মালোদের বিয়েতে বাড়ির উঠোনে মারোয়া সাজানো হয়। এ সময় মালোরা লুচকি নাচ নাচে। মারোয়া সাজানো বিষয়ে মালোরা বলে-কলা গাছ লাগে চাইরটে, মইধ্যে একটা বাঁশ, ফুল দেইকে ঘেরেক লাগিলো। একটি মাটির কলস রাখার জন্য মারোয়ায় তিন চাক মাটি বসানো হয়। বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) ও দিদিরা দলবেঁধে নেচে-গেয়ে মাঠ থেকে কেটে আনে সে মাটি। অতঃপর ঘরের ভেতর রাখা মাটির কলসটা নিয়ে উপোস অবস্থায় বোহনে ও দিদিরা পুকুর বা নদী থেকে কিছু পানি নিয়ে আসে। এটিকে পানিকাটা পর্ব বলে। অতঃপর বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) কনেকে কোলে তুলে নিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। সেখানে ওই বাড়ির মেয়েদের চুল ও কনের চুল একত্র করে পানি ঢেলে সে পানির কিছু অংশ কলসে সংগ্রহ করা হয়। কলসটা রাখা হয় গোপন একটি ঘরে। বাবা-মা ও বোহনে ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ। মালোরা বিশ্বাস করে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কনের অমঙ্গল হবে। বিয়ের দিন সবাই উলুধ্বনি দিয়ে প্রথমে কলসটা নিয়ে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে। অতঃপর কলসটিকে রাখা হয় মাটির চাকের বিশেষ জায়গায়।
মালোদের বিয়ের মূল পর্বটিকে বলে বিহা। ওইদিন বাড়িতে নাপিত ডেকে প্রথমে কনেকে শুদ্ধি করানো হয়। কনের কানি আঙুল সামান্য কেটে আমবা (আম) পাতায় রক্ত নিয়ে তা বেঁধে দেওয়া হয় কনেরই হাতে। বরপক্ষ এলে কনের মা ও কাকিরা কুলাতে গোবর গুলি, গুড়ের গুলি, দুর্বাঘাস, আতপ চাল, মিষ্টি, পানি, পানপাতা, প্রদীপ বা বাত্তি নিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেয় বরকে। অতঃপর কনের ভাই বরকে গামছায় টেনে পাঁচ পাক ঘোরায় মারোয়ার চারপাশে। এরপর বর-কনেকে বসানো হয় মারোয়ায়। শুরু হয় দানপর্ব। আত্মীয়-স্বজনরা তাদের আর্শীবাদ করে নানা উপহারে। দান শেষে বর-কনেকে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়। এ সময় একটি শাড়ি বা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় দু’জনকে। চাদরের আড়ালে থেকে বর কনেকে সিঁদুর দেয়। অতঃপর বর-কনে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ফিরে সবাইকে প্রণাম জানায়। বিয়ে শেষে রাতভর চলে নাচ-গান আর হাড়িয়া খাওয়া। ধর্মান্তরিত মালোদের মাঝে অন্য জাতি বা গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধের আদি বিশ্বাসটি টিকে নেই। এখন অন্য জাতি হলেও আদিবাসীদের মূল পরিচয় তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। ফলে বিয়ের সর্ম্পক করতেও নেই কোনো বাধা।
মালোদের বিয়ে বিচ্ছেদ নেই বললেই চলে। তবে কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হলে উভয়পক্ষের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামপরিষদ তা মীমাংসার চেষ্টা করেন। তা না হলে সকলের উপস্থিতিতে বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। মালো সমাজে স্বামী স্ত্রীকে অত্যাচার করলেও পরিবার ও সমাজ চেষ্টা করে সংসারটিকে টিকিয়ে রাখতে। এসব বিষয় তারা খুব গোপন রাখেন। এছাড়া মালো সমাজে বহু বিয়ে একেবারেই নেই।
