পাখিরক্ষা কমিটি হোক গ্রামে গ্রামে
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। সেখানে রয়েছে অনেক আমবাগান। বাগানের প্রায় ৫০টি গাছে বাসা বেঁধেছে দেশি প্রজাতির শামুকখোলা পাখি। এ সময়টা তাদের প্রজনন সময়। তাই প্রতিটি গাছে শামুকখোলা পাখিগুলো ডিম দিয়েছে। ডিম ফুটে বাচ্চা হলেই তারা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। কিন্তু এখনই যদি বাগানের মালিক পাখির বাসাগুলো ভেঙে দেয়! তাহলে পাখির ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভবিষ্যতে ওই বাগানের গাছে শামুকখোলা পাখিগুলো আর আসবে না, বাসাও তারা বাঁধবে না।
আশার কথা, দেশের নানা আলোচিত ঘটনা, সমস্যা আর গুরুগম্ভীর আলোচনার মধ্যেও হাইকোর্টের নজর এড়ায়নি খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের শামুকখোলা পাখিগুলোর এমন পরিস্থিতি। সম্পªতি একটি দৈনিকে পাখির বাসা ভাঙা-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন আদালতের নজরে এলে বিজ্ঞ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যতিক্রমী এই আদেশ দেয়। আদেশে বলা হয়– ‘আমবাগানের পাখির বাসা কখনোই ভাঙা যাবে না’। একই সঙ্গে খোর্দ্দ বাউসা গ্রামকে কেন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।’
খোর্দ্দ বাউসা গ্রামটির পাখি নিয়ে আলোচনার আগে চলুন দৃষ্টি ফেরাই অন্য জেলায়। আদালতের আদেশ ছাড়াই দিনাজপুরের ভাটিনা গ্রামের মানুষরা পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরি করেছেন অনেক বছর আগেই। সেই গ্রামে গিয়েছিলাম বার-কয়েক। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় পাখিগ্রাম দর্শনের সেই অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরছি।
দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার ভেতরে গ্রামটি। এর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে ধানক্ষেত। মেঠোপথে গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে বড় সাইনবোর্ড ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা, পাখি মারা নিষেধ’। গ্রামের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক বাঁশঝাড়। রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট পুকুরও। পুকুরগুলো আবার বাঁশ ও আম গাছে ঘেরা। যতই ভেতরে যাওয়া যায় ততই পাখির কিচিরমিচির শব্দ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে।
ভাটিনা গ্রামের বাঁশঝাড়ের ডালে ডালে দেখা মিলে শত শত পাখি– চড়ুই, পানকৌড়ি, সাদাবক, কুনিবক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, টিয়া, শালিক, বক আর মাছরাঙা। মনে হয় পাখিদের মহামিলন উৎসব যেন। বাঁশঝাড়ে দেখা পাওয়া যায় সহস্র পানকৌড়ির। পানিতে ডুব দিয়ে ঠোঁট দিয়ে তারা ধরে আনে ছোট্ট ছোট্ট মাছ। ভাটিনা গ্রামে পাখিদের এমন আনন্দ দৃশ্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
এ গ্রামের শত শত একর জমিতে আবাদ হয় টমেটোর। টমেটো বাগানগুলোতে পাখিদের বসার জন্য গেড়ে দেওয়া হয়েছে বাঁশের ছোট ছোট কঞ্চি। পোকার হাত থেকে রেহাই পেতেই এ ব্যবস্থা। কীটনাশক নয়, এখানে পাখির মাধ্যমে পোকার উপদ্রব কমানোর পদ্ধতিই এটি। বসার জায়গা থাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে খেয়ে যায় সব পোকা। ফলে টমেটোর আবাদে কীটনাশক লাগে না। এতে পরিবেশ বাঁচে, বাঁচে কৃষকের খরচও। এভাবেই ভাটিনা গ্রামে
প্রকৃতিই বাঁচিয়ে রাখে প্রকৃতিকে।
পাখিদের সঙ্গে গ্রামবাসীরও রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। ঝড়-বৃষ্টিতে ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়ে কুলা হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করে আনে ঝড়ে আহত পাখিগুলোকে। সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে বাসায় (বাঁশঝাড়ে) পৌঁছে দিয়ে আসে তাদের। যেসব পাখি মারা যায়, তাদের জন্য কষ্ট হয় গ্রামবাসীর। তাদের মাটির গর্তে কবর দেয় তারা।
কিন্তু ভাটিনার মানুষদের এমন পাখিপ্রেম কি আগে ছিল? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। গোটা গ্রামে তখনো ছিল পাখিদের আনাগোনা। ফাঁদ পেতে পাখি ধরা ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। বিত্তবানরা এয়ারগান চালাতেন দিনভর। দিনশেষে মোটরসাইকেলে মৃত পাখির ঝাঁক ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরত শিকারিরা।
