বাঙালি ছাড়াও এদেশে বসবাস করে নানা ভাষা, সংস্কৃতি ও নানা জাতিসত্তার মানুষ। তাদের উৎসব ও আচারগুলো যেমন ভিন্ন, তেমনি উৎসবের অন্তরালের গদ্যগুলোও অনন্য। আমরা শিশুদের ঈশপের গল্প পড়তে উৎসাহিত করি। কিন্তু সমতল ও পাহাড়ে বসবাসরত জাতিগুলোর বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসব ও বিশ্বাসের মিথগুলো শিশুদের কাছে প্রায় অজানাই থেকে যায়। তেমনি একটি উৎসবের কথা দিয়েই শুরু করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে ম্রো জাতির মানুষেরা। বিভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারী হলেও এরা এখনো প্রকৃতি পূজারী বা সর্বপ্রাণবাদী। গো-হত্যা উৎসব ম্রো সমাজে সর্ববৃহৎ সামাজিক অনুষ্ঠান। জুমের ফসল উত্তোলনের শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকেই ম্রো গ্রামে আয়োজন চলে এ উৎসবটির।
রোগমুক্তির কামনা, পারিবারিক শান্তি ও জুমের উচ্চ ফলনের আশায় এ উৎসবে এরা ‘থুরাই’ বা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পূজা দেয়। এছাড়া কেউ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেও গো-হত্যা অনুষ্ঠানের মানত করে ম্রো-রা। কেননা এদের বিশ্বাস গরুর আত্মা তাদের জাতির শত্রু। কোনো পরিবারের ওপর আত্মার নজর পড়লেই নানা রোগশোকের প্রার্দুভাব ঘটে। আর তা থেকে মুক্তির জন্যই গো-হত্যা অনুষ্ঠানের মানত করে এরা। তিনটি গরু হত্যার মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এক সপ্তাহ আগে পাড়ার সবাই একত্রে বাঁশের চাঁচারি এবং দুতলা বিশিষ্ট একটি মাচাং তৈরি করে নেয়। এরই নিচে তৈরি হয় ছোট্ট একটি ঘের। ঘেরের ভেতরই বাঁধা থাকে গরু। অনুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথি, গোত্রের লোকজন, নিকট আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী অনুষ্ঠান আয়োজনকারীকে সম্মানস্বরূপ আদি রীতি মেনে এক বোতল প্রিয় পানীয় (এক ধরনের মদ) উপহার দেয়। ম্রো ভাষায় এ আসরকেই বলা হয় ‘তাঅই’।
উৎসবের রাতে নাচার প্রস্তুতি নিয়ে তরুণীরা নানা ধরনের রুপার অলংকার পরে। তারা খোঁপায় ও কানে নানা জাতের ও রঙের ফুল, গলায় পুঁতির মালা, কোমরবন্ধ, হাতে রুপার চুড়ি, পায়ে ঘুঙুর পরে। অতঃপর যুবতীরা নাচের জন্য সমবেত হতে থাকে। তাদের ঘুঙুরের শব্দে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ভাঙে। যুবকেরা তখন ১০-১২ হাত লম্বা পুং (বাঁশের তৈরি বাঁশি) নিয়ে মাচাং থেকে সারিবদ্ধভাবে নিচে নামে। এ সময় এক প্রকার জংলি লাউকে ছিদ্র করে লম্বা চিকন বাঁশ ঢুকিয়ে, মোম লাগিয়ে, বাঁশির সুর তোলা হয়। এতে গোটা পাহাড়ি বনভূমি কেঁপে উঠে। যুবকরা তখন বাঁশি বাজায় আর যুবতীরা তালে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে। অদ্ভুত এই বাঁশির সুর গরুকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সুরে ও নাচের তালে সেও তার শেষ জাবর কাটতে থাকে। সারা রাত চলে ম্রোদের এমন আচার। সকালে গৃহকর্তা এক হাতে ধারালো বল্লম আর মুখে আদার জলের মিশ্রিত পানীয় মুখে পুরে গরুর গায়ে ফুঁঁ দেয় এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে। মন্ত্র শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গরুর ডান পার্শ্ব হৃদপি- বরাবর বল্লমের খোঁচা দেওয়া হয়। এতে গরুটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকে। তখন ম্রোদের নাচ ও গানের গতি আরও বাড়তে থাকে। গরু যখন মৃত্যুর মুখে ছটফট করে গৃহকর্তা তখন বল্লম দিয়ে তার জিহ্বা টেনে কেটে ‘লিং’ (গরু বাঁধার খুঁটি) এর ওপর গেঁথে রাখে। শেষে আনন্দ-ফূর্তি করে সবাই গরুর মাংস দিয়ে নানা পদ রান্না করে খায়।
কিন্তু কেন এই গো-হত্যা? কেনই-বা গরুর জিহ্বা খুঁটির মাথায় গেঁথে রাখে এরা? এ নিয়ে আদি বিশ্বাসের ম্রো সমাজে প্রচলিত আছে চমৎকার এক লোককথা। এর ভাবার্থ অনেকটা এমন, ‘ম্রোরা বিশ্বাস করে চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবী বা ভূম-লের সবকিছু সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন এক মহাশক্তিমান। তাদের কাছে তিনি থুরাই বা সৃষ্টিকর্তা। একদিন সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্ট মানুষজাতিসহ জীবকুলকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ দান করবেন বলে মনস্থির করেন। তিনি ওই পুস্তক বা ধর্মীয় গ্রন্থ গ্রহণের জন্য পৃথিবীর সব জাতির নেতাকে উপস্থিত থাকার জন্য একদিন আহ্বান জানালেন। জুমের ফসলাদি উঠেছে তখন। তাই কাজের ব্যস্ততায় ওই অনুষ্ঠানে ম্রো জাতির নেতা যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে পারেননি। অন্য জাতির নেতারা গ্রন্থখানা নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু ম্রো প্রধান উপস্থিত হন সবার শেষে। ততক্ষণে সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই স্বর্গে ফিরে গেছেন। পরের দিন সকালে সৃষ্টিকর্তা গরুর মাধ্যমে ম্রোদের কাছে তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। গ্রন্থে ১২ মাসিক চাষাবাদ, ধর্মীয় নীতিমালা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উল্লেখ ছিল। ধর্মীয় সব বিধিনিষেধ ও উপদেশবাণীও লেখা ছিল কলার পাতায়।
সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে গরুটি গ্রন্থখানা নিয়ে রওনা হলো। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রখর রোদে হাঁটতে হাঁটতে গরুটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পথে ছিল বড় একটি বটগাছ। তার ছায়ায় গ্রন্থের ওপর মাথা রেখেই মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে গরুটি। যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। প্রচন্ড ক্ষুধায় তার পেট চোঁ চোঁ করছে। কী করবে সে? কোনো উপায় না পেয়ে কলাপাতার ধর্মীয় গ্রন্থখানাই সে খেয়ে ফেলে। বর্ণমালা ও ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও ওই পুস্তকে নির্দেশনা ছিল বৎসরে তিনবার ধান, তিনবার তুলা, তিনবার তিল-তিসি ফসল তোলা যাবে এবং মাত্র একবার নিড়ানি দিতে হবে। পুস্তক ছাড়াই গরু যখন ম্রোদের কাছে উপস্থিত হলো, তখন সে সব বিষয়ই ভুলে গেল। কোনো উপায় না দেখে গরু ম্রোদের কাছে গিয়ে বলল ‘গতকাল পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানে তোমরা যে সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে পারোনি এজন্য থুরাই তোমাদের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তোমাদের গ্রন্থ দেওয়া হবে না বলে তোমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয় জানানোর জন্যই তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। ম্রোরা নির্দেশাবলি জানতে চাইলে, গরুটি সব নির্দেশনা গুলিয়ে ফেলে। এরপর বলে‘জুম থেকে একবার ফসল উত্তোলন করা যাবে এবং জুমের ফসলাদি রক্ষণাবেক্ষণসহ বহুবার নিড়ানি দিতে হবে।’ এ নির্দেশনা জানিয়েই সে ফিরে যায় সৃষ্টিকর্তার কাছে।
এদিকে ম্রো’রা অপরাপর জাতির সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের পার্থক্যটা লক্ষ করল। ভুল নির্দেশনায় তাদের ফসল তো হলোই না বরং ক্ষতির মুখে পড়ল তারা। তারা এ নিয়ে অভিযোগ জানাতে যায় থুরাই বা সৃষ্টিকর্তার কাছে। সব শুনে থুরাই বিষয়টি বুঝতে পারলেন। তিনি গরুকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে অভিশাপ দিলেন, ‘যত দিন ম্রো জাতি বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ পাবে না, তত দিন পর্যন্ত তোমাদের (গরুর) শাস্তি হবে গ্রামের মধ্যখানে লিম্পুতে (পাড়ার মাঝখানে) পিঞ্জরে আবদ্ধ করে, তোমাদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তারা সারা রাত নাচবে, ভোরের ঊষারে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে তোমাদের। আর তোমাদের মিথ্যাশ্রিত জিহ্বা কেটে খুঁটির মাথায় গেঁথে রাখবে তারা। মিথ্যা বলায় এটাই তোমাদের ‘উপযুক্ত শাস্তি’।’ মূলত এই ঘটনার পর থেকেই ম্রোরা গো-হত্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। পাশাপাশি তাদের সমাজে মিথ্যা বলা পাপের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
এখন ম্রোদের অনেকেই ক্রামা ধর্ম গ্রহণ করেছে। ক্রামা ধর্মালম্বীদের বর্ণমালা ও ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে। ফলে তারা গো-হত্যা থেকে বিরত থাকে। আবার নানা কারণে এদেশে ম্রোদের সংখ্যা ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি ও সাহিত্য। ফলে আদি সংস্কৃতি ও সাহিত্য জানার ক্ষেত্রে প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে। এদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের রয়েছে শত শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত নিজস্ব আচার, উৎসব ও সংস্কৃতি। দারিদ্র্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতির চাপে আজ তা প্রায় বিপন্ন। তাই জাতিগুলোকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি বিশেষ প্রয়োজন তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য সংরক্ষণের। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯
© 2020, https:.