এ আদিবাসীদের মৃত্যু হলে দাহ করা হয়। দাহের আগে মৃতের শরীর এরা ধূপ, গোলাপজল, সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে শরীরে মেখে দেয় হলুদ ও সিঁদুর। এদের মরার পরে পাঁচদিন পর্যন্ত মাছ, মাংস ও তৈল দিয়ে রান্না খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ। পাঁচদিন পর মুরগি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে এরা কলাপাতায় খাওয়ায় সমাজের পাঁচজনকে। ওইদিন নাপিত এসে ছেলের চুল ফেলে দেয়। মেয়েরা স্নান সেড়ে, নখ কেটে পান করে হলুদের পানি। মালোরা এ দিনটিকে কুয়ারি বলে।
মালোরা উৎসব ও পূজা-পার্বনে-লুচকি নাচ পরিবেশন করে থাকে। এছাড়া এদের একটি বিয়ের গান:
মিন্দে কর মাতল পিয়া
সিতলিয়া আনানে
নিদো নাহি এ পিয়া
আয় আধার রাতিয়া করে কর বাজু আখে
গর এ খর বাজু আখে
কে যে কলি লে লাই পিয়া
আয় আধার রাতিয়া
নিদো নাহি পিয়া
আয় আধার রাতিয়া
ডারাকর পিছু আখে
পিছু আখে ডার আখর
ছো আখে কে যে খলিলে
লাই পিয়া আয় আধার রাতিয়া
নিদ নাহিরে পিয়া
আয় আধার রাতিয়া।
ভাবার্থ: অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি বিয়ে বাড়িতে, আর কে যে পায়ের নূপুরটাকে নিয়ে নিল তা জানি না। আবার চোখে ঘুমও নেই। কে যে কোমরের বিছাটা নিয়ে নিল খুলে, তাও জানি না…।
১৯৭১ সালে বেশ কয়েকজন মালো আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে মালো আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা কতজন, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সরেজমিনে সংগৃহীত তথ্য মতে শুধু ঘোড়াঘাটের শীতল গাঁয়ের মালো গ্রাম থেকেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ধীরেন মালো, শচীন্দ্র মালো, শকুর মালো, জুয়েল মালো ও ভরত মালো।
এরা আগে হিন্দু ধর্মালম্বী ও প্রকৃতির উপাসকও ছিলেন। ধর্মে এরা বৈষ্ণব। শ্রাবণ মাসে এরা বিভিন্ন মানত করে খলকুমারী পূজা পালন করত। মানত পুরো হলে এরা বুড়াবুড়ির পূজা দেয়। আবার খাজাখিজিরের অনুগ্রহ লাভের জন্য নদীতেও বাতি জ্বালায়। এরা করমপূজা, কালীপূজা, সূর্য পূজা, লক্ষ্মী পূজা ও দুর্গা পূজা পালন করে থাকে। কালীপূজায় এরা পাঠা বলি দেয়। সূর্যদেবতাকে এরা ভগবান ডাকে। তারা তাকে প্রনাম করে। এদের গৃহ দেবতা তুলসি। ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে উলু ধ্বনি দিয়ে তুলসি ঠাকুরকে এরা ভক্তি দেয় সকাল-সন্ধ্যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত মালোদের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীস্টান হয়েছে। ফাদার রাক্কা একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে বসবাসরত মালোদের মধ্যে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের অধিবাসীরা প্রথম খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিস্নান গ্রহণ করেন। বর্তমানে ক্যাথলিক মিশন ছাড়াও মালো গ্রামগুলোতে প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ, লুথারিয়ান চার্চ, এফসিসিডি চার্চ, জিপস গড চার্চ গড়ে উঠেছে।
মূলত কৃষিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় মালোদের সামাজিক উৎসবগুলো। তারা উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ঢোল, মাদল, ঝাঁঝর, কর্তাল, টহিলা, নাগড়া ইত্যাদি। বছরের প্রথম দিনে এরা বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরি করে, নতুন পোশাক পরে নাচ-গানের মাধ্যমে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। এছাড়া মালোরা পুষনা, নবান্ন, সহরায় প্রভৃতি উৎসব পালন করে থাকে। সহরায় উৎসবে গৃহপালিত গরুকে তেল মাখানো হয় সিং ও লেজে। এ সময় বিশেষ করে গাভীকে মা হিসেবে ডেকে এরা পূজা করে। খাওয়া-দাওয়া ও হাড়িয়া এদের উৎসবের আমেজকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
