেকে বলছেন, আগুন লাগার দুই ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস এসেছে। যখন বস্তি পুড়ে প্রায় শেষ, তখন ফায়ার সার্ভিস পুরোদমে কাজ শুরু করে। তাই তাদের সন্দেহ, এই আগুন দুর্ঘটনাক্রমে লাগেনি, লাগানো হয়েছে। এর জন্য সবার সন্দেহের তীর স্থানীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দিকে। সরকারি জমির ওপরে গড়ে ওঠা বস্তি থেকে যারা প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোহারা নিতেন। তাই আগুন লাগার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় তারাও এড়াতে পারেন না।

প্রাথমিকভাবে জানা যায়, আগুনের সূত্রপাত প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাসের সংযোগ থেকেই। কিন্তু কারা বস্তিতে এ ধরনের পাইপের মাধ্যমে গ্যাসসংযোগ দিয়ে টাকা তুলছিলেন? সেটিও উঠে আসে পত্রিকায় প্রকাশিত রূপনগর থানা ক্ষমতাসীন দলের সভাপতির বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ৫০ জন ক্ষমতাসীন দলের নব্য সদস্য এই বস্তি থেকে তুলতেন মাসে ৩০ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছিলেন কি না সেটি তিনি জানাননি। ফলে তাদের লোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে হাজার হাজার নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরগুলো। স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্ষমতাসীন দলের সভাপতির বক্তব্যই যদি সত্য হয়, তবে এর দায় ওই দলের ওপরও বর্তাবে। শোকের মাসে সারা দেশ যখন জাতির পিতা ও তার পরিবারের শহীদ সদস্যদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে তখন আওয়ামী লীগের একশ্রেণির বিরুদ্ধে আগুন লাগানোর অভিযোগ আমাদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এরা আসলে কারা? সেটি ক্ষমতাসীন দলকেই খুঁজে বের করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তার দলের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেই যদি বস্তিতে আগুন দেওয়া ও অবৈধ অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠে তবে তা সরকারের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলবে। তাই বস্তির অগ্নিকাণ্ডে সরকারি তদন্তের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের দলীয় তদন্ত টিমও গঠন করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ বিশেষ প্রয়োজন। অবৈধ টাকা কামানোর লোভে দলীয় প্রভাবে যারা বস্তি তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিরুদ্ধেও সরকারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রূপনগরের বস্তিতে আগুনে যাদের ঘর পুড়েছে তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই তৈরি করে দিতে হবে। নগরে নিম্নবিত্তের খেটেখাওয়া মানুষগুলোও যাতে কম টাকায় থাকতে পারে সেই আবাসন ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকেই। সেটি নিশ্চিত করার আগে জোর করে দখলের মাধ্যমে বস্তি উচ্ছেদ বা রহস্যজনক আগুনে পুড়িয়ে জায়গা খালি করা প্রকৃত সমাধান হতে পারে না। আমরা চাই, উন্নয়নের পথে চলা বাংলাদেশে নিম্নবিত্তদের আবাসন ব্যবস্থাও নিশ্চিত হোক।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল : ২১ আগস্ট ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button