আমাদের একটা ক্লাব ছিল ভূতেরগলিতে, নাম উদিতি ক্লাব। শেখ কামাল এসেও সেখানে খেলতেন। আমার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। ধানমন্ডি মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। ফলে আন্তরিকতা ছিল শেখ কামালের সঙ্গে। গোটা ধানমন্ডিকেই তখন আমরা একই মহল্লা ভাবতাম। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। রেজাল্টও বের হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের ঘটনা। শেখ মুজিবকে আনকন্ডিশনালি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ওইদিন হাজার হাজার লোক জড়ো হতে থাকে বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। তারা একনজর দেখতে চান তাকে। ওখানে যেতেই শেখ কামাল বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়।
তখন ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন ওপেন জিপে করেই শেখ মুজিবকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন। ওই জিপে কামাল আমাকেও তুলে নেয়। তোফায়েল আহমেদ, মহিউদ্দিন, শেখ সেলিম, আবাহনীর বাচ্চু ভাইও ছিলেন। কলাভবন হয়ে কার্জন হলের ফার্মাসি ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবকে নিয়ে যাই। কিন্তু তাকে নিয়ে ওভাবে বের হওয়াটা ঠিক ছিল না। নিরাপত্তার ঝুঁকি ছিল। এ খবর আসতেই আমরা সর্তক হয়ে যাই। খোলা জিপে আমি আর শেখ কামাল শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখি শেখ মুজিবকে। ওই স্মৃতি আজও আমাকে উদ্দীপ্ত করে।
পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতো। একজন বাঙালি সে ভাল খেললেও পাকিস্তান টিমে চান্স পেত না। মিলিটারিতে আমরা ছিলাম মাত্র ৫%। বাঙালিরা কর্নেলের ওপর যেতে পারত না। কোনো কারখানা বাঙালি ব্যবসায়ীদের দেওয়া হতো না। তেজগাঁওয়ের কারখানাগুলো নন বেঙ্গলিরাই কন্ট্রোল করতো। এভাবে বাঙালিদের চরম বঞ্চিত করে ওরা।
সেই বঞ্চনা আর বৈষম্যের কথাই বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই রেসকোর্স ময়দানে একত্রিত হয়েছিলাম ওইদিন। বাঙালির দাবি সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মুখে। তিনি বললেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব–এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্…’। বাঙালির হাতে অস্ত্র নেই। তবুও প্রস্তুত থাকতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের কাছে ওই নির্দেশই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত তখন আটটা। আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। বাবার একটা দোনালা বন্দুক ছিল। সেটি নিয়ে গ্রীনরোডে চলে যাই। উদ্দেশ পাকিস্তান আর্মিদের প্রতিহত করা। এলাকার খালেদ, মনির, কবির, লুৎফরসহ আরও অনেকেই রাস্তায় নামে। গাছ কেটে নর্থরোড, সেন্ট্রালরোড, গ্রীনরোড এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে দিতে থাকি। পেট্রোল বোমা বানাতে পাম্প থেকে ড্রামে করে পেট্রোল এনেও জমা করি।
কিন্তু এলাকার মানুষ আমাদের ফিরিয়ে আনে। কারণ পাকিস্তানিরা ট্রেন্ড সোলজার। আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারব না। আমরা আক্রমণ করলে উল্টো ওরা গোটা এলাকা ম্যাসাকার করবে। বাড়ি-ঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। তাই বাড়ির ছাদে বসেই আমরা ওদের তাণ্ডব দেখি। সারারাত শুনেছি মানুষের চিৎকার ও গুলির শব্দ।
২৭ মার্চ ১৯৭১। কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ ওঠে। মানুষ তখন ঢাকা থেকে পালাতে থাকে। মোড়ে মোড়ে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি আর্মি। নিউ মার্কেটের দিকে এগোতেই দেখি লাশের স্তুপ। পলাশী হয়ে ইকবাল হলের দিকে যেতেই চোখে পড়ে শত শত লাশ। ওইদিন ঢাকার রাজপথে ছিল পঁচা লাশের গন্ধ। মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল একাত্তরে। তখনই বুঝে যাই, আমাদের কোনো চয়েজ নাই। ডু ওর ডাই। যুদ্ধ করতেই হবে। নিতে হবে ট্রেনিং। আনতে হবে অস্ত্র। দেশটা ছোট হতে পারে কিন্তু একাত্তরে আমাদের মনোবলটা ছিল অনেক বড়।’ একাত্তরের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত গেরিলা বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলু।
