মুক্তিযুদ্ধ

যুদ্ধাহতদের বন্ধু

মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন নিয়ে কত কান্ড। যারা সক্ষম তারা নিজে ব্যবস্থা করে বেঁচেছেন। শহীদ ও যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সরকারের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন বহু বছর ধরে।

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধে রক্তাক্ত যোদ্ধাদের শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের পাশে কি দাঁড়িয়ে ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র? মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে কি উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন সরকার? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রথমেই তুলে ধরছি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার রক্তাক্ত ইতিহাস। যারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নন, বরং বাঙালি বীর। তাদের রক্তেভেজা এই বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাস একটি পা হারিয়েছেন একাত্তরে। তার বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মানপুর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মানপুর প্রাইমারি স্কুলে। দিনাজপুর অ্যাকাডেমিক স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস। এরপরই শুরু হয়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ফলে তার আর কলেজে পড়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে শুধু নিজের পা-ই নয়, তিনি উৎসর্গ করেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকুও।

একাত্তরে রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা কৃষ্ণ কিশোর দাস তুলে ধরেন ঠিক এভাবে ‘ছদ্মবেশে টার্গেটে আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। আমাদের পথ চিনিয়ে, খাদ্য দিয়ে সাহায্য করত গ্রামের সাধারণ মানুষেরা। ভারতের সীমান্ত দিয়ে ঢুকে দিনাজপুরের ভান্ডারা, বৈরাগীপাড়া, ডুং ডুংগি, রাণীপুকুর এলাকায় অপারেশন করতাম।

জাল দিয়ে বিলে মাছ ধরার ভান করে ছদ্মবেশে একবার এলাম রাণীপুকুর বাজারে। ঠিক তখনই পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ে গেলাম। তারা লাইন ধরে দাঁড় করালেন। ঢালিতে কিন্তু মাছ নেই, রাখা আছে কয়েকটা রাইফেল। ভয়ে বুক দুরু দুরু করছে। সার্চ করতে গিয়ে যদি পেয়ে যায়? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপলাম। একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা সদস্য আমাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর সঙ্গী অন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের বললেন, ‘মাছরি মারতা, ছোড় দো উসকো, গারিব আদমি’। তারা আমাদের ছেড়ে দিলেন। এভাবেই প্রাণে বেঁচে গেলাম সেবার।

১১ নভেম্বর ১৯৭১, শনিবার। মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করছি। বিরলের মুল্লুক দেওয়ানের পাশেই পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতে হবে। ক্যাম্প থেকে রওনা দিলাম খুব ভোরে। দুটি দলে ভাগ হলাম তাই আমরা। আমার দলটি ভান্ডারা দিকে অগ্রসর হলো। অপারেশনের সময় আমরা চলতাম মূল রাস্তার পাশ দিয়ে, কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেই পথেই মাইন বসিয়ে রাখলেন। আমরা বুঝতে পারলাম না। ভান্ডারা পূর্বদিকের রাস্তায় দিয়ে এগোচ্ছি। হঠাৎ পায়ের কাছে বিকট শব্দ। ছিটকে পড়লাম আমি। ভেবেছিলাম, পাকিস্তানিরা আক্রমণ করেছে। চোখের সামনে কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া উড়ে গেল। তখনো কিছু ঠাওর করতে পারিনি। খানিক পরেই খেয়াল করলাম, বাঁ পা-টি রক্তে লাল হয়ে গেছে। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর ভয় গ্রাস করল। খেয়াল করলাম, পায়ের কিছু অংশ উড়ে গিয়েছে। গাছের শেকড়ের মতো ঝুলছে রগগুলো। ছোড়া রগগুলো দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে গল গল করে। ধীরে ধীরে চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। ভেবেছিলাম মরে যাব, কিন্তু সহযোদ্ধা হাবিলদার নাজিম উদ্দিন অসীম সাহসে এগিয়ে এলেন। আমাকে কাঁধে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন বীর সহযোদ্ধা।

