অনেক দেরিতে হলেও রাজাকারদের তালিকা প্রকাশিত হবে- এমন সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে তোলে৷ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গভীর আত্মত্যাগ, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস৷ পাশাপাশি বিশাল এক অর্জনেরও ইতিহাস৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সে ইতিহাস কলঙ্কিত হয়৷ অতঃপর স্বাধীন দেশে রহিত হয় যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের বিচারের কার্যক্রম৷ বাতিল করা হয় দালাল আইন৷ যারা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী, তারাই স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার বৈধতা পায়৷ জিয়াউর রহমান ও তাঁর দলের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান হন চিহ্নিত ও বির্তকিত যুদ্ধাপরাধীরা৷ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন যারা, তাদের গাড়িতেই ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা৷
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘদিন৷ তারা তখন সারাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল, রেকর্ড ও তথ্য-উপাত্ত সরিয়ে ফেলার কাজে যুক্ত হয়৷ পাশাপাশি চলে ইতিহাস বিকৃতির নানা প্রচেষ্টাও৷ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেও চলেছে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত৷ নানা নাশকতামূলক কাজে যুক্ত থেকেছে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির৷
চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আগে ও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়াত ও বিএনপি আদর্শের বহু লোক৷ তাদের চিহ্নিত করতে আওয়ামী লীগের ভেতরেও চলছে শুদ্ধি অভিযান৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, এমন রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যাইবা কত? তারা কে? এখন কোথায়? এমন প্রশ্ন উঠেছে বহুবার৷ এ তালিকা থাকলে হয়তো বহু আগেই এদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো৷
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুসলিম লীগের আদর্শে বিশ্বাসী একটি চক্র, জামায়াতে ইসলামী ও নিজামে ইসলামী এই তিনটি দল পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে৷ এছাড়া ঐসময় সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের দেশদ্রোহী অবহিত করে ওই আসনগুলো অবৈধভাগে শূন্য ঘোষণা করা হয়৷ অতঃপর সদস্য করা হয় পাকিস্তানি আদর্শের লোকদের৷
স্বাধীনতা লাভের পরপরই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারসহ এদের তালিকা চূড়ান্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল৷ কিন্তু সেটি করতে না পারার ব্যর্থতায় বাঙালি জাতিকে এখনও মূল্য দিতে হচ্ছে নানাভাবে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও উচ্চারিত হয়েছিল রাজাকারদের তালিকার দাবিটি৷ দেরিতে হলেও সে দাবি কিছুটা আলোর মুখ দেখবে৷ এটাই আশার কথা৷
রাজাকার কারা?
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করতে একটি বাহিনী গঠন করা হয়৷ যার নাম দেওয়া হয় রাজাকার বাহিনী৷ যুদ্ধকালীন সময়েই আনসার বাহিনীকেও এ বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল৷ প্রথমে এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গঠিত শান্তি কমিটির হাতে৷ পরে তাদের আধাসামরিক বাহিনীর স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান সরকার৷ ফলে রাজাকারদের নামে ইস্যু করা হয় অস্ত্র৷ তাদের ভাতা ও পরিচয় পত্র দেওয়া হয় এসডিও অফিস থেকে৷ এছাড়া আলবদর ও আলশামস বাহিনীও ছিল পাকিস্তানি সরকারের আধা সামরিক বাহিনী৷
স্বাধীনতাবিরোধী এ বাহিনীগুলোর আলাদা নাম থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তারা রাজাকার বাহিনী হিসেবেই পরিচিত৷ আবার উল্লেখিত বাহিনীগুলো ছাড়াও একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিকেও সাধারণ অর্থে রাজাকার বলা হয়ে থাকে৷ তাই এখন রাজাকার শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত৷ রাজাকার বাহিনীর বেতনভোগীদের তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে যেন সাধারণ অর্থে রাজাকারদের নাম অন্তরালে চলে যাওয়ার সুযোগ না ঘটে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে৷
এছাড়া সরকার বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করবে, নাকি রাজাকারদের তালিকা প্রকাশিত হবে? এটিও স্পষ্ট করা প্রয়োজন৷ এ বিষয়ে কথা বলার সময় সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীলদেরও সর্তক থাকতে হবে৷ বিষয়টি নিয়ে সংবাদের শিরোনাম চয়নের ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের আরও সর্তক হওয়া প্রয়োজন৷ তা না হলে এ তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে৷
বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হলেও এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে কার্যকরী ও নিরপেক্ষ উদ্যোগের৷ কেননা ১৯৭১ সালে জেলা ছিল বিশটি৷ ৪৮ বছর আগের তালিকা ওইসব জেলার জেলা প্রশাসকদের নিকট অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে কীনা, সেটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ্য৷
আবার ১৯৭৩ সালের ১৭ মে দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ ১৯৭২ এর অধীনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ প্রভৃতি ১৮ ধরনের যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল৷ এ কারণে আটককৃত ৩৭ হাজার ব্যক্তির মধ্যে সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পেয়ে যায় প্রায় ২৬ হাজার৷ ফলে রাজাকার বাহিনীর তালিকায় সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন এমন রাজাকারদের নাম আছে কীনা? সেটিও যাচাই করার প্রয়োজন পড়বে৷
এছাড়া যেসব জেলায় রাজাকার বাহিনীর তথ্য নেই আটচল্লিশ বছর পর সেসব জায়গায় স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়৷ কেননা রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তালিকাটি প্রভাবিত হলে ভাল উদ্যোগটি বির্তকের কারণেই মুখ থুবড়ে পড়বে৷ এতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে সরকারকেই৷ তাই তালিকা তৈরির দায়িত্বটি পালন করতে হবে সততার সঙ্গে৷
আবার অনেক রাজাকারই ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন৷ তাদের নাম কি প্রকাশ করবে সরকার? এ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে৷ ব্যক্তিগতভাবে প্রায় দুইশো মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছে৷ একাত্তরের রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের দাবির কথা তাদের মুখেও শুনেছি বহুবার৷ মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, সমুদ্র ঘুমায় কিন্তু শক্র ঘুমায় না৷ এটি রাজাকারদের ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে প্রযোজ্য৷ এদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে তারা সব সময় সোচ্চার ছিল, এখনও আছে৷ তাই তাদের চিহ্নিত করে বিচারের (মৃত হলেও বিচার করার বিধান রয়েছে) মুখোমুখি করার প্রথম ধাপ হতে পারে রাজকার বাহিনীর তালিকা প্রকাশ৷ তবে এটা যেন ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে থাকে৷ সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত৷
ইতিহাস সংগ্রহে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়ে অবহেলা আর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি কাইয়ার গুদাম বদ্ধভূমিটিকে৷ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা ওই গুদামেই নিরীহ-নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম টর্চার চালাতো৷ অতপর তাদের গুলি করে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হতো কুশিয়ারা নদীতে৷ অনেক নারীকেও তুলে এনে শারীরিক নির্যাতন করেছে পাকিস্তানি সেনারা৷ একাজে তাদের সবরকম সহযোগিতা করেছিল শান্তিকমিটি ও রাজাকারের লোকেরা৷
একাত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জের শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের ছেলে এখন ক্ষমতাশীল দলের সংসদ সদস্য৷ যদি রাজাকারদের তালিকা প্রকাশিত হয়, তবে সেখানে কি থাকবে ওই শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের নাম? এমন সাহস দেখানোর জন্য কি প্রস্তুত রয়েছে সরকার? একাত্তরের গণহত্যায় যুক্ত থেকেছে এমন অনেক ব্যক্তির বিষয়েও যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে হবে সরকারকেই৷
অনেক আগে শুরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটি এখনও আমরা বির্তকমুক্ত করতে পারিনি৷ ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক দ্বন্দে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আরেক মুক্তিযোদ্ধাকে অবহিত করছে রাজাকার বলে৷ অথচ স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল রাজাকারদের তালিকা করা৷ তাই ৪৮ বছর পর হলেও রাজাকারদের বা বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা প্রকাশে সরকারের সাহসী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই৷ এ কাজে যারা যুক্ত থাকবেন তারা নির্মোহ ও দায়িত্বশীল থেকে ইতিহাসের দায়মুক্তির জন্য কাজ করবেন৷ তেমনটাই আমাদের প্রত্যাশা৷
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলে’তে, প্রকাশকাল: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯
© 2020, https:.