গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে স্কুল থেকে বাড়িতে আসতেন ডালিয়ারা। ছুটি শেষে ফিরে যেতে হবে। চোখ তখন টলমল করছে। এখনই জল গড়িয়ে পড়বে। ঠিক তখনই মা বলতেন, ‘নো ক্রাইনিং। ডাবল মার্চ করে যাও।’ মায়ের কথায় কান্না থেমে যেত। কখনো জড়িয়ে ধরে বিদায় দিতেন না। মা ভালোবাসতেন তার মতো করে। এভাবেই মা আশরাফুন্নেসা ডালিয়াদের শক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
ডালিয়াদের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলার কাজলা গ্রামে। ছুটিতে বাড়িতে আসতেন কর্নেল তাহেরসহ সব ভাই। তখন পাল্টে যেত বাড়ির পরিবেশ। বালির বস্তা ঝুলিয়ে ট্রেনিং করানো হতো সবাইকে। বস্তার সামনে নিয়ে ছোট বোন ডালিয়াকেও কর্নেল তাহের বলতেন, ‘আপনিও কিন্তু ঘুষি দিবেন। শক্ত করতে হবে তো হাতগুলোকে।’
বাড়িতে ইন্দারা (কুয়া) ছিল। দড়ি বেঁধে সেখানে নামানো হতো বেলাল ও ডালিয়াকে। সবচেয়ে সাহসী ছিলেন বাহার। ইন্দারায় ঝাঁপ দিয়ে একা একাই উঠে আসতেন। শীতের রাতে উঠানপোড়া পিঠা বানানো হতো। আগুনের চারদিকে বসতেন ভাইবোনরা। কলাপতায় মোড়ানো পিঠা, আগুনে পুড়ছে। হঠাৎ কর্নেল তাহেরের প্রস্তাব-‘আগুনের ওপর দিয়ে যে লাফ দিয়ে আসতে পারবে, সেই আগে পিঠা পাবে।’ আনন্দ নিয়েই সে চেষ্টাটা চালাতেন সবাই। যুদ্ধের আগে এভাবেই ডালিয়াদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে রেখেছিলেন ভাই কর্নেল তাহের।
২৫ মার্চ ১৯৭১। সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা। ময়মনসিংহ থেকে অনেক পরিবার পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ডালিয়াদের বাড়িতে। শত শত মানুষ বাড়িতে। তাদের খাওয়াতে রান্নাবান্না চলছে। মা ডালিয়াদের নানা কাজে ব্যস্ত রাখতেন। যুদ্ধের ভয়বহতা তেমন বুঝতে দিতেন না। হঠাৎ এক সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা শোনেন তাদের ভাই আনোয়ার নেই। মায়ের হাতে একটা চিরকুটে লেখা, ‘আম্মা, যুদ্ধে যাচ্ছি, দোয়া করবেন।’ কিছুদিন পর বেলাল আর বাহারও চলে যান। ছেলেরা যুদ্ধে গেলেও মায়ের চেহারায় কোনো উৎকন্ঠা খুঁজে পেতেন না ডালিয়ারা। বরং তার চোখেমুখে ফুটে উঠত গর্বের চিহ্ন। বাড়িতে রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শুনতেন। দেশের খবর শুনতে গোটা গ্রামের মানুষ ভিড় জমাত। এভাবে দেশের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে ডালিয়াদের পরিবারের আবহও।
গেরিলা আক্রমণের ভয়ে কাজলা গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা প্রথম আসেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়াতÑ ‘মিলিটারি আইছে, মিলিটারি আইছে’। সবাই তখন দৌড়ে পালাত। ওই সময়ও ডালিয়া তার মায়ের চোখে ভয় খুঁজে পাননি। মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন, ‘তুলা রাখ সবাই। যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়।’ মুড়ি, চিঁড়া আর গুড় একত্রে শত শত প্যাকেট করে আগেই রেখেছিলেন মা আশরাফুন্নেসা।
কর্নেল তাহেরকে খুঁজতে একবার বাড়িতে আসে পাকিস্তানি আর্মিরা। ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল বাবরি দোলানো কবি নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। ওরা ভাবল নজরুল হিন্দু লোক। কারণ তার চুলগুলো লম্বা ও কোঁকড়ানো। ছবিটা নামিয়ে পায়ের নিচে ফেলে ধুমড়েমুচড়ে ফেলল। আর মুসলমান দরবেশ ভেবে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেয়ালেই টাঙানো থাকল।
মেজর তাহের কোথায়? প্রশ্ন শুনে মা ভয় পেলেন না। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন, ‘তোমরাই বলো, আমার ছেলে কোথায়? ওকে তো তোমাদের আর্মিতেই পাঠিয়েছিলাম। তাকে কি মেরে ফেলেছ? কোথায় সে? তার কোনো খবর পাচ্ছি না কেন? শুনে সেনারাও ভড়কে যায়। গ্রামের অনেক যুবতীকে তুলে নিতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান তিনি। চেঁচিয়ে বলেন, ‘কারো গায়ে যদি একটা দাগ তোমরা দাও, তোমাদের ছাড়ব না। আমি কিন্তু ওপরে বলব।’ মা আশরাফুন্নেসার কারণেই ওই দিন কাজলা গ্রামটি পাকিস্তানি সেনাদের তা-ব থেকে রক্ষা পেয়েছিল। মায়ের এমন প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকাই ডালিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
একাত্তরে ডালিয়া ছিলেন ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। পড়তেন ভারতীশ^রী হোমসে। ওই বয়সেই ভারতের মাহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেন। যুদ্ধের সময় এগার নম্বর সেক্টরের সীমান্তবর্তী এলাকায় রেকি করা, গ্রামের মেয়ে সেজে এক ক্যাম্প বা বান্কার থেকে নির্দেশনা নিয়ে আরেক ক্যাম্প বা বান্কারে পৌঁছে দিতেন। এ ছাড়া রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যাগজিনে গুলি ভরে দেওয়ার কাজও করেছেন এই বীরনারী। তার ভাই কর্নেল তাহের ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। এ ছাড়া ভাইদের মধ্যে আবু ইউসুফ খান (বীরবিক্রম), আবু সাঈদ (দাদাভাই নামে পরিচিত), ড. এম আনোয়ার হোসেন, শাখাওয়াত হোসেন বাহার (বীরপ্রতীক), ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক) বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের মাসিক পত্রিকা ইকরিমিকরিতে, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৯
© 2019, https:.