ভ্রমণ বা বেড়ানোর মৌসুম চলছে এখন। পরীক্ষার রেজাল্ট শেষে এ সময়ে ছেলেমেয়েদের স্কুল ও কলেজ থাকে বন্ধ। তাই খানিকটা সময় কাটাতে পরিবারসহ সবাই ছুটে নানা স্থানে। ঋতুবৈচিত্র্যে আমাদের দেশ অপরূপ। শীতে যে পাহাড় দেখলে শুষ্ক ও রুক্ষ মনে হয়; বর্ষার পর সেসব পাহাড়ই সবুজতায় স্নিগ্ধ ও সজীব হয়ে ওঠে। মানুষ ওপ্রকৃতির বৈচিত্র্যের যেমন শেষ নেই, তেমনি এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর জায়গারও অভাব নেই। একেক জায়গার প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার আমাদের মনকে একেকভাবে স্পর্শ করে। ভ্রমণের সে মনছোঁয়া অনুভূতিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে মানুষ যেমন ভ্রমণের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে নেয়, তেমনি ভ্রমণে আগ্রহীও করে তোলে অনেককে।
ভ্রমণের অভিযান শুধু পর্বতের চুড়া আর সমুদ্রের তরঙ্গ ফেনাই নয়; ভ্রমণ সেখানেও, যেখানে নিভৃতে একটি ছোট্ট মটরফুল তার আশ্চর্য নীল রং মেলে ফোটে, দূর জনপদের ছোট্ট বাজারের প্রান্তে ক্লান্ত বৃদ্ধা একডালি শামুক বেচতে বসে, ছোট্ট পুঁটি মাছটি মৃতচোখে তাকিয়ে থাকে খ্যাপলা জালের খোঁপে। ভ্রমণপ্রেমীদের এমন ভাবনাগুলো আমাদের যেমন আশাবাদী করে তোলে, তেমনি এ দেশে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকেও ইঙ্গিত করে। সরকারিভাবে পর্যটনশিল্পের নানা সমস্যার কথা বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবু ভ্রমণে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ভ্রমণকারী বা পর্যটকরা কতটা সচেতন আর পরিবেশবান্ধব থাকছেন? সেই প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায় সব সময়।
তাই প্রথমে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি ফেরাই। সেন্টমার্টিন আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এর চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিনুক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ প্রায় কয়েকশ প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। এখানকার প্রবাল ও শৈবালের জন্য প্রয়োজন বিশেষ পরিবেশের। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই হচ্ছে না পর্যটকদের অসচেতনতা ও অপরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে।
ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি পর্যটক প্রতিদিন পা ফেলছে এই দ্বীপে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটকদের এ চাপ থাকে প্রবল। হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণকালে শুকনো খাবার হিসেবে প্লাস্টিক মোড়কজাত চিপস বা বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য বহন করেন। সঙ্গে থাকে মিনারেল ওয়াটার, জুস, কোল্ডড্রিংসসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি। খাওয়ার পর যত্রতত্র তা ছুড়ে ফেলেন তারা। তাদের ফেলা সেই বর্জ্যেই দূষিত হচ্ছে দ্বীপের পরিবেশ, যা প্রতিনিয়ত সেন্টমার্টিন দ্বীপের অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলছে। কিন্তু এই দূষণের মাত্রা আসলে কতটুকু?