প্রথমে ভারতের ঝগড়াপাড়ায়, পরে রায়গঞ্জের এসবি হাসপাতালে চিকিৎসা চলল আমার। ১৮ দিন ছিলাম অচেতন। যখন জ্ঞান ফিরে এলো, তখন দেখলাম বাঁ পা-টা হাঁটুর নিচ থেকে ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা। হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই খবর পেলাম আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই পা হারিয়ে কোনো আফসোস নেই আমার। স্বাধীনতা পেয়েছি আমার জীবনের বিনিময়ে, কিন্তু পায়ের দিকে তাকালে এখনো ‘১৯৭১’ জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি সেই বীভৎস অপারেশন চোখে দেখতে চাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা চোখে ভাসে ছবির মতো।’

স্বাধীন দেশে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাস ফিরে এলেন নিজ গ্রাম বিরল উপজেলার মানপুরে। ভাঙাচোরা দেশ দেখলেন তারই মতো। তবু সবার মুখে হাসি আছে। নতুন করে বাড়িঘর তুলছেন সবাই। জীবনকে আবার সাজাবেন, কিন্তু পা হারিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর চললেন লাঠিতে ভর দিয়ে। কীভাবে চলবে তার পারিবার? পঙ্গু হিসেবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারেই ভিক্ষা করতে হবে জীবন বাঁচাতে?

অধ্যাপক ইউসুফ আলী তখন নতুন স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী। তার মাধ্যমেই সহযোদ্ধা একাত্তরের বীর খোরশেদসহ চলে গেলেন তিনি ঢাকায়, মগবাজারের সুশ্রী হাউজে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসলেন আরও আরও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা।

সেখানে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা দাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তারা তাদের কাঠের কৃত্রিম পাসহ নানা ধরনের কাজ শেখালেন। ট্রেনিং শেষে কর্মসংস্থানের জন্য দেওয়া হলো আর্থিক সহযোগিতা। সে থেকেই নিজে কৃত্রিম পায়ে চলছেন, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাঠের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এক পা না থাকলেও সেই সময়ের প্রশিক্ষণ আর্থিকভাবেও তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। সেই থেকে আজও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ও কাঠের কাজ করে যা পান, তাই দিয়েই চলে তার সংসার।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী। আরও বেশি শারীরিক অক্ষমতায় কৃষ্ণ কিশোর দাসের মতো কোনো প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। বাড়ি তার লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রামে। ১৯৭১ সালে ছিলেন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সিপাহী (ব্যাচ নং-০৩৯১)। স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছেন চার নম্বর সেক্টরে। এক অপারেশনে মারাত্মক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কীভাবে? ‘নলছড়ি পাহাড়ে ছিলাম ২৩ দিন। আমাদের দলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী। একদিন এলেন সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন রাও। দেশের ভেতর গিয়ে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিলেন আমাদের। বললেন, ‘আপ লোক আবি আপকা জায়গা করো, দেশকা লাগি লড়ো, সাহায্য করনা, হাম করেগা, গোলাবারুদ জো চাহি হাম দেগা।’

আমাদের সবার শরীরের রক্ত টলমল করল। আমরা খুব বিড়ি খেতাম তখন। উচ্চকণ্ঠে তিনি বললেন ‘বাচ্চু, তোম লোগ এক দুশমন মারেগা তো হাম এক প্যাকেট বিড়ি দে গা।’ শুনে খুশি হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুললাম সবাই। ওই রাতেই পরিকল্পনা করা হলো সিলেটের তামাবিল আক্রমণ করব আমরা।