জীবনের তাগিদে বজলুল মাহমুদ বাবলু থাকেন দেশের বাইরে। আমেরিকার একটি বড় কোম্পানিতে চাকুরি করেন। কিন্তু বিজয়ের মাস আসলেই দেশের টানে তার মন ছুটে যায়। চলে আসেন প্রিয় বাংলাদেশ আর একাত্তরের সহযোদ্ধাদের এক নজর দেখবেন বলে। সে খবর জেনেই এক বিকেলে পা রাখি তার সেন্ট্রালরোডের বাড়িতে। দীর্ঘ আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
এ এস ইসমাইল ও মাহমুদা বেগমের পঞ্চম সন্তান বাবলু। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধানমন্ডি হাই স্কুলে। পরে আজিমপুরের ওয়েস্টঅ্যান্ড হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬৯ সালে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন কায়েদে আজম (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী) কলেজে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
তাদের আদিবাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া হলেও বাবলুর বেড়ে ওঠা ঢাকার সেন্ট্রালরোডে। পরিবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ‘আমার দাদার নাম ইউসুফ আলী সরকার। তার দাদা নুরুদ্দিন সিপাহি বিপ্লবে যুক্ত ছিলেন। উনিই দিল্লি থেকে পালিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় চলে আসেন। আর আমার বাবা থাকতেন এ কে ফজলুল হক সাহেবের সাথে। সাতচল্লিশে স্বাধীনতা আন্দোলনে কলকাতায় যে আন্দোলন হয় সেখানেও যুক্ত ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে উনি ক্যালকাটা পার্কস স্কুলের হেডমাস্টার হন। দেশভাগের সময় কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। তখন সাব ডিভিশনাল কন্ট্রোলার ছিলেন। মূলত আমাদের ফ্যামিলির রক্তেই ছিল স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা।’
আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। ২৮ মার্চ বাবলুরা পরিবারসহ চলে যান সোনারগাঁওয়ে, ফুপুর বাড়িতে। বোনদের সেইফ জোনে পাঠিয়ে আবার চলে আসেন সেন্ট্রালরোডের বাড়িতেই। তখন লুকিয়ে থাকতেন তারা। পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি বাড়ি হানা দিত। ওদের সহযোগিতা করত ননবেঙ্গলিরা। তাই তারা এমন জায়গায় থাকতেন যেন সহজে পালানো যায়। কিন্তু নিজের দেশে এভাবে আর কতদিন চলবে পরাধীনতার জীবন? তাই সিদ্ধান্ত নেন ট্রেনিংয়ে যাওয়ার।
সে ইতিহাস শুনি বজলুল মাহমুদ বাবলুর জবানিতে।
তার ভাষায়– ‘জুন মাসের দুই তারিখ হবে। আমি বাড়ি ছাড়ি দেশের টানে। গ্রীনরোডের কুটুসহ কুমিল্লার বর্ডার পার হয়ে চলে আসি ভারতের মেলাঘরে। সেখানে ৩০-৩৫ জনকে সাতদিনের ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় স্টেনগান, এসএলআর, গ্রেনেড ও মাইন বিস্ফোরণের টেকনিক। এরপরই বলা হলো খালি হাতেই ঢাকায় চলে যেতে। অস্ত্র আসবে কমান্ডারের মাধ্যমে। ঢাকার নিকটবর্তী পলখান ক্যাম্প থেকে অস্ত্র আসতো বিভিন্ন ভায়া হয়ে। ক্যাম্প বা অস্ত্র থাকত ধানমন্ডির চারটি জায়গায়– ৭৬ নম্বর সেন্ট্রালরোডে, ওয়েস্টঅ্যান্ড স্ট্রিটে হাক্কানি মসজিদের রাস্তার দিকে ছোট কামরায়, মেহেরুন্নেসা গার্লস স্কুল সংলগ্ন ভূতের গলির মসজিদের ওয়াকফের একটি টিনের ঘরে, ওয়েস্ট স্ট্রিটে এস পি খলিলুর রহমানের বাড়িতে (অভিনেত্রী রানী সরকার ভাড়া থাকতেন যেখানে)। আমাদের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল আজিজ। তার প্ল্যান মোতাবেকই অপারেশনগুলো পরিচালিত হতো।
অপারেশনের ধরনগুলো কেমন ছিল?
