বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
নাটোরের গুরুদাসপুরের মধ্যমপাড়া মহল্লার তিন শিশুর ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। কৈশোরে পা ফেলেছে শিশু তিনটি। তারা পড়ছে সাহিদা-কাশেম পৌর বালিকা বিদ্যালয়ে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে। গ্রামের মেঠোপথে সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে নিয়মিত স্কুলে যায় তারা। কিন্তু সেই চলার পথ হঠাৎ যেন থমকে যায়। আঠারো বছর না হলেও তিন কিশোরীরই বিয়ে ঠিক করে ফেলে তাদের পরিবার।
বিয়ে ঠিক হওয়া এক ছাত্রী জানায়, তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। এক ভাই কলেজে পড়ে। বাকিরা বাবার সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করে। পারিবারিকভাবে দেখাশোনার পর্ব শেষে তার বিয়ে ঠিক করেছে পরিবার। আরেক ছাত্রী জানায়, তার বাবাও স্থানীয় একটি ইটভাটায় কাজ করে। অভাবের কারণেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক করেন তার অভিভাবকরা। প্রতিবেশী এক ভ্যানচালকের সঙ্গে বিয়ের কথা চলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক কিশোরীর। পরিবারের খরচ কমাতেই দ্রুত বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ। বিশেষ করে তার মা বিয়ের জন্য বেশি তৎপর। বিয়েতে যৌতুক কত দিতে হবে সেটি নির্ধারিত হলেই বিয়ের দিন ঠিক হবে। তথ্যগুলো জানিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে সাহায্যের আকুতি জানায় ওই তিন কিশোরী। পরে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পায় তারা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওপরের সংবাদটি দরিদ্র্য পরিবার কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে বাল্যবিয়ে দিতে উদ্যত হয়, সে সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিই। দরিদ্রের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ দেশে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও এমন বাল্যবিয়ে হচ্ছেই।
সবক্ষেত্রে দরিদ্র বাবা-মা ইচ্ছা করে মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেন, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হন। কী কারণে তারা এটি করেন? যত দিন পর্যন্ত এসবের সমাধান না হবে, তত দিন বাল্যবিয়ে চলতে থাকবে। তাই এসব বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে গবেষণা করা ও কৌশলগত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বাল্যবিয়ে কমছে নাকি বেড়েছে? জাতীয় জরিপ বলছে, তিন বছর ধরে বাল্যবিয়ের হার বেশ উঁচুতে আটকে আছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগেই দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে ২০০৭ আর ২০১১ সালেও বাল্যবিয়ের হার ৬৫ শতাংশ বা তার বেশি ছিল। আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১৯ বলছে বাল্যবিয়ের হার কমেছে। তাদের নমুনা জরিপ অনুযায়ী, ৫১ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিয়ে হচ্ছে। কিন্তু ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল ৫২ শতাংশ।
সরকার বলেছে, বাল্যবিয়ে নিরোধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এটি দূর করতে না পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। তাই এটি নিরোধের জন্য সরকার একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) হাতে নিয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করা এবং সার্বিক বাল্যবিয়ের হার এক- তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা। আর সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে দেশ থেকে নির্মূল করা।
এ বিষয়ে একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, ভুয়া জন্মসনদ আর কাজী অফিসের কারচুপির মাধ্যমে অভিভাবকরা অনায়াসে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। ধরা পড়লে কিছু সাজা হলেও বিয়ে হয়ে গেলে তা অবৈধ বা বাতিল হচ্ছে না। ‘উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ’ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে একটি বই বেরোয়। বইটিতে এই দুটি বিষয়কে বাল্যবিয়ে চলার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সরকার নতুন করে আইন করেছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক কর্মসূচিও আছে। