‘জয়বাংলা’ স্লোগানই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র
সাব সেক্টর কমাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ
আমার কমান্ডো ট্রেনিং হয় চিরাটে, পাকিস্তান কমান্ডোদের হেডকোয়ার্টারে। বিভিন্ন বাহিনী থেকে ট্রেনিং নিতে আসা ৫০০ জন থেকে কোয়ালিফাই করে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন। ওটা ছিল কমান্ডোদের বেসিক ট্রেনিং। এরপরই একেকজন একেক বিষয়ে স্পেশাল ট্রেনিং নেয়। আমি ছিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)-এর একজন এলিট কমান্ডো।
করাচিতে বাঙালি গ্রুপ ছিল আমাদের। কামাল সাহেব ছিলেন, পরে তিনি আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হন। ছিলেন সুলতান সাহেবও। উনিও আমেরিকার ট্রেনিংপ্রাপ্ত কমান্ডো। একাত্তরে ক্যাপ্টেন সুলতান নামে নাইন সেক্টরের ইনডাকশন ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন। আর নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল নামে ট্রুপস নিয়ে ফরিদপুরে যুদ্ধ করেছেন। এখন তিনি ফরিদপুর আওয়ামী লীগের বড় নেতা। আমরা তখন করাচিতে একত্রে ভাষাদিবস, নববর্ষসহ নানা অনুষ্ঠান পালন করতাম।
দেশ তখন উত্তপ্ত। আমাদের মধ্যে কিছু ইন্টেলিজেন্সের লোকজন ছিল। তাদের মুখেই শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানে কিছু একটা ঘটবে। তখন উদগ্রীব হতাম। চিন্তা হতো দেশকে নিয়ে। আন্ডার ওয়াটার ফিশিং করার ঝোক ছিল আমার। একদিন করাচি নেভাল পোর্টে ফিশিং করতে গিয়ে দেখি পূর্ব পাকিস্তানে আসার জাহাজে হেভি আর্মস অ্যামুনেশন লোড করা হচ্ছে। তখনই বুঝে যাই ওরা খারাপ কিছু ঘটাবে। কিন্তু কমান্ডো হয়ে তো বসে থাকতে পারি না!
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কয়েকদিনের ছুটিতে দেশে আসি। সুলতান সাহেব ও নূর মোহাম্মদ ভাই ইতিমধ্যে অবসরে, ফিরে এসেছেন। তাদের সঙ্গেই মিটিংয়ে বসি। পরিকল্পনা হয় খারাপ কিছু ঘটার আগে তারাই করাচিতে আমাকে মেসেজ পাঠাবেন। ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবো।
ছুটি কাটিয়ে পাকিস্তান ফিরে গেলাম। হঠাৎ একদিন কমান্ডিং অফিসার টি এ খান একটি টেলিগ্রাম হাতে ছুটে আসেন। টেলিগ্রামে লেখা– ‘মাদার সিরিয়াস কাম শার্প।’ বুঝে গেলাম এটি নূর মোহাম্মদ ভাই পাঠিয়েছেন। ‘মাদার’ মানে মাতৃভূমি। আর ‘সিরিয়াস’ লিখলে বুঝতে হবে যেভাবেই হোক ফিরে যেতে হবে। টি এ খান ছুটি দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি নিজেকে সংযত রাখলাম। ‘মায়ের চেয়ে দেশ আগে’– এমন উত্তর শুনে অবাক হয়ে উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পালিয়ে যাব এটা বুঝতে দিলাম না তাকে। কারণ ওরা নানাভাবে আমাদের সন্দেহ করতো।
ফরমাল ছুটি না নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা আঁটছি। টাকার প্রয়োজনে শখের মটরসাইকেলটাও বিক্রি করি নয়শ টাকায়। ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল অলি। দেশ নিয়ে সেও চিন্তিত। পরিকল্পনার কথা শুনে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলো। রাজি হলাম। কিন্তু প্লেনের টিকিট তো নাই। অলরেডি পাকিস্তান থেকে লোকজন আসা বন্ধ। শুধু হাজিদের ফ্লাইট ওপেন ছিল।
কি করি?
