উই আর নট ফাইটিং ফর ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ
হঠাৎ আব্বা বদলী হন গোপালগঞ্জে। ফরিদপুর থেকে আমরাও আসি তার সঙ্গে। আমি তখন ছোট। তবে মনে আছে অনেক ঘটনা। আমাদের বাসাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অপজিটে। খুব দুষ্ট ছিলাম। নানাবিষয়ে আগ্রহও কম ছিল না। বাড়িতে পাট ঝুলিয়ে রাখা হতো। দেখতে অন্যরকম লাগত। পাটে কি আগুন ধরে? তা দেখতে কুপি নিয়ে একদিন পাটে আগুন দিই। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে পাটগুলো। কী করলি বলে ছুটে আসে সবাই। পানি দিয়ে ওই আগুন নিভায়। এই কাণ্ড দেখে আব্বা ক্ষেপে যান। আমি তখন ভয়ে অস্থির। আব্বা খুঁজছেন আমাকে। পেলেই পিটুনি খেতে হবে। এক দৌঁড়ে চলে যাই রাস্তার ওপারে, শেখ মুজিবুরের বাড়িতে।
তখন সন্ধ্যাবেলা। উঠানে চেয়ার পেতে লোকজন নিয়ে বসে আছেন শেখ মুজিব। তার চেয়ারের পেছনে গিয়েই লুকালাম। আব্বাও তেড়ে আসেন। শেখ সাহেব আমাকে উদ্ধার করেন। আব্বাকে বুঝিয়ে বলেন– ‘ছোট মানুষ, ওকে কিছু বলো না।’ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আব্বার কোলে তুলে দেন। শেখ মুজিবের ওই ছোঁয়া এখনও অনুভব করতে পারি।
এরপর আমরা চলে আসি ফরিদপুরে। ওখানে দুটি লাইব্রেরি ছিল– নাম কায়েদে আজম লাইব্রেরি (বর্তমানে- শেরেবাংলা লাইব্রেরি) ও কোহিনূর লাইব্রেরি। বই পড়ার নেশা ছিল। প্রতিদিন বাড়িতে একটি বই নেওয়া যেত। ভুয়া নাম দিয়ে আমি আনতাম দুটো। ওই বই চাচা-ফুপুরা মিলে পালাক্রমে পড়তাম। মাঝেমধ্যে মাশারির ভেতর হারিকেন নিয়ে সারারাতে বই শেষ করতাম। এখন তো লাইব্রেরিতেই মানুষ যায় না। ঘরে বইভর্তি বুক সেল্ফও কমে দেখা যায়। বইয়ের পাঠক তৈরি করতে না পারলে সত্যিকারের শিক্ষা হবে কেমনে?
১৯৬৯-এর আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্কুলে আসতো কলেজের ছাত্রনেতারা। ছাত্রনেতা ছিলেন শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, কবিরুল আলম মাও, নাসির ভাই প্রমুখ। এরা নানা বৈষম্যের কথা ব্রিফ করতেন। তাদের সঙ্গে আমারা মিছিল নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করতাম। স্কুলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদি স্যার ছিলেন। উনিও সবসময় পাকিস্তানিদের বৈষম্যের কথা তুলে ধরে আমাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন।
এরপর কলেজে গিয়েই ইউওটিসি ট্রেনিং নিই। এটা ছিল সামরিক ট্রেনিং। থ্রি নট থ্রি রাইফেল খোলা, লাগানো, ফায়ার করা আর অপারেশনে ক্রলিং করা শেখানো হয়। কলেজ মাঠে নিয়মিত চলত ট্রেনিং। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হাবিলদার মুনতা খান ছিলেন ট্রেনার। পাকিস্তানিদের দেওয়া ওই ট্রেনিংই কাজে লাগে একাত্তরে।
তখন ফরিদপুরে মুসলিম লীগের নামকরা নেতা ছিলেন সোবহান মোল্লা, রাজ্জাক দারোগা, শমসের মৌলভি (মুসা বিন শমসেরের বাবা), আবদুর রহমান বাকাউল উকিল, রাজ্জাক মোক্তার প্রমুখ। এরা আমাদের মানুষই মনে করতো না। সবাই ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। পরে পিস কমিটির সদস্য হন নুরু মিয়া (সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাবা)। যদিও তিনি কোনো হত্যা বা ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত ছিলেন না। ফরিদপুরে ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন ইমাম উদ্দিন আহমেদ, মোশারফ হোসেন, শামসুদ্দিন মোল্লা, এস এম নুরনবী, ফিরোজ মাস্টার প্রমুখ।