‘গ্রামে-গঞ্জে যারা অপারেশন করেন, তারা পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ঢাকার আরবানে গেরিলাদের অপারেশন করে ঢাকার মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে হতো। এটা খুব সহজ ছিল না। সেইফ জোনে আমরা আলাদাভাবে থাকতাম। রাত এগারোটার পর সবাই একত্রিত হতাম। অপারেশনের সময় মুখ বাঁধা থাকত। ফিরে এসে কে, কোথায় থাকবে–এটা বলা নিষেধ ছিল। কেউ কারও খবর জানত না। এটাই ছিল নিয়ম। কারণ একজন গেরিলা ধরা পড়লে তাকে টর্চার করে যেন পাকিস্তানিরা সবার তথ্য না পায়। তাই ঢাকার গেরিলাদের জীবনের ঝুঁকি ছিল খুব বেশি।’
ঢাকায় দুটি অপারেশনের কথা শুনি এই গেরিলার জবানিতে। তার ভাষায়– ‘গ্রীনরোডে নূর হোটেলের অপজিটে ছিল জাতিসংঘের একটি অফিস ও কয়েকটি বাড়ি। এছাড়া নূর হোটেলের সামনের পথ সাত নম্বর গ্রীনরোড ধানমন্ডির রাস্তা ও আট নম্বর ধানমন্ডির রাস্তার শেষে এক বাড়িতে ছিল ইউনিসেফের একটি অফিস। ফলে সেখানে কিছু ঘটালে সে খবর দ্রুত পৌঁছে যাবে বিশ্ব গণমাধ্যমে। পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে এদেশে একটা গেরিলা যুদ্ধ চলছে। এটাই ছিল উদ্দেশ।
তারিখটা অগাস্টের একুশ হবে। আব্দুল আজিজের নির্দেশে আমি, শেখ মান্নান (বীরপ্রতীক), আব্দুল্লাহ, আলমগীর আর মনসুর আলী দুলাল (বীরপ্রতীক) প্রস্তুত হই অপারেশনের জন্য। কমান্ডে শেখ মান্নান। রাত তখন দেড়টার মতো। মেহেরুন্নেসা গার্লস স্কুল সংলগ্ন ভূতেরগলির মসজিদের ওয়াকফের একটি টিনের ঘর হতে অস্ত্র নিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে রওনা হই। গ্রীনরোডের দিকে সাত নম্বর রোডে ল্যাবএইডের ক্যান্সার হাসাপাতাল এখন যেখানে হচ্ছে, ওখানেই ছিল নূর হোটেল। তখন হোটেলটির কনস্ট্রাকশন চলছিল। আমরা হোটেলের ওপর তলা ও নীচতলা হতে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথমে রাস্তার মধ্যে মাইন সেট করি। এরপর তিনজন খোলা দোতলায় আর দুইজন নিচে দুইদিকে অন্ধকারে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ইপিআর হেড কোয়ার্টাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা তখন ক্যান্টনমেন্টের দিকে ওই রাস্তা হয়েই যেত। ওইরাতে এই পথেই একটা মিলিটারি কনভয় যাবে। কিন্তু এ খবর আমাদের জানা ছিল না।
ভিডিও: যুদ্ধাহত গেরিলা বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলুর ভাষ্য
আনুমানিক রাত দুটো। নিউ মার্কেটের দিক থেকে ফার্মগেট অভিমুখে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম। কয়েকটি গাড়ি খুব ধীরে আসছে। পেতে রাখা মাইনের কাছে আসতেই বিকট শব্দে ডান কাত হয়ে গাড়িটি উল্টে যায়। লক্ষ্য করলাম পেছনে একটি কাপড় ঘেরা পাকিস্তানি সেনাদের বিশাল ট্রাক। দুটি ট্রাক ও একটা জিপ ছিল। সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা একাধারে গুলি ও গ্রেনেড চার্জ করতে থাকি। অল্প সময়েই রাস্তাটা রক্তে রঞ্জিত হয়। এ অপারেশনে ২১ জন নিহত এবং বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পরদিন ওরা ভূতেরগলি, নর্থরোড, গ্রীন কর্ণার ঘেরাও করে তল্লাশী চালাতে থাকে। গেরিলাদের খোঁজ পেতে সাধারণ মানুষের ওপরও চালায় নির্যাতন। তখন এলিফ্যান্ট রোড হয়ে মিরপুর রোড সংলগ্ন স্টাফ কোয়ার্টারে আশ্রয় নিই বন্ধু সৈয়দ মাসুদ হাসানের বাড়িতে।
এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ভয়েজ অব আমেরিকাসহ বিশ্ব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। এই হামলার পর থেকেই গেরিলাদের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা ঢাকা শহরে রাতে মুভ করা কমিয়ে দেয়।
এর কিছুদিন আগেই আমরা অ্যাটাক করি একটা মিলিশিয়া ক্যাম্পে। নিউ মডেল স্কুলটি তখন ছিল ক্রিসেন্ট রোডে, শিরিন ভবন নামে বাড়িতে। ওখানে ছিল পাকিস্তানিদের মিলিশিয়ার বাহিনীর ক্যাম্প। ওদের কারণে ওই এলাকায় আমাদের মুভ করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এছাড়া তারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়েও হানা দিত। আমি, খালেদ, কুটু, আলমগীর, সিদ্দিকসহ সাতজনের একটি দল একরাতে ওখানে অ্যাটাক করি। অস্ত্র ছিল কার্বাইন, আগুন লাগানোর জন্য ফসফরাস, গ্রেনেড আর এসএলআর। ফসফরাস দিয়ে বিল্ডিংটায় আগুন লাগানোর পর ওরা বের হয়ে আসতে থাকে। তখন আমরা গুলি করে ওদের সাতজনকে হত্যা করি। হতাহতও হয়েছিল বহু। এরপর ওরা ভয়ে ওই বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমরা এভাবে গেরিলা অপারেশন চালাই গ্রীনরোড, কলাবাগান, গ্রীনসুপার মার্কেট, নীলক্ষেত প্রভৃতি জায়গায়। ঢাকার গেরিলাদের ভয়ে পাকিস্তানিরা আতঙ্কিত থাকত।’
ঢাকার অন্যান্য গেরিলাদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল বাবলুদের। শহীদ বদি ছিলেন তার বড় ভাইয়ের বন্ধু। দিলুরোডে অপারেশনের সময় ওদের সঙ্গে তার দেখা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আসতেন মুজাহিদ ও জীবন ভাই। যোগাযোগ ছিল শিল্পী শাহাবুদ্দিনের গ্রুপটির সঙ্গেও। অপারেশনের জন্য তারা নিজেদের মধ্যে অস্ত্র আদান-প্রদানও করতেন। গেরিলা হিসেবে একজন আরেকজনকে চিনলেও কে কোথায় থাকছে, কিভাবে মুভ করছে–এটা জানা ছিল না কারোই।
গেরিলা বজলুল মাহমুদ বাবলুকে পাকিস্তানিদের কাছে ধরিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ধারী এক পাকিস্তানি দালাল। এরপর তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। কীভাবে ধরা পড়লেন তিনি? এ বীর সে ঘটনা বললেন ঠিক এভাবে– ‘তখন অপারেশন করছি বিভিন্ন জায়গায়। সেন্ট্রালরোডে মনির চৌধুরীর বাড়ির উল্টো দিকে একদিন আড্ডা দিচ্ছি। সঙ্গে মুন্না আর সালামও ছিল। সেখানে আসে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান। সে মেলাঘর থেকে অস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় আসলেও গোপনে কাজ করতো আলবদরের হয়ে। এটা আমাদের জানা ছিল না।