গ্রামের কলেজপড়ুয়া যুবক একরামুল হক। থাকেন ভাটিনায়, খালার বাড়িতে। নিজেদের ভাগ্য গড়া আর গ্রামের মানুষদের জন্য কাজ করার স্বপ্ন তিনি ছড়িয়ে দেন যুবকদের মধ্যে। তৈরি করেন আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতি। নিজ অর্থায়নে নানা প্রকল্পও হাতে নেন তারা। সমিতির সভাপতি হিসেবে একবার একরামুলই প্রস্তাব করেন পুরো গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। সেই থেকে শুরু। পাখি না মারার প্রস্তাবে প্রথমেই সম্মতি দেন স্থানীয় প্রভাবশালী হাশেম তালুকদার মেম্বার। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছেড়ে নিজের এয়ারগানটি ছুড়ে ফেলে দেন তিনি। শপথ নেন পাখি হত্যা না করার। ফলে অন্যরাও উৎসাহিত হন। এ নিয়ে মসজিদে মসজিদে চলে প্রচারণা। গ্রামে ঢোকার তিনটি প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া হয় ‘পাখি মারা নিষেধ’ লিখিত বড় সাইনবোর্ড। গ্রামবাসীর ভালোবাসায় এভাবেই পুরো গ্রাম মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে।
ভাটিনার মতো রাজশাহীর বাঘার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের মানুষরাও আজ পাখিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আমবাগানের মালিকরা মনে করেন তারা সৌভাগ্যবান। কারণ, বাঘায় অনেক আমবাগান আর অসংখ্য গাছ রয়েছে। কিন্তু সবার গাছে বাসা বাঁধেনি শামুকখোলা পাখি। এ পাখিটি ধানক্ষেতের শামুক খেয়ে পরোক্ষভাবে আমাদের উপকার করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হয়।
স্থানীয়রা গণমাধ্যমে তুলে ধরছেন পাখি নিয়ে নানা অভিমত। তারা বলছেন– ‘এলাকায় পাঁচ বছর ধরে শামুকখোলা পাখি আসছে। কিন্তু এ বছরই ডিম ফোটার জন্য তারা বাগানে বাসা বেঁধেছে। রয়েছে কয়েক হাজার পাখির বাসা। সব বাসাতেই আছে বাচ্চা। আমরা পাখির বাসাগুলো ভেঙে না ফেলার জন্য বাগান ইজারার মালিকদের কাছ থেকে ১৫ দিনের সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। তাদের আপত্তি ছিল। কারণ গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন মহামান্য আদালত পাখির বাচ্চাগুলো রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তাই আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের এলাকায় পাখিগুলো এসেছে। আর তাদের আমরা রক্ষা করতে পেরেছি।’
শামুকখোলা পাখিগুলোকে রক্ষায় আমবাগানের মালিকপক্ষ, ইজারাদার ও আম ব্যবসায়ীদের বছরে মোট ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন তারা। তাই রাজশাহীর জেলা প্রশাসক পাখিগুলোকে রক্ষায় ওই টাকার বরাদ্দ চেয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে, যা পেলে দেওয়া হবে বাগানমালিক ও ইজারাদারদের। তাই সরকারের উচিত পাখি রক্ষায় দ্রুত এই বরাদ্দ প্রদানসহ ওই এলাকায় পাখির অভয়ারণ্য তৈরির উদ্যোগ হাতে নেওয়া। এ বিষয়ে স্থানীয়দেরও সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে শামুকখোলা পাখির আবাসগুলো।
পাখিরা আমাদের পরিবেশের বড় সম্পদ। বনের খাদ্যশৃঙ্খলে স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বীজের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পাখির। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, খাদ্যসংকট, জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে এমনিতেই অনেক পাখি বিলুপ্তির পথে। তারপরও শীত মৌসুমে সারা দেশেই নানা ধরনের দেশি ও অতিথি পাখির আনাগোনা শুরু হয়। তখন বেড়ে যায় এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার, বিষটোপ দিয়ে পাখি মারা, ফাঁদ পেতে আর ধানক্ষেতে কারেন্ট জাল দিয়ে পাখি ধরার প্রবণতা। পাখি রক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের চেয়েও কার্যকর হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি।
পাখি হত্যা, পাখি শিকার ও পাখির বাসা ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখতে গ্রামে গ্রামে সচেতনতা কার্যক্রম প্রয়োজন। স্থানীয়দের নিয়ে পাখিরক্ষা কমিটিও করা যেতে পারে। পাশাপাশি পাখি শিকার বন্ধে ও অতিথি পাখি নিধনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও প্রয়োগ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন থেকেও পাখি নিধন রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি এখনই শুরু করা বিশেষ প্রয়োজন। আমরা চাই খোর্দ্দ বাউসা গ্রামে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি হোক। আর ভাটিনার মতো সারা দেশের মানুষই উদ্বুদ্ধ হোক পাখিপ্রেমে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৩ নভেম্বর ২০১৯
© 2019, https:.