সত্তরের নির্বাচনে ওখানে এমএনএ হিসেবে দাঁড়ান ওবায়দুর রহমান আর এমপিএ ইমাম উদ্দিন আহমেদ। তাদের প্রচারণায় আমরা চুঙ্গা নিয়ে দলবেধে বেরিয়ে পড়তাম। সত্তরে আওয়ামী লীগের গণজাগরণ ঘটে। ফলে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল।
কিন্তু তবুও ক্ষমতা ছাড়ে না পাকিস্তানিরা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এরপর প্রিয় নেতা ভাষণ দেন রেসর্কোস ময়দানে। আমরা তা শুনি রেডিওতে। তখনই পরিস্কার বুঝে যাই– যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই। সাত মার্চের ভাষণই সবকিছু বদলে দেয়। ওই ভাষণ যখনই শুনি তখনই মনে হয় প্রথম শুনছি। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণই আমাদের মুক্তির পথ দেখায়।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাফিজুল হক।
সৈয়দ এ এইচ আতিকুল হক ও হেলেনা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। বাড়ি ফরিদপুর পৌর এলাকায়, নয় নম্বর ওয়ার্ডে। হাফিজুল হকের বাবা সরকারি চাকুরি করতেন, স্বাস্থ্য বিভাগের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। কাজ করেছেন গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়াতে। হাফিজুলের জন্ম হয় গোপালগঞ্জে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গোপালগঞ্জ বীণাপাণি স্কুলে। এরপর ফরিদপুর ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুল ও ফরিদপুর ইশান স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৭০ সালে মেট্রিক পাশের পর ভর্তি হন ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। ওই সময় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদকও হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাফিজুল ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
২৫ মার্চ ১৯৭১। সারা দেশে ক্রাকডাউন হয়। পাকিস্তানি আর্মিদের ঠেকাতে হবে। তাই হাফিজুলরা প্রথমে স্টেডিয়ামে এবং পরে রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে রাইফেল ট্রেনিং দেন। সঙ্গে ছিলেন মোকারম, হেলালি, বদরুল হাসান, ফয়েজ, মেজবা উদ্দিন নোফেল প্রমুখ। কয়েকটা থ্রি নট থ্রি রাইফেলও তখন জোগাড় হয়ে যায়। এরপরই তারা পজিশন নেয় গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। কিন্তু পাকিস্তানিদের সাজোয়া বাহিনী দেখে তারা ভড়কে যায় এবং পিঁছু হটে।
বিশ এপ্রিলের পরের ঘটনা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গ্রুপ যশোর থেকে কামারখালি ঘাট পার হয়ে শেলিং শুরু করে। আরেকটি গ্রুপ ঢোকে গোয়ালন্দ ঘাট দিয়ে। তাদের আক্রমণে ফরিদপুর শহর জ্বলতে থাকে। শহরে ঢুকেই তারা প্রথম সাধুদের হত্যা করে। অতঃপর বিহারী ও মুসলিম লীগের লোকদের নিয়ে গণহত্যা চালায়।
পাকিস্তানপন্থি কুখ্যাত খুনি ছিল মকবুল। ফরিদপুর স্টেডিয়ামের পাশে একটা গণকবর আছে। সেখানে বহু লোককে সে নিজ হাতে জবাই করে সে। এসব দেখে ঠিক থাকতে পারে না হাফিজুল। তার চাচা শামসুল হকের সঙ্গে চলে যান পূর্ব গঙ্গবর্দিতে, এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
এরপর কী ঘটল? সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে।