শাহজাহান এসে কৌশলে বলে– ‘চলো, ভারত যাই। অস্ত্র নিয়ে আসি।’ আমি তখন বলে ফেলি– ‘যেতে হবে না। কত অস্ত্র দরকার?’ সে তখন মুচকি হাসে। ওই হাসির রহস্য উন্মোচিত হয় দুইদিন পর, ১৫ নভেম্বর খুব ভোরে। শাহজাহান বোরখা পরে ট্রাকে করে পাকিস্তান আর্মিদের এনে সেন্ট্রালরোড, ভূতেরগলি, নর্থরোডের বাড়িগুলো ঘেরাও করে। কেউ পালাতে পারে না। আমিও বাড়িতেই ছিলাম। শাহজাহান এসে আমাকে দেখিয়ে বলে– ‘একে নিয়ে যাও।’ অবাক হয়ে শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওইদিন ওরা ড. খোদাবক্স সাহেবের ছেলে হাসান, মনি, নায়ক রহমানের শ্যালক বাবু, ভূতেরগলি মসজিদের পাশে মহসিন ও তার দুই ভাইকে, ফারুক, নর্থরোডের বাদল খান, বাবুল, গোলাম আজম ও তার খালুকে ধরে নিয়ে যায়।
আমাদের প্রথমে নেয় ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডের থানায় এবং পরে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে একটা বড় গোডাইনের জায়গায় রেখে টর্চার করতো। কঁচুক্ষেত যেতে বাঁদিকের কর্নারে ছিল জায়গাটা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। একেকটি শেডে গাদাগাদি করে থাকত প্রায় তিনশ জন। আমি, বাদল ভাই, মহসিন, আজম প্রমুখ মাটিতে কোনোরকম থাকতাম। ওখান থেকে ওরা আমাকে নিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এখন যে অফিস আছে তার পেছনে, ওদের একটা টর্চার ক্যাম্পে। সেখানে ফ্যানে ঝুলিয়ে ওরা পেটাতো আর নানাভাবে টর্চার করতো। অস্ত্র কোথায় আছে, বাকী গেরিলারা কোথায়? এমন তথ্য জানতে চাইত। মুখ খুলিনি। তাই টর্চারের মাত্রাও ওরা বাড়িয়ে দেয়। ওটা রোজার মাসের শেষের ঘটনা। সেন্ট্রালরোড, নর্থরোড এলাকার সবাই ঈদের নামাজ পড়েছে কিন্তু আমাদের কথা ভেবে নতুন কাপড় পর্যন্ত কেউ পরেনি।
বড় ভাই ইকবাল মাহমুদ পাকিস্তানে পড়াশোনা করতেন। পাকিস্তানি কর্নেল বশিরের ছোট ভাই ছিল তার সহপাঠী। বশির সাহেব মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সের চিফ ছিলেন তখন। সে সুবাধে আমাকে রিলিজ করে নেন তিনি। তা না হলে মৃত্যু অবধারিত ছিল। বাকীদের টর্চার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেন্ট্রাল জেলে। কিন্তু ওদের অমানুষিক টর্চারে আমার বাঁ সাইডের একটা নার্ভ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এখনও মাঝেমাধ্যেই ব্লাক আউট হয়ে যাই। পুরো পৃথিবী তখন অন্ধকার দেখায়। ব্যাথাও হয় খুব। বছরখানেক আগে যুদ্ধাহত হিসেবে আবেদন করছি। কিন্তু ওটার কোনো খবর এখনও পাইনি। শাহজাহানের মতো বেঈমান একাত্তরে অনেকেই ছিল। সে এখন পলাতক। আটচল্লিশ বছর ধরে আমরা খুঁজছি তাকে। তার বিচার করতে না পারলে মরেও শান্তি পাব না।’
১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পনের দলিল যে টেবিলে রেখে স্বাক্ষর করেছিলেন সেটি এনে দেন বজলুল মাহমুদ বাবলুরা। কীভাবে? তিনি বলেন–‘সারেন্ডারের খবরটা আমরা আগেই পাই। অস্ত্র নিয়ে ওইদিন সকালেই একটা ওপেন জিপে অবস্থান নিই ঢাকা ক্লাবের কাছে, বটগাছের নিচে। জাহেদ আনোয়ার ছিলেন ড্রাইভিংয়ে। সঙ্গে মিলুও ছিল। ইন্ডিয়ান আর্মিরা বিমানে লিফলেট ছড়াচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ভারতীয় মিগও চলে যায়।