তখন মনে পড়ে লেফটেন্যান্ট ইমতিয়াজের কথা। পাকিস্তানের বাইশ ফ্যামিলির, ধনী পরিবারের সন্তান। চেরিয়ট ট্রেনিংয়ে আমি ছিলাম তার ট্রেনার। ওই সময় সে প্রায় ৬০ ফিট পানির নিচে চলে যায়। ফলে আনকনশাস অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম। সেই থেকেই পরিবারিকভাবে একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। পাঞ্জাবি হলেও তার কাছেই সাহায্য চাইলাম। সেও সবকিছু গোপন রেখেছিল। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন তার এক আত্মীয়। তার মাধ্যমে দুটো টিকেট জোগাড় করে দেন ইমতিয়াজ। রাত দুটোর ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে রওনা হয়ে ৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখ ভোরে পৌঁছি ঢাকায়।’
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই একাত্তরের অজানা সব ঘটনা নিয়ে আলাপ চলে।
তার বাবার নাম প্রফেসার হোসাম উদ্দিন। তিনি বরিশাল বিএম কলেজের নামকরা প্রফেসার ছিলেন। বেগের মায়ের নাম মর্জিনা বেগম। তাদের পৈতৃক বাড়ি ভারতের মালদহ হলেও ১৯২০ সাল থেকেই বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ৭ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে বেগ পঞ্চম। তার বড় ভাই মাহমুদ আলম বেগ ছিলেন ব্যাংকার। আর মেজ ভাই মনজুরুল আলম বেগ একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার।
দেশে ফিরে কী করলেন?
মাহফুজ আলম বেগের উত্তর– ‘ছোট ভাই মাহবুব আলম বেগ তখন ছাত্রলীগ করতো। তোফায়েল আহম্মেদসহ তৎকালীন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন– ‘তুই যা বললি সেটা আমি জানি। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে সেলিমদের সাথে মিশে থাকবি। সেলিম তোকে বলবে তোর কি করতে হবে।’
বুঝলাম বঙ্গবন্ধু নিজেও একটা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাত মার্চ ভাষণের পর শেখ সেলিম ও কিছু ছেলেসহ আমরা নারায়গঞ্জে একটা বাড়িতে আস্তানা গাড়ি। সেখানে পেট্রোল আর সাবান এনে মনোটল ককটেল বানানো শুরু করি। অসহযোগে ঢাকায় ও আশপাশে যত ককটেল ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো অধিকাংশই ছিল নারায়নগঞ্জের। এরপর বলা হলো কলাতিয়া চলে যেতে। ওখানে গগনদের বাড়িতে ক্যাম্প করতে হবে। যদি কোন ঘটনা ঘটে বা পাকিস্তানিরা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে নেতারা কলাতিয়াতে আশ্রয় নিবেন। আমার দায়িত্ব তাদের সেভ ডেসটিনিতে পাঠিয়ে দেওয়া।’
‘গগন ছিল ওখানকার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বড় ভাই গ্রামের চেয়ারম্যান। সেখানে গিয়েই ক্যাম্প করলাম। ট্রেনিং দেওয়াও শুরু হয়। বাড়ির সামনে ছিল একটা পুকুর। পুকুরের ওপারে বোতল রেখে গুলির ট্রেনিং দিতাম। অস্ত্র ছিল একটা পয়েন্ট টু টু রাইফেল। ওখানে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, রাজ্জাক সাহেব, সিরাজুল আলম খান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শেখ ফজলুল হক মনি, আমেনা বেগম, মন্টু, আরেফ প্রমুখ।
ধীরে ধীরে আমরা স্থানীয়দের বন্দুক সংগ্রহ করা শুরু করি। জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা তখন বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছে। একদিন ক্যাম্পে আসেন আ স ম আব্দুর রব। সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫ জন সেনা। তাদের কাছে ছিল একটা চাইনিজ এসএমজি আর চারটা চাইনিজ রাইফেল। তখনই প্রথম মর্ডান আর্মস পাই। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাই নরসিংদীতে, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের গ্রুপে। শিল্পী আপেল মাহমুদও ছিলেন ওখানে।’
পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা থেকে তারাবো দিয়ে নরসিংদীর দিকে অ্যাডভান্স হচ্ছে। তখন বেগকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঠেকানোর। একটা দল নিয়ে তিনি এগিয়ে যান অ্যাম্বুশের জন্য। প্রথম অ্যাটাকেই পাকিস্তানি সেনাদের দুটি ট্রাক রাস্তার দুদিকে পড়ে যায়। ফলে হতাহত হয় অনেক সেনা। কিন্তু পরদিনই তারা ফুলফেইজে বম্বিং করে অ্যাডভান্স হয়। ফলে টিকতে পারে না বেগরা। তারা ফিরে এসে দেখেন ডিফেন্স নেই। তখন যে যার মতো আত্মোগোপনে চলে যায়। বেগ নৌকায় করে চলে যান লৌহজং। সেখান থেকে একটা লঞ্চে ফিরেন নিজ শহরে, বরিশালে।