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধও বাড়ছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৮ সালে দেশজুড়ে মোট ১ হাজার ৭৫৬টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের তথ্য পেয়েছে। প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি হয়েছে কুমিল্লায়, ঘটনার সংখ্যা ১৮২। ময়মনসিংহে এ সংখ্যা দেড় শতাধিক। প্রতিরোধে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা ১০ জেলার মধ্যে আরও আছে গাজীপুর, পাবনা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাল্যবিয়ে নিরোধের বিষয়টি নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে আরও কিছু ইস্যুও, যা আমরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে দেখি না। বাল্যবিয়ে কারা দেন? প্রধানত মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনসহ সমাজের কিছু মানুষও এতে উৎসাহিত করে থাকে। তাই মা-বাবার মানসিকতার পরিবর্তনের দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কোনো নারী যখন গর্ভবতী থাকেন, তখনই তাকে ও তার স্বামীকে বাল্যবিয়ের ক্ষতিসহ উন্নত জীবন সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। তা ছাড়া ছেলে বা মেয়েশিশু যা-ই হোক উভয়কেই মানুষ করার প্রচেষ্টার শিক্ষা পরিবারে লিঙ্গবৈষম্য কমাবে।
ঘরের কাজ মানে নারীর কাজ এটা আমাদের সমাজে ভীষণভাবে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামপর্যায়ে এমন অনেক পরিবার আছে যারা ছেলের বিয়ের কথা চিন্তা করে সংসারে বাড়তি আয় ও একজন কাজের মানুষের প্রয়োজনে। এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তনসহ ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার বিশেষ উদ্যোগ ও সচেতনতার প্রয়োজন।
এ ছাড়া প্রত্যেক মেয়ের জন্য জীবনযাপনের দক্ষতামূলক শিক্ষা জরুরি। যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী নিজেরা সচেতন হবে। তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারবে। এটা করতে পারলে তাদের বিয়ে দিতে চাইলে তারাই প্রতিবাদ করতে পারবে, বলতে পারবে, বিয়ে ছাড়াও অনেক কিছু করার আছে তাদের। তাই বিভিন্ন এলাকায় ‘কিশোরী ক্লাব’ গঠন ও সংগঠনগুলোকে সচল করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, আত্মীয়স্বজনসহ আশপাশের মানুষের চাপ বিভিন্ন কারণেই বাল্যবিয়ে হয়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে অভিভাবকরা অনেক সময় মেয়েদের বিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা মেয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পান না। ফলে বন্ধ হয় মেয়ের স্কুলে যাওয়া। একপর্যায়ে তারা বাধ্য হয় বাল্যবিয়ে দিতে। এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দায়িত্বও নিতে হবে রাষ্ট্রকে।
বাল্যবিয়ে নিরোধের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সরকারের নির্দেশনা রয়েছে সচেতনতা তৈরির জন্য জুমার খুতবার আগে এবং ওয়াজ মাহফিলে বাল্যবিয়ে বিষয়ে ধারণা ও ইসলামি ব্যাখ্যা তুলে ধরার। শীত মৌসুমে সারা দেশে শত শত ইসলামি জলসা ও ওয়াজের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেখানে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার বিষয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য তুলে ধরার খবর আমরা খুব একটা পাই না। এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রদান হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বাল্যবিয়ে সম্পর্কে সচেতনতার অংশ হিসেবে ছেলেমেয়েদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষকরা ওই অধ্যায় পড়ানোর চেয়ে এড়িয়ে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলে কিশোর-কিশোরীরা তাদের স্বাস্থ্যসচেতনতা লাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষকদের এ ক্ষেত্রে আন্তরিক ও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অঙ্গীকার করেছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা তারই অংশ। তাই মেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা ইস্যুতে দৃষ্টি দিতে হবে। বহু বছর থেকে এ দেশে বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক প্রথায় রূপ নিয়েছে। এটি বন্ধে সামাজিকভাবেই ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো উচিত। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও সরকারের এ কাজ বাস্তবায়নে তৃণমূলে সচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের ১০৯ নম্বরে ফোন করে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সাহায্য চাওয়া যায়। কিন্তু বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে দ্রুত চলে যাওয়া, তার পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য যে জনবলের প্রয়োজন, বাস্তবে সেটা নেই। তাই বাল্যবিয়ে রোধ ও বিচার করতে হলে সরকার, বেসরকারি সংগঠন ও পেশাজীবীদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সচেতনতাই নয়, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে চলুক প্রতিরোধ।
ছবি : সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৮ জানুয়ারি ২০২০
© 2020, https:.