কয়েক মাস আগে ফেইসবুকে ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ গ্রুপের ৩৯ জন সদস্য ও ভ্রমণপ্রেমী তিন দিনে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ৯৪ বস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে। যার ওজন ছিল ৫৫৫ কেজি! আবার সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের মাধ্যম জাহাজ ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। কিন্তু জাহাজ ও ট্রলারগুলো তেল ও বর্জ্য পদার্থ ফেলছে সমুদ্রে। সামুদ্রিক বাস্তু বিদ্যার দূষণে চলক হিসেবে কাজ করছে এগুলো। এতে প্রবালের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে ক্রমেই। এ ছাড়া পর্যটকদের প্রবাল সংগ্রহের কারণেও দূষিত হচ্ছে সৈকতের পরিবেশ। পাথরের ওপর ঘোরাঘুরি ও গোসলের কারণে ধ্বংস হচ্ছে এর বাস্তুতন্ত্র। দুর্লভ অলিভ রিডলি কাছিমের প্রজননস্থল এখানেই। কিন্তু দ্বীপে অধিক রাত পর্যন্ত আলো জ্বালানোর কারণে কাছিমের ডিম পাড়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ফলে এখন অনেক কমসংখ্যক কাছিম ডিম পাড়ার জন্য সৈকতে আসছে। মাঝেমধ্যেই তাদের মৃতদেহ ভেসে আসছে তীরে। দ্বীপে পাওয়া মাছগুলোও এখন ক্ষতিকর ভারী ধাতব পদার্থের কারণে দূষিত হচ্ছে।
একসময় সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়িজাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এই প্রাণীর অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন চ্যালেঞ্জ আর অধিক দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য।
দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি পাহাড়ও। এ সময়ের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেক। সেন্টমার্টিনের মতো দিন দিন সেখানেও বাড়ছে পর্যটকদের উপস্থিতি। একই সঙ্গে বাড়ছে ময়লার স্তূপ। সাজেক যাওয়ার পথসহ পর্যটকরা যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ফেলেন। এতে প্রত্যেকটি কটেজ, পাহাড়ের দুদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। যার অধিকাংশই পচনযোগ্য নয়। ফলে ক্রমেই সৌন্দর্য হারাচ্ছে সাজেক। সম্পªতি বিডি ক্লিন নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা টানা ১০ দিন সাজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশ নিয়ে ৫০ হাজার পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির আলুটিলাসহ কয়েকটি স্পট থেকেও ২৫ হাজার পরিত্যক্ত বোতল সংগ্রহ করেছে তারা।
একই সমস্যার মুখে পড়েছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হালদা নদী। হালদায় ১২ কিলোমিটার ধরে ব্লক বসানো ও বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছেন হাজারো পর্যটক। নদীর রূপ দেখতে আসা এসব পর্যটক প্রতিদিন হালদায় ফেলছেন প্লাস্টিকের প্যাকেট, পলিথিন, প্লেট, গস্নাস, পানির বোতল, চিপসসহ নানা প্লাস্টিকের আবর্জনা। এভাবে পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিক ও পলিথিনে দূষিত হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, টেকনাফ, খুলনার সুন্দরবন, নেত্রকোনার বিরিশিরি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ পর্যটন স্থানগুলো।
উল্লিখিত স্থানগুলোতে পর্যটক হিসেবে যারা বেড়াতে বা ভ্রমণে যান, তারা অধিকাংশই সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণির মানুষ। সামর্থ্যের দিক থেকেও তারা এগিয়ে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে নিজের বাড়িটিকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখতেই তারা পছন্দ করেন। সে হিসেবে আশা করা যায় যে, তারা রুচিশীল। কিন্তু ভ্রমণে গিয়ে চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কেন তারা সেই রুচিশীল আচরণটি ধরে রাখতে পারেন না–আমাদের জানা নেই। দূষণকারী হিসেবে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন যারা ফেলেছেন, প্রত্যেক পর্যটকের ওপরই এর দায় বর্তায়। তাই এ বিষয়ে পরিবেশবান্ধব সচেতন পর্যটক হিসেবে নিজেকে পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে প্রত্যেককেই। পাশাপাশি সমুদ্র ও নদীর জীববৈচিত্র্য কী? সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের আচরণ কী হওয়া উচিত? সমুদ্রে ও নদীতে প্লাস্টিক, পলিথিন ফেললে সুদূরপ্রসারী কী কী ক্ষতি হতে পারে? পার্বত্য অঞ্চলকে কেন ও কীভাবে দূষণমুক্ত রাখতে হবে? সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগেরও প্রবল ঘাটতি রয়েছে। সরকার কঠোর হলেই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই। পাশাপাশি ভ্রমণে মানুষকে পরিবেশসচেতন করতে উদ্যোগী হতে পারে গণমাধ্যমও। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপগুলোও সচেতন ও পরিবেশবান্ধব পর্যটক তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, দ্বীপ কিংবা দ্বীপপুঞ্জ মানুষের অবসর কাটানোর আকর্ষণীয় জায়গা। তাই কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনে পর্যটকরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। পরিবেশ রক্ষাকে মাথায় রেখেই পর্যটনের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো হাতে নিতে হবে। এটাকে সমস্যা না ভেবে প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভাবনার দিকে এগোতে হবে। দেশের পর্যটনকে কাজে লাগাতে পারলে সরকারের ২০৪১ সালের উন্নত রাষ্ট্রের ভিশন বাস্তবায়ন সহজ হবে। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে অর্জিত হবে এসডিজিও। এ জন্য পর্যটনকে প্রোমোট করার পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতা নিয়েও জোরালো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটন খাত থেকে বছরে কয়েক কোটি মিলিয়ন রাজস্ব আয় করে। বাংলাদেশকেও সেই কৌশল রপ্ত করতে হবে। পর্যটনশিল্পে সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা এবং পরিবেশবান্ধব সচেতন পর্যটকরাই পারে সে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে।
ছবি: সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৪ জানুয়ারি ২০২০
© 2020, https:.