অতঃপর কী ঘটল? সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে।
তার ভাষায়– ‘বরিশাল গিয়েই ছাত্রদের ত্রিশজনের একটা গ্রুপকে রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। চিফ হুইপ ফিরোজ, আফজাল, প্রফেসার সালাম এরাও ছিলেন ওখানে। ইছাকাঠি গার্ডেন, কাশিপুরে ট্রেনিং করাই। জায়গাটা ছিল লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে, একটা মাঠে।
তিন চারদিন পরেই বরিশালে পাকিস্তান আর্মিরা আসে। প্যারাটুপারসও ল্যান্ড করে। হেভি মেশিনগানের সামনে আমরা টিকতে পারি না। তখন ট্রেইন্ড লোক খুব কম ছিল। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রথম দিকে সবাই ছিল আইডিওলজিক্যাল ফ্রিডম ফাইটার। যারা বুক দিয়ে বিশ্বাস করতো বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।
পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল দখল করলে আমরা চলে যাই আটঘর কুড়িআনায়। পেচানো খাল আর পেয়ারাবাগান ওখানে। চলাচলের জন্য ‘হাক্কা’ ছিল একমাত্র উপায়। বরিশালের ভাষায় ‘হাক্কা’ হলো একটি বাঁশ। একটি বাঁশ দিয়ে তৈরি পুল দিয়েই চলাচল করতে হতো। ফলে বুট পরে তার ওপর দিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। এসব কারণে জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল।
তবুও পাকিস্তানি সেনারা গানবোট নিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করতো। রমা দাস, বিথিকা রাণী বিশ্বাস, সমিরন, হরিমন বিশ্বাসসহ আরও অনেক মেয়ে ওখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অধিকাংশই ছিল কলেজের ছাত্রী। এছাড়া সেখানে ছিল পরিমল, ভুলু, তারেক প্রমুখ। আমাদের কাছে দুইটা স্টেনগান, ত্রিশটার মতো রাইফেল। তা দিয়েই যতটা সম্ভব ঠেকিয়েছি। রাজাকার বাহিনীও মাঠে নেমেছে তখন। ছোটখাট যুদ্ধও চলেছে। এক সময় অস্ত্রের সংকটে পড়ি। তখন নির্দেশ আসে ছোট্ট ছোট্ট দলে ভাগ হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার। ফলে সবাইকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিই।’
মাহফুজ আলম বেগ পরিকল্পনা করেন বোনের সঙ্গে দেখা করে রাজশাহী হয়ে মালদহে ঢুকবেন। বোনের শশুড়বাড়ি ছিল কানসাটে। সেখানে বর্ডার ক্রস করতেই প্যাচানো গোফ দেখে পাকিস্তানি স্পাই ভেবে বিএসএফ তাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে ছাড়া পেয়ে তিনি চলে যান কলকাতায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অফিসে।
প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা ফণিভুষণ মজুমদার তাকে নাইন সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হাসনাবাদে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নাইন সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তিনি বেগকে পেয়ে খুশি হন এবং ঐ দিনই ট্রেনিং থেকে আসা একটি কোম্পানির দায়িত্ব দেন তাকে। ভারতের বসন্তপুরের পাশে বর্ডারে রাইস মিলে প্রথম ঘাঁটি গাড়ে মাহফুজ আলম বেগ। সামনে নদী। ওপারে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। বেগের গ্রুপে প্রথম দুইশজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও পরে তা বেড়ে দাড়ায় পাঁচশ’তে। নাইন সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডারও ছিলেন তিনি। পরে তাকে শমশেরনগর সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন বেগ নামে উনি অধিক পরিচিত।
সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করেন মাহফুজ আলম বেগ। এছাড়া বরিশালের দোয়ারিকায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এই যোদ্ধা। রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হন এই বীর। অতঃপর স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন একাত্তরের দুঃসাহসিক সেই দিনগুলোর কথা।
তার ভাষায়– ‘গেরিলা ইউনিটগুলোকে কমান্ড করতাম। গোয়েন্দা রিপোর্ট আসতো আর্মি মুভ করছে। রেইড, কোথাও অ্যাম্বুশ, কোনো কোনো বিওপি দখল করতাম। যত অপারেশন হয়েছে সেগুলো আমি, মেজর জলিল আর ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের অফিসাররা প্ল্যান করতাম।