২১ জুন, ১৯৭১। রাত ১২টার পর থেকে নলছড়ি পাহাড় থেকে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর একটি দল আর্টিলারি ছুড়তে লাগল তামাবিল ইপিআর সেন্টারে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ভোর চারটার পর আমরা পাহাড় থেকে নামলাম দুটি দলে। আমাদের সঙ্গে নায়েক সুবেদার মোস্তফা রহমান, ফজলুর রহমান, পিন্টু আছেন। নলছড়ি ধরে হেঁটে আসামি বস্তির কিনার দিয়ে তামাবিলে উঠলাম। আরেকটি দল তামাবিল চেকপোস্ট দখল করে নিতে গেল। তারা দখলও করল।

তখন ভোর পাঁচটা। আমরা অবস্থান নিলাম তামাবিল ইপিআর সেন্টারের কাছাকাছি। প্রবল আর্টিলারির আঘাতে কোনোভাবেই সেখানে একজনও পাকিস্তানি সেনাসদস্য থাকার কথা নয়, এই ভেবে সামনে এগোতে যাব অমনি বৃৃষ্টির মতো গুলি ও শেল এসে পড়তে থাকল। একটি গোলা এসে পড়ল ফজলুর রহমানের মাথায়। সে আমার পাশেই আছে। আমার চোখের সামনেই তার মাথাটি ছিটকে পড়ে গেল। তার শরীরটা মাটিতে পড়েই ছটফট করতে থাকল। অন্যপাশে নায়েক সুবেদার মোসলেম উদ্দিন। তার নিতম্বের মাংসখন্ডই গেল গোলার আঘাতে উড়ে।

তখনো জানি না সামনে আরও ভয়ংকর কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? সহযোদ্ধার আত্মত্যাগ সামলে নিজেকে সামলে পজিশন নিলাম। পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকলাম দেশ ও জীবনের প্রশ্নে। হঠাৎ কয়েকটা গুলি এসে লাগল আমার শরীরে। ছিটকে পড়লাম। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি। খানিক পরেই দেখলাম, বাম পায়ের উরু রক্তে ভিজে গেছে। হাত দিতেই দেখলাম, পায়ের সব রগ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। বাম হাতের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, কবজির ওপরে কনুইয়ের নিচ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ডান হাতের আঙুলের স্পর্শে বুঝে গেলাম, হাতের হাড় উড়ে গেছে। আর নেই।  স্প্রিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে ডান পা ও গোপনাঙ্গের কিছু অংশ। ভয়ংকর ব্যথায় ‘মাগো’ বলে চিৎকার করলাম অজান্তেই। আমার পাশেই নায়েক সেকান্দার। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে কাঁধে তুলে তামাবিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন অস্ত্র হাতে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হলো শিলং হাসপাতালে। হাত ও পায়ের অপারেশন হলো সেখানে। তখনো আমার বাম পা অকেজো। ৫ থেকে ৬ মাস পর ফিরে এলাম আমার স্বাধীন বাংলাদেশে। চিকিৎসা চলল প্রথমে সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, এরপর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।’

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর শিলং হাসপাতালে বসে বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী ভেবেছিলেন তার দেশে যাবেন। সবাই তাকে দেখতে আসবে। তিনি সাহায্য পেয়ে শান্তিতে জীবন কাটাবেন। সবাই মুক্তিযোদ্ধার সম্মান করবে, কিন্তু বাড়ি ফিরে শুললেন ভয়ংকরতম দুঃসংবাদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আপন বড় বড় ভাই সিরাজ। তিনি মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টের পেয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গী রাজাকার বাহিনীর সদস্য মন্টু গাজীর সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাকে ধরে নিয়ে গেল। তার লাশও পাননি তারা। স্বাধীন দেশে রাজাকার মন্টু গাজী বেঁচে আছেন, কিন্তু বেঁচে নেই তার ভাই। শুকুর বেঁচে আছেন পঙ্গু ও অক্ষম হয়ে। হুইল চেয়ার তার সঙ্গী। তিনি মানতে পারেন না।