এখন যেখানে শিশু পার্ক তার ভেতরেই হয়েছিল আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানটি। ইন্ডিয়ান আর্মিদের কয়েকজন এসে বলল একটা টেবিল দরকার। তখন ঢাকা ক্লাব থেকে বের করে আনলাম একটি টেবিল। সেই টেবিলেই ইতিহাস হয়ে গেল। সারেন্ডারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। এটা পরম পাওয়া। ওই মুহুর্তটির কথা ঠিক বোঝাতে পারব না। হাজারো ঈদের মতো আনন্দ ছিল ১৬ ডিসেম্বরের দিনটিতে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে এ বীরপ্রতীক অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়– ‘দেশ স্বাধীন না হলে আমাদের দেশ ক্রিকেটে ওয়ার্ল্ডকাপ খেলতে পারত না, এতো গার্মেন্টেস মালিক আর ব্যাংকের মালিক, জেনারেল আর মিনিস্টারও হতো না। এভরি ক্রেডিট গোস টু বঙ্গবন্ধু। তিনি ও তারা পরিবার যে কষ্ট করে গেছেন, যে সেক্রিফাইস করে গেছেন, এটা ইতিহাসে বিরল, আন পারসেবল। শেখ মুজিব ভেরি কুল পারর্সন ও দয়ালু ছিলেন। পাকিস্তানিরা তার সাথে একটা সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। তারা ক্ষতি করতে পারে এটা তিনি ভাবতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এ বিষয়ে ভেরি কনসাস। হুইচ ইচ গুড। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাঙালি বিট্রে করতে পারে। দেখেন পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা যখন ঢুকেছে বাঙালিদের ভেতর দিয়াই ঢুকেছে। বোম্বে, গুজরাট আর হায়দারাবাদ দিয়ে তো ঢুকতে পারে নাই। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করেছিল বাঙালিরাই।’
জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন এই যোদ্ধা। পাশাপাশি জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছিল বলে মত দেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানে যে সকল বাঙালি সেনারা আটকা ছিলেন, তারা ছিলেন পাকিস্তান মেন্টালিটির। স্বাধীনের পর তাদের ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধ করেছে যারা তাদের দেশের কাজে লাগানো উচিত ছিল বলেও মনে করেন বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলু।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে কলঙ্কজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন–‘জিয়ার আমলে স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি, তিনি তাদের নিয়েই দেশ চালিয়েছেন। দেশকে উল্টো পথে নিয়ে গেছেন। তখন রাজাকারদের গাড়িতে উড়েছে স্বাধীন দেশের পতাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটা যে কত কষ্টের ছিল বোঝাতে পারব না ভাই। জিয়া দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন। প্রমাণও করেছেন বেঈমান কখনও দেশের বন্ধু হতে পারে না।’
দেশের কোন জিনিসটি দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাল লাগে? এমন প্রশ্নে চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে এই যোদ্ধা বলেন– ‘আমরা তো বিবেকের তাড়নায় দেশ ও মাটি রক্ষায় যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এখন তরুণ প্রজন্মেও তেমন দেশপ্রেম দেখলে ভাল লাগে। আজ যখন আপনার মতো ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইতিহাস তুলে আনার কাজ করতে দেখি, তখন গর্বিত হই। স্বাধীনতার জন্যও আনন্দ বোধ করি।’
খারাপ লাগে কখন?