ছোটদের নিয়ে একটা গ্রুপও করেছিলাম। তাদের বয়স ১১-১৪ বছরের মতো। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল চল্লিশের মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস’। আসলে ওরা বিচ্ছুবাহিনী। ওদের এসএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের ওপর ট্রেনিং দেওয়া হয়। নৌকা চালানোর ওপর ছিল বিশেষ ট্রেনিং। তাদের মেইন কাজ ছিল অ্যামুনেশন ক্যারি, ইন্টিলিজেন্সের কাজ করা। ওরা গল্প বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতো। পরে আর্মি ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কি আছে। তাদের কাজে ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে ট্রেইন্ড মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না। সেখানে ওরা বলত– স্যার আমি যাব।
‘মেজর জলিল একবার প্ল্যান করলেন পাকিস্তানি গানবোটকে কাউন্টার দিতে হবে। গানবোটে ৪০ মিলিমিটার বাফার থাকে। ইপিআরের স্টিল বডি লঞ্চ ছিল তখন। বিগ্রেডিয়ার সালেক ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের কমান্ডার। তাকে রিকোয়েস্ট করে আনা হয় হেভি মেশিনগান। সেগুলো লঞ্চে ফিট করে গানবোট বানানো হয়। বঙ্গ বজ্র নামের দুটি লঞ্চকেই গানবোট হিসেবে ব্যবহার করতাম আমরা। প্রথম নেভি বলতে গেলে নয় নম্বর সেক্টরেই শুরু হয়। নেভির লেফটেন্যান্ট গাজী, লেফটেন্যান্ট আলম ছিলেন। তাদেরকে দিয়েই নৌ অপারেশনগুলো প্ল্যান করা হতো।
বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে সেখানে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। আমাদের পুরো ব্যাটেলিয়ান ঘিরে ফেলে ওদের। পাকিস্তান আর্মি ছাড়া ওরা সারেন্ডার করবে না। পরে তারা অস্ত্র ফেলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। দোয়ারিকা থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওয়াবদায়। পাকিস্তান আর্মি মাথা নিচু করে ওয়াবদার দিকে মার্চ করছে। আর অস্ত্র উচিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে ছেড়া শার্ট আর ছেড়া লুঙ্গি পড়া মুক্তিযোদ্ধারা। এই দৃশ্যটা কখনও ভুলতে পারব না। পরে তাদের ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করি।
আমাদের সঙ্গে থাকতেন ফটোগ্রাফার খোকন দাস ও মিন্টু দাস। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যুদ্ধকালীন নানা ছবি তুলতেন। মিন্টু দাস এখন বেঁচে নেই। খোকন দাস চলে গেছেন ভারতে। কিন্তু তাদের তোলা ওই ছবিগুলোই এখন মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল। অথচ ইতিহাসে ওই ফটোগ্রাফারদের কথা তুলে ধরা হয়নি।’
নয় মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরেন এই সূর্যসন্তান। তার ভাষায়– ‘স্লোগান দিয়েই তো আমরা দেশ জয় করেছি। পাকিস্তানিরা আসছে অন্যের দেশে। জোর কইরা একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মাতবরি করতে আসছে। আর আমাদের দেশেই আমরা। নদীনালা, খালবিল, পাহাড় সব চেনা। এখানে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনেছেন ৯০ হাজার ওয়েল ইকুয়েপড সেনা সারেন্ডার করেছে। একমাত্র যদি তারা কাপুরুষ না হয়। এমন নয় যে তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবুও সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল কাপুরুষ পাকিস্তান সেনারাই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই হয়েছে এটা। যারা ছিল আইডোলজিক্যাল যোদ্ধা। এই দেশ আমার মায়ের দেশ। মাকে মুক্ত করাই তখন ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। প্রতিটি মুুক্তিযোদ্ধার বুকে তখন একটাই আগুন ছিল– মাতৃভূমিকে মুক্ত করা।
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘অবশ্যই পেয়েছি। পাকিস্তান আমলে ভাঙাচোরা একটা কর্নেল ছিল আমাদের। তাই নিয়েই গর্ব করতাম। এখন বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামে একজন সেক্রেটারি আছে। আমার নিজের একটা পতাকা আছে। আছে একটা মানচিত্র, একটা ভাষা। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!’