শেখ হাসিনার এই সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর গজনবী সড়কের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারের জায়গায় অর্থাৎ ১/১, ১/২, ১/৩ নং প্লটে (কলেজ গেট) মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-০১ নামে বহুতলার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেই পরিবার নিয়ে ঠাঁই হয়েছে এতকাল পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলীর।

একাত্তরের ক্ষত নিয়ে সূর্যসন্তান প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। অথচ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্রও পাননি। বরং স্বাধীনতার এই বীরের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সে ইতিহাস বড়ই কষ্টের, বড়ই লজ্জার।

বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমল থেকে যুদ্ধাহত ভাতা পাওয়া ও গজনবী রোডের বিশ্রামাগারে ১৯৭৮ সাল থেকে চিকিৎসার জন্য অবস্থান নিলেও মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলীর মৃত্যুর পরপরই মিথ্যে অভিযোগের অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হছে ভাতা। পরে আদালতের রায়ে চালু হলেও তার পরিবার এখনো পায়নি আবাসনের কোনো বরাদ্দপত্র। ফলে নানা শঙ্কায় জীবন কাটছে তাদের। তারা অসম্মানিত হচ্ছেন।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা। বয়স ৭০ প্রায়। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে কেটে ফেলতে হয়েছে তার ডান পা। শরীরের ভারে বাঁ পা-ও এখন বেঁকেছে। ফলে তিনি আর হাঁটতে পারেন না, শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন কেবল। জীবনের হিসাব তার  মেলে না। দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতিদান চান না, কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর অন্যদের সঙ্গে নিজের জীবনের হিসাবটুকুও মেলাতে পারেন না স্বাধীনতার অন্যতম নায়ক।

বাকি মোল্লার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হামিদকুড়া গ্রামে। থাকেন ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। একাত্তরে ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। তার সংসারে তখন তিনটি ছেলে। বউ ফের অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের মায়া, প্রবল পিছুটান ফেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন তিনি। যুদ্ধ করেছেন সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা ডাকবাংলা সাব-সেক্টরের অধীনে।

প্রথম অপারেশনেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা। রক্তাক্ত দিনটির আদ্যোপান্ত তার জবানিতে ‘জুনের প্রথম সপ্তাহ। রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে আমি গুলি খেলাম। আগেই আমাদের কাছে খবর ছিল ভিতরবাগ, মইরবাগ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বহর যাবে নন্দনগাছির দিকে। আমরা মাত্র ২৫-৩০ জন। আমাদের কমান্ডার নায়েক সুবেদার কাশেম। আমাদের কাছে ছিল রাইফেল। রাতে পজিশন নিলাম আড়ানি ব্রিজের পাশে। ভোর হয়-হয়, পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে আসছে। আতঙ্ক তৈরি করে ওরা এইভাবেই পথ চলত।

ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই আমরা দুইপাশ থেকে আক্রমণ করলাম। শুরু হলো গোলাগুলি। দৌড়ে আমি সামনে এগুবো অমনি একটি গুলি উড়ে এসে লাগল ডান পায়ের হাঁটুতে। দুই লাফ দিয়ে ছিটকে পড়লাম। শরীর দুটি ঝাড়া দিল আপনা আপনি। প্রথম বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে। পরে দেখি, পিনপিন করে রক্ত বেরুচ্ছে। পাশেই সহযোদ্ধা মিল্লাত আলী মুক্তিযুদ্ধ করছেন। তার বুকে এসে লাগল একটি গুলি। শরীরটি তার ঝাঁকি দিয়ে নিথর হয়ে গেল। ‘মাগো’ চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখলাম, অন্য পাশে সুধাংশু বাবু। মাথার পেছন দিয়ে গুলি লেগে চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে তার। ভয়াল এসব ঘটছে আমার চোখের সামনে! অসহায়ের মতো পড়ে আছি অনেকক্ষণ। সর্বক্ষণ মৃত্যুভয় তাড়া করছে। সহযোদ্ধারা আমাকে টেনে পেছনে এক গ্রামের ভেতর নিয়ে গেলেন। পরে এংকটা দরজার পাল্লায় শুইয়ে নেওয়া হলো আড়আনীর বাজারে। ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসার হলো। আমরা বেরুতে পারছি না। সন্ধ্যা নামল। আমাকে নিয়ে তারা বেরুলেন। সাগরপাড়া ক্যাম্প হয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ভারতের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাসপাতালে। অপারেশন করে আমার ডান পা হাঁটুুর এক বিঘা ওপর থেকে কেটে ফেলা হলো। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, পা-টি নেই।’