পোষ মাসে এ আদিবাসীরা ধুমধামের সঙ্গে পুষনা উৎসব পালন করে থাকে। এ সময় তীর-ধনুক নিয়ে এরা শিকারে বের হয়। শিকারের মাংস দিয়ে সবার জন্য রান্না হয় খিচুড়ি। তবে যে শিকার ধরে তাকে একটু বেশি বা বিশেষ অংশ খেতে দেয়া হয়। এ ছাড়া মালো আদিবাসীরা ফসল কাটার পর ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগহ্র করে। এটি তাদের পূর্বপুরুষদের আচার। ধানের সঙ্গে সঙ্গে এ সময় এরা দলবেঁধে মুসা ( ইঁদুর ) ধরে। তবে মালোদের এ আচারগুলো এখন ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে।
এদের কারো জ্বর বা পেটে কৃমি হলে চিরতার পানি খাওয়ানো হয়। এছাড়া এরা আমাশয়, পেটে ব্যাথা নিরাময়ে বন থেকে কাঁচা মাশরুম সংগ্রহ করে তা বেটে চাল দিয়ে রুটির মতো করে সেঁকে খেতে দেয়। কারো বমি হলে তা বন্ধ করতে এরা পুদিনা পাতা খাওয়ায়। তবে বর্তমানে এদের শারীরিক সমস্যায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মালো আদিবাসীরা কিছু সামাজিক সংস্কার মেনে চলে। এদের সমাজে মামাশ্বশুরকে ভাগ্নে বউ স্পর্শ করতে পারেন না। সে প্রণাম করলেও দূর থেকে মাটি ছুঁয়ে ভাসুর ও মামা শ্বশুরকে প্রণাম করতে হয়। তবে শ্বাশুড়িকে সে ছুঁতে পারে।
আবার এরা বিশ্বাস করে জমির ধান গাছে গান্ধি পোকা লাগলে গলায় গামছা নিয়ে ধূপ উড়িয়ে যদি ছোড়া হয় তাহলে গান্ধি পোকা চলে যায়। আবার ধান গাছ লাল বা সাদা হয়ে গেলে, কয়েকজন ঘুষ, সুদ খোর লোকের নাম এবং কয়েকজন খারাপ মেয়ের নাম ধরে কতগুলো গাছের ডাল ভেঙে হাতে করে জমির এপার থেকে ওপারে নিয়ে গেলে ধান গাছ ঠিক হয়ে যায়। মালো সমাজে স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হলে সে স্ত্রীকে লক্ষ্মী আখ্যা দেওয়া হয়। ফলে ওই স্বামী সাধারণত দ্বিতীয় বিয়ে করেন না।
এক সময় এদেশে মালোদের নিজস্ব অনেক জমি ছিল। অভাবের সময়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে কড়া সুদে এরা টিপসই দিয়ে কর্জ নিত। সে সুযোগে মহাজনরাও ধীরে ধীরে দখল করে নেয় মালোদের জমিগুলো। জমির দখল নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে এখনও এদের বিবাদ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে মালো আদিবাসী সমাজে আজ শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা। এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। পাশাপাশি এরা নিঃশব্দে হারিয়ে ফেলছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের আদি রেওয়াজগুলো। কিন্তু তবুও মালোরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবেই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে। আর নিজের জাতির প্রতি ভালবাসার এ বোধটুকুই মালোদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
ছবি: সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সারাবাংলা ডটনেটে, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ৩, ২০১৯
© 2020, https:.