১৯৭৪ সালে মাহফুজ আলম বেগ পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ওয়াবদায়। ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। আগে থেকেই খন্দকার মোশতাকের ক্ষোভ ছিল বেগের প্রতি। তিনি বলেছিলেন– ‘জীবিত বা মৃত বেগকে চাই।’ এরপরই তাকে খুঁজতে ক্যাপ্টেন মাজেদ তার আত্মীয় স্বজনের বাসায় রেইড দিতে থাকে। এক পর্যায়ে কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় বেগ প্রথম নেত্রকোণার কাজলা এবং পরে চাপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যান। দেরাদুনে তারা ‘মুজিবস আইডোলজিক্যাল ফোর্স’ নামে একটি ফোর্সও গঠন করেন। সঙ্গে ছিলেন শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহসহ অনেকেই।
কী ছিল এই ফোর্সের উদ্দেশ্য?
মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ বলেন– ‘দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগঠিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিছু করাই ছিল উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারেরও সহযোগিতা পাই। কিন্তু দেশে ফিরেই অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হতেই হতাশ হই। বড় বড় নেতারাই ধমকের সুরে সেসময় বলেছিল– ‘তুমি আবার আসলে পুলিশে ধরায়া দিমু।’ মোশতাকে কেবিনেটে কারা ছিল বলেন। এরপরই আমি সেমি কট হই। ডিজিএফআই থেকে বলা হলো সারেন্ডার করতে। সারেন্ডার করি। বহু কষ্টে চার বছর পর চাকরি ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু চার বছরের বেনিফিট পাইনি। ওই সময়টা কেটেছে নানা অবহেলা আর আতঙ্কে।’
ওয়াবদার পরিচালক হিসেবে সততার সঙ্গেই চাকুরি জীবন শেষ করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজের কোন বাড়ি নেই তার। সাব সেক্টর কমান্ডার হয়েও পাননি কোন সরকারি প্লট। থাকছেন ছোটবোনের বাসাতে। রাষ্ট্রীয় কোন অনুষ্ঠানের দাওয়াতও এখন পৌঁছায় না তার বাড়িতে। এ নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। বরং এখনও দেশ নিয়েই স্বপ্ন দেখেন এই যোদ্ধা।
কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
প্রশ্ন শুনে খানিক নিরব থাকেন। অতঃপর চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে বলেন– ‘সোনার বাংলাদেশ। যেখানে কোন বিভেদ থাকবে না। ধর্মে ধর্মে ভেদ থাকবে না। প্রত্যেক মানুষ মিনিমাম একটা খাওয়া পরার সুযোগ পাবে। সম্পদের সৎ ব্যবহার থাকবে।’
মেজর জলিলের সঙ্গে একাত্তরে যুদ্ধ করলেও তার সম্পর্কে এই যোদ্ধার মূল্যায়নটি শুনি ঘটে যাওয়া বাস্তব একটি উদাহরণের মাধ্যমেই। বেগের ভাষায়– ‘অ্যাজ এ ম্যান হি ইজ ভেরি গুড। অ্যাজ এ ফাইটার হি ইজ অলসো ভেরি গুড। অসাধারণ সব যুদ্ধের প্ল্যান করতেন উনি। কিন্তু কোন একটা বিষয়ে উনি নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন না। যেদিন জাসদে জয়েন করলেন। সেদিন সন্ধ্যায় মেজর জলিলকে নিয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায়। বঙ্গবন্ধু দেখেই তার সহধর্মিণীকে ডেকে বললেন– ‘দেখ, বেগ জলিলকে নিয়ে আসছে। মিষ্টি মুখ করাও ওদের।’ উনি কালোজাম নিয়ে আসলেন। জলিলকে বঙ্গবন্ধু বললেন– ‘তোর ওপর অবিচার হয়েছে জানি। সব তথ্য আমার কাছে আছে। আমি খুব শীঘ্রই তোকে একটা যোগ্য জায়গায় বসাব। কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। উনি বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়ে আসলেন।