হাফিজুলের ভাষায়– ‘উই আর মোটিভেটেট বাই আওয়ার লিডারস। বঙ্গবন্ধুর ভাষণও অনুপ্রাণিত করেছে প্রবলভাবে। তাই যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ২৭ এপ্রিল খুব ভোরে চাচা শামসুল হক ও বন্ধু মতিনকে সঙ্গে নিয়ে কুমার নদীর একটি খাল পার হয়ে হেঁটে তিনদিনে পৌঁছি ভারতের বনগাঁওয়ে। সেখান থেকে যাই টাকি ক্যাম্পে। পাশেই ছিল পিফা ক্যাম্প, ক্যাপ্টেন সিপা দায়িত্বে। ওখানেই নাম লেখাই প্রথম। এরপর হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় বিহার চাকুলিয়ায়।
আমরা ছিলাম থার্ড ব্যাচে। ত্রিশ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখি এসএলআর, থ্রি নট থ্রি, এসএমসি, এলএমজি, পিস্তল, গ্রেনেড, টুইঞ্চ মর্টার, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, অ্যান্টিপারসনাল মাইন, জামপিং মাইন, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন প্রভৃতি। ‘দাউ কেলি রেডি’ নামক একটি ট্রেনিং হয়। খালি হাতে শত্রুকে পরাস্ত করার কৌশল শেখায় সেখানে। শেষের দিকে চলে নাইট প্যারেড। অন্ধকার রাতে পথ চলে কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে সেটাও শিখি। ট্রেনিং করান হবিলদার সুকুমার ও হযরত আলী নামের এক কাশ্মিরি।
ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠানো হয় কল্যাণীতে। এরপর বয়রা বর্ডারের দত্তবলিয়া থেকে অস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয় শিকারপুরে। ১৪ জনের গ্রুপে কমান্ডার ছিলেন মোকাররম ভাই, টোয়াইসি আবুল ফয়েজ। সহযোদ্ধা ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, শহিদুল ইসলাম, জুরমত আলী, মতিন, খানে মাহবুব খোদা, হায়দার আলী মোল্লা, খলিলুর রহমান, পরশ ও সুবোধ প্রমুখ। আমরা যুদ্ধ করি আট নম্বর সেক্টরের লোহাগড়া, রাজবাড়ি, চৌগাছি, ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা প্রভৃতি এলাকায়।’
মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি অপারেশনের কথা এই যোদ্ধা তুলে ধরেন ঠিক এভাবে– ‘আমরা কুষ্টিয়ার শিকারপুর হয়ে ঢুকি। সুবেদার মোসলে উদ্দিনের ক্যাম্পে থাকতাম। ইন্ডিয়ান বিওপি ওটা। ইপিআররাও ছিল। অগাস্টের শেষ দিকের ঘটনা। ভেড়ামারা হাই স্কুলে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। ওখানে অ্যাটাক করতে হবে।
আগেই রেইকি করা হয়। আমি, হায়দার, মতিন ও শহিদসহ মোট ত্রিশজন। কমান্ডে ইপিআররের তোফায়েল। হেঁটে রওনা হই। তালতলী খাল পার হয়ে এসে দেখি পাকিস্তানিদের ক্যাম্প নেই। ঘটনা কী? রেইকির পরপরই ওরা ক্যাম্প সরিয়ে ফেলেছে। ভোরে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরি। অবাক হলাম। আমাদের ক্যাম্পেও কেউ নেই। কয়েকজন ছিল। তাদেরও ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি আর্মিরা। এরপর মিরপুর থেকে ওরা শেলিং শুরু করে। ফলে শিকারপুর ক্যাম্পেই আমাদের ১৮-১৯ জন সহযোদ্ধা শহীদ হন। এরপরই ক্যাম্প সরিয়ে ফেলা হয়।
এরপর দত্তবলিয়ার বয়রা বর্ডার দিয়ে লোহাগড়া থানার ইটনায় আসি। রাতুল হাটে ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। অস্ত্র নিয়ে ওরা হাট পাহারা দিত আর লুটপাট করতো। বিকেলে দেখি হাটের দোকানগুলো থেকে টাকা তুলছে। আমরা ওদের ধরে ওরাকান্দি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিই। এরপর ফরিদপুরের নগরকান্দায় আসি।
কেন?