‘যখন রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রাজাকারদের নাম দেখি তখন কষ্ট আর অপমানে নিরব হয়ে যাই। যখন দেখি যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের নামেও স্বাধীন দেশে সড়কের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে তেমন সড়ক নেই। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে শুনি তখন কষ্ট লাগে। কতদিনইবা বাঁচবে মুক্তিযোদ্ধারা? এ সরকার তবুও সম্মান দিয়েছে। তা না হলে মরার মতোই বেঁচে থাকতে হতো আমাদের।’
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৭ জনকে বীর শ্রেষ্ঠ, ৬৯ জনকে বীর উত্তম, ১৭৫ জনকে বীর বিক্রম ও ৪২৬ জনকে বীর প্রতীক খেতাব বা উপাধিতে ভূষিত করে বঙ্গবন্ধু সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অপারেশনে বীরত্বের জন্য একই নামে অর্থাৎ ৫ জন সেনা সদস্যকে বীর উত্তম, ২০ জনকে বীর বিক্রম এবং ৮০ জনকে বীর প্রতীক উপাধি প্রদান করা হয়। যা জাতির জনককে অসম্মান ও মুক্তিযুদ্ধের উপাধিকে বির্তকিত করার জন্যই করা হয়েছিল বলে মনে করেন একাত্তরের এই বীরপ্রতীক।
তার ভাষ্য–‘ওই সেনা সদস্যও বীর প্রতীক, আমিও বীর প্রতীক। তাহলে আপনি কীভাবে বুঝবেন কেন, কোন সময়ের বীরত্বের জন্য উপাধি পেল। একাত্তরে যারা বীরত্বের সঙ্গে দেশ স্বাধীন করেছেন এটা তাদের গালে জুতা মারা আর বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করার সামিল। সেনাবাহিনীতে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়ার বিরোধী নই আমরা। কিন্তু জাতির পিতা যাদেরকে সম্মান দিয়েছেন ওই খেতাবের নামেই কেন খেতাব দেওয়া হলো তখন। ওই খেতাবের নাম পরিবর্তন করা হয়নি এখনও। পাশাপাশি তখনকার সরকার কেন একই নামে খেতাব বা উপাধি দিল, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারের উচিত বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উপাধি নিয়ে এমন বিভ্রান্তি দূর করা।’
কী করলে দেশ আরও এগোবে?
এই বীরের উত্তর– ‘দেখুন, রাস্তায় কাগজ পড়ে থাকতে, থুতু ফেলতে আর নোংরা করতে দেখি। এটা তো সরকার পরিবর্তন করতে পারবে না। মানুষকেই শিখতে হবে। দায়িত্বও নিতে হবে। আমি নোংরা করব আর পরিস্কার করবে রাষ্ট্র– এটা তো হবে না। করাপশনের মাত্রা দেশে খুব বেশি। সবাই না হলেও এখন অধিকাংশ নেতারা কর্মাসিয়াল। শেখ হাসিনা যে শুদ্ধি অভিযান করছেন, সেটা প্রশংসার যোগ্য। তবে এটা খুবই শক্ত কাজ। একটা খারাপ মানুষকে দিয়ে আপনি সত্যিকারভাবে কোনো ভাল কাজ করাতে পারবেন না। করাপশনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সাহস দেখিয়েছেন, এটাই ইতিহাস হয়ে থাকবে। সফল হলে দেশটা অবশ্যই এগিয়ে যাবে।’
তরুণ প্রজন্মকে আশাবাদী হতে হবে। তাদের হাত ধরেই দেশ উন্নত বাংলাদেশ হবে। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত গেরিলা বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলুর। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন এভাবে– ‘তোমাদের দেশপ্রেম থাকতে হবে। সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করো। ন্যায়ের পক্ষে থেকো। মনে রেখো, একটা ভাল মানুষ এক লক্ষ খারাপ মানুষের চেয়েও ভাল। আর দেশ ভাল থাকা মানেই সবাই ভাল থাকা।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত গেরিলা বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলু।
ট্রেনিং: ভারতের মেলাঘরে সাতদিনের ট্রেনিংয়ে স্টেনগান, এসএলআর, গ্রেনেড ও মাইন বিস্ফোরণের টেকনিক শিখে নেন।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা অপারেশন করেন ঢাকার গ্রীনরোড, কলাবাগান, গ্রীনসুপার মার্কেট, নীলক্ষেত প্রভৃতি জায়গায়।
যুদ্ধাহত: ১৫ নভেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে অমানুষিক টর্চার করে। ফলে তার বাঁ সাইডের একটা নার্ভ নষ্ট হয়ে যায়। এখনও মাঝেমাধ্যেই কিছু সময়ের জন্য তিনি ব্লাক আউট হয়ে যান। পুরো পৃথিবী তখন অন্ধকার দেখায়। ব্যাথাও হয় খুব।
ছবি ও ভিডিও : সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯
২০২০ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ- ১৯৭১: রক্ত, মাটি ও বীরের গদ্য
© 2020, https:.