সেখান থেকে বের হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন শাহবাগে, এক হোটেলে। একটা রুমে ঢুকতেই দেখি ভাসানী সাহেব শুয়ে আছেন। তিনি ভাসানীর পা ছুয়ে সালাম করে কথা দিলেন ভাসানী ন্যাপে জয়েন করবেন। আমি তাকে বললাম– ‘আপনি তো বঙ্গবন্ধুকেও বলে আসলেন। আর এখানে এসে বললেন আরেক কথা।’ উনি উত্তর দিলেন না। উনাকে পল্টন নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরলাম। সকালে উঠে শুনি জাসদ নামে নতুন পার্টি ফরম করেছে। যার প্রেসিডেন্ট মেজর এম এ জলিল। উনি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু, সন্ধ্যা রাতে ভাসানী ন্যাপ আর মধ্যরাতে হয়ে গেলেন জাসদ। এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। এছাড়া ইতিহাসে নাইন সেক্টরের যোদ্ধারা তেমন মূল্যায়িত হয়নি। এর জন্য সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর জলিলের দায়ও কম নয়।’
বর্তমান সরকারের শাসনামল প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ অকপটে বলেন– ‘বঙ্গবন্ধু সিংহ হৃদয়ের দয়াপ্রবণ মানুষ ছিলেন। আমি বলব তার মেয়ে বেটার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। ফাইন্যানশিয়ালি দেশ উপরের দিকেই যাচ্ছে। বাধা বিপত্তি আসবে। তবু শেখ হাসিনা এগিয়ে যাবেন বলে আমার বিশ্বাস। তবে সব বিষয়ে কেন প্রাইমিনিস্টারকে নির্দেশ দিতে হয়। তাহলে মন্ত্রীরা কি করেন? একজন মানুষের পক্ষে পুরা দেশ কন্ট্রোল করতে পারা ভেরি ডিফিক্যাল্ট। কোর্ট এখন অনেক বিষয়েই সরাসরি নির্দেশ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। এসব দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।’
বর্তমান প্রজন্ম ভাল না হলে পরবর্তী প্রজন্মও ভাল হবে না– এমনটাই মনে করেন সাব-সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ। তার ভাষায়– ‘ঘুষখোরের পোলা ঘুষখোরই হবে। বিল গেটস তার নিজের ছেলে মেয়ের হাতে মোবাইল দেয় না। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা ড্রাগ আর মোবাইল নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। সবকিছুতে কন্ট্রোল থাকা উচিত, লিমিটেশনও থাকতে হবে। এখনই অভিভাবকরা সচেতন না হলে প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।’
পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন– ‘তোমরা সৎ নাগরিক হইও। মাদক থেকে নিজেকে মুক্ত রেখো। বাবা-মাকে ঘুষ না খেতে উদ্বুদ্ধ করো। ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে নিজেকে দূরে রেখো। তবেই তোমাদের হাত ধরে দেশটা সোনার বাংলাদেশ হবে।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : সাব সেক্টর কমাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ।
ছিলেন: প্রথমে নয় নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডার। পরে তাকে শমশেরনগর সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যুদ্ধ করেছেন : নয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করেন। এছাড়া বরিশালের দোয়ারিকায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এই যোদ্ধা।মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবিগুলো তুলেছেন: খোকন দাস ও মিন্টু দাস।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯
© 2019, https:.