আমাদের সঙ্গে দুটো ছেলে ছিল। ওদের বাড়ি খলিলপুরে, রাজবাড়ি ও ফরিদপুরের মাঝামাঝি জায়গাটা। টার্গেট ছিল ওখানে ক্যাম্প করব। তাই করলাম। পরানপুর গ্রামে থাকি আর খাল পার হয়ে সুলতানপুরের হোসেন মোল্লার বাড়িতে ক্যাম্প করি। আর্মির এক হাবিলদারও যুক্ত হয় ওখানে। দলটা বড় হতে হতে ১৪ জন থেকে প্রায় ২০০ জনে গিয়ে পৌঁছে। তাই রাজাপুর, ধর্মশীসহ পাঁচ মাইলের ভেতর আরও কয়েকটি ক্যাম্প করা হয়।
রোজার আগে ফরিদপুর রাজবাড়ির রেল লাইন উড়াতাম। এরপর ইলেট্রিক পোলও উড়ানো শুরু করি। রাজাপুর ব্রিজে রাজাকারদের ক্যাম্পও দখলে নিই। অতঃপর প্ল্যান হয় ফরিদপুর টাউন অ্যাটাকের।
ফরিদপুর শহরের টেপাখোলায় বিহারীদের সহযোগিতায় পাক আর্মিরা থাকত। পাকিস্তানি প্যারা মিলিটারি ট্রুপ ছিল ওখানে। ঈদের দিন ওখানে কাওয়ালি হবে। এ খবর পাই আমরা। পরিকল্পনা হয়, আমি আর হায়দার গ্রেনেড থ্রো করবো কাওয়ালির আসরে। মিরোজ আর কাশেম বোমা মারবে ফরিদপুর সিনেমা হলে। আমার মাথায় টুপি, পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, পায়ে স্যান্ডেল। হায়দারসহ আসি সাইকেলে। পকেটে ২টা করে গ্রেনেড। আমার কাছে একটা পিস্তলও। ঈদ উপলক্ষে বাঙালি নামের এক বিহারীর বাড়িতে চলছে কাওয়ালি। সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা একটা গ্রেনেড মেরেই সরে পড়ি। বিকট শব্দে সেটা বিষ্ফোরিত হয়। তারপর দ্রুত সরে গিয়ে এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। ওই বাড়ির লোকেরা মেয়েদের থাকার রুমে আমাদের লুকিয়ে রাখে। তখন খুঁজতে আসে রাজাকাররা। আইয়ুব নামে এক রাজাকার আমাদের পিছুও নেয়। কিন্তু মধ্যরাতে লুকিয়ে আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি। স্বাধীন বাংলা বেতারে ওই অপারেশনটির কথা শোনানো হয়েছিল। একাত্তরে সাধারণ মানুষ গেরিলাদের পাশে ছিল। ঘরে ভাল খাবার নাই, আছে শুধু ভাত আর ডাল। নিজে না খেয়ে তাই আমাদের খাইয়েছে ওরা। আমাদের কাছে ওটাই অমৃতের মতো মনে হয়েছে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কথা। আট নম্বর হেডকোয়ার্টার তখন ব্যারাকপুরে। মেজর এম আবুল মঞ্জুর স্যার সেক্টর কমান্ডার। উনাকে গিয়ে বললাম টুইহ্চ মর্টার লাগবে। উনি নির্দেশ দিলেন তোমরা অ্যাডভান্স টিমের সাথে জয়েন করো, বানপুরে। আমরা তাই করি।
আনুমানিক ৪ ডিসেম্বর ঘটনা হবে। বানপুর বর্ডার থেকে মুভ করে চৌগাছির কাছাকাছি আমরা। সবার প্রথমে এফ এফ, পরে বাঙালি আর্মি ও ইপিআররা, এরপর ইন্ডিয়ান আর্মিরা আরবান ফ্রেইকেলে। সাজোয়া ওই যানটির নাম ছিল তুফান। ওটাতে কামাল লাগানো। প্রতিটিতে গাড়িতে ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ লাগনো। এভাবেই আমরা সামনে এগোচ্ছি। তুমুল সম্মুখ যুদ্ধ চলছে। এক রাতে মঞ্জুর স্যার ডাকলেন।
বললেন–‘ফরম টুমোরো নো ফাইটিং।’
কেন স্যার? তার অকপটে উত্তর–‘উই আর নট ফাইটিং ফর ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ।’ আমরাও বিষয়টিকে ভালভাবে নেইনি। তাই সবাই একমত হলাম। ফলে দুইদিন ফাইটে যাইনি।
কিন্তু সামনে থাকা অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এ খবর পায়নি। তারা অ্যাডভান্স করতে গেলে বহু হতাহত হয়। এরপরই ইন্ডিয়া সরকার স্বীকৃতি দেয়। তখন আমরা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আর জাতীয় সংগীত গেয়ে রণাঙ্গনে মার্চ করা শুরু করি। এ ইতিহাস তো কেউ লিখে নাই। এভাবে আমরা পৌঁছি যশোর ক্যান্টনমেন্টে।
অনেকেই মেজর মঞ্জুর সমালোচনা করেন। যারা বলেন তারা ভুল জানেন। একাত্তরে ওনার মতো দেশপ্রেমিক লোক আমরা দেখিনি। স্যালুট করি তাকে। রণাঙ্গনে নিজেদের পতাকা প্রতিষ্ঠার জন্য একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছি। ভারত সহযোগিতা করেছে। আমরা তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণও করি। কিন্তু এখনও ভারতীয় নানা চলচ্চিত্রে যখন মুক্তিযুদ্ধকে ভুলভাবে দেখানো হয় তখন খুব খারাপ লাগে ভাই। এসবের প্রতিবাদও হওয়া উচিত। একাত্তরের যুদ্ধটা আমাদের ছিল, ভারতের নয়।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কয়েক প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছে। তাই সরকারিভাবে তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো প্রয়োজন বলেন মনে করেন এই সূর্যসন্তান। তিনি বলেন– ‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া, জয় বাংলা বলা, স্বাধীনতার ইতিহাস চর্চা করা ছিল শাসকদের দৃষ্টিতে খারাপ কাজ। এটাই শিখেছে কয়েক প্রজন্ম। বিরাট জেনারেশন গ্যাপ হয়ে আছে। এটার জন্য সরকারকেই তৃণমূলে ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হবে। তা না হলে প্রজন্ম কিন্তু ভুল পথে যাবে।’
