বেপরোয়া চালকদের লাগাম টানবে কে?
গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচ দফা অনুশাসন দিয়েছিলেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে ৩০টি নির্দেশনা দিয়েছিল। এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি খুব একটা। এ ছাড়া ২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ বিষয়ে ৮৬ দফা সুপারিশ এবং ২০১৭ সালে বিআরটিএর তৎকালীন পরিচালকের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি ছয়টি সুপারিশ ও ২২টি পর্যবেক্ষণ সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল। সেই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নের খবর আমরা পাইনি।
সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার খবর দিয়েই শুরু করছি। দেড় বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে ফারহা নাজের। পুরো দিন সে কাটায় তার দাদির কাছেই। বিকেল হলে মায়ের অপেক্ষাতে থাকে। মা অফিস থেকে বাসায় ফেরলে ছুটে যায় তার কাছে। প্রতিদিন এভাবেই মা-মেয়ের আনন্দের মুহূর্তটা প্রত্যক্ষ করতেন দাদি। সেই মিলনক্ষণটি এখন আর হবে না। মা-মেয়ের দেখা হবে না আর কখনো, কোনো দিন। ফারহা নাজও ফিরে আসবেন না মেয়ের কাছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর সকালে মহাখালীর আমতলীতে ফ্লাইওভারের নিচে বিমানবন্দরমুখী সড়কে ফুটপাতের কাছে দাঁড়ানো ছিলেন ফারহা নাজ এবং তার স্বামী নাজমুল। ক্যান্টনমেন্ট বাস সার্ভিসের একটি গাড়ি আমতলী ক্রসিংয়ে ইউটার্ন নিয়ে তাদের ধাক্কা দেয়। ফলে তার স্বামী আহত হলেও ঘটনাস্থলেই মারা যান ফারহা নাজ। ঘটনার পরপরই গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপার পালিয়ে যায়।
এই দুর্ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাজধানীর তুরাগ এলাকায় বেপরোয়া আরেকটি বাসের ধাক্কায় নিহত হন কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক পারভেজ রব। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে উত্তরায় উত্তরপাড়ায় থাকতেন পারভেজ। জীবিকার তাগিদে রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় এক ছাত্রীকে গান শেখাতেন তিনি। ওই ছাত্রীর বাসায় যেতে বেরিয়েছিলেন ওই দিন। বেলা তখন ১১টার মতো। ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেলের সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সদরঘাটগামী ‘ভিক্টর ক্ল্যাসিক’ পরিবহনের একটি বাসকে থামার সংকেত দেন। কিন্তু ওই বাসটি না থেমে বেপরোয়াভাবে তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি বাসের পেছনে নিয়ে চাপা দেয়। হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই পরিবারটি। শনিবার ঘটে আরেক ঘটনা। ‘ভিক্টর ক্ল্যাসিক’ পরিবহনের আরেকটি বাস চাপা দেয় পারভেজের ছেলে ইয়াসির আলভি ও তার বন্ধু মেহেদী হাসানকে। মেহেদী ঘটনাস্থলেই মারা যান আর আলভির কোমরের নিচের পেলভিস বোন ভেঙে যায়। বেঁচে গেলেও তিনি আর কখনো নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবের না। আলভি ও মেহেদীর পরিবার ক্ষতিপূরণ চায় না। চায় বিচার। পারভেজের স্ত্রী ও আলভির মা রুমানা গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি যা হারিয়েছি, তা তো কোটি টাকা দিলেও ফিরে আসবে না। তাই আমি কোনো ক্ষতিপূরণ চাই না। কারণ, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা মার্ডার। আমি শুধু এর বিচার চাই।’
রুমানার মতো বিচার চেয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক কৃষ্ণা রায়ও। রাজধানীর বাংলামোটরের অফিস শেষ করে সন্তানদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে টাকা তোলার জন্য বাংলামোটরে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শাখায় যাচ্ছিলেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে ফুটপাতে উঠে আসে। তিনি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও তার পায়ের ওপর বাসের চাকা উঠে যায়। ওই সময় অনেক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তার হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলেন। পরে আরও সংক্রমণ হওয়ায় তার হাঁটুর ওপরের কিছু অংশও কেটে ফেলা হয়। পায়ের ব্যথার কষ্টে কৃষ্ণা রায় এখন কাতরাচ্ছেন পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায়। তার জীবনের সব স্বপ্নই নষ্ট হয়ে গেছে।
এর আগেও বাংলামোটরের অদূরেই কারওয়ান বাজার ক্রসিংয়ে দুই বাসের পাল্লায় চাপা পড়ে হাত বিচ্ছিন্ন হয় সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেনের। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার কয়েক দিন পরই মহাখালী এলাকায় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পা হারিয়েছিলেন গৃহকর্মী রোজিনা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। প্রায় একই সময়ে বাসের চাকায় পা বিচ্ছিন্ন হয় প্রাইভেটকারের চালক রাসেলের। এখন তিনি পঙ্গু হয়েই জীবনযাপন করছেন। এসব ঘটনায় আদালত জরিমানা এবং সতর্ক করলেও ঢাকায় বাসচালকদের বেপরোয়া মনোভাব থামছেই না। কৃষ্ণাকে চাপা দেওয়া বাসটি চালাচ্ছিল একজন অনিয়মিত চালক। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ওই দিনই সে প্রথম চালকের আসনে বসেছে। দুর্ঘটনার পর ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের মালিক সমিতি কৃষ্ণার পা হারানোর ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টিকে মিটমাট করারও প্রস্তাব রেখেছিল। কৃষ্ণা ও তার পরিবারের স্পষ্ট দাবিÑ ‘ক্ষতিপূরণ নয়। বিচার চাই।’ অদৃশ্য কারণে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি বাসের মালিক ও চালকের সহকারী। তাহলে এদের বিচার নিশ্চিত করবে কে?
রাজধানীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জীবনের ঝুঁকি। আপনি, আমি ঘর থেকে বেরোলে সুস্থ শরীরে ফিরতে পারবÑ সেই নিশ্চয়তা কতটুকু? এই নগরে জীবন কাটাতে হচ্ছে জীবন হারানোর শঙ্কা নিয়ে। নগরে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কমছে না। ফলে সড়কে চলাচলে ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও। গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর আসে প্রতিনিয়তই। কোনোটি আলোচিত হয়। কোনোটি থাকে অনালোচিত। নতুন নতুন দুর্ঘটনার খবরে একসময় চাপা পড়ে যায় আলোচিত দুর্ঘটনার খবরগুলোও। কিন্তু যে পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় হারায় তার প্রিয়জনকে, দুর্ঘটনায় যারা হারিয়েছেন নিজের হাত, পা বা অন্য কোনো অঙ্গ। তারা কি ভুলে যেতে পারবে সেই ভয়ার্ত ক্ষণটিকে। বরং বুকে জমে থাকা চাপা কষ্টগুলো সারা জীবন গুমরে কাঁধে ওই মানুষগুলোর মনে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, বছরে গড়ে প্রায় আট হাজার মানুষ সড়কে প্রাণ হারায়। এ নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণহানি প্রায় ২৫ হাজার। আর পুলিশের তথ্য বলছে, গত বছর সড়কে প্রাণ গেছে ২ হাজার ৩৫ জনের। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রাণহানি ৮২৭। আর যারা আহত বা যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে আসেনি। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই দশককে নিরাপদ সড়ক দশক ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলোকে এ সময়ের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমরা কি সেই অঙ্গীকারের পথে আছি। রাজধানীতে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বাসের কারণে ঘটছে বলে তথ্য উঠে এসেছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায়। ঢাকায় সাম্প্রতিক আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সব কটিতেই বাসের বেপরোয়া চালনাকে দায়ী করেছে এআরআই। তারা বলছেÑ ‘ঢাকা শহরে বাসের সিস্টেমটা বিশৃঙ্খল। বাসের চালকরা অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া চলাচল করে বেশি। অধিক যাত্রীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস চালায়। তাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণও বেশি হয়।’
ঢাকা শহরে বেশির ভাগ চালকই পাকা লাইসেন্সধারী নয়, অনভিজ্ঞ। তারা লেগুনা, পিকআপসহ হালকা যানবাহনের চালক। ভারী লাইসেন্সধারী চালকরা ঢাকায় গাড়ি চালাতে আসে না। ফলে দক্ষ চালকের অভাবে মালিকরা তাদের (অদক্ষ) হাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন। ফলে দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও। তাই এই দায় মালিকপক্ষও এড়াতে পারেন না। সরকার ও মালিকপক্ষ চাইলেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ চালক তৈরি করতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগের খবর আমরা এখনো পাইনি। এ ছাড়া রয়েছে যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা। ঢাকায় নানা কোম্পানির নামে চলাচলকারী বাসগুলো বিভিন্ন মালিকের। মালিকরা চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে চলে। এ কারণে চালকরা বেশি আয়ের আশায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ফলে দুর্ঘটনাও বেশি হচ্ছে। এই বাসগুলোর মালিক আসলে কারা? সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। ফলে দুর্ঘটনা হলেও তারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে পারে নানাভাবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনার কাক্সিক্ষত বিচারও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন নগরের অনেকেই।
গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচ দফা অনুশাসন দিয়েছিলেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে ৩০টি নির্দেশনা দিয়েছিল। এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি খুব একটা। এ ছাড়া ২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ বিষয়ে ৮৬ দফা সুপারিশ এবং ২০১৭ সালে বিআরটিএর তৎকালীন পরিচালকের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি ছয়টি সুপারিশ ও ২২টি পর্যবেক্ষণ সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল। সেই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নের খবর আমরা পাইনি। এবার কমিটি নয়, সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এটা আশার কথা। কিন্তু তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা এখনো আমরা জানতে পারিনি। রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর সড়কে অপমৃত্যু রোধ করতে উদ্যোগী হতে হবে সরকারকেই। এ নগরে সড়কে বাসচালকদের বেপরোয়া মনোভাব রোধ করতে না পারলে সরকারের ভালো অর্জনগুলোও স্নান হয়ে যাবে। আমরা সড়কের বুকে রক্ত দেখতে চাই না। চাই, সব সড়ক সবার জন্যই হোক নিরাপদ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯
© 2019, https:.