এক পা হারালেও মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা বেঁচে আছেন, এই তার সান্ত্বনা। স্বাধীন দেশে ফিরে স্বপ্ন দেখতেন, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার করবেন। বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কোলে দেখবেন ফুটফুটে নবজাতক। স্বাধীনতার পর এমন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে দ্বিতীয়বার মানসিকভাবে রক্তাক্ত হলেন। ফিরে দেখেন, পেটের সন্তানসহ তার স্ত্রীও আর বেঁচে নেই। তারা মারা গিয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকার ঢাকার জিপিওতে এমএলএসএস পদে চাকরি দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লাকে। পরবর্তী সময়ে তাদের পুনর্বাসনের জন্য মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গড়ে তোলা হয়েছে। নামে কমপ্লেক্স হলেও আসলে এটি সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৪৯ বছর পরেও সেখানে কমপ্লেক্স তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়নি। বুকে জমানো কষ্ট স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত বীর প্রকাশ করেন ঠিক এভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধে যদি না যাইতাম, পঙ্গু হইতাম না, পঙ্গুদের কোনো দাম নাই, আপনারা লিখবেন। তারপরই কাজ শেষ। এরপর আর খোঁজও রাখবেন না। একটা অঙ্গ না থাকলে কী অবস্থা হয় সেটা আপনারা বুঝবেন না। আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি দেবেন? তাইলে বাজেট নাই এই অজুহাত দেখাইয়া কেন মুক্তিযোদ্ধাদের কমপ্লেক্সের কাজ বন্ধ রাখা হয়?’ মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। এভাবে স্বাধীন দেশে পুনর্বাসনের নানা উদ্যোগ নিয়ে আশা-নিরাশায় জীবন কাটাচ্ছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা হলো। এর পর পরই তাদের সবাইকে নিজ নিজ পেশায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, হারিয়েছেন নিজের অঙ্গ এমন শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে কীভাবে জীবনযাপন করবেন যুদ্ধাহতরা?

মূলত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কল্যাণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৯৪ আদেশ বলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়। এরপরই ‘পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন’ নামক একটি প্রকল্প হাতে নেন বাংলাদেশ সরকার। সেটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও আইআরসি (ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি)সহ বেশ কিছু বিদেশি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হতো। তারই আওতায় তিনটি পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলা হয় ঢাকার আসাদগেটের কলেজগেট, দিনাজপুর ও খুলনা শহরে। যেখানে যুদ্ধাহতদের ইলেকট্রনিক উইজার্ড, সাইনবোর্ড লেখা, সেলাই, ঘড়ি মেরামত, রেডিও মেরামত, বেতের কাজ, টাইপ রাইটিং, কাঠের কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে নগদ টাকাও প্রদান করা হয়েছে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রেড ক্রিসেন্টের উদ্যোগে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে মগবাজারের সুশ্রী হাউজে। আনুমানিক ৫শ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে এভাবে। ফলে কৃষ্ণ কিশোর দাসের মতো কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। তবে শারীরিক সক্ষমতা না থাকা ও কর্মসংস্থানের জন্য দেওয়া টাকার পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়ায় যুদ্ধাহতদের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন সবাই। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের আওতায় একটি ‘জব প্লেসমেন্ট সেল’ খোলা হয়েছে তখন। কার্যালয় ছিল ঢাকার ফার্মগেটে। সেলের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের সক্ষমতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি প্রদান করা হয়েছে। কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন এক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য মতে, প্রায় ২শ মুক্তিযোদ্ধাকে তখন চাকরি প্রদান করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ চাকরি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান তাবানি ভেবারেজ, মুন সিনেমা হল, হরদেও গ্লাস ওয়ার্কস ফ্যাক্টরি, মিমি চকলেট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে।

বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকেই ভাতা প্রদান করা হয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের। তখন ৭৫ টাকা ভাতা ছিল প্রতিজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার আর শহীদ পরিবারের সদস্যরা পেতেন ১শ টাকা করে। মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র হলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাভাতা। কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় থেকেই ভাতার অর্থ সংস্থান করা হয়েছে বরাবর।

১৯৭৬ সালে সরকারি উদ্যোগে যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের কল্যাণে ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ফান্ড সংগ্রহে সারা দেশের সিনেমা হলগুলোর টিকিট থেকে কেটে রাখা হতো ১০ পয়সা করে। এই ফান্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য মিরপুর চিড়িয়াখানার কাছে স্থানে দুটি স্ক্রিম হাতে নেওয়া হয়। পরিকল্পনা হয়, ভবন তৈরির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে করা হবে ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল চালু করা হবে। প্রথম দিকে কমপ্লেক্সের জায়গা নেওয়া ও হাসপাতালটি চালু হয়েছে, কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে পরবর্তী সময়ে হাসপাতালটি ছেড়ে দেওয়া হয় বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে।

এখন হাসাপাতালটি পড়ে আছে পরিত্যক্ত। ঢাকার মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের কমপ্লেক্স তৈরির কাজ আজও সফল হয়নি। ফলে বাকি মোল্লার মতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা নানা অনিশ্চয়তায় জীবন কাটাচ্ছেন সেখানে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের আওতায় সরকার তখন পাকিস্তানি ও বিহারিদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়ি তাদের প্রদান করেন, কিন্তু ওইসব বাড়ির প্রতিটির জন্য সরকারকে যে পরিমাণ টাকা প্রদানের বিধান রাখা ছিল, তা প্রদান করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ফলে বাড়ির কাগজপত্র এখনো পরিপূর্ণভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামে হয়নি। অনেকের বাড়ি বেহাত হয়ে গিয়েছে।

এই দেশ স্বাধীনের পর সরকার প্রথমেই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে মুক্তিযুদ্ধে আহতদের আনা হলো প্রথমে শেরে বাংলা নগর হাসপাতাল (এখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসাপাতাল)-এ। মূলত মুক্তিযুদ্ধে আহত রোগী নিয়েই হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করেছে। মাজা থেকে পা পর্যন্ত অবশ এমন ১৩ জন প্যারাপ্লেজিক যুদ্ধাহত ছিলেন সেখানে। যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল ও অভিজ্ঞ ডাক্তার তখন ছিলেন না সেখানে। ফলে বিদেশ থেকে ডা. আরজে গার্স্টসহ অভিজ্ঞ ডাক্তাররা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। আস্তে আস্তে সেবা, চিকিৎসা ও প্রয়োজনে হাসাপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগল।

