টংক আন্দোলন ও রাসিমণি হাজংয়ের বীরত্বের গদ্য
বাংলার কৃষক আন্দোলনে এক অবিস্মরণীয় দিন ৩১ জানুয়ারি। এদিন উচ্চারিত হয় হাজংদের বীর মাতা রাসিমণির বীরত্বের কাহিনী, যা সংগঠিত হয়েছিল টংক আন্দোলনের ইতিহাস ধরেই। তাই টংক আন্দোলন দিয়েই শুরু করছি।
‘টংক’ মানে ধান কড়ারি খাজনা। জমিতে ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে দিতেই হবে। ‘টংক’ স্থানীয় নাম। এই প্রথা চুক্তিবর্গা, ফুরন প্রভৃতি নামে ওই সময় বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল। ময়মনসিংহ জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, শ্রীবর্দী থানায় বিশেষ করে সুসং জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। টংকব্যবস্থায় সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে পনেরো মণ। ধানের দর হিসেবে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগারো থেকে প্রায় সতেরো টাকা, যা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ। এ ছাড়া টংক জমির ওপরও কৃষকদের কোনো মালিকানা ছিল না। ফলে এই শোষণের বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন
কৃষকরা। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার সন্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ। টংক আন্দোলন চলছে পুরোদমে। আন্দোলনকারীদের দমাতে ময়মনসিংহ থেকে সশস্ত্র পুলিশ দল আসে দুর্গাপুরে। বিরিশিরিতে তারা একটি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে। গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে সঙ্গে থাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও। এরপরই ঘটে রক্তাক্ত ঘটনাটি। কিন্তু তার আগে জানা প্রয়োজন কে এই রাসিমণি?
রাসিমণি হাজংয়ের জন্ম ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মাইজপাড়া গ্রামে, এক দরিদ্র টংকচাষির ঘরে। বারো বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বিধবা হন। এ কারণে গ্রামের লোকরা তাকে ‘ডাইনি’ বলে ডাকত। কিন্তু তিনি কারও কথায় কান না দিয়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। পরের জমিতে রোয়া ধান লাগিয়ে আর ধান কেটে মজুরি বাবদ যে সামান্য ধান পেতেন, তাই ঢেঁকিতে ভেনে চাল তৈরি করে হাটে-বাজারে বিক্রি করতেন রাসিমণি। অবসর সময়ে গরিব হাজং মেয়েদের জন্য তাতে কাপড় ও ওড়না বুনতেন। সুসং অঞ্চলের মায়েদের আঁতুড়ঘরের শ্রেষ্ঠ ‘দাই’ বা ধাত্রীও ছিলেন তিনি। একসময় ‘মহিলা-আত্মরক্ষা সমিতি’র মাধ্যমে তার চাল-সংগ্রহকারী দল পরগণা ঘুরে সংগ্রহ করত ধান, চাল, অর্থ ও বস্ত্র। তেরোশ পঞ্চাশের মহা-মন্বন্তরে যখন সব দরিদ্র মানুষ খাওয়ার অভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন, তখন রাসিমণি তিনটি গ্রামের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। হাজং অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য যে ‘বেশি খাদ্য ফলাও’, খাল কাটা, বাঁধ বাঁধার আন্দোলন আরম্ভ হয়, তারও পুরোভাগে ছিলেন রাসিমণি। এসব কারণে তিনি হাজংদের কাছে মা হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে টংক আন্দোলনের সভা ও মিছিলের পুরোভাগে নারী বাহিনী নিয়ে চলতেন রাসিমণি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে তিনি হাজং নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন মৃত্যুপণ সংগ্রামের জন্য।
কিন্তু কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? সুসং-দুর্গাপুরের অপর পাড়ে বহেড়াতলী গ্রাম। ওই গ্রামেই হাজং ও গারোদের বাস। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি। দুপুর বেলা। পঁচিশজনের পুলিশ দল ওই গ্রামে প্রবেশ করে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে মা-বোনদের ওপর নির্যাতন চালায়। এ সময় পুলিশ বিশ-একুশ বছর বয়সের একজন কৃষক-বধূকে ধরে নিয়ে যায়। নাম তার সরস্বতী, আরেক নাম কুমুদিনী হাজং। লাঞ্ছিত কুমুদিনীর চিৎকার তখন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। বহেড়াতলীর পাশের গ্রামে রাসিমণির সশস্ত্র প্রচার দল বিশ্রাম নিচ্ছিল। কুমুদিনীর চিৎকারে তারা সচকিত হয়ে ওঠে। রাসিমণির অন্তরে তখন জ¦লে উঠে প্রতিহিংসার আগুন। তিনি নিঃশব্দে তুলে নেন তার রক্তপতাকা আর চিরসঙ্গী হাতিয়ার বড় দা-খানি। ৩৫ জন বীর নিয়ে রাসিমণি হাজংকন্যা কুমুদিনীকে বর্বর পুলিশদের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য ছুটে আসেন। সবার সামনে থেকে পুলিশের ওপর প্রাণপণে দা চালাচ্ছিলেন রাসিমণি আর পাশে দাঁড়িয়ে বর্শা চালায় তারই সাথী সুরেন্দ্র হাজং। যে পুলিশটি হাজংকন্যা কুমুদিনীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল, রাসিমণি তাকে খুঁজে পেয়ে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দায়ের এক কোপ বসিয়ে দেন। ফলে তার মুণ্ড দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আরেক পুলিশ এগিয়ে এলে সেও দায়ের আঘাতে ধরাশায়ী হয়। হাজং মায়ের ভয়ংকর রূপ দেখে পুলিশ দল ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উন্মত্তের মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ফলে দশটি বুলেটে রাসিমণির দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। যুদ্ধ করতে করতেই তার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। যুদ্ধরত সুরেন্দ্র তার বর্শা দিয়ে রাসিমণির হত্যাকারী পুলিশটির বুকে বর্শা নিক্ষেপ করে। কিন্তু তার আগেই পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট সুরেন্দ্রের বুকে বিদ্ধ হয়। ফলে তার দেহও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে যুদ্ধ। খবর পেয়ে কয়েক গ্রামের যুবকরা তাদের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে। তারা পুলিশের দিকে বল্লম ছুড়তে থাকে। সশস্ত্র পুলিশ তখন নদীর দিকে সরে এলেও দুজন আলাদাভাবে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। সেখানে কিছু ঝোপঝাড় থাকায় বরাক বাঁশের বেড়ায় আটকে পড়ে তারা। ফলে হাজংদের বল্লমের আঘাতে ওখানেই মারা পড়ে তারা। ওইদিন হাজংচাষি ও পুলিশের রক্তে সোমেশ্বরী নদীর বালুকাময় তীরভূমি রক্তে রঞ্জিত হয়। পুলিশদের মধ্যে দুজন নিহতসহ ১৫ জন আহত হয়। আর বিদ্রোহীদের মধ্যে হাজং মাতা রাসিমণি ও হাজংদের বীর সন্তান সুরেন্দ্র প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শহিদ হন। মূলত রাসিমণি ও সুরেন্দ্রের মতো শ্রেষ্ঠ হাজং বীরদের আদর্শ এবং আত্ম-বলিদানের ফলেই পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টংকবিরোধী হাজং বিদ্রোহ আরও ব্যাপক আকারে, আরও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। ওই বিদ্রোহের ফলেই পূর্ববাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে টংক প্রথার অবসান ঘটে।
১৯৫০ সালে ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগ। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন তখন জনসভা করেন সুসং এলাকায়। তিনি বক্তৃতায় সেখানে টংক উঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারী হাজং কৃষকরাও তখন আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু সরকার তাদের ওপর আরেক অত্যাচার শুরু করে। সীমান্ত এলাকায় হাজংবিদ্রোহী গ্রুপকে সমূলে উচ্ছেদের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। হাজং গ্রামগুলোতে চালানো হয় বিভীষিকাময় অত্যাচার। হাজংদের ঠেকাতে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমান কৃষকদের এনেও বসিয়ে দেওয়া হয় সুসং এলাকায়। ফলে হাজং কৃষকদের দুঃখের দিন আর শেষ হয় না। টংক আন্দোলনে যে হাজংশ্রেণি রক্ত দিল, টংক বাতিলের পর সেই হাজংদেরই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো। লক্ষাধিক হাজং ছিল তখন। নির্মম অত্যাচারে টিকতে না পেরে তারা অধিকাংশই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের আসামে। এভাবে প্রায় বিস্মৃত হতে থাকে টংক আন্দোলনে হাজংদের বীরত্বের ইতিহাসগুলো।
শহিদ রাসিমণি হাজংয়ের আদর্শ, জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বাংলা তথা ভারতের কৃষক-সংগ্রামে নতুন প্রাণসঞ্চার করেছিল। তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে টংক প্রথার উচ্ছেদের জন্য শহিদ হন হাজংচাষিদের বীরকন্যা রেবতী, শঙ্খমণিসহ প্রায় দেড়শ হাজং বীর সন্তান। অথচ রাসিমণি হাজংয়ের বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি প্রজন্মের কাছে। এ প্রজন্ম জানে না টংক আন্দোলনের কথাও। কারণ সরকারিভাবে সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ ও প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কোনো চেষ্টাই হয়নি কখনো। দুর্গাপুরের বহেড়াতলীতে রাসিমণির স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও জীর্ণশীর্ণ, অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে সেটি। সেখানে টাঙানো নেই কোনো ইতিহাসের তথ্য। রাশিমণিসহ হাজং বীরদের নামে নেই কোনো সড়ক কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের নামও। বীরদের সম্মান জানাতে না পারলে এ দেশে কীভাবে বীরের জন্ম হবে? তাই এ বিষয়ে রাষ্ট্রের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
© 2020, https:.