জাসদের রাজনীতি সম্পর্কে এই মুক্তিযোদ্ধার মত এমন– ‘সিরাজুল আলম খানরা রোমান্টিক বিপ্লবী ছিলেন। অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছেলেকে তারা নষ্ট করেছে। জাসদের কিছু লোক পিওর মুক্তিযোদ্ধা ছিল সত্য। তখন পরাজিত পাকিস্তানিদের তো সেল্টার দরকার। সুবিধার জন্য তারাও জাসদের পাশে থাকে। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে আনপপুলার করতে কাজ করেছে তারা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের হাওয়া তুলে জাসদ হাজারো তরুণকে মিসগাইড করেছে। এই ভুল তারা স্বীকার করে কিনা জানা নেই।’
স্বাধীন দেশে ভাল লাগার অনুভূতির কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যোদ্ধা বলেন– ‘দেশের উন্নতি আর সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সম্মান দেখলে, আনন্দে চোখে জল আসে। বুকটা ভরে যায়।’
খারাপ লাগে কখন?
‘পাশে বসে একজন অমুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতাবিরোধী যখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার কথা বলে, যখন তারাই বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে সরকারি সম্মাননা নেয়– তখন লজ্জা লাগে। কষ্টও পাই।’
রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের ধরার পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মোটিভেশনও দরকার বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুল হক। শুধু আইন দিয়েই নয়। মনের দিক থেকেও রাজনীতিবিদরা যেন সৎ থাকতে চান সেই পরিস্থিতিও তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে সারাদেশে লাখো বিলবোর্ড আর তোরণ তৈরি করে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি চালু আছে। এটা বন্ধ করা খুব প্রয়োজন। এই সব তোরণ বানানোর টাকা কোথা থেকে আসে? তৃণমূলে নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করেন আর মানুষ গালি দেয় সরকার আর শেখ হাসিনাকে। এসব কাজের দায় কেন বঙ্গবন্ধু কন্যা নিবেন। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোর বিষয়েও সুনির্দিষ্ঠ নির্দেশনা দেওয়াও প্রয়োজন বলে মত দেন এই যোদ্ধা।’
আপনার কি মনে হয়, দেশ দুর্নীতি মুক্ত হবে?
চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার উত্তর– ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা কঠিন ও কোমল হৃদয়ের নারী। আমরা নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করি। উনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করতে পেরেছেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছেন, এখন দেশটাকে দুর্নীতি মুক্ত করে গেলেই অমর হয়ে থাকবেন। আমাদের বিশ্বাস তিনি পারবেন। তার মূল লক্ষ্য হলো দেশের মঙ্গল করা। আমাদেরও উচিত তার পাশে থাকা।’
পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুল হকের। তাই তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– ‘সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালবাসতে হলে সৎ হতে হবে, কমিটেড থাকতে হবে, নিজের দেশের ইতিহাস জানতে হবে। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে। তোমরা সে পথেই দেশকে এগিয়ে নিও।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুল হক।
ট্রেনিং: রাইফেল চালানোর ইউওটিসি ট্রেনিং ছিল আগেই। পরবর্তীতে ত্রিশ দিনের ট্রেনিং করেন ভারতের বিহার চাকুলিয়া থেকে।
যুদ্ধ করেছেন: আট নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন লোহাগড়া, রাজবাড়ি, চৌগাছি, ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা প্রভৃতি এলাকায়।
ছবি: সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৫ নভেম্বর ২০১৯
সালেক খোকনের নতুন গ্রন্থ- ১৯৭১: রক্ত, মাটি ও বীরের গদ্য
© 2019, https:.