ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বিপন্নতা
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ভাষার সংখ্যা কতটি? এ নিয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষার সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৮টি হবে। এ ভাষাগুলোকে মূলত চারটি ভাষা পরিবারে ভাগ করা যায়। অস্ট্রো-এশিয়াটিক, তিব্বতি-চীন, দ্রাবিড় ও ইন্দো-ইউরোপীয়। বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগুলো আবার দুটি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে মোন-খমের ও মুন্ডারি শাখা। বর্তমানে প্রায় ১০০টির অধিক ভাষা মোন-খমের শাখার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাসি ভাষা। এ ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। তবে বর্তমানে এ ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়।
সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা দুটিই মুন্ডারি শাখার অন্তর্ভুক্ত। উভয় ভাষারই নিজস্ব কোনো হরফ নেই। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতাল বর্ণমালা তৈরি করেন এবং তা সরকারি স্বীকৃতিও লাভ করে। চীনা-তিব্বতি ভাষাগুলো আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন বোডো, কুকি-চীন, সাক-লুইশ ও লোলো-বার্মিজ শাখা। মান্দি বা গারো, ককবোরক (ত্রিপুরা), লিঙ্গাম, পাত্র বা লালং, কোচ, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষা বোডো শাখার অন্তর্ভুক্ত। মৈত্রেয় বা মণিপুরি, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো ভাষাগুলো কুকি-চীন শাখাভুক্ত। রাখাইন, ওঁরাওদের কুড়ুখ, পাহাড়িকা ও মাহালি ভাষা দ্রাবিড় ভাষা পরিবারে অন্তর্ভুক্ত। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। রাখাইন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ওঁরাওদের কুড়–খ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত ভাষার মধ্যে বাংলা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এই পরিবারে চাকমা ভাষা এবং সাদরি ভাষাও রয়েছে। মণিপুরিদের বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং প্রভৃতি ভাষাও এই শ্রেণিভুক্ত। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারের এই দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখের ও অপমানের।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কিছু কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করলেও তা চলছে ঢিমেতালে। প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা হয়, প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওঁরাও (কুড়–খ), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষায়ও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে।
সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের পাঁচটি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। এ বছরও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাকার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। তাই সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষাগুলো কতটা বিপন্ন, তা নিয়ে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা প্রায় ৩০টি ভাষার ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপ চলে ‘ফিশম্যান মানদ-’ মোতাবেক। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদ-ের রয়েছে আটটি স্তর। কোনো ভাষা চতুর্থ স্তরের পরের স্তরে চলে গেলেই ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই মানদণ্ডের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয়- ভাষাটি ঊর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি না। বিপন্নতার শুরু যে পঞ্চম স্তরে, সেখানে বিচার্য বিষয়- ভাষাটির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি এবং ওই ভাষায় সাহিত্য রয়েছে কি না। মানদ- মোতাবেক দেশের প্রায় সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাই আছে বিপন্নের স্তরে।
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা । আবার এসব ভাষায় বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রবলভাবে। বয়সে প্রবীণরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষাটির কোনো ব্যবহারই জানে না। দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চাকমাদের ভাষায় সাহিত্য রয়েছে। কিন্তু ওই সাহিত্য খুব কম লোকের কাছেই পৌঁছে। জরিপে অংশ নেওয়া চাকমাদের পঞ্চাশ শতাংশ বলেছে, তারা নিজ ভাষার নানা উপকরণ পড়েছে; কিন্তু সেগুলো তাদের কঠিন মনে হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ বলেছে, শুধু প্রার্থনার সময় তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করে। জরিপে দেখা যায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো প্রয়োজনীয়তার চাপে পড়ে নিজ মাতৃভাষার চেয়ে এখন বাংলাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এর প্রভাব সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই বেশি। সাঁওতালদের ৪৯ শতাংশই মনে করে, নিজ মাতৃভাষার চেয়ে আজ বাংলাই বেশি প্রয়োজনীয়। উত্তরবঙ্গের কোদা ও কোল জাতির কেউই এখন আর নিজ ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের কোচ ও দিনাজপুরের কড়া, ভুনজার, মুসহরদের। আবার বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে দ্বিতীয় আরেকটি ভাষা হিসেবে বাংলা জানে বা লিখতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ তিনটি ভাষাও জানে। যেমন বান্দরবানের খুমিরা নিজ ভাষা ছাড়াও মারমা ও বাংলা জানে। উত্তরবঙ্গের ওঁরাওরা বাংলা, সাঁওতালি এবং সাদরি ভাষায় কথা বলে।
সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা- এই প্রধান পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের ভাষা বিপন্নতার দ্বারপ্রান্তে। ঘরের মধ্যে ছাড়া তাদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। নতুন প্রজন্ম শিক্ষার সুযোগ এবং বাস্তবতার কারণে নিজের ভাষার চেয়ে বাংলা ও ইংরেজি চর্চাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ফলে এখন তাদের ভাষার উচ্চারণে শুধু পরিবর্তনই ঘটছে না; বরং তাদের শব্দভান্ডারে অনেক বাংলা শব্দও স্থান করে নিয়েছে। আবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শহরে বসবাস করছে, পারিপার্শ্বিকতার নানা কারণে তাদের মাতৃভাষা আজ তারা প্রায় ভুলতে বসেছে। তাই এবারের প্রতিপাদ্যটি খুবই যৌক্তিক। কিন্তু এটি শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবারকে মাতৃভাষার চর্চা রাখতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন অতিদ্রুত তাদের ভাষাগুলো রক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান পুরোপুরি নিশ্চিত করা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন এবং সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে ওই গোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ। আর এর জন্য সত্যিকারভাবেই এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। তবেই ভাষার এ দেশে রক্ষা পাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষাগুলো।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৫ আগস্ট ২০১৯
© 2019, https:.