ফলে তখন ডা. জোয়ারদারের পরামর্শে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দুলাল, শাহজাহান, লতিফ, তাহের, আজাদ, আলী আহম্মদ, আশরাফ প্রমুখের উদ্যোগে ঢাকার গজনবী রোডে কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ‘যুদ্ধাহত চিকিৎসা বিশ্রামাগার’ খোলা হলো। বিশ্রামাগারের জায়গায় জন্য একটি বাড়িতে অবস্থানরত দখলদারদের গুলিতে মারা গেলেন অলি আহাদ নামের একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এমন তথ্য দিয়েছেন উদ্যোক্তাদের একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল। বিশ্রামাগারে ওষুধ ও অন্যান্য সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ আইআরসি, রেড দা ব্রার্নার, তেরে দেশ হোমস, আনরট প্রভৃতি বিদেশি সংস্থা। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো ঢাকার মহাখালীর যক্ষ্মা হাসাপাতাল (এখন আইসিডিডিআর,বি) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ডে। বঙ্গবন্ধু সরকার অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ভারত, বুলগেরিয়া, যুগোস্লোভিয়া, জার্মান, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে পাঠিয়েছেন। উদ্যোগটি না হলে আহত বহু মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতো না কোনোদিন।

চিকিৎসাসহ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে অবহেলা শুরু হয়েছে জিয়াউর রহমান সরকারের অমলে। সেটি ১৯৭৮ সালে, ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলা ও জীবন যুদ্ধে টিকতে না পেরে মনের কষ্টে আবু তাহের নামে এক মুক্তিযোদ্ধা এই হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বিখ্যাত সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় তখন এই দুঃসহ খবর নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘এই লাশ রাখব কোথায়?’ অস্তে আস্তে এমন অবহেলা ও কৌশলে বন্ধ করে রাখার কার্যক্রমে ১৯৮০ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন’ মুক্তিযোদ্ধারা এই জাতির ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে তারা আমাদের একটি দেশ ও পতাকা উপহার দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের মাসিক রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন নয় হাজার ৭শ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা করছেন। ভাতাপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো স্বল্পমূল্যে রেশন সামগ্রীও পাচ্ছেন তাদের কারণে। এসব উদ্যোগ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডে (কলেজগেট) নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা ভবনটি সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ, কিন্তু ভবন নির্মিত হলেও নিয়ম মেনে এখনো পুরোপুরি বরাদ্দ প্রদান করতে পারেনি সরকার। এ বিষয়ে অসযোগিতার অভিযোগ উঠেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও। ফলে ফ্ল্যাট দেওয়া না দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই পকেট ভারী হচ্ছে চক্রের। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়, হতে দেওয়া যায় না। বিষয়টি ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত ভবনে অবস্থানকারীদের মধ্য থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের কার্যক্রম সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।

এ ছাড়া বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা বাবদ যে সরকারি বরাদ্দ প্রদান করে তা প্রাপ্তিতে তৃণমূলের দুস্থ মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।

ফলে প্রায়ই গণমাধ্যমে উঠে আসছে বিভিন্ন উপজেলার দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার বিনা চিকিৎসা ও অবহেলায় কষ্ট পাওয়া খবরগুলো। তারা রাষ্ট্রীয় শেষ মর্যাদাও নিতে রাজি নন। তাই সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো হাসপাতালে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় ‘ভূমিহীন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ’ উদ্যোগও প্রকৃত নিরীক্ষার ভিত্তিতে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করা খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে নির্মোহ দায়িত্ব পালন করা উচিত মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার ও স্থানীয় প্রশাসনের। তা না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে সরকারের এ উদ্যোগ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মানিত করতে পারবে না।

মিরপুর চিড়িয়াখানার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা পল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বর্তমান সরকারের, কিন্তু এই পরিকল্পনাগুলো কবে বাস্তবায়ন হবে সেই তথ্য জানা নেই কারও। দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সরকারের সব পরিকল্পনাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের বয়সই এখন ৬০ বছরের বেশি। আগামী পাঁচ বা ১০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ আমরা হারাব চিরকালের মতো। এই বীরের দেশে এমন বীররা কষ্ট পাবেন এমন প্রত্যাশা ভুলেও করি না। যাদের ত্যাগে স্বাধীন হলো দেশ, সবকিছুর ঊর্ধ্বে ও সবকিছুর আগে তাদের পাশেই থাকুক বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তর এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়, প্রকাশকাল : ২০ জানুয়ারি ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button